১১ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ কার্তিক ১৪৩১, ৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ছোট সমস্যা, বড় ব্যথা

ড. মাহবুব হাসান - ছবি : লেখক

গ্যাস আজ সবচেয়ে প্রয়োজনীয় পণ্য আমাদের নাগরিক জীবনে। গ্যাস না থাকলে (লাইন আছে, গ্যাস সরবরাহ নেই বললেই চলে) সকালের নাস্তা খাওয়া হয় না। ঢাকা মহানগরের কোন কোন এলাকায় এরকম গ্যাস সঙ্কট চলছে, তা আমার জানা নেই। এ নিয়ে গণমাধ্যমে কোনো সংবাদও নেই। (আজ অবশ্য টিভিতে গ্যাসের অবৈধ লাইন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার সচিত্র নিউজ প্রচারিত হয়েছে। সেই সাথে আরো নিউজ হচ্ছে শিল্প কারখানায় গ্যাস সরবরাহ বা গ্যাসের চাপ না থাকায় মালিকরা বড় রকমের বিপদে পড়ছেন বা পড়তে যাচ্ছেন। তারা মনে করছেন ৬০-৭০ শতাংশ গ্যাসনির্ভর কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে বা বন্ধ করতে হবে। এই তথ্য প্রকৃত তথ্যনির্ভর কি না সেটি বলতে পারবেন গ্যাস উৎপাদক বা বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।- বাসাবাড়িতে গ্যাসের চাপ কম বা নেই বললেই চলে। আমরা ভাবি এরকম সমস্যা হয়তো ছোট, কিন্তু তার কামড়টা বড্ড কঠোর। কিন্তু তাদের চোখের পাতার ফাঁক গলে নিচে পড়ে যায়। কিংবা সংবাদপত্রের পাতায় স্পেস হয় না ওই নিউজের জন্য। স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলগুলোতেও এ নিয়ে কোনো নিউজ দেখিনি বা শুনিনি। অথচ ইলেকট্রনিকস মিডিয়ার কর্মকর্তা কর্মচারীদেরও প্রতিদিন নাশতা খেতে হয়। তারাও গ্যাস সঙ্কটের ভুক্তভোগী। বলতে গেলে নীরব যাতনায় তারাও নাকাল, কিন্তু বলতে পারছে না। নীরব যন্ত্রণায় পরিণত হয়েছে এ বিষয়টি।

রামপুরার বনশ্রীর প্রতিটি ব্লকে গ্যাসের চাপ চলে যায় সকাল ৬-৭টার দিকে। আবার তা ফিরে আসতে থাকে দুপুরের পর। দুপুর ২-৩-৪ টার দিকে। ৬ ঘণ্টার জন্য গ্যাস কোথায় যায় আমরা জানি না। গ্যাস কোম্পানিগুলো কখনো জানায়নি যে এই সময় থেকে এই সময় পর্যন্ত এই এই এলাকায় গ্যাসের চাপ থাকবে না। তার কারণও তারা ব্যাখ্যা করবেন। গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক অবস্থায় আসবে কবে, তারও কোনো ইঙ্গিত বা ইশারা নেই। আমরা জেনেছি যে শীতকালে গ্যাসের চাপ কমে যায়। সেটা হতে পারে কিংবা নাও হতে পারে। তবে এই মতটা বেশ আগে থেকেই চাউর হয়ে আছে। সত্য-মিথ্যা আমরা জানি না। আম-জনতা অনেক কিছুই জানে না। আর ওই না জানাটাই বুদ্ধিমানদের সামাজিক ও রাজনৈতিক পুঁজি। সুযোগটা তারা গ্রহণ করেন। কিন্তু আম-জনতার ক্ষুদ্র সঙ্কট দূর হয় না, বরং আরো চেপে বসে।

এ এলাকার যারা সমাজের নেতা, সোসাইটির নির্বাচিত কর্মকর্তা তাদের কানেও এই সঙ্কট তোলা হয়েছে। তারা আশ্বাস দিয়েছেন এ নিয়ে কাজ করবেন। অর্থাৎ তারা সংশ্লিষ্ট সংস্থার কর্তাদের সাথে আলাপ করবেন সঙ্কট সমাধানে। কিন্তু আজো পর্যন্ত তারা কোনো তথ্য জানাননি আমাদের। মানে ভোক্তা জনগণকে যে জবাবদিহি করতে হয়, তা তাদের র‌্যাশনালিটিতে নেই। তারা ভাবেন না যে সমস্যার বিষয় নিয়ে এলাকার লোকদের সামনে জবাব দিতে হয়, ওটাই গণতান্ত্রিক রীতি।

রাজনীতিতে যেমন চালু আছে তেমনি সমাজেও, জনগণকে সার্ভ করা সমাজ নেতাদের ইতি-কর্তব্যের প্রধান কাজ। জনগণের সেবায়ই তারা নিয়োজিত। এ জন্য তাদেরকে বলা হয় জনপ্রতিনিধি বা জনগণের সেবক। তাই তারাই জনগণের সমস্যা সঙ্কট নিরসনে তৎপর থাকবেন, এটিই স্বাভাবিক। গত কয়েক মাস (শীতকাল আসার আগে থেকেই) থেকেই বনশ্রীতে গ্যাস সরবরাহ সঙ্কট দেখা দিয়েছে। শুনেছি, সিএনজিচালিত বেবিট্যাক্সি, কার ও অন্যান্য যানবাহনের জন্য এলাকাবাসী গ্যাস পান না। আবার বিকেলের দিকে রাজধানীর সব সিএনজি স্টেশনে বিক্রিবাট্টা বন্ধ থাকে। সিএনজি স্টেশনগুলোর দরোজায় (তাদের দরোজা নেই, কিন্তু লাল ফিতার ঘের আছে) তালা পড়ে। তখন অবশ্য গ্যাসের চাপের সমস্যা থাকে না। তাই বলে তো সকালের নাশতা বিকেলে বা রাতে খাওয়ানোর কোনো নিয়ম তৈরি হয়নি। আমরা এখন দেখছি, সুবেহ সাদেকের সালাত আদায়ের পর নাশতার আয়োজন করেন গৃহিণীরা। একে স্বাভারিক নগরজীবন চিত্র বলে না।

২.
প্রকল্পের গতি গাধার নাকে মুলো ঝুলিয়ে দেয়ার মতো নয় নিশ্চয়ই। তার পরও আমরা দেখছি মেট্রোরেলের গতি প্রগতির চাকায় থাকলেও নির্মাণ কচ্ছপগতিতেই হচ্ছে। ২০১২ সালে নেয়া হয়েছে মেট্রোরেলের নির্মাণ প্রকল্প। উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে মতিঝিলের বাংলাদেশ ব্যাংক বা কমলাপুর পর্যন্ত দূরত্ব ২০.১০ কিলোমিটার। এই টুকু মেট্রোরেলের একটি লেনের নির্মাণকাজ শেষ হলো আজ ২৭ জানুয়ারি ২০২২; অর্থাৎ দিয়াবাড়ি টু মতিঝিল পর্যন্ত একটি লাইনের স্প্যান নির্মাণ বসানোর কাজ শেষ হলো। এ পথের স্টেশনগুলোর একটিমাত্র প্রেস ক্লাবও সচিবালয়ের সামনে যেটা, নির্মাণ হয়েছে। দ্বিতীয় লাইনসহ আনুষঙ্গিক কাজ অচিরেই শুরু হবে বলে জানিয়েছেন একজন জাপানি কর্মকর্তা। মেট্রোরেল নির্মাণ শেষ হলেই যাতায়াতের সুযোগ পাবে যাত্রী সাধারণ। নয়া দিগন্তেুর এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘এ এলাকায় বসবাসকারী লাখো নগরবাসী মেট্রোরেল ব্যবহার করে গন্তব্যে যাতায়াত করতে পারবে। রিপোর্টারের এ আশার বাণী তখনই ফলবে যখন মেট্রোরেলের কাজ সম্পন্ন হবে। কাজ যে শেষ হয়নি তারা জানা গেল জাপানি সিকিউরিটি কনসালট্যান্ট সিকুমুর কাছে থেকে। তিনি বলেছেন, একটি পথের কাজ শেষ হলেও অনেক স্টেশনের কাজ বাকি। সে সব স্টেশন নির্মাণের পর রেললাইন বসানোর কাজ হবে। রেললাইন বসানো সম্পন্ন হলেই আমরা বলতে পারব এবার ঢাকার বাসিন্দারা নতুন পথে যাত্রার আনন্দ উপভোগ করতে পারবে। কিন্তু তার জন্য আর কত দিন বা কতকাল অপেক্ষা করতে হবে আমাদের?

তা আমরা জানি না। জানেন সিকুমু ও তার কর্মবীররা। ২০১২ সালে শুরু করে তারা যদি একটি লেনের কেবল স্প্যান নির্মাণ শেষ করতে পেরেছেন, তা হলে বাদবাকি কাজ শেষ করতে কত বছর লাগতে পারে? আমাদের কোনো ধারণা নেই। কারণ ধারণা তখনই করা যায় যখন প্রকল্পের কাজ দ্রুত গতিতে চলতে থাকে। কোভিড-১৯ এর মহামারী আমাদের ভয়ার্ত করেছে, করেছে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত, কিন্তু কাজের অদম্য স্পৃহাকে ধ্বংস করতে পারেনি। টুকটুক করে হলেও কাজ এগিয়েছে। আর আমরা বুকে আশার স্বপ্ন নিয়ে তাকিয়ে আছি কবে মেট্রোতে চড়ব।

আরো কিছু অদম্য আশার ভেতরে আমরা বাস করছি, কিন্তু সেই আশার ভেতর থেকে নিজেদের সমস্যাসঙ্কুল জীবনযাপনের মাথা উপরে তুলে দাঁড়াতে পারছি না। ফলে আশা বিপন্ন হতাশায় মুষড়ে পড়ছে। সেই সাথে আছে সরকারের বিশাল অঙ্কের টাকার অপব্যবহার। মেট্রোরেল নির্মাণে কত ব্যয় হবে সেটি মাথাব্যথার কারণ হতো না, যদি তা প্রাক্কলিত সময়ে প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হতো। ২০.১০ কিলোমিটার উড়াল পথ নির্মাণে জাপানি কারিগরি শক্তির যদি ৯ বছর লেগে যায়, তা হলে তাদেরকে কেন এত এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নে পারঙ্গম ও প্রযুক্তির সেরা দেশ হিসেবে চিত্রিত করব আমরা? জাইকার মাধ্যমে টাকা লগ্নি করেছে তারা, যাতে লাভবান হয়। আমরা ভুলে যাই যে জাইকা লোন দিয়েছে বিভিন্ন প্রজেক্টে সুদের বিনিময়ে। লাভ ছাড়া কোনো দেশ টাকা দেয় না, এ সত্য চিরদিনের। তার পরও আমরা বলতে চাই চুক্তিতে যে সময় দেয়া হয়েছে, সেই সময়ের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হয় না। কোন সালে এই প্রকল্প সম্পন্ন করার কথা ছিল, এ রিপোর্টে পাওয়া গেল না। কেবল বলা হয়েছে প্রকল্পটি ২০১২ সালে শুরু হয়েছে। সরকার কেন প্রাক্কলিত সময়ে মেট্রোরেলের নির্মাণ সম্পন্ন করতে না পারার যে ক্ষতি হলো তার সমাধান কী? ৯ বছর ধরে ঢাকার বাসিন্দারা যে যাতায়াতে চরম দুর্ভোগ পোহালো বা পোহাচ্ছে, তার কী হবে? সেই মূল্য কে পরিশোধ করবে? একটা মেট্রোরেল হলো এই আনন্দটুকু কি সেই ক্ষতি পোষাতে পারবে?


আরো সংবাদ



premium cement

সকল