নতুন আশায় বুক বাঁধি
- সৈয়দ আবদাল আহমদ
- ০৩ জানুয়ারি ২০২২, ১৯:৪৭
নতুন আশা নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন ইংরেজি বছর ২০২২ সাল। গত দু’টি বছরের মতো নতুন বছরটিও এসেছে করোনা মহামারীর মধ্যে। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রধান তেদরোস আধানম গেব্রেয়াসুস আশা প্রকাশ করেছেন, ২০২২ সালে করোনাভাইরাসের মহামারী হার মানবে। এটা যদি সত্যি হয়, তবে বছরটি অবশ্যই হবে একটি আশার বছর।
নতুন বছরটি কেমন যাবে সেটা করোনাভাইরাসের ওপরই নির্ভর করছে। কারণ গত দু’টি বছর আমরা দেখেছি সব কিছুই এর নিয়ন্ত্রণে। বিশ্বের প্রতিটি দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, মানুষের আয় রোজগার, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা, সাধারণ চলাফেরাসহ সব কিছুই বিপর্যস্ত হয়েছে করোনা মহামরীর কারণে। টিকা আবিষ্কার এবং ওষুধ উদ্ভাবনের পরও বিপর্যস্ত অবস্থা কাটিয়ে ওঠা এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মহামারীর শুরু থেকেই বিশ্বকে দিকনির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে। তাই সংস্থার প্রধান যখন আশাবাদ ব্যক্ত করেন, তার সাথে পুরো বিশ্বই আশা করছে; করোনা মহামারী হার মানবে। তবে এ ক্ষেত্রে কয়েকটি শর্তের কথাও বলেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাসচিব। তিনি বেশ কিছু পরামর্শও রেখেছেন। বলেছেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে দেশগুলোর একসাথে কাজ করতে হবে। করোনার টিকার ক্ষেত্রে যে অসমতা রয়েছে তা বজায় থাকলে ভাইরাসটির নতুন ধরন আসার ঝুঁকি বাড়বে। যেকোনো মূল্যে টিকার অসমতা দূর করতে হবে। টিকা নিয়ে জাতীয়তাবাদী আচরণ ও মজুদের বিষয়ে সতর্ক হতে হবে। অর্থাৎ দেশে দেশে মানুষকে টিকার আওতায় আনতে হবে। ধনী দেশ, গরিব দেশ- এই বৈষম্য করলে চলবে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ ক্ষেত্রে ২০২২ সালের নতুন লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। করোনা মহামারী শেষ করতে আগামী জুলাই মাসের মধ্যে বিশ্বের ৭০ শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে চায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এ লক্ষ্য সফল হলে করোনা মহামারী বিদায় নেবে এ কথা অনায়াসেই বলা যায়।
চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে প্রায় দু’বছর আগে (২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর) করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছিল। ইতোমধ্যে বিশ্বজুড়ে প্রায় ২৯ কোটি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন প্রায় ৫৫ লাখ মানুষ। করোনার কারণে বিধিনিষেধসহ সার্বিক পরিস্থিতি বর্তমানে মানুষের জীবনের নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে গেছে। দেশগুলো সীমান্ত বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। এখনো হচ্ছে। মানুষ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। মাস্ক ছাড়া বাইরে যাওয়ার বিষয়টি এখনো চিন্তাতীত। এ অবস্থা আর কত দিন চলতে পারে? এর তো একটা সুরাহা হওয়া উচিত। সে জন্যই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার শর্তগুলো মানা জরুরি।
করোনা সংক্রমণ বাড়ার শঙ্কা
নতুন বছর ২০২২ সালে করোনা বিদায় নেবে এ আশাবাদ উচ্চারিত হয়েছে। তবে বছরটি শুরু হয়েছে করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। কিছু দিন ধরে পুরো বিশ্বেই (বিশেষ করে ইউরোপে) উদ্বেগজনক হারে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে। করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন আর ইউরোপে এক দিনে নতুন রোগী শনাক্তের রেকর্ড হচ্ছে। এক দিনে বিশ্বে ১০ লাখের বেশি করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে নতুন বছরটিতে। ওমিক্রনের কারণে অনেক দেশেই সংক্রমণ বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতোমধ্যে ওমিক্রন ও ডেল্টার দাপটকে ‘সুনামি’ আখ্যায়িত করেছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতেও করোনার ওমিক্রন সংক্রমণ ব্যাপকভাবে বাড়ছে। পশ্চিমবঙ্গে ওমিক্রন নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে বিধিনিষেধ জারি হয়েছে। কলকাতায় কারফিউ জারির কথা ঘোষণা করা হয়েছে।
বাংলাদেশেও করোনা সংক্রমণের হার ঊর্ধ্বমুখী। আগের এক সপ্তাহের তুলনায় সংক্রমণ বেড়েছে ৬০ শতাংশ। গত ২০ ডিসেম্বর থেকে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, এভাবে বাড়তে থাকলে আবার বিধিনিষেধ তথা লকডাউন ঘোষণা করা হতে পারে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে করোনা শনাক্ত ১ শতাংশের ঘরে ছিল। তবে গত ২ জানুয়ারি তা হয়েছে ২ দশমিক ৪৩ শতাংশে। অর্থাৎ দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে গেছে।
তবে শঙ্কার মধ্যেও সুখবর আছে। করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন শনাক্ত হওয়া প্রথম দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা। তারা জানিয়েছে, সেখানে ওমিক্রন আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত কারো মৃত্যু হয়নি। নতুন বছরে আঁধার কেটে আশার আলো দেখা দেয়ার যে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে তার একটি হচ্ছে করোনা মহামারীর ধকল কেটে যাওয়া। এজন্য নতুন ধরন ওমিক্রনের ধকল সামলাতে হবে। বিশ্বে টিকাবৈষম্য দূর করতে হবে।
যত প্রয়োজন তত টিকা
ফাইজারের প্রধান নির্বাহী ড. আলবার্ট বুর্লা বিশ্বকে সুখবর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ২০২২ সালে কারোনার টিকার ঘাটতি হবে না। কারণ, মানুষকে করোনা থেকে সুরক্ষা দিতে বিশ্বজুড়েই একটি প্রতিযোগিতা চলছে। নতুন বছরে দেশগুলো যত প্রয়োজন তত ডোজ টিকা পাবে। তিনি জানান, করোনা মহামারীর এ সময়ে উদ্ভাবিত টিকা লাখ লাখ মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে। এই টিকা উদ্ভাবিত না হলে আমাদের সমাজের মূল কাঠামোই ঝুঁকির মধ্যে পড়ত। নতুন বছরের শুরুতে ফাইজার তাদের তৈরি এমআরএনএ টিকার ৩০০ কোটি ডোজ সরবরাহ করতে পারবে। ২০২২ সাল শেষ হওয়ার আগে আরো ৪০০ কোটি ডোজ টিকা সরবরাহ করবে। ড. বুর্লা আরো জানান, করোনাভাইরাসের ডেল্টা এবং বেটা ভ্যারিয়েন্ট মোকাবেলায় ফাইজারের টিকা কার্যকর করার পদক্ষেপ তারা ইতোমধ্যে নিয়েছেন। একই সাথে তা হালনাগাদ করা হয়েছে। নতুন ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে টিকা কার্যকর করার কাজ তারা করেছেন। আগামী ১০০ দিনের মধ্যে সেই টিকা হালনাগাদ হবে। ফাইজার ‘প্যাক্সলোভিড’ নামে মুখে খাওয়ার ট্যাবলেটও বের করেছে; যা ব্যবহারে হাসপাতালে ভর্তি এবং মৃত্যুর হার ৯০ শতাংশ কমে যাওয়ার বিষয় ট্রায়ালে দেখা গেছে। ডা: বুর্লা সবাইকে ভয় ভেঙে টিকা নেয়ার সঠিক পদক্ষেপটি নেয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, টিকা নেয়া এ কারণেই জরুরি-এটা শুধু আপনার স্বাস্থ্যই নয়, আপনার কাছের প্রিয়জনের স্বাস্থ্যের জন্যও জরুরি।
বাংলাদেশের সামনে চ্যালেঞ্জ
ইউরোপ ও আমেরিকায় এ মুহূর্তে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ার কারণ হচ্ছে ভাইরাসটির নতুন ধরন ওমিক্রন। এএফপির খবরে বলা হয়েছে, ইউরোপে ১০ কোটিরও বেশি করোনা শনাক্তের রেকর্ড রয়েছে। ইউরোপ আবারো মহামারীর কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছে। ওমিক্রনের বিস্তার বেড়ে যাওয়ায় গোটা ইউরোপই বলা যায়, ভাইরাসের সাথে লড়াই করছে। ওমিক্রনের প্রকোপ যুক্তরাষ্ট্রেও বেড়েছে। সংক্রমণ বৃদ্ধির প্রভাব এয়ারলাইন্স কোম্পানিগুলোর ওপরও পড়ছে। গত কয়েক দিনে যুক্তরাষ্ট্রে এ কারণে ১২ হাজার ফ্লাইট বাতিল হয়েছে। সিএনএনের খবরে বলা হয়েছে, করোনার নতুন ওমিক্রনের ঊর্ধ্বগতির পাশাপাশি বৈরী আবহাওয়ার কারণে নতুন বছরের প্রথম দিন পয়লা জানুয়ারি শনিবার চার হাজারের বেশি ফ্লাইট বাতিল করতে হয়েছে। এয়ারলাইনের অনেক পাইলট, ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট ও কর্মী ছুটিতে আছেন। তাদের মধ্যে অনেকে করোনায় আক্রান্ত, কেউ আবার করোনা রোগীর সংস্পর্শে আসায় কোয়ারেন্টিনে থাকতে হচ্ছে।
ওমিক্রন ধরন বাংলাদেশের জন্যও চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে সাতজনের শরীরে ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছে। বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা: এ এস এম আলমগীর বলেন, আগামী তিন থেকে পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশেও ওমিক্রনের সংক্রমণ বাড়তে পারে, এমন আশঙ্কাই তারা করছেন। তিনি বলেন, আমাদের এখানে এখনো ডেল্টা বেশি। কিন্তু ওমিক্রন সেটাকে সারপ্লাস করে যাবে। কারণ, গত দু’বছর ধরে দেখছি ইউরোপ আমেরিকায় ছড়ানোর তিন থেকে পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে সেটি আমাদের এদিকে আসে। তার মতে, শ্বাসতন্ত্রের ভাইরাসে যেসব বৈশ্বিক মহামারী হয়েছে, ঐতিহাসিকভাবে সেগুলো তিন বছর স্থায়ী হয়েছে। ওমিক্রনে অবশ্য ফুসফুসে প্রদাহ কম হচ্ছে। সে কারণে এর সংক্রমণ অনেক বেশি হলেও গুরুতর অসুস্থতা ও মৃত্যুর সংখ্যা কম হতে পারে। বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা: নজরুল ইসলাম জানিয়েছেন, মার্চ নাগাদ সংক্রমণ আরো বাড়তে পারে। দেশে এখন পর্যন্ত করোনায় ১৬ লাখ লোক আক্রান্ত হয়েছে। মৃত্যুর সংখ্যা ২৮ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে ঢাকাতেই মৃত্যু হয়েছে ৪৩ শতাংশ। বাংলাদেশে মোট জনগোষ্ঠীর ৬০ শতাংশ ইতোমধ্যে প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছেন। দু’টি ডোজই নিয়েছেন ৪০ শতাংশের মতো। এ বছরের জুনের মধ্যে ৮০ শতাংশকে টিকা দেয়া শেষ করতে চায় সরকার। দেশে ফাইজার, মডার্না ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার বুস্টার ডোজও দেয়া শুরু হয়েছে। চলতি জানুয়ারি মাসেই চার কোটি মানুষকে টিকা দেয়া হবে। টিকার কোনো স্বল্পতা এখন আর নেই। কয়েক দিন হলো দুই কোটি টিকা এসেছে দেশে। করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে রাখা বড় চ্যালেঞ্জ হলেও নতুন বছরে তা সম্ভব হবে।
শতভাগ মানুষকে টিকা দেয়া অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলেও সরকার আশা করছে কোভ্যাক্সের সহায়তায় তা সম্ভব হবে। কারণ বাংলাদেশ একটি টিকাবন্ধব দেশ।
মেসিকেও ছাড়েনি করোনা
করোনাভাইরাসে বিশ্বের অনেক মানুষ তাদের প্রিয়জনকে হারিয়েছেন। ফুটবল বিশ্বের প্রিয় মানুষ লিওনেল মেসিকেও ছাড়েনি করোনা। ছুটি নিয়ে বউ-বাচ্চাসহ লিওনেল মেসি নিজ দেশে আর্জেন্টিনায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। কিন্তু করোনায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন মেসি। প্যারিস সেন্ট জার্মেই বা পিএসজি ক্লাব জানিয়েছে, মেসিসহ তাদের চার ফুটবলার করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। অন্যরা হলেন হুয়ান বের্নাত, সের্হিও রিকো এবং নাথান বিতুমাজালা। করোনামুক্ত হয়ে মেসিসহ অন্যরা আবারও ফুটবল মাঠে নৈপুণ্যে মেতে উঠুন, করোনা মহামারীর অবসান হোক- নতুন বছরে এ আশায় বুক বাঁধি।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাতীয় প্রেস ক্লাব
ই- মেইল : abdal62@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা