বাংলা সাহিত্যে অন্ধকার যুগ : মিথ বনাম বাস্তবতা
- মুসা আল হাফিজ
- ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৯:৪৪, আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৯:৪৫
[অষ্টম ও শেষ কিস্তি]
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য মূলত পয়ার ও ত্রিপদী ছন্দে রচিত বৈষ্ণব কাব্য। লিখেছেন বড়– চণ্ডীদাস। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে চর্যাপদের পরেই শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের স্থান। ১৯০৯ সালে বসন্তরঞ্জন রায়বিদ্বদ্বল্লভ বাঁকুড়া জেলার বনবিষ্ণুপুরের কাঁকিল্যা গ্রাম নিবাসী দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে এর পুঁথি আবিষ্কার করেন। পুঁথিটির মাঝখানের এবং শেষের কয়েকটি পাতা না থাকায় এর নাম জানা যায়নি। তাই এর বিষয়বস্তু কৃষ্ণলীলাবিষয়ক বলে নাম রাখা হয়েছে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। ঐতিহাসিক রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, ‘ইহা স্থির সিদ্ধান্ত যে, শ্রীযুক্ত বসন্তরঞ্জন মহাশয় ‘শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনের’ যে পাণ্ডুলিপি আবিষ্কার করিয়াছেন তা ১৩৮৫ খ্রিষ্টাব্দের আগে, সম্ভবত চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে লিখিত হইয়াছিল।’
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন গীতি-আলেখ্য। রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলা এর বিষয়বস্তু। এর মূল কাহিনী ভাগবত থেকে নেয়া হলেও এতে বিভিন্ন পুরাণ এবং জয়দেবের গীতগোবিন্দের প্রভাব রয়েছে। কাব্যের প্রধান চরিত্র তিনটি; কৃষ্ণ, রাধা ও বড়াই (দূতি)। কাব্যের চরিত্রগুলোর মধ্যে ঘাত-প্রতিঘাত আছে, ঘটনার ঘনঘটা আছে, বিতণ্ডা ও কচাল আছে, হিংসা-দ্বেষ যেমন আছে, তেমনি আছে প্রেম ও কাম। গীতিময়তার আবেশ এবং নাট্যশীলতার চমক এ গ্রন্থকে দিয়েছে বিশিষ্টতা।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মূল নাম ‘শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ব্ব’। কাব্যটি মোট ১৩টি খণ্ডে রচিত। যদিও শেষ খণ্ডটা নিয়ে একটু বিতর্ক রয়েছে, খণ্ডের নামে ‘খণ্ড’ শব্দটি নেই বলে।
প্রথম খণ্ডের নাম জন্ম খণ্ড। এতে দেখানো হয় রাধা ও কৃষ্ণ জন্ম নিলেন ঈশ্বরের ইচ্ছায় মানব রূপে। কৃষ্ণ জন্ম নেন কংস রাজাকে বধ করবেন বলে। দেবকী ও বাসুদেবের ঘরে সন্তান হিসেবে তার আবির্ভাব। বাসুদেবের ভয় ছিল, সন্তানকে কংস রাজা মেরে ফেলবে। ফলে জন্মের পরপরই তিনি কৃষ্ণকে রেখে আসেন বৃন্দাবনে। সেই বৃন্দাবনে এক গোয়ালার ঘরে জন্মগ্রহণ করে রাধা। যখন সে অল্পবয়সী বালিকা, ঈশ্বরের ইচ্ছায় তার বিয়ে হয়। বৃদ্ধা বড়ায়ি থাকেন তার সেবায়।
দ্বিতীয় পর্ব ‘তাম্বুল খণ্ড’। এখানে রাধাকে দেখা যায় দুধ বিক্রির জন্য মথুরায়। সাথে বড়ায়ি এবং কিছু সঙ্গী। রাস্তায় রাধাকে হারিয়ে ফেলেছে বৃদ্ধা বড়ায়ি। খোঁজে পায় কৃষ্ণকে। জানায় রাধার রূপ, জানতে চায়, এই রূপের মেয়েটিকে দেখেছ কি? রূপের বিবরণ শুনেই কৃষ্ণ মোহিত হন রাধার প্রতি। এ খণ্ডেই দেখা যায়, কৌশলে সে প্রেম নিবেদন করছে রাধার কাছে। কিন্তু বিবাহিত রাধা অসতী হবে কীভাবে? সে প্রেম প্রত্যাখ্যান করে।
তৃতীয় পর্বে ‘দান খণ্ড’। রাধা ও তার সঙ্গীদের দেখা যায় মথুরায় ফিরে যাচ্ছে। কৃষ্ণ তাদের পথরোধ করে। পথে নদী। পার হওয়া কঠিন। কৃষ্ণ প্রস্তাব করে নদী পার করে দেবে। বিনিময়ে শুধু চায় রাধার সঙ্গ। রাধা তা মানে না। সে চায় কৃষ্ণের প্রস্তাব করে চলতে।
তৃতীয় পর্বে নৌকা খণ্ড। কৃষ্ণ রাধাকে না পেয়ে থামছে না। রাধা তাকে পাত্তা দিচ্ছে না। একদিন হলো কী? কৃষ্ণ সাজল নৌকার মাঝি। রাধাকে তুলল নৌকায়। মাঝনদীতে নৌকা দিলো ডুবিয়ে। প্রাণে বাঁচতে রাধা বাধ্য হলো সঙ্গদানে। উঠে এলো তীরে। কিন্তু লোকলজ্জার ভয় তাড়া করছিল রাধাকে। সবাইকে সে জানাল, নদীতে ডুবে গিয়েছিল নৌকা। বাঁচার উপায় ছিল না। কৃষ্ণই তাকে জলডুবি থেকে বাঁচিয়েছে।
পঞ্চম পর্বে ‘ভার খণ্ড’। রাধাকে আর বাইরে দেখা যাচ্ছে না। সে ঘরেই থাকে। কিন্তু তাকে দেখবে বলে উদগ্রীব হয়ে আছে কৃষ্ণ। তার তর সইছিল না কোনোভাবেই। সে বড়ায়ির আশ্রয় নেয়। তাকে দিয়ে বুঝায় রাধার শাশুড়িকে; যেন রাধাকে আবার দুধ বিক্রির জন্য বাইরে পাঠান। রাধা বের হলো। ভারী বোঝা নিয়ে মথুরায় যেতে হবে। কৃষ্ণ তার কাছে এলো ছদ্মবেশে, মজুর হয়ে। সে রাধার বোঝা বহন করবে। বিনিময়ে চায় তার আলিঙ্গন। রাধা মিথ্যা আশ্বাস দিলো, যেন ভারী বোঝা বহনের কাজটি করে দেয় কৃষ্ণ। বোঝা মথুরায় পৌঁছে দিলো সে। কিন্তু রাধার আলিঙ্গন পেলো না।
ষষ্ঠ পর্বে ‘ছত্র খণ্ড’। মথুরা থেকে ফিরছে রাধা। কৃষ্ণ চায় কাজের বিনিময়। প্রার্থিত আলিঙ্গন। রাধা চালাকির আশ্রয় নেয়। বলে, সূর্যের তাপ প্রচণ্ড, আগে ছাতা দিয়ে বৃন্দাবন পৌঁছে দাও। কৃষ্ণ বৃন্দাবন অবধি পৌঁছে দিলো রাধাকে। কিন্তু কথা রাখল না রাধা।
সপ্তম পর্বে ‘বৃন্দাবন খণ্ড’। কৃষ্ণ নিরুপায়। এত অবহেলা, এত উদাসীনতা! কিন্তু রাধাকে তো তার পেতেই হবে। নতুন উপায় তালাশ করে সে। বৃন্দাবনকে সাজায় চমৎকার সজ্জায়। সৌন্দর্য ছিল অপূর্ব। তা দেখে মুগ্ধ হয় রাধা, অনুরক্ত হয় প্রেমিকের প্রতি।
অষ্টম পর্বে ‘কালীয়দমন খণ্ড’। এখানে রাধার জন্য অপূর্ব আত্মত্যাগ দেখায় ও জান বাজি রাখে কৃষ্ণ। কালীয়নাগের কবল থেকে রাধাকে বাঁচাতে সে প্রাণের মায়া ত্যাগ করে। যমুনা নদীতে ঝাঁপ দেয়। কালীয়নাগের সাথে প্রচণ্ড যুদ্ধে লিপ্ত হয়। যুদ্ধরত কৃষ্ণের প্রতি রাধার কাতরতা উচ্চারিত হয়।
নবম পর্বে ‘যমুনা খণ্ড’। রাধা ও তার সঙ্গীদের দেখা যায় যমুনা নদীতে, জল আনতে এসেছে তারা। কৃষ্ণ হঠাৎ নদীতে ঝাঁপ দেয়, দেয় লম্বা ডুব। মনে হচ্ছিল সে ডুবে গেছে। তাকে তো বাঁচানো দরকার। রাধা ও তার সঙ্গীরা পানিতে নেমে তাকে খুঁজতে শুরু করে। তারা যখন জলডুব ও সাঁতারে মগ্ন, কৃষ্ণ কৌশলে উঠে যায় তীরে। নদীতীরে ছিল রাধার গলার হার। সেটা চুরি করে কদম গাছে উঠে বসে রইল সে।
দশম পর্বে ‘হার খণ্ড’। রাধা বুঝে গেছে হারের কাহিনী। চালাকি করেছে কৃষ্ণ। বিরক্ত হয়। নালিশ করে কৃষ্ণের পালক মায়ের কাছে। অভিযোগ অস্বীকার করে কৃষ্ণ। সে হার চুরি করেনি। গোটা ব্যাপার বুঝে ফেলে বড়ায়ি। রাধার স্বামী যেন হার চুরির বিষয়ে না জানে, সে প্রচার করে, রাধার হার হারিয়ে গেছে।
একাদশ পর্বে ‘বাণ খণ্ড’। রাধা আর কৃষ্ণের সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়। রাধা বিরক্ত, কেন হার চুরি করল কৃষ্ণ? আর কেন নালিশ দিলো রাধা, এ নিয়ে কৃষ্ণের কষ্ট। কিন্তু রাধাকে সে বশীভূত করতে চায়। বড়ায়ি তার সহায়ক হয়। সে বুদ্ধি দেয় রাধাকে প্রেমবাণে বশীভূত করার জন্য। কৃষ্ণ তাই কদমতলায় গিয়ে বসে, হাতে পুষ্পধনু। নিক্ষেপ করে প্রেমবাণ। বাণাহত রাধা পতিত, মূর্ছিত ও অজ্ঞান হয়ে পড়ে।
দ্বাদশ পর্বে ‘বংশী খণ্ড’। কৃষ্ণের বাঁশির সুর শোনা যাচ্ছে। রাধার মন আনচান করে। কী অপূর্ব সুর! কী মায়া! রাধা স্থির থাকতে পারে না, কোনো কাজে মন বসে না। অস্থির মন, শান্তি উধাও। বড়ায়ি সব জানে, বোঝে। সে রাধাকে বলে, কৃষ্ণের বাঁশি চুরি করো। সমস্যার সমাপ্তি আসবে।
ত্রয়োদশ পর্বে ‘রাধাবিরহ’। রাধা এখন কৃষ্ণকে ছাড়া বাঁচবে না। সব ছেড়ে দিতে প্রস্তুত। কিন্তু কৃষ্ণ এখন রাধার প্রতি উদাসীন। পরিস্থিতি যখন এই, তার পরের কাহিনী আর পাওয়া যায় না। বইয়ের বাকি পৃষ্ঠাগুলো নেই। ফলে আমরা আর জানতে পারি না, এ গ্রন্থে কাহিনীর পরিণতি।
এ গ্রন্থ যখন রচিত হয়, ততক্ষণে মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রভাব বাঙালির বৈদগ্ধে গভীর অভিঘাত তৈরি করেছে। চিন্তা-চেতনায় মানুষ লাভ করেছে প্রাধান্য। বাস্তব জীবনে সমর্পিত হতে শুরু করেছে দৃষ্টি ও মন। দেবতানির্ভর লোকগল্প বা লোকগল্পনির্ভর দেবতা-ভাবনা থেকে যুক্তি ও বাস্তববুদ্ধিতে প্রত্যাবর্তনের একটি গভীর আহ্বান সমাজমানসের জমিতে বয়ে গেছে স্রোতের মতো। এর প্রভাব মুসলিম জীবনে তো বটেই, হিন্দু জীবনেও পড়েছে। সাহিত্যে এর প্রতিফলন ছিল অবধারিত। অতএব এ কাব্যে আমরা দেখি, কৃষ্ণের দেবতারূপ উপেক্ষিত হয়ে তার লৌকিক রূপ বর্ণিত হয়েছে। এখানে কৃষ্ণকে দেবতা হিসেবে না দেখিয়ে গ্রামের চঞ্চল যুবক হিসেবে দেখানো হয়েছে। দেবতার মানবায়ন ঘটেছে সেখানে। যদিও পরবর্তীতে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন সমাদর পায়নি বলা যায় এ কারণে যে পরবর্তীতে বৈষ্ণব পদাবলির সাহায্যে শ্রীকৃষ্ণের উপস্থাপনের আঙ্গিক সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে।
তৎকালীন বৈষ্ণব পদাবলির পদকর্তারা গুরুজন। তারা কৃষ্ণের মানবায়নকে খুব একটা পছন্দ করেননি। এ কারণেই ধারণা করা হয় যে, এই ‘কৃষ্ণকীর্তন’কে লুকিয়ে ফেলা বা সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে দেবতাদের দেবত্বের যে শৃঙ্খল, সেই শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার প্রথম প্রয়াস এই শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। বাংলা ভাষার প্রাচীনতম অপ্রস্তুত রূপ অতিক্রম করে মুসলিম বিজয় পরবর্তী বাংলা ভাষা যে অবয়ব লাভ করল, এর নিদর্শন রয়েছে এ কাব্যে।
কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি কালিনী নই কূলে।
কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি এ গোঠ গোকুলে।।
ও বড়াই, কালিন্দীর তীরে কে বাজায় এমন বাঁশি? তার বংশী ধ্বনি আমি এই গোঠ গোকূলেও শুনতে পাচ্ছি।
পাখি নহোঁ তার ঠাঞি উড়ি পড়ি জাওঁ।
মেদনী বিদার দেউ পসিআঁ লুকাওঁ।।
আমি এখন কি করি বলো? হে ধরণী দ্বিধা হও আমি তোমার ভেতরে গিয়ে লুকোই। এই বাঁশির সুস্বর আমি যে আর শুনতে পারছি না গো!
বন পোড়ে আগ বড়ায়ি জগজনে জাণী।
মোর মন পোড়ে জেহ্ন কুম্ভারর পণী।।
আন্তর সুখাএ মোর কাহ্ন আভিলাসে।
যখন বনে আগুন লাগে সেটা সর্বজনে দেখতে পায়, আর মনে যখন আগুন লাগে কেউ দেখতে পায় না। কুমোরের পণের আগুন যেমন কেউ দেখতে পায় না তাতে শুধু মাটির বাসন পুড়ে যায়, আমার মন সেরকম কুমোরের পণের মতোই ধিক ধিক করে জ্বলছে বড়াই, খালি কেউ দেখতে পাচ্ছে না। বড়াই এই বাঁশি শুনে কাহ্নাইকে পাওয়ার জন্য আমার অন্তর শুকিয়ে যাচ্ছে!
শূন্যপুরাণ
শূন্যপুরাণ রামাইপণ্ডিতের অনবদ্য গ্রন্থ। এর আসল নাম আগামপুরান। নগেন্দ্রনাথ বসু মহাশয় এটি আবিষ্কার করেন। বৌদ্ধধর্মের পতনকালে রামাই ছিলেন খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। কারো মতে, তিনি স্বয়ং ধর্মের অবতার। হিন্দুধর্মের সাথে বৌদ্ধবাদের মিলন নিশ্চিত করার জন্য তিনি চালু করেন ধর্মপূজা। এতে বৌদ্ধদের শূন্যবাদের সাথে হিন্দুদের লৌকিক ধর্মের ঘটেছে প্রণয়। শূন্যপুরাণে রয়েছে ধর্মপূজার ইতিবৃত্ত। এ গ্রন্থের নিরঞ্জনের রুষ্মা কবিতা মুসলিম বিজয় পরবর্তী রচনা। এ কাব্যে ইসলাম সম্পর্কে অপরিণত বোধ থেকে স্পষ্ট হয়, ইসলাম তখনো স্থিত হয়নি সমাজে, সবেমাত্র জয়ী হয়ে এসেছে। এতে রয়েছে বিখ্যাত ‘নিরঞ্জনের রুষ্মা’; যা বয়ান করে মুসলিম পীর-গাজী কর্তৃক ব্রাহ্মণদের অত্যাচার থেকে বৌদ্ধদের রক্ষা করার বিবরণ। গ্রামাঞ্চলে পূজিত ধর্মঠাকুরের পূজাপদ্ধতি এখানে বিধৃত। বঙ্গে পালদের পতন ও সেনদের আবির্ভাবে বৌদ্ধমত ও ব্রাহ্মণ্যবাদের দ্বন্দ্ব ও সমন্বয়ের যুগসন্ধিক্ষণের ধর্মীয় চেতনা থেকে ধর্মপূজার উদ্ভব হয়। রামাই পণ্ডিত একে সংগঠিত ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন। নিম্নশ্রেণীর লোকেরা শুরুতে ছিলেন ধর্মদেবতার ভক্তপূজারী। পূজাপদ্ধতিও ছিল লোকাচারপ্রধান। মন্ত্রগুলোতেও ছিল লোকভাষার প্রাবল্য। রামাই পণ্ডিতের আবির্ভাবের সময় অনুমান করা হয়েছিল খ্রিষ্টীয় একাদশ শতাব্দী বা তার নিকটবর্তীকালে। ফলে আলোচ্য কাব্যটিও এই সময়েই রচিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। আজ পর্যস্ত এই কাব্যের যে তিন খানি পুঁথি পাওয়া গেছে। ‘শূন্যপুরাণ’-এর কোনো পুঁথিই পূর্ণাঙ্গ নয়, ফলে কাবোর মূল নাম জানা যায়নি। বিশ্বকোষ’ প্রণেতা নগেন্দ্রনাথ বসু তিনটি পুঁথির পাঠ সংগ্রহ করে কাবোর বিষয়সম্মত নামকরণ করেন। তার সম্পাদনায় ১৩১৪ সালে সাহিত্য-পরিষদ থেকে শূন্যপুরাণ প্রকাশিত হয়। মুখবন্ধে নগেন্দ্র বাবু লেখেন, ওই পুরাণ বাঙলাভাষার একখানি আদিগ্রন্থ। গ্রন্থের রচয়িতা রামাই পণ্ডিত। তিনি গৌড়েশ্বর দ্বিতীয় ধম্মপালের সময়ে ছিলেন এবং এই রাজা খৃ: ১১শ শতাব্দীর প্রথমে ছিলেন। সে আজি নয়শ’ বছর আগের কথা।
গ্রন্থটি ৫১টি অধ্যায়ে বিভক্ত। গ্রন্থটির প্রথম পাঁচটি অধ্যায় সৃষ্টিতত্ত্ব সম্বন্ধীয়। এই সব সৃষ্টিতত্ত্ব বর্ণনায় মহাযান বৌদ্ধধর্মের প্রভাব লক্ষ করা যায়। বাকি সব কয়টি অধ্যায়ই বিভিন্ন ও বিচিত্র রকমের ধর্মপূজার পদ্ধতি বিশ্লেষণে পূর্ণ। মূল গ্রন্থে বৌদ্ধধর্মের শূন্যবাদ ও হিন্দু লোকধর্মের মিশ্রণ ঘটেছে।
শূন্যপুরাণ গদ্য ও পদ্যের মিশ্রণে রচিত একটি চম্পুকাব্য! এর প্রথম পাঁচটি অধ্যায়ে সৃষ্টিতত্ত্ব সম্বন্ধে বর্ণনা আছে। এতে ধর্মদেবতা নিরঞ্জনের যে কল্পনা করা হয়েছে তা বৌদ্ধদের শূন্যবাদের অনুরূপ।
সেতাই, নীলাই, কংসাই, রামাই ও গোসাই এই পঞ্চপণ্ডিত পঞ্চ ধ্যানীবুদ্ধের প্রচ্ছন্ন রূপ। গ্রন্থের পরের ৪৬টি অধ্যায়ে ধর্মপূজার রীতি-পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে। দেবীর মনঞি অধ্যায়ে হিন্দুদের অনুরূপ পশুবলির কথা আছে; কিন্তু বৌদ্ধধর্মে পশুবলি নিষিদ্ধ। শেষের দু’টি অধ্যায়ে নাথদেবতার উল্লেখ আছে।
অন্ধকার যুগের প্রবক্তাদের কেউ কেউ সেকালের সাহিত্যিক নিদর্শনগুলোকে যেনতেন প্রকারে পূর্ববর্তী বা পরবর্তীকালের সাথে যুক্ত করতে চেষ্টা করেন; যা থেকে রেহাই পায়নি শূন্যপুরাণও। নিরঞ্জনের রুষ্মাকে কেউ কেউ পরবর্তীকালের রচনা বলে মনে করেন। দাবি করেন, হিন্দু-মুসলমানের ধর্মসমন্বয়ের চেতনা থেকে পরে তা যোগ করা হয়েছে।
‘শূন্যপুরাণ’-এর নিরঞ্জনের রুষ্মা অধ্যায়ে বিধৃত হয়েছে মুসলিম আগমনের চিত্রপট এবং গণজীবনে এর প্রতিক্রিয়া। জাজপুরের পূর্বদিকস্থ ব্রাহ্মণরা ধর্ম-উপাসকদের ওপর অত্যাচার জারি রাখে। নিরঞ্জনের রুষ্মায় আছে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের অত্যাচার ও হত্যার বিবরণ-
মালদহে লাগে কর,
না চিনে আপন পর
জালের নাইর দিশ পাস।
বোলিষ্ঠ হইল বড়
দশ বিশ হইয়া জোড়
সধর্ম্মীকে কর-এ বিনাশ।
হিন্দু ধর্মের নামে বিনাশের এমন বিবরণী তাতে লক্ষ্য করে হরপসাদ শাস্ত্রী লিখেন, ‘রমাই পণ্ডিতের পুঁথিতে শ্রীনিরঞ্জনের রুষ্মা নামে একটি অধ্যায় আছে সেটি ছোট, সব স্থলে অর্থবোধ হয় না, কিন্তু যাহা হয়, তাহাতেই ভক্তগণের হিন্দুদ্বেষ ও যবনমৈত্রী প্রকাশ পায়। শুধু এই নয়,... বোধহয়, অনেক স্থলে ব্রাহ্মণদিগের বিরুদ্ধে মুসলমানদিগকে ইহারাই ডাকিয়া আনিয়াছিল।’
লেখক : কবি, গবেষক
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা