বাংলায় অন্ধকার যুগ : মিথ বনাম বাস্তবতা
- মুসা আল হাফিজ
- ১০ জানুয়ারি ২০২২, ২০:২৯
(চতুর্থ কিস্তি)
মুসলিম শাসনের ফলে গণজীবনে অশান্তি ও ধ্বংসযজ্ঞের প্রচারণা একান্তই সারবত্তাহীন। কথিত অন্ধকার যুগের ১৫০ বছরে যেসব শাসক বাংলা শাসন করেন, তাদের সময়টা ছিল প্রধানত শান্তিপূর্ণ। বখতিয়ার খলজি একজন সুশাসক ছিলেন। ১২০৫-১২০৬ এ স্বল্পসময়ের শাসনকালে তিনি তার রাজ্যকে কয়েকটি জেলায় বিভক্ত করেন এবং সেগুলোর শাসনভার তার প্রধান অমাত্য ও সামরিক প্রধানদের ওপর ন্যস্ত করেন। তাদেরকে শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা করা, রাজস্ব আদায় করা, শিক্ষা ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করা এবং জনগণের পার্থিব ও নৈতিক উন্নতির দিকে লক্ষ্য রাখার দায়িত্ব দেয়া হয়। বাংলার ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির নবপ্রতিষ্ঠিত মুসলিম রাজ্যের সীমানা ছিল পূর্বে তিস্তা ও করতোয়া নদী, দক্ষিণে পদ্মা নদী, উত্তরে দিনাজপুর জেলার দেবকোট হয়ে রংপুর এবং পশ্চিমে বিহার পর্যন্ত বিস্তৃত। বখতিয়ার খলজি বাংলায় মুসলিম সমাজের ভিত্তি স্থাপন করে রাজ্যময় মুসলমানদের নামাজের জন্য মসজিদ, শিক্ষাদানের জন্য মাদরাসা এবং ধর্মপ্রচারের সুবিধার্থে সুফিদের জন্য খানকাহ্ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি যেমন ছিলেন একজন প্রতিভাবান ও দুঃসাহসিক সৈনিক তেমনি ছিলেন একজন ন্যায়পরায়ণ, ধর্মপরায়ণ ও প্রজারঞ্জক শাসক। তিনি বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করায় এ অঞ্চলে ইসলাম ধর্মের প্রসার ও মুসলিম সংস্কৃতির বিকাশের পথ সুগম হয়। তার শাসনকাল বিশ্লেষণ করে টি আলী দেখান, বখতিয়ার আদৌ রক্তপিপাসু ছিলেন না। তিনি অহেতুক প্রাণহানি পছন্দ করতেন না। বিজিত অধিবাসীদের ওপর তিনি কোনো নিপীড়নমূলক আচরণও করেননি। তার অভিযাননীতির প্রধান লক্ষ্য ছিল অল্পসময়ে ও অল্প রক্তপাতে অধিক লাভবান হওয়া। তিনি তার স্বল্প মেয়াদি রাজত্বকালে রাজ্যের অমুসলিম প্রজাবর্গের প্রতি (হিন্দু-বৌদ্ধ ইত্যাদি) অত্যন্ত সদয় ছিলেন।
রাজ্যঘটিত ব্যাপারে তার দ্বারা যেমন বিন্দুমাত্র রক্তপাত বা হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়নি, তদ্রুপ ভিন্নধর্মীদের মধ্যে ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রেও তিনি অহিংস নীতির পক্ষপাতী ছিলেন। ... দেবকোটের কোচ দলপতি, তিব্বত অভিযানের পথপ্রদর্শক ও অনাত্মীয় বখতিয়ারের একমাত্র স্থানীয় বন্ধু আলীমেচ তারই আদর্শে মুগ্ধ হয়ে সদলবলে স্বেচ্ছায় মুসলমান হন। তার মধ্যে যদি ইসলাম প্রচারের গোঁড়া মনোবৃত্তি কিংবা হিংসানীতি অথবা জবরদস্তিমূলক পদ্ধতির অবকাশ থাকত, তাহলে তার বিজিত রাজ্যের অবস্থা অন্য রূপ হতো এবং পরবর্তী ইতিহাসেও তার প্রতিক্রিয়া হতো সুদূরপ্রসারী।
ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির মৃত্যুর পর তার তিন সহযোদ্ধা মুহম্মদ শিরান খলজি, হুসামউদ্দিন ইওয়াজ খলজি ও আলী মর্দানের খলজির মধ্যে ক্ষমতার পালাবদল হয়। খলজি আমির ও সৈন্যরা এ সময় মুহম্মদ শিরান খলজিকে নেতা নির্বাচিত করেন। শিরান খলজি মাত্র এক বছরকাল শাসকের দায়িত্ব পালন করলেও নিজ যোগ্যতাবলে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলে বাংলায় শৃঙ্খলা ফিরে আসে। বিদ্রোহী আলী মর্দান তার হাতে বন্দী হলেও কৌশলে পালিয়ে দিল্লির সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেকের কাছে আশ্রয় নেন এবং বাংলার রাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে।
শিরান খলজির মৃত্যুর পর ইওয়াজ খলজি (১২০৮-১২১০ খ্রি.) দিল্লির অধীনস্থ শাসক হিসেবে দেবকোটের শাসক নিযুক্ত হন। কিন্তু মাত্র দুই বছর পর আলী মর্দান খলজি দিল্লির সুলতানের সহায়তা নিয়ে দেবকোটে ফিরে এলে হুসাম উদ্দিন ইওয়াজ খলজি স্বেচ্ছায় শাসন ক্ষমতা ছেড়ে দেন। আলী মর্দান খলজি (১২১০-১২ খ্রি.) বিনা বাধায় শাসক নিযুক্ত হন।
আলী মর্দান লাখনৌতি শাসন করেন ১২১০-১২১২ সালে। খলজিদের মধ্যকার অন্তর্দ্বন্দ্ব দমন করে তিনি বাংলায় রাজনৈতিক ঐক্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। কুতুবউদ্দিন আইবেকের কর্তৃত্বের অধীনে শাসনকার্য শুরু করলেও, ১২১০ সালে আইবেকের মৃত্যুর পর তিনি বাংলায় স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং ‘সুলতান আলাউদ্দীন’ উপাধি গ্রহণ করে মুদ্রা জারি করেন। তার মুদ্রার ছবি কলকাতা এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয়।
সুলতান হিসেবে আলী মর্দান যোগ্য এবং শক্তিশালী ছিলেন। ধারণা করা হয় যে, স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর তিনি যথেচ্ছ ব্যবহার করতে থাকেন। রাজত্বকালের প্রথম দিকে তিনি বিভিন্ন অঞ্চলে সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেছিলেন। তার এ বাহিনী অধিক সংখ্যক খলজি অভিজাত মুসলিমকে হত্যা করেছিল। তিনি বিচক্ষণতার সাথে উচ্চাভিলাষী ও প্রতিদ্বন্দ্বী খলজি অভিজাতদের নির্বাসিত করেছিলেন। তার সময়ে রাজবংশে অস্থিরতা থাকলেও অমুসলিম পীড়ন বা হত্যার কোনো নজির নেই।
এরপর ক্ষমতায় আসেন সুলতান গিয়াসউদ্দিন ইওয়াজ খলজি। (শাসনামল : ১২১২ - ১২২৭)। তার শাসনামলে বাংলায় শান্তি বজায় ছিল। তিনি দেবকোট থেকে গৌড়ে রাজধানী সরিয়ে আনেন। বাংলায় তিনি একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী গড়ে তোলেন। পূর্ববঙ্গ, কামরূপ (আসাম), ত্রিহুত (উত্তর বিহার) ও উৎকলে (উত্তর উড়িষ্যা) অভিযান পরিচালনা করেন ও এগুলোকে তার করদরাজ্যে পরিণত করেন।
গিয়াসউদ্দিন ইওয়াজ খলজি একজন দক্ষ ও সুশাসক ছিলেন। তার সুশাসনে দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি ন্যায়বিচারক ও প্রজারঞ্জক শাসক ছিলেন। প্রজাকল্যাণে তিনি সর্বদাই সচেষ্ট ছিলেন। সামরিক মেধা, কূটনীতি ও প্রশাসনিক দক্ষতার অধিকারী ইওয়াজ খলজি বাংলায় প্রথম নৌবহর গঠন এবং সর্ব প্রথম রৌপ্য মুদ্রা চালু করেন। তিনি শিল্প-সাহিত্যের একজন উদার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি বিদ্বানদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। জ্ঞানী, সাধক এবং সৈয়দদের মধ্যে উত্তম ব্যক্তিদের তিনি ভাতা প্রদান করেন।
দিল্লির সম্রাটের বিরুদ্ধে লাখনৌতির স্বাধীনতার লড়াইয়ে তাকে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে বেশি। এ লড়াইয়ে সপরিবারে তাকে জীবন দিতে হয়েছে। জনগণের ঐক্য ছিল তার জন্য জরুরি। অমুসলিম নাগরিকদের সাথে অসদাচরণ তার বিরুদ্ধেই যেত। কারণ রাষ্ট্রে তখন অমুসলিমরাই বেশি ছিল। তিনি বরং তাদের আস্থা অর্জনে ছিলেন যত্নবান। তাদের ধর্ম, জান-মালের ওপর কোনো বিপদ যেন না আসে, সে ব্যাপারে ছিলেন সজাগ। ঐতিহাসিক বিবরণী তার শাসনামলকে যথার্থই আখ্যা দিয়েছে, ‘তাৎপর্যপূর্ণ ও গঠনমূলক’ অভিধায়।
সুলতান গিয়াসউদ্দিন ইওয়াজ খলজি নিঃসন্দেহে খলজি শাসকদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন। বখতিয়ার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বাংলার মুসলমান রাজ্যকে শক্তিশালী ও সুদৃঢ় করতে তিনি সচেষ্ট হয়েছিলেন। শাসনকার্যের সুবিধার জন্য তিনি রাজধানী দেবকোট হতে গৌড় বা লখনৌতিতে স্থানান্তরিত করেন। রাজধানীর প্রতিরক্ষা সুদৃঢ় করার জন্য বসনকোটে একটি দুর্গ নির্মাণ করা হয়। লখনৌতি নদী-তীরবর্তী হওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধা ছিল। বাংলায় মুসলমান শাসকদের মধ্যে ইওয়াজ খলজিই নৌবাহিনীর গোড়াপত্তন করেছিলেন।
রাজধানীর নিরাপত্তার জন্য এর তিন পাশে গভীর ও প্রশস্ত পরিখা নির্মাণ করা হয়। বার্ষিক বন্যার হাত থেকে লখনৌতি ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল রক্ষার জন্য তিনি বহু খাল খনন ও সেতু নির্মাণ করেন। রাস্তা নির্মাণ করে সৈন্য ও পণ্য চলাচলের বন্দোবস্ত করেন। যা যোগাযোগের উন্নয়ন ঘটায় এবং বার্ষিক বন্যার কবল থেকে জনপদ, ঘরবাড়ি ও শস্যক্ষেত্র রক্ষা করত। কামরূপ, উড়িষ্যা, বঙ্গ (দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা) ত্রিহুতসহ নিকটবর্তী হিন্দুরাজ্যগুলো তার কাছে কর পাঠাতে বাধ্য হয়। লখনৌতির দক্ষিণ সীমান্তের লাখনৌতি শহর শত্রুর কবলে পড়লেও পরে তিনি তা পুনরুদ্ধারে সক্ষম হন।
সুলতান ইলতুৎমিশ পুত্র নাসিরউদ্দীন মাহমুদ বাংলা আক্রমণ করেন। প্রতিরোধ যুদ্ধে ইওয়াজ খলজি পরাজিত ও বন্দী হন। পরে তাকে হত্যা করা হয়।
শিল্প ও সাহিত্যের একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ইওয়াজ। তারই পৃষ্ঠপোষকতায় গৌড়ের জুমা মসজিদ এবং আরো কয়েকটি মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। তার আমলে মধ্য এশিয়া থেকে বহু মুসলিম সুফি ও সৈয়দ তার দরবারে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। সুফি ও সুধীগণ বঙ্গদেশে ইসলাম প্রচারে যথেষ্ট সহায়তা করেন। তাদের আগমন ও ইওয়াজ খলজির পৃষ্ঠপোষকতায় লখনৌতি মুসলিম শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্রে পরিণত হয়।
ইওয়াজ খলজির মৃত্যুর পর থেকে ১২৮৭ সাল পর্যন্ত ষাট বছর বাংলা দিল্লির মুসলমান শাসকদের একটি প্রদেশে পরিগণিত হয়। দিল্লির সুলতান শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশের কাছে পরাজিত ও নিহত গিয়াসউদ্দিন ইওয়াজ খলজির মৃত্যুর পর ১২২৭ সাল থেকে ১২৮৭ সাল পর্যন্ত ষাট বছর বাংলা দিল্লি সালতানাতের একটি প্রদেশে পরিণত হয়। এ সময় দিল্লির সুলতান কর্তৃক মনোনীত ১৫ জন প্রাদেশিক শাসনকর্তা বাংলা শাসন করেন। এদের মধ্যে দশজন ছিলেন মামলুক বা দাস। তবে তারা সবাই তুর্কি ছিলেন বলে এ যুগকে তুর্কি শাসনামল বলাই যুক্তিসঙ্গত। এরপর বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হয় বলবনী শাসন (১২৮১-১৩২০ সাল)। বুগরা খান (১২৮৭-১২৯০ সাল) সুলতান রুকন উদ্দিন কায়কাউস (১২৯১-১৩০১ সাল), সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহদের (১৩০১-১৩২২ সাল) শাসন শান্তি ও প্রজাকল্যাণে ছিল নিবেদিত। তখন বাংলা নিজের স্বাধীনতার জন্য লড়েছে দিল্লির বিরুদ্ধে। ফলে শাসনক্ষমতার আসন থেকেছে অস্থির, টলটলায়মান। যে ধারায় প্রতিষ্ঠিত হয় ছয় বছরের (১৪৮৭-৯৩) হাবশী শাসন। এই সময়ে সাধারণ জীবনযাত্রা কেমন ছিল?
ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের রাজত্বকালে ১৩৪৫-৪৬ সাল মরক্কোর বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা বাংলায় আসেন। উত্তর আফ্রিকা ও মধ্য এশিয়ার মুসলিম দেশগুলো সফর করে তিনি প্রথমে দিল্লি ও পরে দিল্লি থেকে বাংলায় ভ্রমণ করেন। তার বাংলায় আসার মূল উদ্দেশ্য ছিল সিলেট গিয়ে হজরত শাহজালাল (র:)-এর সাথে সাক্ষাৎ করা। সিলেটে কিছু দিন অবস্থান করে তিনি নদীপথে সোনারগাঁও আসেন এবং সেখান থেকে চীনা নৌযান যোগে জাভার পথে যাত্রা করেন।
ইবনে বতুতার ভ্রমণবৃত্তান্তে তখনকার বাংলার আর্থ-সামাজিক অবস্থার চিত্র পাওয়া যায়। বাংলার প্রাচুর্য ও অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ইবনে বতুতাকে অবাক করেছিল। তিনি বাংলার খাদ্যসামগ্রীর স্বল্পমূল্য দেখে বিস্মিত হন। স্বল্পব্যয়ে জীবনযাপনের সহজতা প্রত্যক্ষ করেন। তিনি তার বিবরণে নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যের প্রাচুর্য এবং রমরমা অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্যের কথা বলেছেন, বলেছেন দ্রব্যসামগ্রী বিশেষত চালের উদ্বৃত্ত মজুদ এবং বিদেশে চাল রফতানির কথা, আর প্রতিবেশী দেশ চীন ও জাভার সঙ্গে সোনারগাঁয়ের বাণিজ্যিক যোগসূত্রের কথা। তার বর্ণনায় নদীপথে ব্যবসা-বাণিজ্যের উল্লেখ আছে। দেশে সুফি সাধক ও ফকিরদের মানবপ্রেম, কল্যাণী ভূমিকা ও অলৌকিকতা কাছ থেকে দেখেন। খাদ্য, পোশাক, বাহন, সেবকসহ প্রয়োজনীয় উপকরণের সহজলভ্যতা, জীবনযাপনের সাবলীলতা আর মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলি ইবনে বতুতাকে আকৃষ্ট করলেও এ দেশের আবহাওয়া তার পছন্দ হয়নি। অতিবৃষ্টি ও তার ফলে আর্দ্রতা, বর্ষাকালের কর্দমাক্ত পথঘাট এবং বন্যাজনিত দুরবস্থা তিনি পছন্দ করতে পারেননি। তাই তিনি বাংলাকে ‘দোজখপুর-আয-নিয়ামত’ বা ধনসম্পদে পূর্ণ নরক বলে অভিহিত করেছেন। ইবনে বতুতা কিংবা তখনকার অন্য কোনো প্রত্যক্ষদর্শী ভাষ্যকারের জবানিতে বাংলায় বর্বরতার চিত্রায়ন নেই, উল্লেখমাত্র নেই। আছে বরং শান্ত, নিরাপদ, সমৃদ্ধ জীবনের ভাষ্য, যার প্রতি একজন ভ্রমণকারী ঈর্ষা করতে পারেন।
দিল্লির আধিপত্যের বিরুদ্ধে অব্যাহত লড়াইয়ে এ সময় বহু শাসক জীবন হারিয়েছেন, বন্দী অনেকেই থেকেছেন যুদ্ধলিপ্ত। প্রাসাদ ষড়যন্ত্র এবং ক্ষমতা বদলের ঘটনা ঘটত প্রায়ই। কিন্তু এরই মধ্যে তাদের শাসনের স্বাক্ষর চিত্রিত হয়েছে সুদৃশ্য মুদ্রায়, চারুশিল্প ও হস্তশিল্পের পৃষ্ঠপোষকতায়, ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণে, বহিরাগত ও ফকির-দরবেশদের উদার পৃষ্ঠপোষকতায়, মসজিদ সমাধিসৌধ ও সড়ক নির্মাণে, বহিরাগত হামলাবাজ, দস্যু ও মগদের অত্যাচার ও লুণ্ঠন থেকে রাজ্যের জনগণের রক্ষণে। তখনকার শাসকরা জনসাধারণের জীবনধারণের প্রয়োজনীয় সামগ্রীর প্রাচুর্য এবং পণ্যের সস্তাদর নিশ্চিত করতেন। রাজ্যের জনগণের জন্য ন্যায়বিচার এবং সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনযাপনের সুযোগ প্রসারিত করতে সচেষ্ট থাকতেন।
মুসলিম শাসনামলে বাঙালির বস্তুগত উন্নতি ও জীবনযাত্রার সমৃদ্ধি সম্পর্কে রাজকৃষ্ণ বাবুর উদ্ধৃতি দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লেখেন,
‘লিখিত আছে যে, হোসেন শাহার রাজ্যারম্ভ সময়ে এতদ্দেশীয় ধনীগণ স্বর্ণপাত্র ব্যবহার করিতেন এবং যিনি নিমন্ত্রিত সভায় যত স্বর্ণপাত্র দেখাইতে পারিতেন, তিনি তত মর্যাদা পাইতেন। গৌড় ও পাণ্ডুয়া প্রভৃতি স্থানে যে সকল সম্পূর্ণ বা ভগ্ন অট্টালিকা লক্ষিত হয়, তদ্বারাও তাৎকালীন বাঙ্গালার ঐশ্বর্য্য শিল্পনৈপুণ্যের বিলক্ষণ পরিচয় পাওয়া যায়। বাস্তবিক তখন এ স্থাপত্যবিদ্যার আশ্চর্য্যরূপ উন্নতি হইয়াছিল এবং গৌড়ে যেখানে সেখানে মৃত্তিকা খনন করিলে যেরূপ ইষ্টক দৃষ্ট হয়, তাহাতে অনুমান হয় যে, নগরবাসী বহুসংখ্যক ব্যক্তি ইষ্টকনির্মিত গৃহে বাস করিত। দেশে অনেক ভূম্যধিকারী ছিলেন এবং তাঁহাদিগের বিস্তর ক্ষমতা ছিল; পাঠানরাজ্য ধ্বংসের কিয়ৎকাল পরে সঙ্কলিত আইন আকবরিতে লিখিত আছে যে, বাঙ্গালার জমিদারেরা-২৩,৩৩০ অশ্বারোহী, ৮,০১,১৫৮ পদাতিক, ১৮০ গজ, ৪,২৬০ কামান এবং ৪,৪০০ নৌকা দিয়া থাকেন। এরূপ যুদ্ধের উপকরণ যাহাদিগের ছিল, তাহাদিগের পরাক্রম নিতান্ত কম ছিল না।’
কথিত অন্ধকার যুগের এসব শাসনামলে কোনো কোনো শাসকের শাসনপর্বে সাকুল্যে পনের-বিশ বছর দেশে অশান্তি ছিল। বাকিদের শাসনকাল ছিল শান্তিপূর্ণ। নাগরিক জীবনে সম্প্রীতি, স্থিতি ও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জনকল্যাণের ধারা অবিচ্ছিন্ন ছিল। যুদ্ধবিগ্রহ যা হয়েছিল, তা হয়েছিল দিল্লির আধিপত্যের বিরুদ্ধে, কিংবা শাসকবংশের মধ্যে। তা ব্যাপকভাবে কখনো ছড়ায়নি এবং গণজীবনে বিপর্যয় ডেকে আনেনি।
ড. মোহাম্মদ আবদুল মান্নানের ভাষ্য, ‘মুসলিম শাসন আমল বাংলার ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা গঠনমূলক যুগ হিসেবে ঐতিহাসিকদের বিবেচনা লাভ করেছে। এ জনপদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো এ যুগেই একটি উন্নত ও সংহত রূপ লাভ করে। রাজনৈতিকভাবে এ যুগেই বাংলার জনগণ একটি আদর্শের ভিত্তিতে সামাজিক ঐক্যমঞ্চে সঙ্ঘবদ্ধ হয়। বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসের ভিত্তিও এই যুগেই প্রতিষ্ঠিত হয়।’
ঐতিহাসিক সত্য হচ্ছে, এখানে, মুসলিম বিজয়ীরা না সম্মুখ সমরে কোনো মন্দির দখল বা ধ্বংস করেছেন, না ধর্মপ্রচারের প্রয়োজনে অন্য ধর্মের উপাসনালয়ের হানি করেছেন। নিজেদের শাসনাধীন অমুসলিমদের সব ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছিল ইসলামনির্দেশিত দায়িত্ব। তাদের জীবন, সম্পদ, সম্মান ও ধর্মপালনের অধিকারকে বরাবরই সুরক্ষিত রাখতে সচেষ্ট থেকেছেন। হিন্দু বা বৌদ্ধধর্মীয় নেতাদের হত্যার কোনো ঘটনা ঘটেনি। কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা ধর্মীয় নিপীড়নের নমুনা তৈরি করেনি মুসলিম রাষ্ট্র ও সমাজ।
হিন্দু জাতিসত্তা বরং আপন প্রচলিত নাম ও পরিচিতি পায় মুসলিম শাসনের ফলে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ লিখেন, মুসলমান রাজত্বের পূর্বে ‘হিন্দু’ এই জাতীয় নামই ছিল না। ছিল ব্রাহ্মণ, শূদ্র ইত্যাদি। প্রাচীন বর্ণ মূলত জাতি কিংবা স্বর্ণকার, কর্মকার, তন্তুবায় ইত্যাদি ব্যবসায় মূলত জাতি। কিন্তু ‘হিন্দু’ জাতি ছিল না। হিন্দু ধর্মও ছিল না। ছিল শৈব-শাক্ত-বৈষ্ণব-গাণপত্য সম্প্র্রদায়। আসলে হিন্দু জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ঘটে অংশত শ্রী চৈতন্য দেবের (১৪৮৬-১৫৩৩ সাল) প্রেমবাদে, বিশেষত বঙ্কিমচন্দ্রের (১৮৩৮-১৮৯৪ সাল) স্বসম্প্রদায় ও স্বদেশপ্রেমে এবং কিছুটা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের (১৮৬৩-১৯১৩ সাল) স্বদেশ- স্বজাতির আত্মগ্লানির অনুসন্ধিৎসা থেকে। যার গোড়ায় ছিল মুসলিম বিজয় ও শাসনের বিপরীতে প্রতিক্রিয়াজাত ধারাবাহিকতা।
লেখক : কবি, গবেষক
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা