২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ভয়ের সমাজে মায়ের ডাক!

- ছবি : সংগৃহীত

ছোটবেলায় পড়েছিলাম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মাতৃভক্তির কাহিনী ‘মায়ের ডাক’। মা অসুস্থ, ঈশ্বরচন্দ্রকে বাড়ি যেতে হবে। অফিসের বড় কর্তার কাছে ছুটি চেয়ে বিফল হলেন। ছুটি মঞ্জুর হলো না। তাই চাকরি ছেড়ে দিতে হলো ঈশ্বরচন্দ্রকে।

মায়ের চিঠি, বাড়ি যেতে হবে। তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। শুরু হয়েছে ভীষণ ঝড়-বাদল। দামোদরের তীরে পৌঁছে দেখলেন নদী পার হওয়া মতো একটি খেয়া নৌকাও ঘাটে নেই। কিন্তু তাকে যে মায়ের কাছে যেতেই হবে!

ঝড়ের রাতে ঈশ্বরচন্দ্র খরস্র্রোতা দামোদার নদী সাঁতরে পাড়ি দিলেন। শরীর খুব ক্লান্ত। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছালেন মেদিনীপুরের বীরসিংহ গ্রামে মা ভগবতী দেবীর কাছে। ছেলে আসবে, মা জানতেন।

মায়ের ডাকে এভাবেই সাড়া দিয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। মা ভাগবতী দেবী ভাগ্যবতীই ছিলেন। তার ডাকে সাড়া দিয়ে ছেলে কোলে ফিরে এসেছিল। কিন্তু হায়, বাংলাদেশের বর্তমান সমাজে এমন কিছু অভাগা মা আছেন, বাবা আছেন, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, ভাইবোন আছেন, যাদের দিনাতিপাত হয় চোখের পানিতে, স্বজনদের প্রতীক্ষায়। তাদের ডাক পৌঁছায় না স্বজনদের কাছে।

গত ১৫ জানুয়ারি শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘মায়ের ডাক’ নামে একটি সংগঠন প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করেছিল। এ সমাবেশে উপস্থিত হয়েছিলেন এমন অনেক হতভাগ্য মা, স্ত্রী, পুত্র-কন্যারা। তারা দীর্ঘ দিন ধরে প্রতীক্ষায় আছেন হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের জন্য। কিন্তু কষ্টের কথা বলা ছাড়া তাদের সামনে ছিল না কোনো সুখবর। স্বজনদের তারা ডাকছেন, কিন্তু মিলছে না কোনো সাড়া।

তিন বছর ধরে স্বামীর খোঁজ করছেন নাসিমা আক্তার। স্বামীর খোঁজে তিনি দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। স্বামীর কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না। বললেন, আমার ঘরে কোনো উৎসব হয় না। সন্তানরা কখনো হাসে না। নাসিমা আক্তারের এই যখন অবস্থা তখন পুলিশ এসে জিজ্ঞাসা করে তার স্বামী সত্যিই গুম হয়েছে কি না।

মায়ের ডাকের প্রতিবাদ সমাবেশে কষ্টের কথা এভাবেই তুলে ধরে নাসিমা আক্তার জানান, তার স্বামী কাঠ ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেনকে ২০১৯ সালের ১৯ জুন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নামে কিছু অজ্ঞাত ব্যক্তি তুলে নিয়ে যায়। স্বামীর খোঁজ পেতে সরকারি সংস্থাগুলোর কাছে গিয়ে সমাধান তো দূরের কথা, অপমান-অপদস্ত হতে হয়েছে তাকে। তিনি বলেন, ‘আমি থানায় গেছি পুলিশ থানা থেকে বরে করে দিয়েছে। আমার চিঠিটা পর্যন্ত পুলিশের ডিসি একবার পড়ে দেখেননি। পুলিশ আমাকে র‌্যাবের কাছে পাঠায়। তিন বছর হলো এভাবেই দৌড়াচ্ছি। তিন বছর পর এসে পুলিশ আমাদের কাছে জানতে চায়- আমার স্বামী আসলেই গুম হয়েছে নাকি কোথাও চলে গেছে।’

শুধু নাসিমাই নন, এমন ১৯টি অসহায় পরিবারের সদস্য মায়ের ডাকের সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন। দেশের প্রথম সারির বেশ কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এর করুণ বিবরণ। লক্ষ্মীপুর থেকে গুম হওয়া বিএনপি নেতা আলমগীর মোল্লার মা-বাবা বলেন, ১০ জানুয়ারি থেকে তাদের কয়েকবার থানায় যেতে হয়েছে। আলমগীরকে খোঁজে বের করবে তো দূরের কথা, ছেলের সাথে পরিবারের কখন কী ঘটেছিল সেই বিবরণ লিপিবদ্ধ করছে পুলিশ। এই বিবরণের বেশ কয়েকটি অনুলিপি করলেও গুম হওয়া আলমীরের বাবা শাজাহান মোল্লার স্বাক্ষর করা কাগজের কোনো অনুলিপি তাকে দেয়নি পুলিশ।

লক্ষ্মীপুরের গুম হওয়া ফরিদ আহমেদের বোন শিল্পী বলেন, তাদের বাসায় পুলিশ কয়েকবার গেছে। কাগজপত্রে তার, স্বামীর ও মায়ের সই নিয়েছে।

গুম হওয়া ছাত্রদল নেতা মাহবুব হাসান সুজনের ভাই শাকিল খান বলেন, তাদের বাসায় পুলিশ আসে বেশ রাতে। তারা আগে থেকে লেখা একটি কাগজে তার সত্তরোর্র্ধ্ব বাবাকে সই দিতে জোরাজুরি করেন। না হলে তাকে থানায় নিয়ে যাবেন বলেও হুমকি দেন। এ অবস্থায় তার অসুস্থ মা কাঁদতে শুরু করেন। স্বজনের শিশুসন্তানরা ভয়ে কুকড়ে যায়।

কয়েক বছর আগে গুম হওয়া বংশাল থানা ছাত্রদলের সভাপতি পারভেজ হোসেনের স্ত্রী ফারজানা আক্তার বলেন, তিনি এখন সন্তানদের নিয়ে বাবার বাড়িতে থাকেন। কয়েক দিন আগে পুলিশ স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতাকে নিয়ে বংশালে তার শ্বশুরবাড়িতে যায়। শাশুড়ির ফোন থেকে ফোন করে তাকে দেখা করতে বলে। পুলিশকে তিনি ঢাকায় এসে যোগাযোগ করবেন বললে ওই পুলিশ সদস্য তাকে একটি রেস্তোরাঁয় দেখা করতে বলে। ফারজানা আরো বলেন, তার শ্বশুরবাড়ির বাসায় গিয়ে ওই সদস্যরা বলেছে, ফারজানা জানেন তার স্বামী কোথায়। তিনিই স্বামীকে লুকিয়ে রেখেছেন। ফারজানার প্রশ্ন, আমার স্বামীকে যদি আমিই লুকিয়ে রাখি, তাহলে পুলিশ কেন খুঁজে বের করতে পারবে না।

পুলিশের উদ্দেশে মায়ের ডাকের সমাবেশে সংগঠনের সমন্বয়ক আফরোজা ইসলাম বলেন, আপনারা জাতিসঙ্ঘকে কাগজপত্র পাঠাতে বলেছেন। আমরা আমাদের স্বার্থেই সহযোগিতা করব। কিন্তু আপনারা কেন প্রায় বিধবা এমন নারীদের কখনো দিনে কখনো রাতে ডেকে নিয়ে যাচ্ছেন? ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে রাখছেন। এতে তারা ভীষণ ভীতির মধ্যে দিনাতিপাত করছেন।

গত বছরের জুনে জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার পরিষদ গুম হওয়া ৩৪ জনের ব্যাপারে জানতে চেয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়। এর ছয় মাসের মাথায় গত ১০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র সরকার গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে র‌্যাব এবং এই বাহিনীর বর্তমান ও সাবেক সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তখন এ বিষয়ে মার্কিন কর্তৃপক্ষের জারি করা প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের বেসরকারি সংগঠনগুলো অভিযোগ করেছে, র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ২০০৯ সাল থেকে ৬০০ বিচারবহির্ভূত হত্যা, ছয় শতাধিক ব্যক্তির গুম হওয়া এবং নির্যাতনের জন্য দায়ী। মার্কিন এই নিষেধাজ্ঞার পর গুম হওয়া ব্যক্তিদের তথ্যের জন্য স্বজনদের কাছে যাচ্ছে পুলিশ।

মায়ের ডাকের সমাবেশে অংশ নিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইনের শিক্ষক ডা: আসিফ নজরুল। তিনি এ নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছেন, প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন করতে হলে এর সাথে যেসব কর্মকর্তা জড়িত তাদের বিচার করুন। নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, দেশে এখন ভয়ের শাসনই শুধু চলছে না, ভয়ের চাষ চলছে। ঘটনা চাপা দিতে পুলিশ কাগজ নিয়ে গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের কাছে যাচ্ছে।

মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে কয়েক দিন আগে সাংবদিকদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেন, এ নিষেধাজ্ঞা যাতে তুলে নেয়া হয় সে জন্য তারা মার্কিন সরকারকে চিঠি দিয়েছেন, যোগাযোগ রাখছেন এবং নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি সুরাহার জন্য লবিস্ট নিয়োগ করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান তো গুমের বিষয় উড়িয়েই দিচ্ছেন। বলছেন, গুমটুম হচ্ছে না। পারিবারিক বিরোধ ও ঋণ নিয়ে ঝামেলায় নাকি এরা নিজ থেকেই নিখোঁজ হয়ে আছেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞ মহলের প্রশ্ন- গুম নিয়ে, বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে বাংলাদেশ দীর্ঘ দিন ধরে প্রশ্নের সম্মুখীন। এ সমস্যার সমাধান হয় না কেন? গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ হলই তো সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী ও চৌধুরী আলমের গুমের কথা তো মানুষ ভুলেই গেছে। তারা বেঁচে আছেন না মারা গেছেন পরিবারের সদস্যরা জানেন না। গুম হওয়াদের ব্যাপারে স্বজনরা আকুতি জানিয়ে বলেছেন, যদি তারা মারা গিয়ে থাকেন, অন্তত কবর কোথায় জানান। কিন্তু সেটাও স্বজনরা জানতে পারছেন না।

গত ১৪ জানুয়ারি প্রকাশিত এক বিবৃতিতে নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠনগুলোর জোট হিউম্যান রাইটস ফোরাম (এইচআরএফবি) বলেছে, পুলিশ তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করার মাধ্যমে গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার পরিবর্তে ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর দুর্দশা আরো বাড়াচ্ছে। পুলিশের এমন আচরণের বন্ধের দাবি জানানো হয় বিবৃতিতে। এইচআরবির বিশেষজ্ঞ হামিদা হোসেন, সুলতানা কামাল, রাজা দেবাশীষ রায়, ইফতেখারুজ্জামানসহ দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এতে স্বাক্ষর করেন।

মার্কিন কংগ্রেসের টম ল্যান্টোস মানবাধিকার কমিশন সম্প্রতি এক ভার্চুয়াল আলোচনায় উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশে বিরোধীদলের নেতাকর্মী, ভিন্নমতাবলম্বী ও গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের উদ্দেশ্যে একধরনের ভয়ের সংস্কৃতির বিস্তার ঘটেছে। অবাধ বিচারহীনতার সংস্কৃতি- গুমকে উৎসাহিত করছে।

এর আগে গত আগস্ট মাসে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানায়, ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত ১১৫ জনের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তারা একটি রিপোর্ট তৈরি করেছে। এতে এ সময়ে বাংলাদেশে বলপূর্বক গুমের শিকার ৮৬ জনের কথা উল্লেখ করা হয়।

গত ৩১ ডিসেম্বর বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে পর্যবেক্ষণ রিপোর্ট প্রকাশ করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। এতে উল্লেখ করা হয়, বিচারহীনতা, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, খুন, ধর্ষণসহ সমাজে এমন একটি অবস্থা তৈরি হয়েছে, যা ভীতিকর। সারা দেশই বলা যায়, ভয়ের চাদরে আবৃত। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট নতুন করে ভয়ের সৃষ্টি করেছে। আসক-এর রিপোর্টে ২০২১ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার ৮০ জন এবং গুম হয়েছেন সাতজন বলে উল্লেখ করা হয়। এই যে ভয়ের সমাজ, এই যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও অমানবিকতা, সেখানে মায়ের ডাক উপেক্ষিত।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাতীয় প্রেস ক্লাব
ই-মেইল : abdal62@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement