ত্রিমাত্রিক ধর্ষণের কবলে পর্যটনশিল্প!
- গোলাম মাওলা রনি
- ৩০ ডিসেম্বর ২০২১, ২০:২৬
পর্যটন নগরী কক্সবাজারে একজন নারী পর্যটকের ধর্ষণ নিয়ে সারা দেশে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে। পর্যটনের ভরা মৌসুমে যখন লাখ লাখ পর্যটকের উপস্থিতিতে কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকত, হোটেল-মোটেল এবং অলিগলি, রেস্তোরাঁ লোকে লোকারণ্য, ঠিক সেই সময়ে কয়েকজন দুর্বৃত্ত প্রকাশ্যে একজন নারীকে তার স্বামীর সামনে থেকে অপহরণ করল এবং সেই নারীর আট মাস বয়সী শিশুর আর্তচিৎকার অথবা স্বামীর আহাজারি কোনো পথচারীর দৃষ্টিগোচর হলো না। তখন পর্যটন নগরী কি জীবিত ছিল, নাকি মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছিল তা নিয়ে চিন্তাভাবনা না করে কেউ যদি পুনরায় পর্যটনসুখ অনুভবের জন্য ওদিকে পা বাড়ান তবে অনাগত পরিণতি কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।
উল্লিখিত নারীকে দুর্বৃত্তরা প্রথমে নির্জন একটি এলাকাতে নিয়ে যায় এবং তিনজন মিলে খোলা আকাশের নিচে আদিম বর্বরতায় উপর্যুপরি ধর্ষণ করে। একটি চায়ের দোকানের পেছনে যখন এসব পৈশাচিক বর্বরতা চলছিল তখন সেখানে চায়ের দোকানি কী করেছিল তা অবশ্য কোনো পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। পত্রিকায় যেটা প্রকাশিত হয়েছে, তার মোদ্দা কথা হলো- ধর্ষকরা দ্বিতীয় দফায় কুকর্ম করার জন্য অসহায় মহিলাটিকে জিয়া গেস্ট হাউজ নামের একটি হোটেলে নিয়ে আসে এবং ইয়াবা সেবন করে নিজেদের মধ্যে পাশবিক কামভাব জাগ্রত করে পুনরায় উপর্যুপরি ধর্ষণ করে। এরপর তারা মহিলাটির কাছে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে এবং দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তাকে আটকে রেখে মারধর করতে থাকে।
অসহায় মহিলাটি যখন উপর্যুপরি ধর্ষণ, মারধর, হুমকি-ধমকি এবং প্রাণনাশের আতঙ্কে বিপর্যস্ত তখন তার স্বামী আট মাসের শিশুসন্তানকে কোলে নিয়ে কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতের জনাকীর্ণ হোটেল-মোটেল জোনে কিরূপ ছুটাছুটি করছিলেন, তা মানুষ তো দূরের কথা- হিংস্র হায়েনারাও অনুধাবন করতে পারবে। তিনি নিশ্চয়ই পথচারীদের হাতেপায়ে ধরে কান্নাকাটি করেছেন। তার সাথে তার শিশুপুত্রটিও যে কেঁদেছে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তাদের গগনবিদারী কান্না কক্সবাজারের রাস্তায় পর্যটন সুখে উন্মত্ত কোনো জনতার মনে দয়ামায়ার উদ্রেক করেছে এমন খবর পত্রপত্রিকায় আসেনি।
পত্রপত্রিকায় খবর এসেছে, মহিলা নিজে ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে পুলিশের সাহায্য চেয়েছেন। তার স্বামীও একই নম্বরে ফোন করে সাহায্য চেয়েছিলেন। উত্তরে তাদেরকে বলা হয়েছে, ‘থানায় এসে’ একটি সাধারণ ডায়েরি করার জন্য। এরই মধ্যে অসহায় স্বামী টহলরত র্যাবের সাক্ষাৎ পান এবং তাদের কাছে পুরো ঘটনা বলার পর র্যাব নির্যাতিত মহিলাকে উদ্ধার করে। বিষয়টি জানাজানি হলে কক্সবাজার জেলা পুলিশ এবং সেখানে যে ট্যুরিস্ট পুলিশের ইউনিট রয়েছে তাদের পক্ষ থেকে যেসব কথাবার্তা বলা হয়, তা সাধারণ জনগণের কাছে কেমন লেগেছে তা বলতে পারব না। তবে নির্যাতিতা মহিলাকে যদি দুর্বৃত্তরা অন্য কোনো হোটেলে নিয়ে আগের তুলনায় বেশি মাত্রায় ইয়াবা সেবন করে তৃতীয় দফায় উপর্যুপরি ধর্ষণ করে রক্তাক্ত করে ফেলত তবে তিনি যে কষ্ট পেতেন তার চেয়েও অধিক মাত্রায় বেদনা তার হৃদয়কে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে পর্যটন নগরীর পুলিশের কথার মায়াজালে।
উল্লিখিত ঘটনা নিয়ে পুলিশ ও র্যাবের বক্তব্যও পরস্পরবিরোধী হয়ে পড়েছে। র্যাব নির্যাতিতা মহিলাকে উদ্ধার করেছে এবং ঝটিকা অভিযান চালিয়ে শরীয়তপুর থেকে কুকর্মের প্রধান হোতা ধর্ষক আশিককে গ্রেফতার করেছে। ধর্ষকের স্বীকারোক্তি, ধর্ষিতার জবানবন্দী, তার স্বামীর সাক্ষ্য এবং র্যাবের তদন্ত ও পর্যবেক্ষণের মধ্যে কোনো অমিল নেই। কিন্তু ওই ঘটনা নিয়ে পুলিশ যা বলছে তা শোনার পর ঘৃণায় সারা শরীর রি রি করে উঠছে। বারবার মনে পড়ছে মেজর সিনহা হত্যার নির্মমতা এবং ওসি প্রদীপের দানবীয় আচার-আচরণের কথা। সেই সময়ে দায়িত্বেরত এসপি অথবা টেকনাফের জনপ্রিয় কাউন্সিলর একরাম হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের উর্দিধারী অমানুষদের কথাও মনে পড়ে যাচ্ছে।
কক্সবাজারের সাম্প্রতিক আলোচিত ধর্ষণকাণ্ডের হোতাদের সম্পর্কে যা জানা গেছে তা হলো- এদের প্রায় ৩০-৪০ জনের একটি ‘সিন্ডিকেট রয়েছে’। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়া এবং থানা পুলিশ ও প্রশাসনের দুর্নীতিবাজদের সাহায্যে গত ১০-১২ বছর ধরে এই সিন্ডিকেটটি বাংলাদেশের ভূ-স্বর্গ খ্যাত কক্সবাজারকে নরককুণ্ডে পরিণত করে ফেলেছে। খুন-ধর্ষণ-রাহাজানি-চাঁদাবাজি, জুলুম-অত্যাচার, মাদক সেবন, মাদকপাচার থেকে শুরু করে এহেন কুকর্ম নেই যা এই সিন্ডিকেট করে না। ফলে এদের আয় রোজগার, ভোগবিলাস এবং দাপটের সাথে দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মচারী ও দুরাচারী এবং রাজনীতিবিদদের যে গভীর সংযোগ রয়েছে তা নিদ্বির্ধায় বলা যায়। কক্সবাজারের মতো ছোট্ট একটি জেলা শহরে আরব্যরজনীর ৪০ চোরের আদলে একটি সিন্ডিকেট ১০-১২ বছর ধরে দুধ-কলা খেয়ে এমনভাবে কেন বেড়ে উঠল তা যদি আপনারা বুঝতে চান তবে আরিচার দৌলতদিয়ার যৌনপল্লীর যৌনকর্মী এবং ঢাকার ভ্রাম্যমাণ যৌনকর্মী, হিজড়া ও ভিক্ষুকদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করতে হবে।
আপনি যদি ঢাকার ভ্রাম্যমাণ পতিতাদের সাথে কথা বলেন তবে জানতে পারবেন, কারা জোর করে তাদের দেহ ভোগ করে এবং বিনিময়ে টাকা পয়সা তো দেয়ই না; বরং তাদের ভ্যানিটি ব্যাগে থাকা টাকাগুলোও হুঙ্কার দিয়ে ছিনিয়ে নেয়। একইভাবে আপনি যদি পঙ্গু ভিক্ষুকদের সাথে কথা বলেন, তাহলে জানতে পারবেন, তাদের ভিক্ষার বেশির ভাগ ছিনতাইকারী কারা এবং সেসব ছিনতাইকারী ভিক্ষুকের ধন লুণ্ঠন করে কিভাবে বাড়ি-গাড়ি, ঘড়ি-আইফোন কেনে এবং ছেলেমেয়ে-বউকে দেশে-বিদেশে ঘুরিয়ে আনে। একইভাবে দৌলতদিয়ার যৌনপল্লীর অসহায় যৌনকর্মীদের অর্থ যারা গ্রাস করছে তাদের পোশাক-আশাক ও ছুরত দেখলে আপনি বুঝতেই পারবেন না যে, পোশাকের আড়ালে কত্তোবড় রাক্ষস হা করে আছে।
উপরোক্ত বিষয়ের আলোকে যদি কক্সবাজারের ধর্ষণ ঘটনা পর্যালোচনা করেন তবে অনায়াসে কতগুলো প্রশ্ন আপনার মনে চলে আসবে। প্রথমত, র্যাব কেন ধর্ষিতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে এবং পুলিশ কেন ধর্ষিতার চরিত্র নিয়ে আকার ইঙ্গিতে উল্টাপাল্টা কথা বলছে। দ্বিতীয়ত, দুর্বৃত্তরা দুই দফা পালাক্রমে ধর্ষণের পর কেন ধর্ষিতার কাছে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করল। তাদের পাশবিকতা কতটা নিম্নস্তরে গেছে যার কারণে ধর্ষিতার কাছে উল্টো চাঁদা দাবি করে তারা ভুক্তভোগীকে আটকে রাখার হিম্মত দেখাতে পারে। তৃতীয়ত, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে- দুর্বৃত্তরা নিয়মিত ধর্ষণকাণ্ড ঘটায় এবং চাঁদাবাজি করে। তারা তাদের গডফাদারকে চাঁদার অংশ না দিয়ে এবং মাঝে মধ্যে গড়ফাদারের রঙমহলে অপহৃত সুন্দরীদের উপহার না পাঠিয়ে কোনোভাবেই গত এক যুগ ধরে তারা অব্যাহতভাবে এই কুকর্ম করতে পারত না। এখন প্রশ্ন হলো- এসব দুর্বৃত্তের গডফাদার কে বা কারা এবং সেই গডফাদাররা কোথায় অবস্থিত?
বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র্যাব যদি আলোচিত ধর্ষণ মামলা তদন্ত করতে গিয়ে উল্লিøখিত বিষয়াদি আমলে নিয়ে গডফাদারদের খোঁজ করে এবং রঙমহলে তল্লাশি চালায় তবে কত উর্দি যে মনুষ্য বিষ্ঠায় একাকার হয়ে পড়বে এবং রঙমহলের মেঝেতে ধর্ষিতার রক্তের সাথে গডফাদারদের রক্তবমির মিশ্রণ ঘটবে তা কেউ বলতে পারবে না। বাংলাদেশের ভূ-স্বর্গে যারা পর্যটন সুখ অনুভবের জন্য যান তাদের মধ্যে কতজন যে দুর্বৃত্তদের খপ্পরে পড়েছেন এবং দুর্বৃত্ত গড়ফাদারদের দ্বারা লাঞ্ছিত হয়েছেন তা হয়তো মানসম্মানের ভয়ে অনেকে চেপে গেছেন। কিন্তু প্রকৃতির রুষ্টতায় চেপে যাওয়া অপমান মাঝে মাঝে বিস্ফোরিত হয়ে সমাজকে যে কিভাবে নাড়া দেয় তার একটি বাস্তব ঘটনা আমরা দেখতে পেলাম সাম্প্রতিক ধর্ষণকাণ্ডের মাধ্যমে।
আমাদের দেশের পর্যটনশিল্প এমনিতেই অভিভাবকহীন। সরকারের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের এমন কোনো তদারকি নেই, যার ফলে পর্যটকরা ন্যায্য মূল্যে দেশের পর্যটন স্পটগুলোর হোটেল-মোটেলে অবস্থান করতে পারেন এবং খাবারদাবার খেতে পারেন। আমাদের দেশের হোটেল-মোটেলের আবাসন খরচ এবং খাবারদাবারের দাম দেখলে চোখ কপালে উঠতে বাধ্য। ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, দিল্লি, আগ্রা, জাকার্তা-বালি অথবা মক্কা-মদিনার মতো শহরে পাঁচতারা মানের হোটেলে এক রাত্র থাকার জন্য ক্ষেত্রবিশেষ দুই হাজার টাকা থেকে শুরু করে আট-দশ হাজার টাকা ব্যয় হয়। অন্য দিকে বাংলাদেশের বান্দরবান, শ্রীমঙ্গল, সিলেট অথবা কক্সবাজারের যেসব হোটেলের এক রাত্রের ভাড়া ১৫ হাজার টাকা হাঁকা হয় সেসব হোটেল যদি উন্নত কোনো দেশে হতো তবে সংশ্লিষ্ট দেশের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের ম্যাজিস্ট্রেটরা হোটেল মালিককে নির্ঘাত জেলে ঢোকাতেন। আর ইসলামী হুকুমতের দেশ হলে হোটেলের সামনের রাজপথে ফেলে লোভী মালিকদের প্রকাশ্যে বেত্রাঘাত করা হতো।
হোটেল ব্যবসার সাথে জড়িত কয়েকজন প্রভাবশালী মালিককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কেন তারা এত বেশি অর্থ আদায় করে থাকেন? আমি তাদের বলেছিলাম, যেখানে ব্যাংককের সবচেয়ে দামি হোটেল দুসিতজানি বা সাংগ্রিলার ভাড়া ১০০ ডলারের মধ্যে এবং বিশেষ সময়ে তারা ডিসকাউন্ট দিয়ে দৈনিক ভাড়া ২৫ ডলারে নামিয়ে আনে, সেখানে শ্রীমঙ্গলের একটি হোটেলের রুমভাড়া কেন ১৫ হাজার টাকা হবে? আরো জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী, ধানমন্ডিতে অনেক পাঁচতারকা মানের রেস্টুরেন্ট রয়েছে যারা দুপুর কিংবা রাতের বুফে আয়োজন করে সেখানে শতাধিক আইটেম থাকে এবং সেসব বুফে ডিনার বা লাঞ্চের মূল্য সাকুল্যে জনপ্রতি মাত্র ৫০০ থেকে হাজার টাকা। অন্য দিকে তথাকথিত ঢাকার বাইরের ভুয়া পাঁচতারকা হোটেলে ২০-২৫ পদের আইটেম দিয়ে মূল্য হাঁকা হয় জনপ্রতি আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা!
আমার উল্লিখিত প্রশ্নের কোনো সদুত্তর হোটেল মালিকরা দিতে পারেননি। কিন্তু তাদের অর্থপূর্ণ হাসি এবং নির্লিপ্ত ভাবসাব দেখে সেসব হোটেলের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আমার যে সন্দেহ হয়েছিল তা আপনাদের বলতে পারব না। তবে আপনারা যদি অতিমাত্রায় উৎসাহী হন তবে কিছুদিন আগে নারী কেলেঙ্কারির দায়ে বরখাস্ত হওয়া এবং জেলে যাওয়া জনৈক ডিআইজির নিশিরাতের কর্মকাণ্ডের খোঁজ নিলেই বুঝতে পারবেন, কিছু হোটেলের রুমভাড়া এত বেশি কেন। রুমের নিরাপত্তা, অতিথিদের নিরাপত্তা এবং নিজেদের সব কিছু ম্যানেজ করার জন্য তাদেরকে এত বেশি চাঁদা পরিশোধ করতে হয় যা ব্যাংকক-সিঙ্গাপুরের হোটেল মালিকদের দিতে হয় না। এসব দিক বিবেচনা করলে আপনি খুব সহজেই আন্দাজ করতে পারবেন, আমাদের পর্যটনশিল্প কিভাবে ত্রিমাত্রিক ধর্ষকদের খপ্পরে পড়ে আর্তচিৎকার করছে এবং আমরা সেই আর্তচিৎকারের মধ্যেই কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতের বেলাভূমিতে পা রেখে অথবা উত্তাল ঢেউয়ের মাঝে নিজেকে ছুড়ে দিয়ে স্বর্গসুখ অনুভবের চেষ্টা চালাচ্ছি।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা