২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

আমাদের স্মৃতি ও অসংবেদী লতা

-

সমাজ কোনো ব্যক্তির গুণাবলিকে তুলে ধরতে সহায়তা করে থাকে, তার ভালো গুণ থাকলে তা ফুটিয়ে তোলার কাজটা করে থাকে। উল্টা করে বললে, সমাজের ওপর ভর করেই ব্যক্তি ফুটে ওঠে, ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠে। এমনকি তার গুণের উচ্চতা যদি অনেক উপরের হয় তাতে অনেক সময় তার বড় কিছু ত্রুটি যদিও ওই গুণের উচ্চতার নিচে-আড়ালে চলে যায়, তবু এসব অর্থে আমরা বলি, ব্যক্তিত্ব সমাজের সৃষ্টি।

আবার কোনো কোনো ব্যক্তিত্ব তার ভালো-মন্দ যাবতীয় গুণ ও ত্রুটিসহই কখনো সমাজের প্রতীক হয়ে উঠতে পারে। তেমনি এক ব্যক্তিত্ব সম্ভবত গত আট যুগের বিখ্যাত গায়িকা লতা মঙ্গেশকর। গত ৬ ফেব্রুয়ারি ৯২ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার কেরিয়ার বা পেশাদার গায়িকা জীবন অনেক লম্বা, প্রায় ৭২ বছর। মারাঠি পরিবারে জন্ম নেয়া লতার পেশাদার গানের জগতে প্রবেশ বা রেকর্ডিং বলা হয় ১৯৪৮ সালের আশপাশের সময়ে। ব্রিটিশ-ভারত মানে অখণ্ড ভারত থাকার সময় থেকেই ভারতে সিনেমার জন্ম। তাতে নির্বাক চলচিত্রের শুরু বলা হয় ১৯৩১ সাল থেকে। তবে এই সিনেমা নির্মাণ যখন থেকে একদিকে নিজের বোদ্ধা দর্শক ও প্রশংসাকারী আর অন্য দিকে টেকনিশিয়ানগোষ্ঠী তৈরি করে সাজিয়ে বসতে শুরু করেছিল তত দিনে দেশ ভাগ হয়ে যায়। তবু ভাগ হওয়া আজকের তিন দেশে ভারতীয় সিনেমার প্রতি আগ্রহ ভাগ হয়ে যায়নি বা কমে যায়নি।

সম্ভবত এর মূল কারণ কালচারাল বন্ডেজ, এ তিন দেশের সংস্কৃতির মৌল উৎসগুলো একই জায়গার। এথনিক অর্থে মানুষ মাত্রই তার জাতিগত পরিচয় থাকে। আবার আমরা কোনো না কোনো সিভিলাইজেশনের অন্তর্গত থেকে বড় হই। এই বিচারে আমরা সবাই সিন্ধু সভ্যতার অংশ। তাই সিভিলাইজেশন অর্থে এর এথনিক জাতি পরিচয় আমরা তিন দেশেরই কমন বৈশিষ্ট্য। সংস্কৃতির অংশ হিসেবে প্রাচীন ভারতে এর যত প্রকাশ দেখা যায় বা এ সম্পর্কে জানা যায় এর এক বড় চিহ্ন হলো সংস্কৃতিতে গানের ধারা এবং ধরনগুলোর স্টাইল ও বৈশিষ্ট্য। যেমন আমাদের এই গানের ধারা পশ্চিমের ধারা অথবা আরব বা মেসোপটেমিয়ার ধারাও হওয়ার কথা নয়। প্রাচীন ভারত বলতে গেলে এর দাবিদার আমরাও কারণ এর বহু চিহ্নবৈশিষ্ট্য আমরা এখনো বহন করি। যেমন একটা সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য এর কেন্দ্রে আছে; এমন এক চিহ্ন সম্ভবত রাগসঙ্গীত ও এর ঘরানা মানে স্কুলগুলোতে যার প্রকাশ। তাই সভ্যতার চিহ্ন হিসেবে ক্লাসিক মিউজিক একটা খুবই শক্ত চিহ্ন হয়ে আছে। তবে এখন পলিটিক্যালি ডিভাইডেড দেশ তিনটাতে সভ্যতার রূপ-পরিণতি কী কী রূপ নিয়ে আছে, সেখানে অর্জনগুলো কেমন কী, আর তা কত ছোট বা বড় এসবের বিচারের ক্ষেত্রে তুলনায় ফারাক যতই যা নজরে, ভারত-পাকিস্তান ও বাংলাদেশে সংস্কৃতিতে গানের ভিত্তি বা ফাউন্ডেশন একই।

গত ১৯৪৭ সাল থেকে ভাগ হয়ে যাওয়ার পরও আমাদের গানের ভিত্তি এক হওয়া সত্ত্বেও আমরা কে কেমন কত দূর এসেছি, অর্জন করেছি তা মাপার এক সহজ উপায় এসে গেছে। সেটা হলো কোক স্টুডিও। এখানে স্টুডিও বলতে মূলত গানের রেকর্ডিং স্টুডিও। অর্থাৎ রসুইখানা যেখানে ফাইনাল প্রডাকশনটা তৈরি হয়েছে। আর কোক বলতে বহুজাতিক পানীয় প্রস্তুত কোম্পানি ‘কোক’ এর কথাই বলা হচ্ছে, অবশ্যই। তবে এখানে এর ভূমিকা কেবল অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা করা সূত্রে যাতে জোগানো তাদের অর্থের বিনিময়ে এই গানের তৎপরতা ও প্রচারের সাথে জুড়ে থাকার কারণে এই কোক কোম্পানিও প্রচার ও প্রসার পায়। এ থেকেই ব্রান্ড নাম ও শব্দটা হয়ে দাঁড়ায় কোক স্টুডিও। এর শুরু পাকিস্তান থেকে। সাধারণত এমন গানের আয়োজন মানে, সংস্কৃতিতে গান এই শিল্পকলা সৃষ্টির আয়োজনে এক কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব ও অর্গানাইজার বা সংগঠক লাগে। অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, কোক স্টুডিওতে এমন সংগঠক হচ্ছেন যারা তাদের টেকনিক্যাল গুণ হলো তারা সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার ব্যাকগ্রাউন্ডÑ অন্তত বুঝেন ভালো; আর সাথে সেন্স অব মিউজিক। স্বভাবতই তা নিশ্চয় পশ্চিমা-কালচারাল গানের বোধ বুঝাচ্ছি না। সেটা থাকলে তা বাড়তি ভালো, তুলনা করে তারা নিজের বোধগম্যতা বাড়াতে পারবে। কিন্তু মূল জিনিস হলো, নিজের এথনিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা ও ইতিহাস সম্পর্কে একটা ভালো রকমের বোধ থাকতে হবে।

পাকিস্তানে গত ২০০৮ সালে পাকিস্তান-কোক স্টুডিও শুরু হয়েছিল এমন যে কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্বের হাত ধরে তার নাম রাহিলো হায়াত। কাদের কাদেরকে বেছে তুলে এনে রাহিলো তার গানের ধরন ও বৈচিত্র্য বা কম্বিনেশনের ডালি সাজাচ্ছে। সে দিকটা খেয়াল করলে তার ওজন বোঝা যাবে। এর তিন বছর পরে ভারতে একই আইডিয়াতে ইন্ডিয়ান কোক স্টুডিও শুরু হয়েছিল ২০১১ সালে; দক্ষিণী কম্পোজার বা সুরকার লেসলি লুইসের হাত ধরে। আরেক দক্ষিণী গায়ক হরিহরণকে সাথে নিয়ে ১৯৯৬ সালে তার বহুল আদর পাওয়া অ্যালবামের নাম ‘কলোনিয়াল কাজিন’। এ নামেই লুইসকে বেশি মানুষ চেনে।

দুই কোক স্টুডিও-এর তুলনা আমাদেরকে আমাদের একই প্রাচীন উৎস এবং একই সাথে আমাদের ভিন্নতা সম্পর্কে অনেক কথা বলতে পারে, পরিচয় তুলে ধরতে পারে। আগেই বলেছি অবিভক্ত ইন্ডিয়ান ধারার সংস্কৃতিতে এক বড় কমন চিহ্ন হলো ক্লাসিক মিউজিক যা দেখে নিশ্চিত হওয়া যায় আমাদের কালচারাল উৎস একখানে। ক্লাসিক গান বা রাগ-প্রধান গান শুনে সচেতনরা ছাড়া অন্যদের বোঝা মুশকিল যে, সেটা ভারত না পাকিস্তানের উপস্থাপন।

কিন্তু এরপর যদি ভারত-পাকিস্তান কোক স্টুডিওর মধ্যে ফারাক তুলনা করে বুঝতে চাই তা হলো, ভারতের কোক স্টুডিও দেখে বোঝা যাবে ভারতের গানের জগত বাণিজ্যিক ভিত্তি খুঁজে নিতে পেরেছে। বাণিজ্যিক ভিত্তি মানে মডার্ন ক্রিয়েটিভ ইন্ডাস্ট্রি ভারতে যার সবচেয়ে বড় প্রকাশ হলো ভারতীয় বাণিজ্যিক সিনেমা। অর্থাৎ ভারতের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি এক সিনেমা জগতকেন্দ্রিক। ফলে ভারতীয় কোক স্টুডিওতে এর গান, অর্জন ও পারফরমেন্সে এটা মডার্ন এবং সিনেমাকেন্দ্রিকতার ছাপে ভরপুর।

তুলনায় পাকিস্তান কোক স্টুডিওর বৈশিষ্ট্য হলো, সে দেখিয়েছে সে পাকিস্তান এলিট ঘরের কিন্তু গভীর মিউজিক সেন্সের তরুণ যারা পপ বা রক ধরনের মিউজিক থেকে ক্লাসিক খুঁজতে গেছে; আর রাহিলো এদের সাথে শেষে একেবারে ক্লাসিক কাওয়ালি বা বুল্লেহ শাহকে পর্যন্ত একাকার করে করে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে আমাদের। একই ক্লাসিক কালচারাল অরিজিনের ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে গানের শক্তিমত্তার দিক থেকে পাকিস্তান সম্ভবত এগিয়ে কিন্তু আবার এই শিল্পকলাকে পেশা হিসেবে নেয়ার ক্ষেত্রে, বাণিজ্যিক ভিত্তি দেয়ার ক্ষেত্রে ভারত অতুলনীয় উঁচুতে উঠে গিয়েছে। যে ভারতে শিল্পকলার মুখ্য বা ফোকাস প্রতিষ্ঠান ঠিক গান অথবা নাটক থিয়েটার নয়, সিনেমা।

স্বভাবতই এ কারণে দেশগুলো যার যার বাড়তি সুবিধার বা অর্জনের দিক অথবা অসুবিধা বা অবিকশিত নেতিদিকও অবশ্যই আছে ও তৈরি হয়েছে।

কেন লতার আলাপের মধ্যে এত দূরে এলাম মানুষের আবেগ-অনুভূতির ওপর দাঁড়ানো শিল্পকলা বা ক্রিয়েটিভিটি; এটা জন্ম থেকেই এর আদি লড়াই হলো নিজ বিষয়-আশয়ের জীবনের সাথে। সোজা বাংলায়, পেটের সাথে। সে যে শিল্পকলা চর্চায় লিপ্ত হবে তো খাবে কী অথবা কে তাকে খাওয়াবেÑ এই হলো প্রশ্ন। এটাকেই আরেক শব্দে প্রকাশ করতে বলা হয় ‘পৃষ্ঠপোষকতা’কে দেবে? কার অর্থে ‘পেটের চিন্তা’ না করেও নিশ্চিন্তে শিল্পকলা চর্চায় ব্যস্ত হওয়া যায়?

এই প্রশ্নে শিল্পকলা সব সময় একটা আপস করেই এ পর্যন্ত চলে এসেছে বা টিকে গেছে, আছে। যেমন সেটা হলো, রাজ-রাজড়ার আমলে রাজাদের স্তুতিমূলক গান তৎপরতা। যেমন রাজ-বন্দনামূলক গান। এটা হলো রাজ- পৃষ্ঠপোষকতা। অথবা মন্দিরে মাজারে আখড়ায় স্পিরিচুয়াল ক্ষুধা মিটানোর গান, ভক্তিসঙ্গীত, ভজন, কাওয়ালির ধরনে চলে যাওয়া। আর এখান থেকে গণমানুষের দান, ভালোবেসে দান, এমন সামাজিক পৃষ্ঠপোষকতায় বেঁচে থাকা। কিন্তু এখানের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এই ধারা খুবই সিরিয়াস ক্লাসিক্যাল ধারা। যেন শ্রেফ ভালো পৃষ্ঠপোষকতা নয়। সে সবকে ছাড়িয়ে মোক্ষলাভের জন্য সে মন্দিরে মাজারে আখড়ায় স্পিরিচুয়াল ক্ষুধা মিটাতে হাজির হয়েছে।

বলা হয়, আসলে যা মনের থেকে ভালো লাগে তার ‘দাম’ হয় না। আবার উল্টা দিকটা হলো যে এটা সৃষ্টি করে আপনার সামনে হাজির করেছে তাকে বাঁচিয়ে রাখবেন কী করে, সে বেঁচে থাকবে কী করে? তাই একটা বিনিময় মূল্য তার অবশ্যই লাগবে। এই প্রশ্নও কম নয় বরং এক ভাইটাল প্রশ্ন!

বাণিজ্যিক সম্পর্কের যুগে এরই সমাধান হলো, পেশা হিসেবে শিল্পকলার যেকোনো এক শাখায় এতে পেশাদার পারফরমার হিসেবে একদিকে শিল্পকলার চর্চা, অন্যদিকে পেটের চিন্তার সমাধান পেতে হবে বা ব্যবস্থা করতে হবে। তবে বলাই বাহুল্য, আপস ছাড়া কোনো শিল্পকলা চর্চা নেই। মানে, মানুষের শিল্প-চিন্তার প্রকাশ সেটা বেচাবিক্রির বস্তু হয় কেমনেÑ এই প্রশ্ন এড়িয়েই শিল্পকলাকে এই আপস করেই চলতে হয়েছে।

এ ব্যাপারে ভারতে যে বিকাশিত রূপটা হাজির হয়েছে সে দিকে তাকিয়ে বললে ভারতে শুধু বা মূলত গানকে পেশা হিসেবে নেয়ার ব্যবস্থা দাঁড় করানো যায়নি। বরং আরেকটা আরো বড় মাধ্যম তৈরি করে নিতে হয়েছেÑ এটাই সিনেমা জগত। গান-চর্চা টিকে আছে এরই এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ, আরেক শিল্পকলা রূপ হিসেবে সাথে জুড়ে গিয়ে। তাই বাণিজ্যিক সিনেমার ভেতর দিয়ে টিকে আছে ক্লাসিক মিউজিক। তবে ঠিক ক্লাসিক রূপে না, মডার্ন মিউজিক হিসেবে। এখন অলক্ষ্যে এ দুইয়ের সম্পর্কটা বলে রাখা যাক। সেটা হলোÑ ক্লাসিক মানে ব্যাকরণসম্মত দিক এবং যা ভিত্তিমূলক দিক যার মর্ম উপলব্ধি করতে গেলে বোদ্ধার ট্রেনিং থাকা লাগবে। আর এটাই ব্যবহার করে সেই ব্যবহৃত ও সৃষ্ট নতুন রূপটা আম আদমির সামনে পেশ-প্রদর্শন করে তাদের কোনো না কোনো বোধগম্যতায় তা আনা, আর সবচেয়ে বড় কথা, তাদেরকে আনন্দ-মজা দেয়া; অসংখ্য টেনশনের জীবন রিল্যাক্স করার বা স্ফ‚র্তি জাগানো যার লক্ষ্যÑ এই রূপটাই আধুনিক গান।

তাহলে লতা মঙ্গেশকর আমাদের কে?
সাধারণভাবে বললে, এথনিক-সাংস্কৃতিক সভ্যতায় অরিজিনে মিল অর্থে এখনকার ভারত আসলে আমাদের এক কাজিন যেন; চাচাত-মামাত ভাই-বোন যেমন। যদিও একই বøাড, ডিএনএ আমাদের, তবুও আপনার কাজিন আপনার চেয়ে বহু ও বেশি গুণে গুণান্বিত হতে পারে। আবার আপনার থেকে খারাপ এবং কদর্যও হতে পারে। কিন্তু ‘কাজিন’ বলছি কেন? মূল কারণ এথনিক-সাংস্কৃতিক সভ্যতাগত মিল ও একই হবার কারণে।

এখন ভারতে শিল্পকলার প্রভাবশালী মাধ্যম হয়ে উঠতে পেরেছে মুম্বাইভিত্তিক সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি বা বাণিজ্যিক সিনেমা। আরই এরই বগলে লেগে আছে গানের চর্চা। আর লতা মঙ্গেশকর হলেন ওই গানের জগতে টানা এক ৭২ বছরের পেশাদার। ব্রিটিশ-পিরিয়ড থেকে একাল পর্যন্ত কালদর্শী একজন পেশাদার।

কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও লতার সাথে আমাদের কী সম্পর্ক আগেই বলেছি শিল্পকলার প্রধান শত্রু শিল্পীর বৈষয়িক জীবন ও এর চাহিদা। জীবনে বৈষয়িক চাহিদার উপায় কী হবে তা না খাড়া করে শিল্পকলা চলতে পারে না। ফলে একদিক থেকে বললে এটা শিল্পকলার আপস, আবার অন্যদিক থেকে বললে এটাই শিল্পকলাকে পেশা হিসেবে নেয়ার ব্যবস্থা ও সুযোগ। আমাদের এই তিন দেশের মধ্যে ভারতই বাণিজ্যিক সিনেমাÑ এই মিডিয়াকে সফলভাবে শিল্পকলা-সংশ্লিষ্ট মানুষদের পেশা হিসেবে নেয়ার এক স্থিতিশীল ব্যবস্থা হিসেবে হাজির করতে পেরেছে।

তবে এই এক্সপেরিমেন্ট যখন শুরু হয় সেটাকে বলা যায় ১৯১৩ সালের প্রথম নির্বাক চলচ্চিত্র যা পরে আরো বিকশিত হয়ে হয় ১৯৩১ সালের সবাক চলচ্চিত্র।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটা হলো, সে সময়কালে আমরা সবাই অবিভক্ত ভারতের অংশীদার বলে সব অর্জন ও ব্যর্থতারও ভাগিদার ছিলাম। ফলে সিনেমার এই শিল্পকলার বিকাশে মুখ্য ভূমিকা নেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের অবিভক্ত সবার সাথে সে সময়ের পূর্ববঙ্গের বুঝমানেরাও প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে তাকিয়েছিল।

সে আগ্রহ দেশভাগ হয়ে যাওয়ার পরেও থেমে যায়নি। কারণ আগ্রহটা আমাদের কালচারাল ভবিষ্যৎ নিয়ে। আমরা পাকিস্তান-বাংলাদেশ (পূর্ববঙ্গ) হয়ে গেলেও রাজনৈতিক বিবাদ পাশে সরিয়ে রেখে যতটা সম্ভব কালচারালি কানেকটেড থাকার চেষ্টা করেছিলাম। ফলে সেই ঐতিহ্যের স্মরণ থেকেই একালে লতা মঙ্গেশকরের মৃত্যুতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইমরান খানের শোকবার্তা প্রেরণ খুবই ভ্যালিড ও স্বাভাবিক তৎপরতা। অবশ্য এর আরো একটা বড় কারণ ‘স্মৃতি’।

বড় কারণ ‘স্মৃতি’, যা আমাদের তাড়া করে অনেকেই লক্ষ্য করেছেন হয়তো, ছোটবেলায় শোনা অনেক গান দু-একটা যা তখনই খুব অপছন্দ লাগত ফলে কম বা না শুনতাম আমরা হয়তো। অথচ আজ বড় হয়ে সাবিনার সেই অপছন্দের গানটাই খুব ভালো লাগছেÑ এর কারণ কী? এর কারণটা অদ্ভুত। পরিণত বয়স তখন আমরা আর শুধু গান শুনি না। গানশুনার সাথে সাথে সেসব সময়ের টুকরো টুকরো অসংখ্য স্মৃতি মনে ভেসে উঠতে থাকে। আর এতে গান ছাড়িয়ে ওই স্মৃতিতে ডুবে যাই আমরা খারাপ বা ভালোর সুখবোধ জেগে ওঠে। ভালো লাগাটা মূলত ওখান থেকে। ফলে সাবিনার সেই ধীর-লয়ের গান বলে তরুণ বয়সে যেটা ভালো লাগেনি, সরিয়ে রেখেছিলাম, সেটাই এখন মহার্ঘ্য হয়ে উঠতে পারে স্মৃতির গুণে। অতএব গানের আরেক নাম এখানে গভীর স্মৃতি।

তাহলে একালে লতার গান কথার আসল মানে হলো আমাদের পুরনো সেসব দিনের ভালো-মন্দ, দুঃখ-সুখের স্মৃতি। আমরা দেশভাগ হয়ে ছিটকে তিন দেশে পড়েছি কিন্তু লতার গান হলো আমাদের পুরান সেসব স্মৃতির গ্রন্থি-কার। মোটামুটিভাবে বললে, পঞ্চাশ তো বটেই ষাটের দশক পর্যন্ত আমরা সিনেমাকেন্দ্রিক পেশাদার শিল্পকলার যে উত্থান তার খবর নিতে পেরেছিলাম। এরপর থেকে রাজনৈতিক বিবাদ অনেক ভারী হয়ে যায়, প্রজন্মও বদলে যায়। স্মৃতি ফিকে হয়ে আসতে থাকে। তবু যাদের বয়েস এখন ষাটের বেশি তাদের স্মৃতিতে ভারতীয় সিনেমা বা লতা বাস করে, এটা কম নয়।

তবু ঠিক কেন লতা মঙ্গেশকর আজ এখানে প্রসঙ্গ হলো এখন সবাই স্বীকার করে নিয়েছে। গ্লোবাল অর্থনৈতিক তৎপরতার প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠছে বাকি মহাদেশকে ছাড়িয়ে এশিয়া। সে কথা খেয়াল রেখে আমাদের প্রভাবিত করতে আরো অনেক কিছুর মতো আমেরিকার এক থিংকট্যাংক ফেলো মাইকেল কুগেলমানকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে যিনি আমেরিকান ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনে এশিয়ার ঘটনাবলি প্রসঙ্গে সাপ্তাহিক নিজের এক কলাম লিখে থাকেন। কুগেলমানের এবারের প্রসঙ্গে দেখি, লতা মঙ্গেশকর উঠে এসেছে। তবু গুরুত্ব দেইনি। কিন্তু তার একটা প্রাথমিক বাক্য ছিল এমন যে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সবার কাছে কমন কিছু ব্যক্তিত্ব হয়ে হাজির হওয়া সহজ নয়। কিন্তু লতা হয়েছেন। তবু তার ব্যাখ্যাটা পূর্ণ মনে হয়নি। অর্থাৎ তিনি আমাদের তিন দেশে ভাগ হয়ে যাওয়া এবং এখনো তা নিয়েই আমাদের মধ্যে বড় মতবিরোধে জড়িয়ে থাকাকে ইঙ্গিত করছেন? আর স্বভাবতই এ নিয়ে লতা মঙ্গেশকরের ব্যক্তি রাজনৈতিক মতামত বা পছন্দের প্রশ্নে তার হিন্দু-মহাসভা থেকে উঠে আসা আরএসএস-বিজেপি মোদির প্রতি ভালোবাসা আবেগ দেখানো, মোদি যেন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন সেই কামনা, অবলীলায় বাবরি মসজিদ ভাঙার পক্ষে গান গেয়ে দিয়ে অংশ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি মনে পড়া থেকে এসব লিখতে বসা।

আমি আগেও বলেছি, রাজনৈতিক চিন্তায় একটা খামতি কত যুগ ধরে আমাদের তিন দেশকে গর্তে ফেলেছে এর আদর্শ উদাহরণ, এমন ব্যক্তিত্ব হলেন রাম মোহন রায়। গত ১৮১৫ সালে তার ‘আত্মীয় সভা’ নামে পাঠচক্র(?) থেকে ব্রাহ্মধর্ম প্রচলনের প্রস্তাব করেন তিনি। সেখান থেকে ব্রাহ্মসমাজ গড়া শুরু করা এর সবচেয়ে ভালো প্রমাণ। তিনি ভুল অনুমানে বুঝেছিলেন, ব্রিটিশরা একাট্টা অ্যাঙ্গলিকান বা ইংলিশ-ক্যাথলিকভিত্তিক এক ‘জাতি’ বলেই তারা মডার্ন ব্রিটিশ জাতি-রাষ্ট্র। কাজেই ভারতকেও জাতি-রাষ্ট্র হতে হলে আগে এক জাতি হতে হবে তাই এক ব্রাহ্ম-জাতি হয়ে নিতে হবে আগে। কারণ তার অনুমান আমাদের অন্যান্য ধর্মও আছে। এর চেয়েও বড় বিষয়, হিন্দুধর্মে অগুনতি জাতিভেদ আছে। কাজেই আগে সবাইকে এক ধর্মে আনতে হবে। এই হলো তার বোঝাবুঝিতে ব্রাহ্মধর্ম প্রচলন-এর পূর্বশর্ত আরোপের কারণ। তবে গুরুত্বপূর্ণ যে দিকটা আমাদের মনে রাখতেই হবে, ভারতীয় কমিউনিস্ট ইতিহাসের চোখে, তাদের লিখিত ইতিহাসে রামমোহনই নাকি তাদের ‘বেঙ্গল রেনেসাঁ’র আদিগুরু।

পরে এর আঠারো বছরের মধ্যে রামমোহনের মৃত্যু, আর ১৮৭২ সালের মধ্যে ব্রাহ্মসমাজ তিন টুকরা হয়ে ওই ব্রাহ্ম প্রকল্প অকেজো হয়ে যায় যদিও তা উনিশ শতকেও টিকে ছিল। কিন্তু অকেজো হয়ে যাওয়ার পর থেকে বা বলা যায় এ সুযোগে নতুন তত্ত¡কার বা অভিমুখ দাতা হয়ে যান বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনিই যুক্তি সাজান যেহেতু ফেল করেছে, তাই বিকল্প হিসেবে হিন্দু-জাতির ভিত্তিতে ভারত জাতি-রাষ্ট্রের সংশোধিত প্রকল্প নেয়া হোক। আর এর ভিত্তিতেই পরে কংগ্রেস দলের জন্ম হয়। পরিণতিতে ২০ বছরের মধ্যে মুসলিম লীগের জন্ম। আর ওদিকে কংগ্রেসের চেয়েও আরো কট্টর উগ্র হিন্দুজাতিবাদী দল তৈরি হয় হিন্দু মহাসভা যেটা আরএসএস-বিজেপির আদি সাংগঠনিক রূপ।

এখন লতার পছন্দ এই আরএসএস-বিজেপির মোদির রাজনীতি। কিন্তু সাবধান, এটা সাধারণ, যার যা রাজনৈতিক দল পছন্দ এমন ব্যাপার নয়। আপনি আরেক জনগোষ্ঠী-অংশকে কোপাবেন, এটা কোনো রাজনীতি, কারো পছন্দের রাজনীতি হতে পারে না, ফলে এটা আপনার পছন্দের রাজনৈতিক মতামত হতেই পারে না। যিনি সমাজের জন্য গান গাইবেনÑ তিনি এমন রাজনীতি ভালোবেসে সুকুমারবৃত্তির চর্চাও করবেন কিভাবে? এটা দায়ীত্বজ্ঞানহীন, বোধশক্তিহীন চিন্তা ও কাজ।

ফলে এক দিক থেকে আমরা লতাকে আমাদের স্মৃতিগুলোকে রক্ষা করতে তার গান মানে তাকে শ্রদ্ধা জানাই; আমাদের দায়িত্ব পরিপালন করেছি। আমরা আমাদের স্মৃতির হত্যাকারী হতে পারি না, তাই। কিন্তু একই সাথে একই নিঃশ্বাসে লতার চিন্তার অন্ধত্ব, রাজনৈতিক হিন্দুত্বের প্রতি বেহুঁশ ভালোবাসা আমাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য; সেটাও জানিয়ে রাখতে চাই!

তবে এটাও সত্য, গানের জগতের বহু বিখ্যাত লোক যারা বুদ্ধিমান তাদের রাজনৈতিক পছন্দ তারা বাইরে আনেন না। ব্যক্তিগত জগতেই রেখে দেন। তাদের এতটুকু সচেতনতার জন্য আমরা তাদের নিয়ে ঘাটাতে চাই না।

কিন্তু লতা মঙ্গেশকর এতই বোধশক্তিহীন যে, তিনি প্রকাশ্যেই তার ব্যক্তিগত দিক পাবলিক করে দেন। এমনই বেপরোয়া ও মানুষের সুবৃত্তি আমল, অযোগ্য ব্যক্তিত্ব তিনি যা শিল্পকলার সাথে আনফিট! অবশ্য অনেক সময় পেটের দায়ে মানুষ শিল্পকলার জগতে এসে পড়ে, সেটাও ঠিক!

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement