নেত্রীর নির্দেশনা মানবে কি তারা?
- ড. আবদুল লতিফ মাসুম
- ১২ জানুয়ারি ২০২২, ২০:০১
উপদেশ-নির্দেশনা আমাদের সমাজের একটি অনুষঙ্গ। বাবা-মা সন্তানকে উপদেশ দেয়। আত্মীয়স্বজনরা আপনজনকে ভালো-মন্দ বোঝায়। শিক্ষককে পাশ্চাত্যে বলা হয় ‘ফ্রেন্ড-ফিলোসফার-গাইড’। আমাদের দেশে শিক্ষক এবং শিক্ষকসম বড়দের অবিভাবক হিসেবে গণ্য করা হয়। সমাজের গণ্যমান্য-ব্যক্তিরাও মুরব্বি হিসেবে কাজ করেন। একসময় নেতা-নেত্রীরা কর্মী ও সমর্থকদের ‘আইডল’ বা আদর্শ স্থানীয় ছিলেন। তাদের নির্দেশনা এমনকি চলন-বলন, পোশাক-আশাক অনুকরণীয় ছিল।
দীর্ঘকাল ধরে পাশ্চাত্যের প্রভাব, আধুনিকায়ন ও সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে উপদেশ-নির্দেশনা অনেকটাই অকেজো হয়ে গেছে। নেতাকর্মীর সম্পর্ক এখন নির্ণীত হয় স্বার্থ-সুবিধার বিনিময়ে। এখন আদর্শের বাণী নীরবে-নিভৃতে কাঁদে। তবুও প্রাচ্যের কোনো কোনো দেশে কোনো কোনো সমাজে নেতা-নেত্রীদের উপদেশ নির্দেশনা অনুসরণীয় হয়ে ওঠে। কাজে না হলেও অন্তত কথায় নীতিনৈতিকতার দোহাই দেয়া হয়। পরিবর্তিত প্রজন্মের কাছে আদর্শের মোড়কে স্বার্থ-সুবিধার প্যাকেজ ডিল উপস্থাপিত হয়।
দেশের নেতা-নেত্রী এবং ক্ষমতায়িত ব্যক্তিরা যখন উপদেশ-নির্দেশনা দেন তখন তা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কথায় আছে- অযাচিত উপদেশ দিতে নেই। কিন্তু কখনো কখনো উপদেশ ও নির্দেশনা অনিবার্য হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্ম নিয়ে বিদ্বজ্জনদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার শেষ নেই। বিশেষ করে ছাত্ররাজনীতির বর্তমান ভয়াবহতার আলোকে সচেতন নাগরিক মাত্রই চিন্তিত। শাসকদলের ছাত্র অংশ গত এক যুগ ধরে শিক্ষাঙ্গনে এবং সমাজে যে পরিচয় প্রতিষ্ঠিত করেছে তা তাদের নেতা-নেত্রীদেরও ভাবিয়ে তুলেছে। এ কথার প্রমাণ পাওয়া যায় শীর্ষ নেত্রীর উপদেশ ও নির্দেশনায়।
ছাত্রলীগের ৭৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে গত সপ্তাহে এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘ছাত্ররাজনীতি থেকেই তো রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে ওঠে, সেটি মাথায় রাখতে হবে। নিজেদের নেতৃত্বের জায়গায় গড়ে তুলতে গেলে সেভাবেই কাজ করতে হবে। তোমরা সেভাবেই নিজেদের আদর্শবান কর্মী হিসেবে গড়ে তুলবে। খেয়াল রাখবে, কোনো লোভের বশবর্তী হয়ে পা পিছলে পড়ে যেও না। নিজেকে শক্ত করে সততার পথে থেকে এগিয়ে যাবে। সংগঠনকে শক্তিশালী করবে। জাতির পিতার আদর্শ নিয়ে কাজ করবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় কাজ করবে। সেভাবেই নেতৃত্ব গড়ে উঠবে।’
রাজধানীর খামারবাড়ির কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আয়োজিত সভায় গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে অংশ নিয়ে ওই নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী। ছাত্রলীগের সাংগঠনিক অভিভাবক শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে আরো বলেন, ‘রাজনৈতিক নেতা হিসেবে যারা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে চাও তাদের নিয়ে সততার সাথে প্রগতির পথে এগিয়ে যেতে হবে।’ নিজের রাজনৈতিক জীবনে আসা নানা প্রতিবন্ধকতা সাহস ও সততার সাথে মোকাবেলা করার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বুলেট, বোমা, গোলা অনেক কিছুই তো মোকাবেলা করেছি, আজ এ নিয়ে চিন্তা করি না; কিন্তু দেশটাকে যেখানে নিয়ে এলাম, এ গতিটা যেন অব্যাহত থাকে, সেটিই চাই। চিন্তাটা সেখানেই যে, আবার যেন আমাদের পিছিয়ে যেতে না হয়। এ ব্যাপারে ছাত্রলীগ, সহযোগী সংগঠন ও আওয়ামী লীগকে সচেতন থাকতে হবে।’
ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘ছাত্রলীগের মূল মন্ত্রই হচ্ছে শিক্ষা। ছাত্রলীগের প্রতিটি নেতাকর্মীকে প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। এ শিক্ষা যেকোনো উপায়ে পয়সা বানানোর শিক্ষা নয়, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য শিক্ষাটা অন্তর থেকে অনুধাবন করতে হবে।’ নেত্রী আরো বলেন, ‘ছাত্রলীগের আরেকটি মূল মন্ত্র হচ্ছে শান্তি। কাজেই ছাত্রলীগকে সেটিও মনে রাখতে হবে। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ, দুর্নীতি এগুলো থেকে দূরে থাকতে হবে। কখনো যেন কোনো ছাত্র বা যুবসমাজ এ সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ, দুর্নীতির সাথে সম্পৃক্ত না হয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘করোনা একটি শিক্ষা দিয়ে গেছে মানুষকে- ধনসম্পদ কোনো কিছু কাজে লাগে না। মানুষকে যেমন হঠাৎ করে মরতে হয়, আবার সম্পদ বানালেও সেগুলো কোনো কাজেই লাগে না। করোনা কিন্তু সেই শিক্ষা সবাইকে দিয়ে গেছে। কাজেই অহেতুক অর্থের পেছনে না ছুটে মানুষের জন্য কাজ করা একজন রাজনৈতিক নেতার কাজ। সেটিই মাথায় রাখতে হবে।’ উন্নত জাতি গঠনে শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘একটি জাতিকে যদি দারিদ্র্যমুক্ত করতে হয়, শিক্ষা হচ্ছে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বলে ছিলেন, ‘শিক্ষায় যে অর্থ ব্যয় সেটি হচ্ছে বিনিয়োগ। সেই অর্থটা কাজে লাগে। শিক্ষিত জাতি ছাড়া কখনো উন্নত জাতি হওয়া সম্ভব নয়। শিক্ষার ওপর আমরা গুরুত্ব দিয়েছি এবং শিক্ষা বহুমুখী করার ব্যবস্থাও নিয়েছি।’
বিভ্রান্তির পথে না গিয়ে পাঠের মনোনিবেশের আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘তোমাদের উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘নীতি আদর্শ নিয়ে চললে পরে যেকোনো বাধা অতিক্রম করা যায়।’ প্রধানমন্ত্রী তার উপদেশে আরো বলেন, ‘কিছু মানুষ কোনো একটা প্রভু খুঁজে নিয়ে তাদের পদলেহন করতে ব্যস্ত থাকে। তাদের কোনো আত্মমর্যাদা বোধ নেই। তাদের নিজের প্রতি কোনো আত্মবিশ্বাসও নেই। এদের নিয়ে দেশের মানুষের কোনো কল্যাণ হয় না।’ ছাত্রলীগকর্মীদের নির্দেশনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ‘এ ছাত্ররাই শিক্ষিত জাতি হিসেবে গড়ে উঠবে। কাজেই তাদেরই সেভাবে তৈরি হতে হবে। ২০৪১ সালের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার সৈনিক হিসেবে নিজেদের এখন থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে।’
বিগত ১৩ বছরের প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য বাস্তব অভিজ্ঞতাসঞ্জাত। এই সময়ে ছাত্রলীগ প্রায় প্রতিদিন যেভাবে সংবাদ শিরোনাম হয়েছে তা ক্ষমতাসীন সরকারের জন্য ছিল বিব্রতকর। প্রধানমন্ত্রী নিজে এর আগে তাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। অভিমান করেছেন। গালমন্দ করেছেন। কিছু কার্যব্যবস্থাও নিয়েছেন। জাহাঙ্গীরনগরের ভাইস চ্যান্সেলর থেকে চাঁদা দাবির কারণে শীর্ষ নেতাদের পদত্যাগে বাধ্য করেছেন। বুয়েটে যখন ছাত্রলীগের গণপিটুনিতে আবরার নিহত হয়েছেন, তখন আইনকে দৃশ্যত এগোতে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
কুয়েটে যখন একজন শিক্ষক ছাত্রলীগের কারণে মৃত্যুবরণ করেছেন তখনো আইনি প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়নি। তবে দৃশ্যমান অভিজ্ঞতা এই যে, যতক্ষণ পর্যন্ত না বিষয়টি আলোড়িত হয়েছে ততক্ষণে আইন আলোর মুখ দেখেনি। কখনো কখনো মুখে শেখ ফরিদ আর বগলে ইট লক্ষ করা গেছে। বিশ্বজিৎ হত্যা মামলায় যে আসামিরা শাস্তি পেয়েছে তাদের কেউ কেউ রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পেয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। পত্রিকায় এসেছে, অপরাধীরা শহরে ঘোরাফেরা করলেও পুলিশ বলছে, তাদের খুঁজে পাচ্ছে না। আওয়ামী লীগের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতারা অনেকবার সতর্ক করেছেন। তাদের প্রতি সহানুভ‚তিশীল বুদ্ধিজীবীরা বলেছেন, সরকারের এত অর্জন বিসর্জিত হচ্ছে ছাত্রলীগের কারণে। এমন কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই যা এদের দাপটে অস্থির হয়ে উঠেনি। বিশেষ করে টেন্ডারবাজি, ভর্তিবাণিজ্য ও চাঁদাবাজিতে তারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। শিক্ষকসহ তাদের আঘাতে অপদস্থ হয়েছে অনেক কর্মকর্তা। পত্রিকার পৃষ্ঠা উল্টালেই এর প্রমাণ পাওয়া যাবে।
প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের কার্যক্রম সম্পর্কে যে খবর রাখেন তা তার দীর্ঘ বক্তৃতায় প্রতিফলিত হয়েছে। লক্ষ করার বিষয়- প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে বারবার যে বিষয়টি ফিরে এসেছে তা অর্থনৈতিক। তিনি একটি মূল্যবান কথা বলেছেন, ‘লোভের বশবর্তী হয়ে পা পিছলে পড়ে যেও না’। তার এ বক্তব্য অবশ্যই মাতৃসম অবিভাবকের মতো। আমাদের মায়েরা যেভাবে যে দরদ দিয়ে কথা বলেন, তার অনুরণন রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে।
মা যখন সন্তানকে উপদেশ ও নির্দেশনা দেন বাস্তব অবস্থার কারণে তা উপেক্ষিত হয়। এমনো দেখা যায়, সন্তান মায়ের প্রতি খড়গহস্ত হয়ে ওঠে। অনেক নেশাখোরদের হাতে বাবা-মা ও আপনজনদের প্রাণপাত পর্যন্ত ঘটেছে। নেশার আহ্বান যেমন অমোঘ তেমনি অর্থ, ক্ষমতা ও দাপটের আহ্বান হয়ে ওঠে অনতিক্রম্য। এ দেশে একসময় মা-বাবারা সন্তানকে উৎসাহ দিয়েছেন রাজনীতি করতে। তখন রাজনীতির অর্থ ছিল আদর্শ। স্লোগান ছিল ‘মানুষ মানুষের জন্য’। এখন তা আর নেই। নেতারা ছাত্র-যুবাদের ব্যবহার করেন ক্ষমতার সিঁড়ি হিসেবে। বিগত ১২ বছরে শাসকদলের ছাত্র অংশ পেটোয়াবাহিনী হিসেবে যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছে! পুলিশের সাথে সাথে সাধারণ পোশাকে তারা প্রতিপক্ষের ওপর হামলা চালিয়েছে। নিরাপদ সড়ক আন্দোলন অথবা শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলন- সর্বত্রই তাদের একই চেহারা দেখা গেছে। এমনকি বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার মতো সাধারণ ঘটনায় প্রতিবাদকারীদের পিটিয়ে দিয়েছে ছাত্রলীগ।
সাধারণ ছাত্ররা তাদের অসাধারণ অত্যাচারে অতিষ্ঠ। সারা দেশে যখন একই অবস্থা তখন প্রধানমন্ত্রীর এই সর্বশেষ আহ্বান তাদের আচার-আচরণ ও রাজনৈতিক কার্জক্রমে কী পরিবর্তন ঘটাবে বা তারা নেত্রীর নির্দেশনা কতটা মেনে চলবে- সেটিই দেখার বিষয়।
বিদ্বজ্জনরা বলেন, শুধু উপদেশ দেয়াই যথেষ্ট নয়, উপদেশ পালনের কার্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করাও নেতৃত্বের কর্তব্য। হজরত আলী রা:-এর একটি বাণী এ রকম- ‘যা তুমি নিজে করোনা বা করতে পারো না তা অন্যকে করতে উপদেশ দিও না’। উইলিয়াম বলেন, ‘সিংহকে যদি শৃগাল উপদেশ দেয় তবে বুঝতে হবে শৃগালই বুদ্ধিমান’। সুতরাং শাসকদলের শিক্ষার্থীসহ সব শিক্ষার্থীর প্রতি আহ্বান- সংযত হও, নির্ভীক হও, সরল হও, দুর্বৃত্তকে এড়িয়ে চলো। তোমাদের ‘চক্ষে জ্বলুক জ্ঞানের মশাল, বক্ষে দেশপ্রেম’। ন্যায়ের সারথি হও তোমরা।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা