২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

‘কালো কালো মানুষের দেশে’

ডেসমন্ড টুটু - ছবি : সংগৃহীত

‘দক্ষিণ আফ্রিকার বিবেক’ হিসেবে খ্যাত আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটুর ৯০ বছরে (১৯৩১-২০২১) জীবনাবসান হয়েছে এবার ২৬ ডিসেম্বর রোববার। তার মহতী জীবন ও সংগ্রামী কর্ম থেকে বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বের মানুষের শেখার অনেক কিছুই আছে। তিনি বর্ণবাদের বিরুদ্ধে কৃষ্ণাঙ্গ বা কালোদের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা ছিলেন। কালো-সাদার ঊর্র্ধ্বে জাতীয় ঐক্যের প্রবক্তা ও প্রতিভূ ছিলেন। তাই জাতীয় পর্যায়ে নেলসন ম্যান্ডেলার আমলে সত্য ও পুনর্মিলন কমিশনের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। এটা পালন করতে গিয়ে তাকে সমালোচনার সম্মুখীনও হতে হয়েছে। মানুষ হিসেবে ভুলের ঊর্ধ্বে হয়তো তিনি ছিলেন না। তবে মানবিক সাম্য ও সুবিচার এবং বৈষম্যমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় তার আন্তরিকতা নিয়ে কখনো কেউ প্রশ্ন তোলেননি। তিনি বর্ণবাদী অপরাধীর শাস্তির চেয়ে ক্ষমাকে গুরুত্ব দিয়ে ভুল বোঝাবুঝির শিকারও হয়েছেন। অভিযোগকারীরা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার বিষয় আজ পর্যন্ত অনিশ্চিত রয়ে গেছে। তিনি কিন্তু নিজের কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হননি। অনৈক্যকবলিত উন্নয়নশীল ও অনুন্নত বিশ্বের দেশগুলো তার নজির অনুসরণ করতে পারে নিজেদের জন্য। টুটু ম্যান্ডেলাকে ছেড়েও কথা বলেননি। এমনকি, পরে নেলসন ম্যান্ডেলার দলকে (এএনসি) আর ‘ভোট দেবেন না’ বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এটা তার নীতিবোধ ও সৎ সাহসের পরিচায়ক। এমন যুক্তিবাদী, সত্যবাদী ও নিষ্ঠাবান ব্যক্তির প্রয়োজন সব জাতিরই। টুটুর খিল খিল হাসি কারো কারো জন্য বিরক্তিকর হলেও তার মুখের এ হাসি সফল হবে যদি প্রথমে তার দেশ দ: আফ্রিকা কালো, মিশ্র, সাদা- সবার অহিংস ও শান্তিময় আবাস হয়ে ওঠে এবং সে সমাজ থেকে সন্ত্রাস, এইডস, মাদকাসক্তি, নির্যাতন, দুর্নীতি, বৈষম্য, স্বৈরাচারসহ সব অন্যায়ের মূলোৎপাটন ঘটে স্থায়ীভাবে ও কার্যকর পন্থায়। টুটুর বিশ্বাস, অহিংস পন্থার দ্বারাই বর্ণবাদের বিলুপ্তি ঘটাতে হবে। এ নিয়ে ম্যান্ডেলার দল, এএনসির একাংশ ক্ষুব্ধ হয়। কারণ তারা মনে করেন, ‘কোনো না কোনো ধরনের সশস্ত্র সংগ্রাম ব্যতীত বর্ণবাদের অবসান অসম্ভব।’ ম্যান্ডেলার সরকার ‘মন্ত্রীদের বেতন’ বেশি দেন বলে টুটু অভিযোগ করেন। তার ভাষায়, ‘ম্যান্ডেলা তো সাধারণ রাজনীতিক নন। তিনি কেন এসব করবেন?’

বিশপ ডেসমন্ড টুটুর গায়ের রং কালো হলেও তার মনটা ছিল ভালো। তিনি ছিলেন মানবতাবাদী এবং উদারমনা। সাদা সংখ্যালঘু কিংবা কালো সংখ্যাগুরু নির্বিশেষে সবার প্রকৃত মঙ্গল কামনা করে গেছেন তিনি। কেউ কারো ওপর অত্যাচার না করুক- এটাই চেয়েছেন তিনি। তাই সাদা-কালো সবার সহিংসতা ও উগ্রতার তিনি বিরোধী ছিলেন।

জোহানেসবার্গের পশ্চিমে ক্লার্কসডর্প নামের ছোট শহরে ১৯৩১ সালের ৭ অক্টোবর যে ছোট শিশু জন্ম নিয়েছিল- তার একদিন অবদান হবে অনেক বড়- এটা সেদিন কেউ কি বুঝেছিল? হয়তো, না। ১৯৮৪ সালে ডেসমন্ড টুটু বর্ণবাদী দুঃশাসনের বিরোধী হিসেবে শান্তির জন্য বিশ্বসেরা নোবেল প্রাইজ অর্জন করেন। একই বছর তিনি জোহানেসবার্গের পয়লা কালো বিশপ হয়ে স্বদেশ দ: আফ্রিকার সংখ্যালঘিষ্ঠ শ্বেতাঙ্গ শাসনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানান। এর আগে ১৯৬১তে তিনি হলেন অ্যাংলিকান চার্চের ধর্মযাজক। তারও আগে ছিলেন বাবার মতো শিক্ষক। স্মর্তব্য, তিনি সামান্য ‘বুয়া’ মাতার অসামান্য সন্তান। তার মা তাকে জন্ম দিয়ে নিজের জীবনকে সার্থক করেছেন। ১৯৭৬ সালে ডেসমন্ড টুটু হন প্রতিবেশী দেশ লেসোথোর যাজক। ১৯৭৮-এ অত্যন্ত প্রভাবশালী দক্ষিণ আফ্রিকার চার্চ কাউন্সিলের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মহাসচিব হলেন। এর দেড় কোটির মতো সদস্য বর্ণবাদবিরোধী সুদীর্ঘ সংগ্রামে জড়িত ছিলেন। ১৯৮৬ সালে কেবল ম্যারাডোনা বিশ্বকাপ ফুটবলে হাত দিয়ে গোলের দ্বারা রেকর্ড গড়ে বলেননি, It's act of god, সে বছর ডেসমন্ড টুটু স্বদেশের কেপটাউনে প্রথম কালো আর্চবিশপ এবং সে দেশে ২০ লাখ অনুসারীর অ্যাংলিকান গির্জার প্রধানরূপে শপথ নিলেন।

দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের মুক্তি সংগ্রামের মহানায়ক নেলসন ম্যান্ডেলা প্রায় তিন দশক পরে ১৯৯০ সালে মুক্তি পান। ১৯৯৪ সালে তিনি জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হয়ে গঠন করেন দেশের সরকার এবং জাতীয় সত্য ও পুনর্মিলন সংস্থা (ট্রুথ অ্যান্ড রিকন্সিলিয়েশন কমিশন) এবং ডেসমন্ড টুটু এর প্রধান নিযুক্ত হলেন। তার আগে যেদিন ম্যান্ডেলা (‘আদিবা’ নামে বহুল পরিচিত) জেল থেকে মুক্তি পান, সে রাতে ছিলেন বিশপ টুটুর বাসায়। যা হোক, সত্য ও পুনর্মিলন কমিশনের উদ্যোগে টুটু শ্বেতাঙ্গ সরকারের বর্বরতা উদঘাটন করেছিলেন অনেক ঘটনার ব্যাপারে শুনানি করে।

দুঃখের বিষয়, ১৯৯৭ সালে ডেসমন্ড টুটুর প্রোস্টেট ক্যান্সার ধরা পড়ে এবং পরের কয়েক বছর তিনি বারবার এর চিকিৎসা নিয়েছিলেন। এক দশক পরে গঠিত ‘এল্ডার্স গ্রুপ’-এর (বয়স্ক ব্যক্তিরা) চেয়ারম্যান ছিলেন ৬-৭ বছর। এর মধ্যে ২০১৩ সালে পাবলিক লাইফ থেকে অবসর নেন তিনি। ২০১৩ সালে এএনসির প্রাণপুরুষ নেলসন ম্যান্ডেলার এই ঘনিষ্ঠতম সঙ্গীর ঘোষণা : আর দলটিকে (আফ্রিকান জাতীয় কংগ্রেস) ভোট দেবো না। এর কারণ তারা অব্যবস্থাপনা, বৈষম্য, সহিংসতা, দুর্নীতি ইত্যাদিতে জড়িয়ে পড়েছে।’ অবশেষে গত বছর তিনি জনগণের সামনে এলেন বিরল দৃষ্টান্ত হিসেবে। উপলক্ষ কোভিডের টিকা নেয়া। সেদিন হাসপাতাল থেকে বের হলেন হুইল চেয়ারে। তখন জনতার উদ্দেশে হাত নাড়লেও কারো সাথে কথা বলেননি তিনি।

১৯৮৫ সালে বর্ণবিদ্বেষী তদানীন্তন দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানিয়ে ডেসমন্ড টুটু বলেন, ‘সাদা লোকগুলো কি আমাদের কথা শুনবে? আমরা বলছি, আমাদের মানুষ হিসেবে স্বীকার করুন। তারা আঁচড় দিলে আমাদেরও রক্তপাত হয়।’ তিনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হলে নরওয়ের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জোনাস গ্যাহ্র্ স্টোর বলেছিলেন, (নোবেল) শান্তি পুরস্কার এর চেয়ে যোগ্য লোকের হাতে আগে কোনো দিন যায়নি।’ টুটুকে বলা হতো, ‘শান্তি ও মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক সংরক্ষক।’ মাত্র ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি দৈহিক উচ্চতার মানুষটির নৈতিক উচ্চতা ছিল তুলনাবিহীন। তিনি সর্বদাই চেয়েছেন স্বদেশের ও স্বজাতির ঐক্য। যেকোনো বিভেদ-বিভাজনের তিনি বিপক্ষে ছিলেন।

২০১৩ সালে নেলসন ম্যান্ডেলার মৃত্যু ঘটে ৯৩ বছর বয়সে। তখন বিশপ টুটু বলেছিলেন, ‘তার কি দুর্বলতা ছিল? অবশ্যই ছিল। যেমন, তিনি ছিলেন নিজের সংগঠনের অত্যন্ত অনুগত। তিনি আনুগত্য পোষণ করেছেন কয়েকজন সহকর্মীর, যারা তাকে ডুবিয়েছেন। তবে আমার বিশ্বাস, ম্যান্ডেলা ছিলেন সাধুসন্ত মানুষ। তিনি অন্যদের জোরালোভাবে উদ্বুদ্ধ করতেন।’

তিব্বতি নেতা দালাইলামার অতীব ঘনিষ্ঠ ছিলেন ডেসমন্ড টুটু। সে ব্যাপারে বলেছেন, ‘কেউ কেউ বলে থাকেন- সৃষ্টিকর্তা বলবেন, ‘হায় হায়- দালাইলামা তো খ্রিষ্টান নয়।’ আমার মনে হয় না, তা ঘটবে। কারণ স্রষ্টা নিজেও খ্রিষ্টান নন।’ অর্থাৎ খ্রিষ্টানদের একজন যাজক হয়েও টুটু ছিলেন সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে।

টুটু রেখে যান ৬৬ বছরের দাম্পত্য সঙ্গী স্ত্রী লিয়াহ এবং চারজন সন্তান। কিভাবে তাকে মনে করলে উত্তম হবে? এর জবাবে বিশপ ডেসমন্ড টুটু বলে গেছেন, ‘তিনি ভালোবাসতেন। তিনি হেসেছেন, কেঁদেছেন। তাকে মাফ করে দেয়া হয়েছে। তিনি মাফ করে গেছেন। তিনি ব্যাপকভাবে সুযোগ সুবিধা পেতেন।’

দীর্ঘ দিন আফ্রিকান কংগ্রেসের একজন শীর্ষ ব্যক্তিত্ব হয়েও ম্যান্ডেলার পত্নী গ্রাচা তাকে ছেড়ে চলে যান এবং আরেক দেশ মোজাম্বিকের নেতা স্যামোরা ম্যাচেলকে বিয়ে করেছিলেন। টুটু এজন্য বলেছেন, ‘ম্যান্ডেলা তাকে বেছে ভুল করেছেন।’ টুটু চাইতেন, কালো শাসকরাও যেন সাদাদের মতো ‘এলিট’ হয়ে না যায়। এ জন্য তিনি তাদের বিশেষ ট্রেনে না উঠতে বলেন।

আর ম্যান্ডেলা বিশপ টুটু সম্পর্কে বলে গেছেন, ‘তার সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হলো, তিনি ভীত না হয়ে যেকোনো অজনপ্রিয় পদ নিতেন। জনগণের নৈতিকতা প্রসঙ্গে তিনি মন খুলে কথা বলেছেন। বর্ণবাদ ব্যবস্থার বহু নেতা তার কথায় বিরক্ত হয়েছেন। অনুসারীদেরও তিনি ছাড়েননি। আমাদেরও তিনি মাঝে মধ্যে বিরক্ত করতেন। কারণ আমরা নতুন ব্যবস্থা চাইতাম। তার মনের স্বাধীনতা কখনোবা ভুল ও কৌশলহীন ছিল। তবে তা প্রাণবন্ত গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য।’

ডেসমন্ড টুটুর দুঃখ ছিল, স্বদেশে তিনি ঐক্যবদ্ধ ‘রংধনু জাতি’ দেখে যেতে পারেননি যারা হবেন বর্ণবাদের ঊর্ধ্বে এবং যারা হবেন আদর্শ।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল