ফুল শাখাতে দিসনে আজি দোল
- ড. গাজী মো: আহসানুল কবীর
- ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৯:৪৫
পত্রিকার পাতায় খবরটিতে চোখ পড়তেই আঁতকে উঠলাম। এ-ও কি সম্ভব? যে মেয়েটি সমাজের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে অত্যন্ত বৈরী পরিবেশে মেয়েদের শিক্ষার জন্য প্রতিবাদী কণ্ঠে সোচ্চার হয়ে সারা পৃথিবীর প্রশংসা কুড়িয়েছে এবং ইতিহাসে সর্বকালের সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে ২০১৪ সালে শান্তির জন্য নোবেল জয় করেছে সেই পাকিস্তানি ‘মালালা ইউসুফজাই’কে গৃহকর্মী হিসেবে নিলামের নোটিশ! নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কারণ এ মেয়েটি তো যেন তেন মেয়ে নয়, পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের সোয়াত উপত্যকার পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের অধিবাসী হয়েও মাত্র ১১-১২ বছর বয়সে তালেবান কর্তৃক মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধের বিরুদ্ধে বন্ধুদের নিয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে এবং বিবিসির জন্য ব্লগ লেখার অপরাধে গুলিবিদ্ধ হয়। প্রথমে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে ও পরে ব্রিটেনে নিয়ে চিকিৎসা করার পর জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ থেকে বেঁচে আসা এক অনন্য মালালা।
অজপাড়াগাঁয়ের এ সাহসী মেয়েটি পরে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়ে আজ সারা পৃথিবীতে নারী অধিকার আদায়ে কাজ করছে। বয়স মাত্র ২৪, এই বয়সেই সে
1) ডয়সে ভ্যালের বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ খ্যাতিমান ব্যক্তি
2) পাকিস্তানের জাতীয় যুবা শান্তি পুরস্কার
3) টাইম ম্যাগাজিনের বিশ্বের সর্বোচ্চ প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব
4) ডেসমন্ড টুটুর আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার
5) কানাডার সম্মানিত নাগরিক
6) অস্কার ডকুমেন্টারির কেন্দ্রীয় চরিত্র
7) আন্তর্জাতিক best seller ‘I am Malala বইয়ের লেখক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে। আর সেই মালালাকেই নাকি গৃহকর্মী হিসেবে কে বা কারা নিলামে তুলেছে! কী জঘন্য নোংরামি! এখানেই শেষ নয়। ভারতের কিংবদন্তি অভিনেত্রী শাবানা আজমি, কাশ্মিরের প্রখ্যাত সাংবাদিক কুরাতুলাইন রেহবার, দিল্লি হাইকোর্টের একজন বিচারকের স্ত্রীসহ ভারতের ৮০ জন প্রখ্যাত মুসলিম নারীকে এ অবমাননাকর অবস্থায় ফেলার চেষ্টা করেছে ভারতেরই এক ধর্মান্ধ নিম্ন রুচির গোষ্ঠী। তারা ‘বুল্লিবাই’ নামে একটি অ্যাপ তৈরি করে তার মাধ্যমেই এ কাজটি করেছে।
কারণ কী? কারণ এরা সবাই মুসলিম নারী এবং নিজ নিজ ক্ষেত্রে নক্ষত্রসম ব্যক্তিত্ব। এ বিষয়টি হিন্দুত্ববাদীদের গায়ে জ্বালা ধরিয়েছে। খবরটি পয়লা জানুয়ারির পত্রিকায় আসে। এর আরো ছয় মাস আগে জুলাই, ২০২১-এ সম্ভবত একই চক্র ‘সুলি ডিল্স্’ নামের অনুরূপ আর একটি অ্যাপের মাধ্যমে ভারতের নারী পাইলট হেনা মহসিন খান, নাবিয়া খান ছাড়াও সাংবাদিক, লেখক, পাইলট, অধিকারকর্মীসহ আরো শতাধিক প্রভাবশালী মুসলিম নারী ব্যক্তিত্বকে নোংরা ভাষা ব্যবহার করে অনলাইনে বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। অবাক ব্যাপার হলো ছয় মাস আগের এসব ঘটনার পর ব্যাপক প্রতিবাদ-অভিযোগ উত্থাপনের পরও আজ অবধি কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সবার প্রশ্ন, তাহলে কি অসভ্য চক্রের এসব নোংরামি চলতে থাকবে? দেশের প্রায় চার কোটি মুসলমান নারী যাবে কোথায়?
শুধু মুসলিম নারীই নয়। অনলাইন বিবিসিতে প্রকাশিত গীতা পান্ডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখন কোনো প্ররোচনা ছাড়াই ভারতে মুসলমানদের ওপর হামলা চালায় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। গরু জবাই করলে বা হোটেল রেস্তোরাঁয় গরুর গোশত সরবরাহ করলে তো বটেই এমনকি গরু রাখলে বা গরু নিয়ে চলাচল করলেও মুসলমানরা আক্রমণের শিকার হচ্ছে। গীতা পান্ডের রিপোর্টে বলা হয় রাজস্থানের নিজের ছোট্ট দুগ্ধ খামারে গরু নিয়ে যাওয়ার অপরাধে পেহলু খানকে হত্যা করা হয়। উত্তর প্রদেশে নিজ বাড়িতে গরুর গোশত রাখায় আখলাক খানকে জীবন দিতে হয়েছিল। মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণাপ্রসূত আক্রমণের এমন প্রায় ২০০ ঘটনার ভিডিও ২০১৯ সালে তার হাতে এসেছে। এ সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
আরো ভয়াবহ হলো, যে আসামের এক-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠীই মুসলিম সেখানে সম্প্রতি চালু করা ‘নাগরিকত্ব আইনে’ প্রায় সাড়ে তিন লাখ দরিদ্র মুসলমানকে অবৈধ অভিবাসী আখ্যা দিয়ে জোরপূর্বক ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ অভিযান করা হয়েছে। একই সময়ে সেখানকার মসজিদ আর মাদরাসাগুলোকেও গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। আসামের মুখ্যমন্ত্রী বিশ্ব শর্মার মতে, কৃষিজমি পুনরুদ্ধারের জন্য এসব জরুরি পদক্ষেপ নিতে হয়েছে। বাহ, কী চমৎকার কথা! আর সেখানকার হিন্দু পুরোহিত উধব দাস আরো এক ধাপ এগিয়ে বললেন, আমাদের তো মসজিদ ও মাদরাসার কোনো প্রয়োজন নেই। আর জমি উদ্ধার হলে হিন্দুরা তাদের জমি ফিরে পাবে। এ না হলে কী আর মন্দিরের পুরোহিত? অবশ্য স্থানীয় কংগ্রেস নেতা অখিল গগৈর মতে, এসবই একটি বর্বর সমাজের কাজ।
পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরার অবস্থাও খারাপ। ত্রিপুরার সীমানাঘেঁষে অবস্থিত বাংলাদেশের কুমিল্লাতে গত অক্টোবর মাসে দুর্গা পূজার সময় একটি মন্দিরে দেবীর পায়ের কাছে কুরআন শরিফ রাখাকে কেন্দ্র করে যে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে তারই প্রতিক্রিয়া হিসেবে সম্ভবত ত্রিপুরায় মসজিদ-মাদরাসাসহ মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর ব্যাপক তাণ্ডব চলে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর করে আগুনে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। শত শত মুসলমানের ঘরবাড়ি-ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। অথচ কুমিল্লার মন্দির ভাঙচুরের সাথে সাথেই বাংলাদেশ সরকারব্যবস্থা গ্রহণ করে। উত্তেজিত জনতাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ তৎক্ষণাৎ গুলি চালালে পাঁচজন নিহত হয়। ৭০০ মানুষকে গ্রেফতার করা হয়, জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ৭২টি মামলা দেয়া হয়। ঘটনার পরদিনই বাংলাদেশের একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রী ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু এলাকা পরিদর্শন করে সাহায্য ঘোষণা করেন। দুঃখজনক হলো এত কিছু করার পরও ভারত সরকার এ ঘটনার জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। আর বাংলাদেশ সরকার তা নীরবে হজম করে। কিন্তু কুমিল্লার যে ঘটনার জন্য ত্রিপুরার দরিদ্র অসহায় মুসলমানরা দায়ী নয়, তাদের ওপর যখন দিনের পর দিন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সন্ত্রাসীদের আক্রমণ ও অগ্নিসংযোগ চলে তখন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বা ত্রিপুরার রাজ্য সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ তো দূরের কথা কেউই তাদের কোনো খোঁজখবর পর্যন্ত নেয়নি। অথচ ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী এ কুমিল্লার চাঁদপুরের মাটিতে জন্মগ্রহণ, শিক্ষা গ্রহণ সব কিছু সমাধা করেই এখন ত্রিপুরার কর্ণধার।
সবচেয়ে দুঃখজনক হলো ত্রিপুরার মুসলমানদের ওপর এসব তাণ্ডবের পর বাংলাদেশ সরকার যখন প্রতিবাদ জানাল তখন ভারত সরকারের প্রতিক্রিয়া হলো এটি তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। বাহ, তা হলে কুমিল্লার সহিংসতায় ভারতের প্রতিবাদ এলো কেন? সেটিও কি ভারতেরই অভ্যন্তরীণ বিষয়? শুধু এ ঘটনাতেই নয়। এর আগে গত বছর দিল্লির উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সালিমপুর ও জাফরাবাদে যখন ব্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়, বহু মুসলমান প্রাণ হারায়, মসজিদগুলো পুড়ে ছাই হয়ে যায় তখন পুলিশ উল্টো মুসলমানদেরই গ্রেফতার করে যারা আজো কারাবন্দী। সে ঘটনার ব্যাপকতায় হতবিহ্বল হয়ে পাকিস্তান, ইরান, তুরস্ক ও ঙওঈ-সহ সারা মুসলিম বিশ্ব ভারত সরকারের কাছে প্রতিবাদ জানালে ভারতের উত্তর ছিল এটি তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার।
আসলে অন্যদের অধিকারের ব্যাপারে ভারত সবসময়ই অনুদার। অথচ আমাদের ঔদার্য সীমাহীন। ধর্মীয় সম্প্রীতির ব্যাপারে বাংলাদেশ পৃথিবীর যেকোনো দেশের জন্য অনুকরণীয়। এই যে দেখুন না, কুমিল্লার সাম্প্রতিক ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের ঘর তৈরি করে দেয়াসহ তাৎক্ষণিক সাহায্য দেয়া হয়। একইভাবে সবার মনে থাকার কথা, কয়েক বছর আগে যেসব দুষ্কৃতকারী রামুর প্যাগোডা ধ্বংস করেছিল তারা সর্বোচ্চ সাজা পেয়েছিল। আজো তারা জেলবন্দী। ধ্বংসপ্রাপ্ত প্যাগোডাগুলো আরো মনোরম ও সুন্দর অবয়বে বিশাল কমপ্লেক্সের আকারে নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। একইভাবে পাকিস্তানের খায়বার পাখতুন অঞ্চলে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে একটি মন্দির ধ্বংসের ঘটনায় সুপ্রিম কোর্ট নিজ উদ্যোগে সুয়োমোটো মামলা দিয়ে তার বিচারকাজ শেষে এক রায়ে ১২৩ জন আসামিকে কারাদণ্ড দিয়েছেন। আসামিদের কাছ থেকে ৩৩ কোটি রুপি আদায়ের জন্য চিফ জাস্টিস গুলজার আহমেদের নেতৃত্বে দুই সদস্যের বেঞ্চ এক মাস সময় বেঁধে দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়; মন্দির নির্মাণের জন্য মন্দির কমিটি যত পরিমাণ জায়গা চায় তা দিতে পাকিস্তান সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে। অবশ্য পাকিস্তান এরই মধ্যে ৩৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন করে মন্দির নির্মাণ করে দিয়েছে।
প্রতিবেশী দেশগুলোর এ উদারতার বিপরীতে ভারতে চিত্রটি ঠিক উল্টো। আজ থেকে ৩০ বছর আগে দিনের আলোতে হাজার হাজার উগ্র হিন্দু ৫০০ বছরের পুরনো বাবরি মসজিদ ভেঙে মাটিতে মিশিয়ে দিলো। সে কাজে লালকৃষ্ণ আদভানিসহ ভারতের শীর্ষস্থানীয় হিন্দুত্ববাদী নেতারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, পুলিশ সহায়তা করেছে। অবাক ব্যাপার হলো এমন একটি ধ্বংসযজ্ঞে অংশগ্রহণের জন্য একজন লোকও গ্রেফতার হয়নি, একটি মামলাও করেনি সরকার। মুসলমানদের করা মামলা দীর্ঘ দিন চলার পর রায় এলো- কাজ ঠিক হয়েছে, সেখানে রাম মন্দিরই হবে। তাই হচ্ছে। এাট নাকি অসাম্প্রদায়িক ভারত।
দিন যত যাচ্ছে ভারতের ২২ কোটি মুসলমানের জন্য পরিস্থিতি ততই প্রতিক‚ল হচ্ছে। রাজধানী দিল্লির উপকণ্ঠের শহরতলি গুরগাঁওয়ে গত তিন মাস থেকে উন্মুক্ত স্থানে মুসলমানদের জুমার নামাজ আদায়ে লাঠিসোটা নিয়ে বাধা দেয়া হচ্ছে। যুক্তি হলো উন্মুক্ত স্থানে গাড়ি পার্কিংয়ে অসুবিধা হয় এবং উচ্চস্বরে আজান আর কুরআন তেলাওয়াতে শব্দ দূষণ হচ্ছে। কোথায়? পৃথিবীর সবচেয়ে বায়ুদূষণের শহর দিল্লিতে? যেখানে ক’দিন আগেই অসম্ভব দূষণের কারণে ৫০ ফুট দূরের কিছু দেখাই যেত না। স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, কোর্ট-কাচারি সব বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল সেখানে নাকি আজানে শব্দ দূষণ হয়? কী আর বলার আছে? যে গুরগাঁওয়ে ১০ লাখ অধিবাসীর মধ্যে অর্ধেক অর্থাৎ পাঁচ লাখই মুসলমান সেখানে নগর পরিকল্পনায় মসজিদের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে একটিমাত্র প্লট। অথচ মন্দিরের জন্য ৪২টি এবং গুরুদ্দোয়ারার জন্য ১৮টি প্লট। সে কারণেই স্থানীয়ভাবে কোর্টের ও স্থানীয় প্রশাসনের লিখিত অনুমতি নিয়েই মুসলমানরা উন্মুক্ত স্থানে নামাজ আদায় করছিল। অথচ সেটিতেও বাধা। শুধু বাধাই নয় গুরগাঁও শহরটি যে হরিয়ানা রাজ্যে পড়েছে সেখানকার বিজেপি দলীয় মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল খাত্তার ঘোষণা দিয়েছেন প্রকাশ্যে নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা সহ্য করা হবে না।
কংগ্রেস নেতা ও সাবেক খ্যাতিমান অর্থমন্ত্রী পি চিদাম্বরাম সম্প্রতি বলেছেন, এসব ঘটনাকে বৈধতা দিয়েছে আরএসএস ও বিজেপির নীতি। কারণ আরএসএসের প্রতিষ্ঠাতা এম এস গোলওয়ালকার তার we or our nationhood defined বইতে লিখেছেন, ‘এ দেশটি হিন্দুদের। মুসলমানরা অবশ্যই হিন্দু জাতি ও সংস্কৃতির ধারণার বাইরে কিছু ভাবতেও পারবে না, কিছু দাবিও করতে পারবে নাÑ এমনকি নাগরিক অধিকারও নয়।’ বস্তুত এসব বক্তব্য আর নীতিই উগ্রবাদীদের অসহিষ্ণু আর হিংস্র করে তুলেছে। সুতরাং তারা ভাবল এবার আর বাধা নয়, প্রকাশ্য হুমকি। তা-ই ঘটল গত মাসে ১৭-২০ ডিসেম্বর উত্তরাখন্ডের হরিদ্বারে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের আয়োজিত ‘ধর্ম সংসদে’। সেখানে চরম কুরুচিপূর্ণ ভাষায় মুসলমানদের সমূলে নিধনের দাবি জানানো হয়। এ সভার আয়োজক স্বামী নরসিংহানন্দ বলেছেন মুসলমানদের হত্যা করার জন্য তরবারি নয়, উন্নত অস্ত্র সংগ্রহ করতে হবে। একজন ধর্মগুরু তো বলেই দিলেন মুসলমান নিধনে মিয়ানমার হলো মডেল। মিয়ানমারের মতো প্রতি ২০ লাখ মুসলমান মারতে এক শ’ হিন্দু তৈরি হয়ে যান। হিন্দু যুবকদের মোবাইল কিনে অর্থ নষ্ট না করে তা দিয়ে অস্ত্র কিনে মুসলিম হত্যা করতে হবে।
এসব উগ্রবাদিতার বিরুদ্ধে মোটা দাগে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না হওয়ায় মুসলমানদের এখন চরম আতঙ্কে দিন কাটাতে হচ্ছে।
হরিদ্বারে মুসলিম গণহত্যার আহ্বানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অঞ্জনা প্রকাশ এবং কংগ্রেস নেতা ও আইনজীবী কপিল সিগাল ভারতের সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন। তবে সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ আসে ভারতীয় নৌবাহিনীর সাবেক এক প্রধান অ্যাডমিরাল অরুণ প্রকাশের কাছ থেকে। তিনি বলেছেন, কট্টরপন্থী হিন্দুদের মুসলিম গণহত্যার আহ্বান ভারতকে ভয়ঙ্কর এক গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেবে। সংবাদমাধ্যম ট্রিবিউন এক্সপ্রেস জানিয়েছে তিনি এ বিষয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্বের নীরবতাকে দুঃখজনক ও অশুভ আখ্যা দিয়ে নিজেই এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য গত ৩১ ডিসেম্বর ভারতের প্রেসিডেন্টের কাছে একটি খোলা চিঠি পাঠিয়েছেন। তার সাথে ওই চিঠিতে স্বাক্ষর করতে তিনি ভারতের সাবেক সব সেনাপ্রধান ও বাহিনী প্রধানদের আহ্বান জানালেও তাদের কেউই সাড়া দেননি। এমনকি ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি তার চিঠিরও কোনো জবাব পাননি। এতে তিনি হতাশ। হতাশ হবেনই বা না কেন? কারণ এরই মধ্যে ‘আন্তর্জাতিক জেনোসাইড ওয়াচ’-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার জর্জ মেসন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জেনোসাইড অ্যান্ড রেসিস্ট্যান্স’ বিষয়ের অধ্যাপক ড. গ্রেগরি স্ট্যান্টন ভারতে আসন্ন মুসলিম গণহত্যার বিষয়ে কড়া সতর্কবাণী জানিয়েছেন।
এই ড. স্ট্যান্টনই ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডায় যে ৮০ হাজার মানুষের গণহত্যা ঘটেছিল সে সম্পর্কে তার পাঁচ বছর আগেই ১৯৮৯ সালে রুয়ান্ডাকেও সতর্ক করেছিলেন। তখন রুয়ান্ডা এটিকে পাত্তা না দিলেও রুয়ান্ডায় কঠিন ও দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি ঠিকই ঘটে যায়। ড. স্ট্যান্টনের মতে, সম্প্রতি জারি করা নাগরিকত্ব আইনের বৈষম্যমূলক প্রয়োগসহ বিভিন্ন ঘটনা কট্টর হিন্দুদের সাহস আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই মুসলিম গণহত্যার আশঙ্কা এখন আরো প্রবল হয়েছে। ড. স্ট্যান্টন অবশ্য দৃঢ়ভাবে বলেন, এটি আমরা হতে দিতে পারি না।
মনে রাখতে হবে যে বিশ্ব সমাজ এসব দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ছাড় দেয় না। সবারই স্মরণ থাকার কথা, নব্বইয়ের দশকে সার্বিয়ার তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট রাদোভান কারাদজিচ বসনিয়া হার্জেগোভিনার মুসলমানদের ওপর যে গণহত্যা চালিয়েছিলেন বিশ্ব আদালত সেটিকে আমলে নিয়ে রাদোভান কারাদজিচকে ধরে এনে ৪০ বছরের জেল দেয়। একইভাবে ’৭০-এর দশকের কম্বোডিয়ার নরপিশাচ শাসক খিউ সাম্পানের বর্বরতারও শাস্তি হয় যাবজ্জীবন।
গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ আর অসাম্প্রদায়িক নীতির জন্য এক দিন যে ভারতের দুনিয়া জোড়া খ্যাতি ছিল সেটি তো এমন সাম্প্রদায়িক চেতনার বা অশান্তির ভারত নয়। সেটি দাদাভাই নওরোজি আর মহাত্মা গান্ধীর শান্তির ভারত, সেটি জওয়াহেরলাল নেহরু, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ আর ড. জাকির হোসেনদের অসাম্প্রদায়িক ভারত, ইন্দিরা গান্ধী আর মোরারজি দেশাইয়ের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারত, নরসিমা রাও আর মনমোহন সিংদের সম্প্রীতি আর সহনশীলতার ভারত। মহাত্মা গান্ধীর তো কথাই ছিল ভারতে হিন্দু আর মুসলমান একই বৃন্তে দু’টি ফুল। একে ঝাঁকালে তো বৃন্তের দু’টি ফুলই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই তো কবির ভাষায় বলতে হয়- ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে দিসনে আজি দোল’।
লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা