২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ঘৃণা ভাষণ

- ছবি : নয়া দিগন্ত

পৃথিবী যেন উল্টো দিকে ঘুরছে। সভ্যতার সুপ্রভাত থেকে মানবজাতি ভালোবাসার ভাষণ শুনে আসছে। বিজ্ঞান ও জাগতিক উন্নয়নের এই সময়ে ‘প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা’-এর বদলে হত্যা-আক্রমণ আর ঘৃণার নির্দয় জগতে প্রবেশ করেছে মানবজাতি। বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, ধর্ম মানুষকে ভালোবাসা শেখায়। এখন সেই ধর্মকে বেছে নেয়া হয়েছে ঘৃণার বাহন হিসেবে। ধর্ম সভ্যতার ভিত নির্মাণ করেছে। পৃথিবীর প্রতিটি সভ্যতা আদিতে ছিল ধর্মাশ্রয়ী। ধর্মের বিধি-বিধানের ভিত্তিতে পরিচালিত হতো দেশ-জাতি-রাষ্ট্র।

ধর্মগুরুরা যখন ধর্মের পরিবর্তে অধর্মকে শাসন ও নিপীড়নের বাহন করেছে, তখনই প্রতিবাদ উত্থিত হয়েছে। মধ্যযুগে ‘সিজার বা শাসকের যা প্রাপ্য শাসককে দাও, বিধাতার যা প্রাপ্য তা বিধাতাকে দাও’-এভাবেই মীমাংসিত হয়েছে ক্ষমতার সীমারেখা। ধর্মপক্ষ ও বিরোধী পক্ষ উভয়ের চরম ও উগ্রপন্থা পৃথিবীর ইতিহাসকে করেছে ক্লেদাক্ত ও রক্তাক্ত। সে যুগ হয়েছে বাসি। জ্ঞান, সভ্যতা ও মানবিকতা দ্বারা শাসিত হওয়ার কথা এই সমাজ- এই পৃথিবী। এখন ‘কী দেখার কী দেখছি, কী শোনার কী শুনছি’। দেশে-দেশে, রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে, ধর্মে-ধর্মে বিভেদ, সঙ্ঘাত ও যুদ্ধ পৃথিবীকে করেছে আকীর্ণ। উচ্চারিত শব্দাবলি ও ক‚টনৈতিক ভাষায় সেই ধর্মের আবেদন ফিরে এসেছে আবার। মনে হয় দর্শনের সেই তত্ত¡কথাই যেন সত্য-থিসিস, এন্টি থিসিস, সিনথিসিস বা অস্তি, নাস্তি ও স্বস্তি এর বিবর্তনে পৃথিবী আবার ধর্মাশ্রয়ী হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে নাইন-ইলেভেনের পর বিষয়টি ভদ্রতার লেবাস অতিক্রম করে অপ্রীতিকরভাবে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।

ক্ষণিকের তরে সিনিয়র বুশের উচ্চারিত ‘ক্রসেড’ই যেন নির্মম সত্য হয়ে দেখা দিয়েছে। এক সময় সভ্যতার স্বর্ণযুগের স্র্ষ্টা ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা প্রাচ্য অথবা পাশ্চাত্যে ঘৃণা, হিংসা ও বিদ্বেষের শিকার হয়ে পড়েছে। কারণ পৃথিবীজুড়ে তাদের পুনরুত্থানের সম্ভাবনা। এই সম্ভাবনা তাদের সংখ্যায়, সম্পদে ও ক্রমবর্ধমান ক্ষমতায়। ইহুদি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এস পি হান্টিংটন তাই ইসলাম ও পাশ্চাত্যের মাঝে ‘সভ্যতার সঙ্ঘাত’ প্রত্যক্ষ করেছেন। ১৫২৯ সালে ইউরোপের প্রাণকেন্দ্র ভিয়েনা পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল উসমানীয় সালতানাত। আর মধ্যযুগে আফ্রিকা অতিক্রম করে আজকের স্পেন ও পর্তুগাল অর্থাৎ আন্দালুসিয়া দখল করে পিরেনিজ পর্বত অতিক্রম করতে যাচ্ছিল ইসলামের অনুসারীরা। খ্রিষ্টান ও ইহুদিদের পবিত্র ভূমি জেরুসালেম হাজার বছর ধরে শাসিত হয়েছে ইসলামের অনুক‚লে। ১০৯৫-১২৯১ পর্যন্ত ক্রুসেডের নামে আক্রান্ত হয়েছে মুসলিম জাহান। সমস্ত পাশ্চাত্য শক্তির ক্রমাগত ষড়যন্ত্র ও যুদ্ধের কবলে নিপতিত হয়েছে উসমানীয় সালতানাত। ইসলাম ও মুসলমানদের শেষ গৌরবটিও মুছে যায়। নিঃশেষ হয়ে যায় তাদের সামরিক ও বৈশ্বিক শক্তি।

পরবর্তীকালে ন্যাশন স্টেট বা জাতি রাষ্ট্রের বিবিধ অভ্যুদয় ইসলাম ও মুসলমানদের ‘উম্মাহ’ ধারণাকে অবলুপ্ত করতে পারেনি। জামাল উদ্দিন আফগানি, আল্লামা ইকবাল ও মাওলানা মোহাম্মদ আলী, মাওলানা শওকত আলীরা ‘মুসলিম হায়! সারা জাহা হামারা’ ¯স্লোগান চির জাগরূক রাখতে চেয়েছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ অবসানে ১৯৪৮ সালে মুসলমানদের প্রিয়ভূমি ও পবিত্র ভূমি ফিলিস্তিন তথা জেরুসালেমে সেই পুরনো খ্রিষ্টজগৎ ভিন্ন নামে ভিন্ন পরিচয়ে সৃষ্টি করেছে ইসরাইল। বিতাড়ন করেছে লাখ লাখ মুসলমানকে তাদের আবাসভূমি ফিলিস্তিন থেকে। ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামী বিপ্লব নতুন করে পাশ্চাত্যকে বাধ্য করেছে ইসলামের পুনর্জাগরণ নিয়ে ভাবতে। পৃথিবীর বিভিন্ন জনপদে ইসলাম ও মুসলমানদের উপর খ্রিষ্ট তথা পাশ্চাত্যের সমর্থনপুষ্ট অন্যায়-অত্যাচার নিয়ত ক্ষুব্ধ করেছে ইসলামবিশ্বাসীদের। মুসলমানদের ক্ষমতায় পুনরুত্থান, জ্বালানি তথা শক্তি-সম্পদের ওপর তাদের একনায়কত্ব, প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য পাশ্চাত্যকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। পাশ্চাত্যের সমন্বিত ষড়যন্ত্র, সুদূরপ্রসারী ইহুদি পরিকল্পনা ইসলামের অগ্রযাত্রাকে প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে নাইন-ইলেভেনের মতো নাশকতা ঘটায়। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে জমে থাকা ক্ষোভ, ক্রোধ ও হিংসাকে নতুন করে জাগিয়ে তুলে নাইন-ইলেভেনের ঘটনাবলি। যখন শক্তি মদমত্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ও ইরাক দখল করে নেয়, তখন কোটি কোটি মুসলিম মানসে পাশ্চাত্যের প্রতি ভালোবাসা উদয় হওয়ার কথা নয়। এই অবস্থায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে ইতিহাসের লুকিয়ে থাকা সেই ক্রুসেড হঠাৎ করেই যেন আঘাত হানে গোটা মুসলিম বিশ্বে। একদিকে সব সন্ত্রাসের জন্ম ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি দোষারোপ, অপরদিকে মুসলমানদের পক্ষ থেকে পাশ্চাত্যবিরোধী মনোভাব- সব মিলিয়ে এক অস্থিরতা সারা পৃথিবীতে জেঁকে বসে।

ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের পক্ষ থেকে সাধারণভাবে ইসলাম ও মুসলমানরা আক্রান্ত হতে থাকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। এবার আর কোনো রাখঢাক নয়, খোলামেলাভাবে আক্রান্ত হয় মুসলমানদের পবিত্র গ্রন্থ আল-কুরআন। হামলা করা হয় মুসলমানদের পবিত্র ইবাদতের স্থান মসজিদে। পরিকল্পিত ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পাশ্চাত্যে ইসলামবিদ্বেষ আনুষ্ঠানিকতা অর্জন করে। এটাকে অর্থাৎ মুসলমানদের প্রতি এবং মুসলমানদের প্রদর্শিত ক্ষোভ, ক্রোধ ও কার্যক্রমকে তারা বলে ‘হেইট ক্যাম্পেইন’ বা ঘৃণার প্রচার। এই ঘৃণার প্রচার পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন নামে অভিহিত হয়ে আসছে। ভারতে প্রতিষ্ঠিত হিন্দুত্ববাদী সরকারের ক্ষোভের কারণ যে সে দেশটি সাত শ’ বছর ধরে শাসন করেছে ইসলাম অনুসারীরা। তারা সে অতীতের ইতিহাসকে সামনে আনছে বারবার।

সাম্প্রতিককালে ধর্মের জিকিরে ভারতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিজেপি সরকার। তাদের প্রধান বাহন হচ্ছে ইসলাম ও মুসলমানবিরোধী ‘হেইট ক্যাম্পেইন’ বা ঘৃণা প্রচার। গত দু’তিন মাসে এই ঘৃণা প্রচার সেখানে নতুন মাত্রা অর্জন করেছে। এত দিনে তারা মুসলিমবিদ্বেষ ও হিংসা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রচার করেছে। এখন তারা ভারতের ২০ কোটি মুসলমানকে হত্যার জন্য প্রকাশ্যে আহ্বান জানাচ্ছে। গত ডিসেম্বর মাসের ১৭-১৯ তারিখ পর্যন্ত উত্তর ভারতের হরিদ্বারে সনাতন ধর্মের এক সভা বা সম্মেলন আহ্বান করা হয়। এতে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতারা অংশগ্রহণ করেন। তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত ওই ধর্মসভায় ধর্মীয় সেই গেরুয়া পরিহিত ধর্মগুরুরা ইসলাম ও মুসলমানদের প্রকাশ্যে হত্যা করার আহ্বান জানায়। ওই সম্মেলনের ধারাবিবরণী বেশ কিছু গণমাধ্যমে প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়। গণমাধ্যমে এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। হিন্দুত্ববাদী বা হিন্দু ধর্মের একজন ধর্মগুরু জোতি নরসিংহানন্দ সম্মেলনে বলেন, অর্থনৈতিক অবরোধে কোনো কাজ হবে না। হিন্দুদের নিজেদেরকে আরো ভালো অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হতে হবে। অস্ত্রই এর সমাধান। মুসলমানদের বিরুদ্ধে এই অস্ত্রই আমাদের বড় হাতিয়ার।

এই ধর্মযাজক গাজিয়াবাদের দশনা মন্দিরের প্রধান। তিনি তার উগ্র মতবাদের জন্য ইতোমধ্যেই বিখ্যাত! হয়ে উঠেছেন। হিন্দু মহাসভার সাধারণ সম্পাদক ধর্মগুরু সদভী অন্নপূর্ণা মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যার জন্য আহ্বান জানান। ইংরেজি ওয়েবসাইট ‘দ্য উইয়ার’ এ প্রকাশিত বক্তব্যে তিনি বলেন, কোনো কিছুই অস্ত্র ছাড়া সম্ভব নয়। আপনারা যদি মুসলমানদের থেকে মুক্তি চান তাহলে তাদের হত্যা করুন। তাদেরকে হত্যা করার জন্য আপনাকে জেলে যেতে হবে। জেলে যাওয়ার জন্য আপনারা তৈরি থাকবেন। প্রতি ২০ লাখ মুসলমানকে হত্যা করার জন্য যদি ১০০ হিন্দু তৈরি হয়ে যায় তাহলেই আমরা বিজয়ী হবো। বিহারের ধর্মগুরু ধর্মদাস মহারাজ বলেন, আমি যদি সেদিন পার্লামেন্টে উপস্থিত থাকতাম যখন সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বলেছিলেন, সংখ্যালঘুদের অধিকার সর্বাগ্রে, তখন তাকে নাথুরাম গডসের অনুসরণেই তার উত্তর দিতাম। আমি তার বুকে রিভলবার দিয়ে ১০ বার গুলি করতাম।

অন্য আরেকজন ধর্মগুরু স্বরূপ মহারাজ বলেন, সরকার যদি আমাদের কথা না শুনে, যদি তারা আমাদের দাবি অনুযায়ী হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না করে তাহলে আমরা ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের চেয়েও বড় বিদ্রোহ করব। উল্লেখ্য, এরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নির্মূল করে হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য দাবি জানাচ্ছে।

আরেকজন ধর্মগুরু মুসলিম বিতাড়নে মিয়ানমারের অনুসরণ করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, মিয়ানমার মুসলিম বিতাড়নের ক্ষেত্রে একটি মডেল। আমাদেরও সে পথ অনুসরণ করতে হবে। একজন ধর্মগুরু পরামর্শ দেন, হিন্দু যুবকদের মোবাইল ক্রয় না করে সে টাকায় অস্ত্র ক্রয় করা উচিত, যাতে সে মুসলমানদের হত্যা করতে পারে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলেন, হিন্দু সনাতন ধর্মসহ সব ধর্মের আবেদন মানবিক হলেও এই ধর্মগুরুরা হিন্দু ধর্মকে অধর্মের স্থানে প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী মোদির নেতৃত্বে ২০১৪ সালে যখন বিজেপি দিল্লির মসনদে আরোহণ করে তখন তারা মুসলিমবিদ্বেষকেই সম্বল করেছিল। তখন থেকেই গোটা ভারতে মুসলিম জনগোষ্ঠী তথা গোটা সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী ভীতির মধ্যে বসবাস করছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ ভেবেছিলেন, জয় লাভের পরে হয়তো তাদের সুর নরম হয়ে আসবে। ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের পরে তারা হয়তো নমনীয় পথ গ্রহণ করবে। কিন্তু বিবেকবান মানুষকে অবাক করে দিয়ে তারা একের পর এক মুসলিমবিদ্বেষী নীতি গ্রহণ করে। কাশ্মিরের স্বতন্ত্র মর্যাদা বিলোপ করে সরাসরি কেন্দ্রের পদানত করে। নতুন নাগরিক আইন তৈরি করে পরিকল্পিতভাবে মুসলিম জনসংখ্যা উৎখাতের জন্য প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বলা হয়- ভারতে এলে তারা নাগরিকত্ব পাবেন। কিন্তু কোনো মুসলিম প্রতিবেশী দেশ থেকে গেলে নাগরিকত্ব পাবেন না।

নাগরিকপঞ্জি আইন অনুযায়ী তারা সিদ্ধান্ত নেয়, ১৯৪৭ সালের পর যারা ভারতে আশ্রয় নিয়েছে এবং ভারতীয় নাগরিকত্ব অর্জন করেনি তাদেরকে নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে। এভাবে আসামে ২০ লাখ মুসলমানকে বাংলাদেশী বলে চিহ্নিত করে বিতাড়নের প্রয়াস চলছে। পশ্চিম বাংলাসহ সব রাজ্যে একই প্রক্রিয়া চলছে। যদিও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এ ধরনের প্রক্রিয়া অনুসরণে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এসব নীতিগত সিদ্ধান্তের পর বাস্তবেই তারা মুসলিম নিধনযজ্ঞ শুরু করে। কোনো মুসলমানের ঘরে গরুর গোশত আছে কি নেই অথবা গরুর গোশতের ব্যবসা করে বা গরুর প্রতি দুর্ব্যবহার করে- এমন অভিযোগে অনেক মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে। ‘জয় শ্রিরাম’ হচ্ছে বিজেপির রাজনৈতিক ¯স্লোগান। এই ¯স্লোগান দিতে অস্বীকার করায় অনেক মুসলমানকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে অসংখ্য দাঙ্গা-হাঙ্গামা ভারতজুড়ে বিস্তৃত হয়েছে। ভারতে এমন কোনো দিন যায় না যেদিন সংবাদমাধ্যমে মুসলিম নিধনের খবর ছাপা হয় না। বিগত ছয় মাসের এ ধরনের একটি হিসাব প্রকাশিত হয়েছে হাবিব সিদ্দিকীর একটি নিবন্ধে। (৬ জানুয়ারি ২০২২, নিউ এজ)
ক্রমাগতভাবে এসব সাম্প্রদায়িক ও হিংসাত্মক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে ভারতের বিবেকবান মানুষ প্রতিবাদ করছেন, আন্দোলন করছেন। অতি সাম্প্রতিক ঘৃণা ভাষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়েছে সব ধরনের মানুষ। জনস্বার্থে ঘৃণা ভাষণ মামলায় উত্তরখণ্ড সরকারকে নোটিশ পাঠিয়েছে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। প্রধান বিচারপতি এন ভি রমনা, বিচারপতি সূর্যকান্ত ও বিচারপতি হিমা কোহলির এজলাস থেকে এই নোটিশ দেয়া হয়। এ মামলার আর্জিতে বলা হয়, উত্তরখণ্ডের হরিদ্বারে অনুষ্ঠিত ধর্ম সংসদ সম্মেলন থেকে যারা দেশে মুসলিমদের হত্যার ডাক দিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া হোক। একজন মুসলিম সাংবাদিক এবং একজন হিন্দু আইনজীবী জনস্বার্থে এই মামলাটি করেন। সুপ্রিম কোর্ট সেদিনই তা শুনানির জন্য গ্রহণ করে। উল্লেখ্য, শাসকদল বিজেপির তরফ থেকে ঘৃণা ভাষণের কোনো প্রতিবাদ এখন পর্যন্ত শোনা যায়নি। চুপ রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। একই রকম ধর্ম ভাষণে ছত্রিশগড়ের একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ওই রাজ্যে কংগ্রেস সরকারে রয়েছে।

মামলার আইনজীবী কপিল শিবাল মামলাটি উত্থাপন করতে গিয়ে বলেন, আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি যেখানে সত্যমেব জয়তে অর্থাৎ সত্যের জয়ের পরিবর্তে সত্যমেব অস্ত্রশস্ত্র জয়তে অর্থাৎ অস্ত্রের জয়ের কথা শোনা যাচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টের ৭৬ জন আইনজীবী এক চিঠিতে এর প্রতিবাদ জানান। ভারতের সাবেক প্রতিরক্ষা প্রধান, ক‚টনীতিক ও আমলাসহ দুই শতাধিক বিশিষ্ট নাগরিক রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ করেন। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় এই, গত ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতে হাজার বছর আগের ইতিহাসের সাথে চলতি সময়ের সন্ত্রাস ও উগ্রবাদকে মিলিয়ে এমন এক বক্তব্য দিয়েছেন যাতে মনে হচ্ছিল ভারতের সেই শাসকদের কথিত অপরাধের দায় দেশটির মুসলমানদের ওপর বর্তায় এবং তার জন্য তাদের সাজা প্রাপ্য। (অপূর্বানন্দ : ১৭ জানুয়ারি ২০২২, প্রথম আলো)
ভারতের ২০২৪ সালের নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই মুসলমানদের ওপর চাপ বাড়ছে। উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ও বিজেপির মারমুখী নেতা যোগী আদিত্যনাথ ঘোষণা করেছেন, রাজ্যটিতে শিগগিরই যে বিধানসভা নির্বাচন হতে যাচ্ছে তাতে ৮০ বনাম ২০ শতাংশ হিসাবে আখ্যায়িত করা যায়। এখানে ৮০ শতাংশ অর্থ হিন্দু এবং ২০ শতাংশ অর্থ মুসলমান, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোক। বিভিন্ন রাজ্যে একের পর এক মুসলিমবিরোধী আইন পাস হচ্ছে এবং একই ধরনের নীতি গ্রহণ করা হচ্ছে। মুসলমানদের উদ্বেগ মহা আতঙ্কে রূপ নিয়েছে বলে একজন ভারতীয় কলামিস্ট মন্তব্য করেছেন। কেন্দ্রীয় সরকার থেকে বিভিন্ন রাজ্যের সরকার মুসলমানদের খাদ্যাভ্যাস, ধর্মীয় অনুশাসন, পোশাক-পরিচ্ছদসহ নানা ক্ষেত্রে বাধা দেয়ার আইন পাস হচ্ছে। শুধু মুসলমানরাই নয়, সেখানকার খ্রিষ্টান সম্প্রদায় এবং উপজাতি ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা হিন্দুত্ববাদীদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছে না। ভারতের একজন সাবেক নীতিনির্ধারক আমলা কুল কার্নি এ ধরনের সাম্প্রদায়িকতার বিপদ সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক করেছেন।

এতদিন মুসলমানরা নীরব ছিল। এখন তারা ক্রমশ প্রতিবাদী হয়ে উঠছে। ১ জানুয়ারি বুল্লি বাই নামের একটি নিলাম অ্যাপে আপলোড করা শতাধিক মুসলমান নারীর ছবি দিয়ে ঘোষণা করা হয়- রক্ষিতা হিসেবে এদের বিক্রয় করা হবে। যাদের ছবি সেখানে আপলোড করা হয়েছিল তাদের মধ্যে প্রখ্যাত অনেক সাংবাদিক, অভিনেত্রী ও অধিকারকর্মী ছিলেন। সংশ্লিষ্ট মহিলারা চুপ থাকেননি। প্রবল জনমতের চাপে কয়েকজনকে পাকড়াও করা হয়েছে। ভারতে বিজেপি সরকার ভোটের জন্য ধর্মীয় বিভাজন টেনে দিচ্ছে, তার মধ্যে সেখানকার ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার মানুষ এবং অনেক সাংবিধানিক কাঠামো জেগে উঠতে শুরু করেছে।

ভারতের সাম্প্রদায়িক এরকম পরিস্থিতিতে এর প্রভাব প্রতিবেশী দেশগুলোতে পড়তে পারে বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্তব্য করেছিলেন। এর মাধ্যমে নিরেট সত্যই প্রকাশিত হয়েছে। সাম্প্রদায়িকতা বা ঘৃণা প্রকাশ কোনো সমাধান নয়। বাংলাদেশের মানুষ ধার্মিক কিন্তু সাম্প্রদায়িক নয়। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। প্রতিবেশী দেশে এ ধরনের সাম্প্রদায়িক বিকার বন্ধে বাংলাদেশের সরকার সরব হবে বলে জনগণ আশা করে। সব দেশেই দুষ্কৃতকারীরা সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। বাংলাদেশেও যাতে এ ধরনের অমানবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়, সে জন্য সবাইকে সচেষ্ট থাকতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement