২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

বাংলা সাহিত্যে অন্ধকার যুগ : মিথ বনাম বাস্তবতা

-

(ষষ্ঠ কিস্তি)
বাংলায় মুসলিম অভ্যুত্থানের আগে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অস্তিত্ব স্পষ্ট ছিল, বলা যায় না। শিক্ষিত ও উচ্চকোটির লোকেরা চর্চা করতেন সংস্কৃত ভাষা। গ্রামের চাষা ও অন্ত্যজ মানুষের মুখের ভাষা ছিল বাংলা। তার উদ্ভব হয়েছিল প্রাকৃতের যে রূপান্তর থেকে, তাকে সংস্কৃতগর্বীরা তাচ্ছিল্য করে বলত অপভ্রংশ বা মূর্খ ও সংস্কৃতিহীন মানুষের ভাষা। যার কোনো লেখ্য ও সভ্যরূপ থাকতে পারে না। বাংলা তখনো লেখ্য অবয়বে বিকশিত হয়নি। তখনকার বাস্তবতায় বাংলাভাষীদের না ছিল কোনো সামাজিক প্রতিপত্তি, না ছিল সাংস্কৃতিক গুরুত্ব। তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি ছিল অবহেলিত ও অবজ্ঞাত। এর অস্তিত্বকে স্বীকার করা হতো বড়জোর ভাষায়ং মানবং বা লোকভাষা বলে। ব্রাক্ষণ্যবাদের চোখে এই মানুষেরা হয় ধর্মরহিত বৌদ্ধ, নয় নিম্নশ্রেণীর, অচ্ছুৎ। সংস্কৃত তখন ছিল ধর্মের ভাষা, সংস্কৃতিরও ভাষা। ব্রাহ্মণরা বেদের ভাষা অর্থাৎ সংস্কৃত ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় ধর্মীয় গ্রন্থ রচনাকে ধর্মদ্রোহিতার শামিল বিবেচনা করত। ধর্মগ্রন্থগুলো ছিল শূদ্রদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। হিন্দু আমলে দরবারের ভাষাও ছিল সংস্কৃত। ফলে শাসক ও শিক্ষিত লোকের আগ্রহ ছিল শুধুই সংস্কৃত ভাষার প্রতি। পাল যুগে বাংলাভাষী ব্রাত্য মানুষ তান্ত্রিক বৌদ্ধসাহিত্যের যে ধারার সূচনা করেন, হিন্দু শাসনামলে তার প্রসার কমে যায়। তা নিন্দিত হয়, বিতাড়িত হয় এবং উচ্ছেদের শিকার হয়। ফলে বিলুপ্তির আশঙ্কা বাংলা ভাষার মাথার ওপর ঝুলছিল।

সেন রাজাদের অন্যতম কীর্তি ছিল অপভ্রংশ বা বাংলার জন্য কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করে এ দেশে সংস্কৃতের অনুশীলনকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া। রাজদরবার ও ধর্মকেন্দ্রগুলো সংস্কৃতকে শুধু পবিত্রতা দিচ্ছিল না, এর সর্বাত্মকতা নিশ্চিত করতে সচেষ্ট ছিল। যেন এক ভাষা ও এক সংস্কৃতি অবধারিত হয়। এর জন্য চলছিল জোর-জুলুম। রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্বেচ্ছাচারী ব্যবহার। লক্ষণ সেনের দরবার ছিল সংস্কৃতের ভাষিক আধিপত্য নিশ্চিত করার প্রাণকেন্দ্র। দরবারের প্রধান কবি ছিলেন আচার্য গোবর্ধন এবং জয়দেব। জয়দেবের গীতগোবিন্দ বিস্ময়কর সাংগীতিকতার জন্য আদরণীয় হয়। এতে বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণের গোপিনীদের সঙ্গে রাসলীলা, রাধার বিষাদ বর্ণনা, কৃষ্ণের জন্য ব্যাকুলতা, উপালম্ভ বচন, কৃষ্ণের রাধার জন্য উৎকণ্ঠা, রাধার সখীদের দ্বারা রাধার বিরহ-সন্তাপের বর্ণনা গ্রন্থিত হয়েছে। কাব্যের মনোরম রচনাশৈলী, ভাবপ্রবণতা, সুমধুর রাগরাগিণী, সুললিত কোমল-কান্ত-পদাবলী এক অপূর্ব মায়াবি জাল সৃষ্টি করেছিল। সংস্কৃত ভাষায় রচিত এ কাব্যেও লোকভাষা বা বাংলাকে তাচ্ছিল্য করা হয়। এমন মনোহর কবিতা লোকভাষায় লেখা সম্ভব নয় বলে ঘোষণা করেন জয়দেব।

গোবর্ধনের বিখ্যাত গ্রন্থের নাম আর্যাশপ্তশতী। সেকালের সংস্কৃত গাথা শপ্তশতী অনুসরণে এটি রচিত। সাত শতাধিক শ্লোকে বিন্যস্ত এ কাব্য কামরসে টইটম্বুর। সংস্কৃত বর্ণানুক্রমে গ্রন্থটি রচিত। বিভিন্ন ব্রজ্যা বা বিভাগে এটি বিভক্ত। বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত মানুষের চিত্র ও চরিত্র এতে উঠে এসেছে চরম পরিহাসের সাথে। তখনকার গৌড়বঙ্গের রাজকীয় ও উচ্চবিত্ত শ্রেণীর কামক্ষুধা, ভোগলালসা, নারী সম্ভোগের প্রকট স্ফূর্তি এর পাতায় পাতায়। এতে এক দিকে দাম্পত্য প্রেম ও তরুণ প্রেমের উচ্ছ্বাস ফেনায়িত হয়েছে, অন্য দিকে যৌনজীবনের স্বেচ্ছাচার, যৌনতার অনুশীলনের বিচিত্র উপায়, বিধিবহির্ভূত নাগরপ্রেম, বেসামাল যৌনাচার এতে লীলায়িত। গীতগোবিন্দের মতো সুললিত ছিল এর ছন্দ। শ্রবণসুখে মধুর ছিল এর গীতি। উভয় কাব্য রাজকীয় পৃষ্ঠপোণকতায় খুব বিখ্যাত হয়। এর মাধ্যমে লক্ষণ সেন চেয়েছিলেন জনসাধারণের মধ্যে অপভ্রংশ তথা বাংলার প্রচার বন্ধ করে সংস্কৃতকে প্রিয় করে তুলতে।

গীতগোবিন্দ ও আর্যাশপ্তশতী তখনকার বাংলার অবক্ষয়ের ভয়াবহ চিত্রকে ধারণ করে। নর-নারীর উদ্দাম যৌনতাই ছিল এ দুই কাব্যের মূলীভূত বিষয়। তখনকার অন্যান্য কাব্যও রুচির বিকার ও বেলেল্লাপনার রাজসাক্ষী হিসেবে সেন শাসনামলের মনোবিকারের মুসাবিদা করে। সেখানে নিম্নশ্রেণীর মানুষের স্থান ইতরের স্তরে। গোটা জগত যেন উচ্চশ্রেণীর লাম্পট্য ও ভোগের বাজার। উচ্চশ্রেণীর পোষকতা ছিল বহিরাগত সেন রাজাদের প্রধান হাতিয়ার। তাদের দ্বিতীয় হাতিয়ার ছিল সংস্কৃত ভাষা ও ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে দেশীয় ভাষা ও সংস্কৃতির উচ্ছেদ। ফলে বাঙালির জীবনে এ ছিল চরম এক অন্ধকারের দীর্ঘ প্রহর। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্য অন্ধকারের যুগ যদি একান্ত চিহ্নিত করতেই হয়, সেটা হলো সেন রাজত্বের কাল। এ শাসন যদি দীর্ঘস্থায়ী হতো, যদি মুসলিম বিজয় নিশ্চিত না হতো, তাহলে বাংলা ভাষা মাথা তুলে আর দাঁড়াতে পারত না। অপমৃত্যু ঘটত তার। কারণ বাংলা তখন কেবল অনাদর, অবহেলার শিকার ছিল না, এর অনুশীলন ও অনুশীলনকারী পীড়িত-লাঞ্ছিত মানুষের বিরুদ্ধে চলছিল ক্রমাগত ইনকুইজিশন।

মুসলিম বিজয়ের ফলে ব্রাহ্মণ্যবাদের হাতে নিগৃহীত বৌদ্ধ ও নিম্নবর্ণের হিন্দুরা নতুন আত্মীয়তার পরশ লাভ করলেন। নতুনভাবে প্রাণস্পন্দন অনুভব করলেন। তাদের আত্মার তীব্র যন্ত্রণা যেন উপশমের পথ খুঁজে পেল। সমগ্র বাংলায় একটি সামাজিক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হলো। মুসলিম বিজয়ের পরে ফারসি হলো দরবারের ভাষা এবং সংস্কৃত পেছনে পড়ে যায়। সাধারণ মানুষ স্থানীয় গুণী ব্যক্তিদের নিজ নিজ ভাষা ও সাহিত্যচর্চায় প্রেরণা জোগানো হয়। স্থানীয় ভাষা ও সাহিত্যচর্চাকে উৎসাহিত করে মুসলিম শাসন এবং হিন্দু কবিদের দান করে পৃষ্ঠপোষকতা।

এ সময় থেকে অপরিণত রূপের প্রাথমিক পর্যায় থেকে ক্রমান্বয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য উৎকর্ষের পথে অগ্রসর হয়েছে। পূর্বাপর নিদর্শন ও বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করে বাংলা সাহিত্যে যে ধারাবাহিকতা প্রত্যক্ষ করা যায়, তাতে এ ধাপকে বৈপ্লবিক অগ্রগতি বলেই চিহ্নিত করা যায়।

কিন্তু তারপরও এই সময়ে খুব বেশি সাহিত্য রচনা হয়েছে বলা যাচ্ছে না। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এই না পাওয়ার উপর ভিত্তি করে বলছেন- ‘এই সময়ে সাহিত্যচর্চা নামমাত্র ছিল। বস্তুত মুসলমান অধিকারকাল হইতে এই সময় পর্যন্ত কোনো বাংলা সাহিত্য আমাদের হস্তগত হয় নাই। আমরা এই ১২০১ হইতে ১৩৫২ পর্যন্ত সময়কে বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের অন্ধকার বা সন্ধিযুগ বলিতে পারি।’

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ভাষাতত্ত্বেব প্রবাদপ্রতিম মনীষী। তার বৈদগ্ধে শ্রদ্ধা রেখেও তার এই অনুসিদ্ধান্তকে যথেষ্ট অনুসন্ধানের ফসল বলে আমরা মনে করতে পারছি না। তবে এ সময়খণ্ডকে সন্ধিযুগ আখ্যা দেয়ার মধ্যে ঐতিহাসিক বাস্তবতাবোধের পরিচয় স্পষ্ট।

এই সময়টি মূলত বাংলা ভাষার আকার লাভের যুগ, হয়ে ওঠার যুগ। এর আগে শব্দে, বাক্যে বাংলা ভাষা একটি কুয়াশাকালের মধ্যে ছিল। স্পষ্ট ছিল না তার অবয়ব। চেনা যাচ্ছিল না তাকে। ভাষাটির ধরন এমন ছিল, যাকে বলা হয় সান্ধ্যভাষা। আবছা আলো, আবছা আঁধারিতে আচ্ছন্ন। মুসলিম বিজয়ের পরে আবছা আঁধার সরিয়ে আপন চেহারা উন্মোচন করতে শুরু করল বাংলা ভাষা। ক্ষেত্রগুপ্ত তাই অন্ধকার যুগের প্রচারে অংশ নিয়েও অংশ নিতে পারেননি। অন্ধকার বলে একে আখ্যা দিলেও এর মধ্যস্থিত আলোর উত্থানকে তিনি অবলোকন করেন, যা ভিত গড়ে দেয় পরবর্তী অগ্রগতির। ক্ষেত্রগুপ্ত লিখেন- ত্রয়োদশ -চতুর্দশ শতকের সাহিত্যের কোনো লিখিত নিদর্শন এখনো মেলেনি। চর্যার যুগ থেকে এক পদক্ষেপে ২০০ বছর ডিঙিয়ে আমরা কৃত্তিবাস-মালাধর বসুর সময়ে গিয়ে পৌঁছি। অবশ্য কোনো বস্তুগত নিদর্শনের অভাবে এমন সিদ্ধান্ত করা যায় না যে, এ ২০০ বছর বাংলা ভাষায় কিছু লেখা হয়নি। হয়তো কিছু লেখা হয়েছিল। কিন্তু তা রক্ষিত হয়নি এবং আবিষ্কৃত হয়নি। তবুও এ কথা বলা যায় যে, এই কালসীমায় আদৌ কিছু লেখা হয়ে থাকলেও তার পরিমাণ বেশি নয়। লেখ্য সাহিত্য সম্পর্কে এই কথা। লোকসাহিত্য সৃজন নিশ্চয়ই চলেছে, তাকে কিছুতেই সুনির্দিষ্ট কালানুক্রমিক ইতিহাসের অঙ্গীভূত করা চলে না। যে পর্বের রচনা-সম্পদই কিছু নেই, তাকে একটা স্বতন্ত্র পর্ব বলে চিহ্নিত করে আলোচনার তাৎপর্য কী, এমন প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের এই ২০০ বছরের শূন্য স্থানটি যে একেবারে শূন্যগর্ভ নয় এ কথা বিশ্বাস করার কারণ আছে। কোনো জাতির ইতিহাস থেকে মাঝখানের কিছু সময়কে কেটে বাদ দেয়া চলে না। সাহিত্য-সৃষ্টি জাতির মানসলোকের ইতিহাস। মনোপ্রবাহ ২০০ বছর ধরে নিবৃত্ত ছিল না। কারণ গতিই তার ধর্ম। এই কালস্রোত বাঙালির মনে অনেক পলি জমিয়েছিল, না হলে হঠাৎ পঞ্চদশ শতকে শুকনো ডাঙা দেখা যেত না। কৃত্তিবাস-মালাধর-বড়– চণ্ডীদাসের অথবা মনসামঙ্গলের আদি কবিদের সৃষ্টিজগৎ চর্যা থেকে অনেকটা দূরে। আলোচ্য অন্ধকার পর্ব এই দূরত্বকে সম্বন্ধে বেঁধেছে। সে সৃষ্টি করেনি, পুরনোর সমাপ্তি ঘটিয়ে নতুনের জন্য পথ তৈরি করেছে। এই ২০০ বছর বাঙালির মনের রাজ্যে যে ভাঙাগড়া চলেছে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তার গুরুত্ব অনেকখানি। বাঙালি ইতিহাসেও। এই ২০০ বছর তাই একটি স্বতন্ত্র পর্ব- অন্ধকার পর্ব। ‘অন্ধকার’ শব্দটির অর্থ এ ক্ষেত্রে শূন্য নয়। ইতিহাসে কোনো শূন্যস্থান থাকতে পারে না।

শূন্য যদি না হবে, তাহলে অন্ধকার হবে কেন? কমসংখ্যক সৃষ্টিসম্ভারের কারণে? কিন্তু আমাদের হাতে তখনকার সৃষ্টিসম্ভার অল্পসংখ্যায় পৌঁছেছে, তার পেছনে রয়েছে বাস্তব কারণ।

এ দেশের মানুষের চিরন্তন জীবনযাপন ব্যবস্থা, এখানকার আবহাওয়া, মহামারী, প্রাকৃতিক দুর্যোগ অথবা আকস্মিক দুর্ঘটনার ফলে এই সময়ের কোনো সাহিত্য নিদর্শনের অস্তিত্ব বর্তমান থাকা হয়তো সম্ভব হয়নি। চর্যাগীতি, সেক শুভোদয়া ও শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনের একটি করে পাণ্ডুলিপি পাওয়া গেছে। এগুলোর এই একটি মাত্র নমুনা যদি না পাওয়া যেত তবে এসব সাহিত্যও লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে যেত। অতএব এ সময়ে সাহিত্য সৃষ্টি হয়ে থাকলেও তার অস্তিত্ব হয়তো লুপ্ত হয়ে গেছে, এ সম্ভাবনা বাস্তব।

আমাদের অবগতিতে তখনকার সাহিত্যিক নিদর্শনের অভাব সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টিময় আলোকপাত করেন ড. আহমদ শরীফ। তথাকথিত অন্ধকার যুগে বাংলা সাহিত্যের কোনো নিদর্শন না পাওয়ার কারণগুলো এভাবে চিত্রিত করেছেন :

ক. ধর্মমত প্রচারের কিংবা রাজ্যশাসনের বাহন হয়নি বলে বাংলা তুর্কি বিজয়ের আগে লেখ্য ভাষার মর্যাদা পায়নি।
খ. তের-চৌদ্দ শতক অবধি বাংলা ভাষা উচ্চবিত্তের সাহিত্য রচনার যোগ্য হয়ে ওঠেনি।
গ. সংস্কৃতের কোনো ভাষাতেই রসসাহিত্য চৌদ্দ শতকের আগে রচিত হয়নি। তুর্কি বিজয়ের পর প্রাকৃতজনেরা প্রশ্রয় পেয়ে বাংলা রচনা করেছে মুখে মুখে। তাই লিখিত সাহিত্য অনেক কাল গড়ে ওঠেনি।
ঘ. তের-চৌদ্দ শতকে সংস্কৃত চর্চার কেন্দ্র ছিল হিন্দু শাসিত মিথিলায়, তাই এ সময় বাংলায় সংস্কৃতচর্চা বিশেষ হয়নি।
ঙ, আলোচ্য যুগে বাংলায় কিছু পুঁথিপত্র রচিত হলেও জনপ্রিয়তার অভাবে, ভাষার বিবর্তনে এবং অনুলিপিকরণের গরজ ও আগ্রহের অভাবে তা নষ্ট হয়েছে। আগুন-পানি উই-কীট তো রয়েছেই।
চ. লিখিত হলেও কালে লুপ্ত হওয়ার বড় প্রমাণ চর্যাগীতি, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, সেক শুভদোয়া প্রভৃতির একাধিক পাণ্ডুলিপির অভাব।
ছ. চর্যাগীতি রচনার শেষ সীমা যদি বার শতক হয়, তাহলে তের-চৌদ্দ শতক বাংলা ভাষার গঠন যুগ তথা স্বরূপ প্রাপ্তির যুগ। কাজেই এ সময়কার কোনো লিখিত রচনা না থাকারই কথা।
জ. দেশজ মুসলমানের ভাষা চিরকালই বাংলা। বাংলায় লেখ্য রচনার রেওয়াজ থাকলে তুর্কি বিজয়ের আগের বা পরের মুসলমানের রচনা নষ্ট হবার কারণ ছিল না।

এই বাস্তবতার মধ্যে মুসলমানরা যখন বাংলা শাসন হতে নিলেন, স্থানীয়দের ভাষা ও সংস্কৃতিকে বোঝার ও লালনের চেষ্টা শুরু করলেন। যে সংস্কৃত প্রধানত হিন্দুদের ভাষা, সেই ভাষার গুরুত্বপূর্ণ রচনার অনুবাদে উদ্যোগ দেখা গেল খিলজির বঙ্গজয়ের দশ বছর পেরুতে না পেরুতেই। সুলতান আলী মর্দান খিলজি (১২১০-১২১২) সংস্কৃত যোগশাস্ত্র ‘অমৃতকুণ্ড’-এর তরজমা করাতে উদ্যোগী হন। কামরূপের যোগী ভোজর (পরে মুসলমান হন) যোগশাস্ত্রের গ্রন্থটি আলী মর্দানের কাজী রুকনউদ্দিন সমরকন্দিকে দেন। রুকনউদ্দিন সেটিকে আরবি ও ফারসিতে তরজমা করেন। এটি ফারসিতে ‘বাহর-উল হায়াত’ আর আরবিতে ‘হাউজ-উল হায়াত’ নামে পরিচিত। ফলে জ্ঞান ও সংস্কৃতি মুসলিম শাসকদের কাছে উপেক্ষিত ছিল, সেটা বলার সুযোগ তারা রাখেননি। কিন্তু সংস্কৃত গ্রন্থটি কেন বাংলায় অনূদিত হলো না? বস্তুত একটি ভিন্ন ভাষার গ্রন্থকে বাংলায় অনুবাদের কোনো পূর্বদৃষ্টান্ত তখন অবধি ছিল না। এ ভাষায় গ্রন্থ রচনার কোনো অবয়ব মুসলমান শাসকদের সামনে পরিদৃষ্ট ছিল না। যারা বাংলা চর্চা করতেন, তারা শাসনকেন্দ্র থেকে ছিলেন অনেক দূরে। সেন শাসনে তারা ছিলেন ভীত, পলায়নপর, তখন এমন চর্চাকারীদের অস্তিত্বও কমে এসেছিল প্রকটভাবে। ভাষাও তখন বাস্তবিক অর্থেই নিজের রূপকে খুঁজে পায়নি, অনুসন্ধান করছিল কেবল। অতএব ডক্টর এনামুল হকের মতে, ‘বাংলা সাহিত্যের তুর্কিযুগ প্রধানত ভাষা গঠনের কাল। বাঙালির মন এ সময়ে আত্মপ্রকাশের পথ খুঁজে বেড়াচ্ছে নদীর ধারার মতো এঁকে-বেঁকে। নিজের পথ নিজের ভাষার খাতে কেটে চলেছে।’ এ সময়েই বাংলা ভাষা তার সাবেক সান্ধ্য বা আধো আধো বুলি থেকে উত্তরণ পেয়ে নিজস্ব রূপায়ণ লাভ করে। প্রতিষ্ঠিত হয় আপন স্বাতন্ত্র্যে। সময়টা কোনোভাবেই অনাসৃষ্টির ছিল না। ওয়াকিল আহমদ তার ‘বাংলা সাহিত্যের পুরাবৃত্ত’ গ্রন্থে লিখেছেন- “বাংলা সাহিত্যের কথিত ‘অন্ধকার যুগ’ মোটেই সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্বের যুগ ছিল না। ধর্ম-শিক্ষা, শিল্প চর্চার দায়িত্ব যাদের ওপর ন্যস্ত ছিল, তারা সীমিত আকারে হলেও শিল্প-সাহিত্যচর্চায় নিয়োজিত ছিলেন। তবে, কী হিন্দু কী মুসলমান কেউ লোকভাষা বাংলাকে গ্রহণ করেননি। বাংলা সাহিত্যের নিদর্শন না থাকার এটাই মুখ্য কারণ।” ফলত আবুল মনসুর আহমদ একে বলেছেন বাংলা ভাষার আদিযুগ। আহমদ শরীফ বলছেন, আকার লাভের কাল।

এই যে আত্মগঠন ও আকার লাভের সময়, তা সার্থক উপসংহারে উপনীত হলো মুসলিম শাসনামলের দ্বিতীয় পর্বে; যখন প্রতিষ্ঠিত হলো স্বাধীন সুলতানী আমল। ততক্ষণে বাংলা ভাষা আপন অবয়ব খুঁজে পেয়েছে এবং প্রবল পায়ে নিজের স্বরূপে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। যা নিশ্চিত হয় মুসলিম শাসনের প্রথম পর্বে; খিলজির বঙ্গজয়ের পরবর্তী সময়কালে। আশ্চর্য! তাকেই বলা হচ্ছে অন্ধকার যুগ!

লেখক : কবি, গবেষক
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement