২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

বাংলা সাহিত্যে অন্ধকার যুগ : মিথ বনাম বাস্তবতা

-

[সপ্তম কিস্তি]
বস্তুত বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্য তুর্কি শাসনকাল ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্য স্তন্যদায়ী ভূমিকা পালন করেছে এই সময়পর্ব।

এ সময়ে বাংলা ভাষায় রচিত হয় বহু অজর-অমর সাহিত্য। মোটাদাগের নিদর্শনগুলোর মধ্যে আছে ‘পিঙ্গলের গীতিগ্রন্থ’ ‘প্রাকৃত পৈঙ্গল’, রামাই পণ্ডিত রচিত চম্পুকাব্য শূন্যপুরাণ এর কলিমা জলাল বা নিরঞ্জনের রুষ্মা, হলায়ুধ মিশ্র রচিত গদ্যপদ্যমিশ্রিত চম্পুকাব্য ‘সেক শুভোদয়া’ এর পীর-মাহাত্ম্যজ্ঞাপক বাংলা ‘আর্যা’ ‘ভাটিয়ালী রাগেন গীয়তে’ ডাক ও খনার বচন এবং শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। এ ছাড়া শ্রীধর দাসের সদুক্তি কর্ণামৃত, (১২০৬ সাল) কাজী রোকনুদ্দীনের হাওকুল হায়াত (১২১০-১৩ সাল) নারায়ই এর চম্পুকাব্য (১৩৭৩) ইত্যাদি এ সময়ের প্রকাশিত গ্রন্থ।

বাংলার হয়ে ওঠার যেসব ধাত্রীগ্রন্থ একালে রচিত হয়, আলোকপাতের জন্য সেগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহাসিক বিচারে এগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলা ভাষার সম্পন্নতার ধারায়ও এসব গ্রন্থ একেক মাইলফলক। এমন কিছু প্রধান রচনাকর্মের সাথে পরিচিত হওয়া যাক।

সেক শুভোদয়া
হলায়ুধ মিশ্র রচিত সেক শুভোদয়া এ সময়ের অন্যতম সাহিত্যনিদর্শন। গ্রন্থের রচনাকাল বারো শতকের শেষ বা তেরো শতকের গোড়ার দিকে হওয়ার কথা। ড. মুহম্মদ এনামুল হকের মতে, ‘সেক শুভোদয়া খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর একেবারেই গোড়ার দিককার রচনা।’ যদিও কেউ কেউ এ নিয়ে কল্পনাপ্রসূত প্রস্তাবনা পেশ করেন, দাবি করেন কোনো মুসলমান লেখক হয়তো ‘হলায়ুধ মিশ্র’ ছদ্মনামে এটি রচনা করেছেন এবং তা ষোড়শ শতকের কাছাকাছি সময়ে রচিত হয়ে থাকবে। বাংলা-সংস্কৃত-প্রাকৃতমিশ্রিত ‘সেক শুভোদয়া’ গ্রন্থটিতে ইসলাম প্রবলভাবে উপস্থিত। ধর্ম ও সমাজ সংগঠনের পাশাপাশি ‘সেক শুভোদয়া’, থেকে গুপ্ত, পাল ও সেন রাজাদের ঐতিহাসিক কাহিনীগুলোর সাথে সাথে তদানীন্তন বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের বাস্তবতার সন্ধান পাওয়া যায়? বিশেষত মুসলিম শাসন ও প্রভাবের ঊষালগ্ন সেখানে উন্মেষিত।

সম্রাট আকবরের আমলে রাজা টোডরমল যখন বাংলায় জমি জরিপ চালান, তখন মালদহের বাইশ হাজারি মসজিদের ওয়াকফ সম্পত্তির দখলিস্বত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে শেখ শাহজালাল ও লক্ষ্মণ সেনের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন হয় আর সেই সম্পত্তির ভোগ-দলিলস্বরূপ এ গ্রন্থ প্রণীত হয়। গ্রন্থটি বাইশ হাজারি মসজিদেই সংরক্ষিত ছিল। উনিশ শতকে সেখান থেকে একে খুঁজে নেন মালদহের জেলা প্রশাসক উমেশ চন্দ্র বিদ্যালঙ্কার।

সেক শুভোদয়ায় মোট ২৫টি অধ্যায় আছে। প্রায় প্রতিটি অধ্যায়ে এক বা একাধিক গল্প আছে এবং গল্পগুলো কখনো সেখের অভিজ্ঞতায়, কখনো লক্ষ্মণ সেনের অভিজ্ঞতায়, আবার কখনো মন্ত্রী-যোগীর অভিজ্ঞতায় বর্ণিত হয়েছে। মূলত সেখ-সেনকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেই কাহিনীগুলো বিবৃত হয়েছে। বাদশাহ হারুন অর রশিদকে কেন্দ্র করে আরব্য রজনী এবং বিক্রমাদিত্যকে কেন্দ্র করে বত্রিশ সিংহাসন গ্রন্থের অনুকরণে সেক শুভোদয়ার কাহিনী-পরিকল্পনায় লেখকের কৃতিত্ব লক্ষণীয়। বেশির ভাগ গল্পে এক দিকে অলৌকিক ক্ষমতা ও আধ্যাত্মিক মহিমার অধিকারী শেখ শাহজালালের চরিত্রগৌরব এবং অন্য দিকে মসজিদ, খানকাহ প্রতিষ্ঠা ও ধর্মান্তরীকরণ প্রক্রিয়ায় ইসলাম প্রচার করা হয়েছে। মানুষকে নীতি-উপদেশ শিক্ষা দেয়ার জন্য গল্পের মাঝে মধ্যে কিছু জ্ঞানগর্ভ শ্লোক আছে। সেখ শুভোদয়া-গ্রন্থের কাহিনী রাজা লক্ষ্মণ সেন ও মুসলিম বিজয়-পরবর্তী সমাজের শিল্পরুচি ও সাধারণ জীবনচর্চার উপকরণ সামগ্রী জোগাতে কার্পণ্য করেনি? সেক শুভোদয়ায় বর্ণিত গঙ্গোনটবধূ বিদ্যুৎপ্রভা, বুঢন মিশ্র, জয়দেবসতী পদ্মাবতী ও কবি জয়দেবের নৃত্যগীত সম্পৃক্ত কাহিনীর মধ্যে তা লক্ষণীয়। মুসলিম শেখের প্রতি শ্রদ্ধা এ গ্রন্থে বিবৃত। মুসলিমদের প্রতি এমন শ্রদ্ধা তখনকার ভারতের নানা ভাষায় উচ্চারিত হচ্ছে। এমনকি যে বখতিয়ার খিলজির হাতে লক্ষ্মণ সেনের পরাজয়, সেই খিলজির প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন রয়েছে লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি উমাপতি ধর রচিত একটি শ্লোকে। স্বভাবগতভাবেই মুসলিমদের ম্লেচ্ছ বলে আখ্যায়িত করেছেন তিনি। নিজেদের ব্রাহ্মণসুলভ উচ্চবংশীয় অহমিকা থেকে মুসলমানদের নীচ বংশীয় সাব্যস্ত করেছেন। তবুও বখতিয়ার বন্দনায় তার ভাষ্য-
‘সাধু ম্লেচ্ছ নরেন্দ্র সাধু ভবতৌ মাতৈন বীরপ্রসুর
নীচেনাপি ভবদ্বিধেন বসুধা সুক্ষত্রিয়া বর্ততে।’
অর্থ- স্নেচ্ছরাজ সাধু! সাধু! আপনার মাতাই যথার্থ বীরপ্রসবিনী। নিচ বা পতিত হলেও আপনার মতো লোকের জন্য পৃথিবী বীরত্বময় রয়েছে।

সুকুমার সেন সেক শুভোদয়াকে ষোড়শ শতকের পাণ্ডুলিপি বলে দাবি করেন। তার মতে, সংস্কৃত কম জানেন, এমন কারো হাতে গ্রন্থটি রচিত হয়ে থাকবে। কিন্তু স্বীকার করেন, এই গ্রন্থে আলোচিত লক্ষ্মণ সেনের সভাষদ উমাপতি ধর, গোবর্ধন আচার্য, হলায়ুধ মিশ্র, ধোয়ী, গঙ্গোক, বিজয় সেন, রামপাল প্রমুখ ঐতিহাসিক ব্যক্তি। এ গ্রন্থে যেসব কাহিনী বর্ণিত, তার নানা কিছু তিনি ইতিহাস গ্রন্থেও খুঁজে পেয়েছেন। যেমন লক্ষ্মণ সেনের স্ত্রী ও শ্যালকের ইতিবৃত্ত মেরুতুঙ্গাচার্যের প্রবন্ধ ‘চিন্তামণি’ গ্রন্থেও পেয়েছেন তিনি। যাদের নিয়ে গ্রন্থটিতে আলোকপাত করেছে, তাদের সবাই ইতিহাসবিশ্রুত এবং আলোচনা আবর্তিত হয়েছে লক্ষ্মণ সেনের সময় ও কালের প্রত্যক্ষণের ওপর।

লক্ষ্মণ সেন যে বিদেশী তুর্কি বা মুসলিমবিদ্বেষী ছিলেন তাও ঐতিহাসিক সত্য বলে স্বীকার করেন। ‘সদুক্তিকর্ণামৃত-বৃত কবি শরণের একটি রাজস্তুতিমূলক পদে রয়েছে ‘গ্নেচান ম্লেচ্ছ? বিনাশম নয়তি’। (তিনি) স্বেচ্ছায় ম্লেচ্ছ (তুর্কি)-দের হত্যা করান। সেক শুভোদয়ায়ও পাই, তত্র যো যবন যাতি তম ঘাতয়তি। - সেখানে (গৌড়ে) যে যবন (মুসলিম বা বিদেশী ) যায় তাকেই হত্যা করেন।

আহমদ শরীফ লিখেন, এই গ্রন্থ নিশ্চয়ই ভালো সংস্কৃত জানা সৃজনশীল হিন্দু পণ্ডিত রচিত, যার লক্ষ্মণ সেনের সভা, সভাষদ, কবি এবং প্রাসাদ-জীবন, জনজীবন, জনজীবিকা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা ছিল, আর শিল্পীসুলভ সৃজনশীলতা নৈপুণ্য ও রসবোধও ছিল। ইতিহাস বিরল সে যুগে চার শ’ বছর আগেকার বাস্তব ঘটনা ও পরিবেশ বানিয়ে বানিয়ে রচনা করা কি তার পক্ষে সম্ভব ছিল?

সবিস্তার বিশ্লেষণ করে আহমদ শরীফের সিদ্ধান্ত, আমাদের ধারণা, ‘সেক শুভোদয়া’ রাজমন্ত্রী হলায়ুধ মিশ্রেরই রচনা। তুর্কি বিজয়ের পর উমাপতি ধরের মতো তিনিও তুর্কি প্রভুর প্রসন্ন দৃষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে এই পীর প্রীতিমূলক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। কাজেই সেক শুভোদয়া গ্রন্থের অকৃত্রিমতায় সন্দেহে করা অমূলক। আমাদের ধারণায় জালালউদ্দীন তাবরেজি ১২০০-১২ সাল অবধি গৌড়ে ছিলেন এবং তাজকিরাতুল আউলিয়া মতে ১২২৫ সালে তার মৃত্যু হয়। ৩

‘সেক শুভোদয়ায় ২৭টি পরিচ্ছেদ ছিল। ২৬-২৭ পরিচ্ছেদ হয় ২৫ এর অন্তর্গত অথবা লিপিকর দুটো পাননি তার নকলের আদর্শ পুঁথিতে। রাজা লক্ষ্মণ সেন ও শেখ জালাল উদ্দিনের প্রথম সাক্ষাৎ দিয়েই গ্রন্থের শুরু। বর্ণিত বিষয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে শেখের প্রতি রাজা, মন্ত্রী ও অবিশ্বাসীদের ক্রমেই আকৃষ্ট হবার চমকপ্রদ কাহিনী, রাজশ্যাপক কুমার দত্ত-মধবী-মধুকর-রানী বল্লভা সম্পৃক্ত ঘটনা, শেখের প্রথম জীবনের নানা অলৌকিক কাহিনী, বিজয় সেনের কাহিনী, তীরন্দাজ লক্ষ্মণ সেন-মদন-উমাপতি ধর সম্বন্ধীয় ঘটনা, বৃঢন মিশ্র, পদ্মাবতী- জয়দেবের সঙ্গীত প্রতিযোগিতা, রাজা ও ধোপা সম্বাদ, ধোয়ী ও চার ব্রাহ্মণ, মন্ত্রী, বিদ্যুৎপ্রভা সম্বাদ, শেখের মসজিদ তৈরি ও সম্পত্তি লাভ, নট গাঙ্গোর কাহিনী, বিদ্যুৎপ্রভা ও তাতী প্রভৃতির আখ্যায়িকা।

এর মধ্যে রয়েছে বাংলা ছড়া ও শ্লোক। যা বাংলা ভাষাকে চিহ্নিত করে, বিশেষভাবে। যেমন -
ক. মকদম শেক শাহ জালাল তবরেজ
তব পাদে করে পরণাম
চৌদ্দিশ মধ্যে জানিবে বাহার নাম
বারেক রক্ষা কর মোর পণ (পণ্য) প্রাণ
দেশে গেলে দিব তোমার নামে অর্ধেক দান।
খ. বনের শাখ খায় সে বনের গোনা
ঝিকরির পোটলি বান্ধিয়া দেয় সেক
হাটে বিকাইলে হয় সোনা
গ. উদয়াচল পবতের নাম।
উদয় সুয প্রত্যুষ বিহান
সেক শুভোদয়ায় রয়েছে শেখের কাছে এক বন্দিনী ডাকিনীর মুক্তি প্রার্থনা- আহমদ শরীফের মতে, এটি যথার্থই প্রাচীন বুলি।

রমণী বলেন-
হঙ জুবতী পতিএ হীন।/গঙ্গা সিনায়িবাক জাইএ দিন/দৈব নিয়োজিত হৈল আকাজ।/বায়ু ন ভাঙ্গএ ছোট গাছ/ছাড়ি দেহ কাজ্জ মুঞি জাঙ ঘর।/সাগর মৈদ্ধে লোহাক গড়/হাত জোড় করিঞা মাঙ্গো দান।/বারেক মহাত্মা রাখ সম্মান
এ গ্রন্থ প্রাচীন যুগের ব্যক্তি মানস এবং সংস্কৃতি ও সমাজচিত্রের প্রতিফলন ঘটায়, যা মধ্যযুগের প্রথম দিকের বাঙালির সৃজনশীল মনের অন্যতম এক রূপায়ণ। এর ঐতিহাসিক মূল্যও বিপুল। ভবিষ্যদ্বাণীরূপে এ গ্রন্থে তুর্কি বিজয়ের উল্লেখ রয়েছে। এ থেকে আহমদ শরীফ অনুমান করেন, সেক শুভোদয়া গৌড় বিজয়ের অব্যবহিত পরেই (১২০৪ সালে) রচিত। কারণ রাজ্যজয়ী বিদেশী বিজাতি-বিধর্মী প্রভুর ক্ষমা ও অনুগ্রহ লাভের জন্য পরাজিত রাজার মন্ত্রীর এমন একটা কিছু করার প্রয়োজন ছিল। উমাপতি ধর সে জন্য বখতিয়ার খিলজির প্রশস্তিকাব্য রচনা করেন। হলায়ুধ মিশ্র এ ধারায় রচনা করেন পীর প্রশস্তি, যা বাংলা কাব্যে পীরমঙ্গল সাহিত্যের পথপ্রদর্শক।

গ্রন্থটি প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। যার শিল্পমূল্য যেমন অনন্য, ভাষিক অগ্রগতির ধারাবিচারেও এর গুরুত্ব অমর।

প্রাকৃত পৈঙ্গল
‘প্রাকৃত পৈঙ্গল’ গ্রন্থ’ সম্পর্কে ড. মুহাম্মদ এনামুল হক লিখেন, “দ্বাদশ শতাব্দী অবধি বাংলা ভাষা নিজেকে গঠনের অবস্থায় ছিল, সেই ভ্রূণাবস্থার ভাষা রয়েছে চর্যাপদে। ভাষার সেই বঙ্গীয় বৈশিষ্ট্যময় অপ্রন্দ্রংশ তুর্কি আমলে আসিয়া আরো বেশি মাত্রায় বাংলা হয়ে ওঠে। এ সময়ের যে ভাষা, তার নমুনা রয়েছ ‘প্রাকৃত পৈঙ্গল’ নামক অপভ্রংশ ভাষায় রচিত নীতি কবিতার সঙ্কলনটিতে।’ ‘বাংলা ভাষার অনুরূপ ভাষায় যে কয়টি নমুনা এই গ্রন্থে’ পাওয়া যায়, সেগুলো বাংলাদেশেই রচিত হইয়া থাকিবে এবং এগুলির রচনাকালও তুর্কি আমলের একেবারে গোড়ার দিকে বলিয়া মনে হয়।”

অপভ্রংশ ভাষায় রচিত প্রাকৃত পৈঙ্গল একটি গীতি কবিতার সঙ্কলন, যার ছন্দ ও ভাষা প্রাকৃত বা আদি পর্যায়ের বাংলা। এ হচ্ছে ছন্দগ্রন্থ’; সৌরসেনী প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত। মধ্যযুগের যে কৃষ্ণলীলা, তার প্রধান উপাদানগুলোর উৎসকে চিনিয়ে দেয় বইটি। এর সঙ্কলক পিঙ্গল ছন্দসূত্রের কবি কি না, সেটি যেমন অমীমাংসিত, তেমনি ভিন্ন কোনো পিঙ্গল হলে তিনি কে, তা অস্পষ্ট। গ্রন্থটি চতুর্দশ শতকের রচনা বলে দাবি করেছেন ড. ভোলাশঙ্কর ব্যাস। তিনি ধরে নিয়েছেন এর সঙ্কলন হয়েছে পূর্ব ভারতের কাশিতে। কিন্তু তাতে বাঙালির রচনা বিস্তর। গ্রন্থটিতে বাংলার জীবন ও যাপন যেভাবে চিত্রিত, তা কাশির কথা বলে না। অনুপুঙ্খ বাংলায় জীবনের অনুশীলনের অভিজ্ঞতার কথা বলে। এর যে ভাষা, তা চতুর্দশ শতকে রচিত হওয়ার দাবিকে কবুল করবে না। বরং এর বহু আগেই গ্রন্থটি রচিত হয়ে থাকবে। দ্বাদশ শতকে যে প্রাকৃত থেকে সাহিত্যিক বাংলার উন্মেষের সন্ধিক্ষণ চলমান ছিল, সে প্রাকৃতের নমুনা লক্ষ করা যায় গ্রন্থ ভাষায়। এতে রাধাকৃষ্ণ ও গোপীলীলার প্রসঙ্গ এসেছে। যেখানে নদীপ্রধান চিত্রায়ন রয়েছে প্রবলভাবে। রয়েছে রাধার নৌকালীলা।
একটি শ্লোক পাঠ করা যাক :
অরে রে বাহহি কাহ্ন ণাব
ছোড়ি ডগমগ কুগতিণ দেহি।
তইঁ ইথি ণদিহিঁ সঁতার দেই
জো চাহহি সো লেহি।
ওরে ও কৃষ্ণ, নৌকা বাইয়া যাও, টলমল টলমল ঢঙে ফেলো না দুর্গতিতে, আগে পার করো এই নদী, পরে যা চাও, তাই নিয়ে নিয়ো।

এ গ্রন্থের কিছু কবিতায় বাংলাদেশের প্রকৃতি, আচার-আচরণ, নিষ্ঠা, সংস্কৃতি ও কৃষ্টি এমনভাবে প্রস্ফুটিত হয়েছে যে, সহজেই অনুমিত হওয়া যায়, কবিতাগুলো বাঙালি কবিদের রচনা। বাঙালির যে চিরায়ত ভাবসাধনা, তার বিবৃতি রয়েছে এতে। সেকালেও এই ভূমির কবিরা ছিলেন দার্শনিক তত্ত্ব ও আধ্যাত্মিক গুণে গুণান্বিত। যেমন :
ণব মঞ্জরি সজ্জিঅ চুঅঅ গাছে,
পরিফুলি-অ কেসু ণআ বণে আছে।
জই এত্থি দিগন্তর জাহিই কন্তা,
কিঅ বম্মহ ণত্থি কি ণত্থি বসন্তা ।

অনুবাদ : আম্রবৃক্ষে নবমঞ্জরী সজ্জিত হয়েছে, বনে নতুন কিংশুক প্রস্ফুটিত আছে। এখান থেকে যদি কান্ত দিগন্তে (প্রবাসে) যায়, তবে কি মন্মথ নেই, বসন্তও নেই।

প্রাকৃত পৈঙ্গলের উদাহরণগুলি বাঙালির যে-ছবি ফুটিয়ে তোলে তাতে রসাভাসের কোনো সম্ভাবনা নেই। বরং সেন আমলের সংস্কৃত কবিরা যেভাবে বাঙালির প্রতি তাচ্ছিল্য দেখিয়েছেন, তার বিপরীত চিত্র এখানে লক্ষণীয়। স্থানীয় সংস্কৃতি ও রুচির প্রতি ব্রাক্ষণ্যবাদীদের অব্যাহত কটাক্ষপাতের বিপরীতে প্রাকৃ তপৈঙ্গল-এর টুকরো কবিতা এই ভূমি ও তার সন্তানদের জীবনযাত্রা ও জীবনপ্রক্রিয়ার জন্য গর্বের উপাদান হয়ে ওঠে। ততক্ষণে তারা নিজেদের জীবন ও সংস্কৃতি নিয়ে গর্বের চাতাল পেয়ে গেছে। একটি পরিবর্তন ইতোমধ্যে ঘটে গেছে যে! প্রাকৃত পৈঙ্গলে আমাদের খাওয়া দাওয়ার সামান্য কিন্তু রুচিশীল আয়োজনের চমৎকার ছবি ফুটে উঠেছে। কলাপাতায় ফ্যানা ভাত, তাতে যথেষ্ট গাওয়া ঘি আর বাটিতে করে দুধ। পাটের শাকও আছে আর বেড়ে দিচ্ছেন স্ত্রী, এমন স্বামীকে যদি পুণ্যবান না-বলা হয় তাহলে ধর্মে সইবে?

‘ওগ্রভত্তা / রম্ভঅপত্তা, / গাইকঘিত্তা / দুদ্ধসঙ্গুত্তা / মোইণিমচ্ছা/ ণালিচগচ্ছা / দিজ্জই কন্তা।
যে রমণী কলাপাতায় গরম ভাত, ঘি, মৌরলা মাছ এবং এবং নলিতা অর্থাৎ পাট শাক পরিবেশন করে স্বামীকে খাওয়ায়, সেই স্বামী ভাগ্যবান।

পল্লীবাসী কৃষি-নির্ভর প্রাচীন বাঙালী মধ্যবিত্ত জীবনে এসেছিল সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য। তার পরিচয় ‘প্রাকৃত পৈঙ্গলে’ ভাষা লাভ করেছে। একটি পদ নিম্নরূপ :
পুত্ত পবিত্ত বহুত্ত ধণা ভত্তি কুটুম্বিণি সুদ্ধমণা।
হাক্ক তরাসই ভিচ্চগণা কো কর বব্বর সগ্গমণা ॥
অর্থাৎ, পুত্র পবিত্রমনা, প্রচুর ধন, স্ত্রী ও কুটুম্বিনীরা শুদ্ধচিত্তা, হাঁকে ত্রস্ত হয় ভৃত্যগণ-এই সব ছেড়ে কোন বর্বর স্বর্গে যেতে চায়।

প্রাকৃত পৈঙ্গলের পঙক্তিমালা অপরিচয়ের জঠর থেকে বাংলার পরিচয় উন্মোচনের নমুনা। এর মধ্যে লক্ষ্য করা যায়, কয়েক শতক ধরে আলংকারিকদের বহু নিয়মের গাণ্ডী পেরিয়ে, অনেক কবির শব্দ-সন্ধানের নিদ্রাহীন রাত ছুঁয়ে সান্ধ্যভাষার অস্পষ্টতা থেকে কীভাবে আপন জন্মস্বর ঘোষণা করছে নবজাতক বাংলাভাষা।

লেখক : কবি, গবেষক
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement