বাধা দিলে বাধবে লড়াই
- ড. মাহবুব হাসান
- ২৪ ডিসেম্বর ২০২১, ২১:০০, আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৫:১৯
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একটি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন, ‘বাধা দিলে বাধবে লড়াই, সে লড়াইয়ে জিততে হবে’। না, ভাষাটা ঠিক এমন নয়, তবে তার বক্তব্যের সার অর্থ করলে এ-রকমই দাঁড়াবে। এটা ছিল গত শতকের ছয় এর দশকে বাম ঘরানার রাজনৈতিক দলগুলোর স্লোগানের ভাষা। বিশেষ করে চীনাপন্থী বিপ্লবীদের মুখে ছিল এই স্লোগান। এই স্লোগানের উৎস যেখানেই হোক, দেয়া হতো পাকিস্তানি শাসকদের উদ্দেশে। কারণ, সে সময় আমরা মনে করেছি, পাকিস্তানি সরকার আমাদের শোষণ করছে, বঞ্চিত করছে, আমাদের রাজনৈতিক অধিকার হরণ করছে, আমাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দমন করছে। আজো আমরা আমাদের রাজনৈতিক জীবনাচারে সেই সত্যই দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু দেশ তো আমরা স্বাধীন করেছি। নিজেরাই এখন শাসক ও শাসিত। উভয় তরফেই আমরা, মানে বাঙালিরা। আমাদের রাজনৈতিক-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে পাকিস্তানিরা নেই। তাদেরকে আমরা বিতাড়িত করেছি মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে।
কিন্তু যে বঞ্চনা ও শোষণের বিরুদ্ধে উত্তাল হয়েছিলাম আমরা গোটা ছয়ের দশকজুড়ে, সেই রাজনৈতিক কীর্তির যে স্বরূপ আমাদের স্মৃতিতে জেগে আছে, তা আজো অমলিন। সেই পরিবেশ ও সেই রাজনৈতিক সংস্কৃতি কেন স্বাধীনতার ৫০ বছরেও আমরা বহন করছি? কেন তা পরিবর্তিত হলো না? কেন রূপান্তরিত সত্যে পরিণত হলো না আমাদের ত্যাগ-তিতিক্ষা ও লক্ষ্য? আমরা কেবল কি ভূরাজনৈতিক স্বাধীনতা চেয়েছিলাম, নাকি এক শোষণহীন সাম্যময় সমাজ গঠনের অঙ্গীকার করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম, যাতে একটি সুখি সমৃদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়ার স্বপ্ন পুনর্গঠনের মাধ্যমে জাতিকে উপহার দেয়া যায়। সেই স্বপ্ন রয়ে গেছে সুদূর পরাহত এক স্বপ্নেরই শাখা হয়ে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমরা এটা খুব স্পষ্ট করে বলতে চাই, এভাবে দমন-পীড়ন করে, হত্যা করে, গুম করে কখনোই জনগণের যে ন্যায়সঙ্গত দাবি, তাদের যে অধিকার আদায় করার জন্য যে দাবি একটা গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য এবং সবচেয়ে বড় যে দাবি নিয়ে এখন যে আমরা আন্দোলন করছি, বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং তাকে বিদেশে পাঠানোর জন্য যে আন্দোলন করছি সেই আন্দোলনকে কখনোই দমন করা যাবে না (প্রথম আলো, ২৩ ডিসেম্বর ২০২১)।
এই বক্তব্যের পর কি আমরা বলতে পারব, দেশে ছয়ের দশকের, পাকিস্তানি দমন-পীড়নের অবসান হয়েছে? না, বলতে পারব না। এই অভিযোগ আজ যেমন বিএনপির, যখন আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে ছিল তখন বিএনপির বিরুদ্ধে একই অভিযোগ করেছিলেন আওয়ামী লীগ ও তার নেতারা। মূলত এই দলন-পীড়নের সংস্কৃতি নিহিত আছে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক প্যাটার্নের মধ্যে। আমাদের রাজনীতি পড়ে আছে পাকিস্তানি রাজনৈতিক প্যাটার্নে। যে সব বিশ্বাস ও রাজনৈতিক স্বপ্ন ও দলিল (সংবিধান) রচনা করেছি আমরা, তা তুলে রেখেছি পবিত্র আমানত হিসেবে। এর ব্যবহার এড়িয়ে চলা ও কখনো কখনো তাকে লঙ্ঘন করে চলেছেন রাজনীতিকরা। কিন্তু সে ব্যাপারে তারা এতটাই ক্যালাস যে এ নিয়ে কথাও বলা যায় না।
মহাসচিব প্রায় প্রতিদিনই স্পষ্ট করেই তার এবং দলের নীতিনির্ধারকদের কথামালা জনসমক্ষে বলে যাচ্ছেন। আমরা দেখতে পাচ্ছি, দেশে এখন করোনা মহামারীর পরে রাজনৈতিক অঙ্গন অনেকটাই সচল হয়ে উঠেছে। সুস্থ রাজনৈতিক চর্চা শুরু হয়েছে। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক মনন ও সততা-অসততা এতটাই ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও দলকেন্দ্রিক যে, দলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও প্রশ্নবিদ্ধ। এই কথাগুলো দেশের সব রাজনৈতিক দলের উদ্দেশেই বলা হলো।
ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির রশি এখন আওয়ামী লীগের হাতে। গত ১৩ বছর ধরে তারা রাজনীতির সিংহাসনে বসে উন্নয়নের জন্য যেসব রোল মডেলের মেগা প্রকল্প নিচ্ছেন এবং তা বাস্তবায়নের চেষ্টা চালাচ্ছেন, তাতে বোঝা যায় তারা গণতন্ত্র নয়, তারা ভালোবাসেন উন্নয়ন। কিন্তু উন্নয়নের মডেল যদি কেবল রাজধানীকেন্দ্রিক হয়, তা যদি কেবল শিক্ষিত নাগরিকদের সুবিধার জন্য হয়, তাহলে ৮০ শতাংশ শ্রমজীবী উৎপাদক (কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণী যারা গ্রামের মানুষ) কি বঞ্চিত হলো না, হচ্ছে না। আমি জানি সরকারি দলের লোকেরা বলবেন, আমরা তো সড়ক অবকাঠামো করছি গ্রাম স্তরেও, সেখানে তো ওই সব লোক সুবিধা ভোগ করছে। কিন্তু অনেক ব্রিজ যে তৈরির আগেই ধসে পড়েছে, অনেক সড়কে যে খানাখন্দের উন্নয়ন হয়েছে পথের গতিকে থামাতে, সেটা কে দেখে? কৃষকের জন্য গ্রামের উন্নয়ন কাঠামোর বৈচিত্র্যময় পরিকল্পনা কি করা হয়েছে। কৃষিকে কেন এক নম্বরের গুরুত্ব না দিয়ে অন্য বিষয়কে দেয়া হয়েছে। শিক্ষাকে কেন ঠেলে পেছনে দেয়া হয়েছে। শিক্ষা কারিকুলাম কেন চলমান উন্নয়ন ধারার এক নম্বরে জায়গা দেয়া হয়নি। প্রযুক্তির কথা স্বরগ্রামের উঁচুতে তুলে যারা বলেন দেশটা ডিজিটাল হয়ে গেছে, তারা কি বলতে পারেন গ্রামের লোকেরা কি কি ডিজিটাল সুযোগ পেয়েছে? বিদ্যুৎ কি সব গ্রামের মানুষ পেয়েছে? সব মানুষ কি ডিজিটাল ডিভাইস কেনার মতো আর্থিকভাবে সচ্ছল? তারা কি লেখাপড়া শিখেছে? তাদের লেখাপড়ার লেভেল কী?
আমরা জানি সরকারি দলের লোকেরা বলবেন তাদের তথ্য-উপাত্ত। তারা নানা রকম উদাহরণ ও পরিসংখ্যান দেবেন, কিন্তু বলতে পারবেন না, নিভৃত বাংলার হাজার হাজার গ্রামে কেন আজো কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয়নি। কেন প্রতিটি গরিবের শিশু স্কুলে যেতে পারে না। কেন তারা শিক্ষা থেকে এই ৫০ বছর পরও বঞ্চিত। কেন তাদের বঞ্চিত রেখে বিজয়ের ৫০ বছর পালিত হচ্ছে। গ্রামের লোকেরা তো জানে না যে, স্বাধীনতার ৫০ বছর আমরা পেরিয়ে এসেছি। জানে না, কারণ তাদের জানানোর জন্য যে শিক্ষা দেয়া দরকার ছিল, সরকারগুলো তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এটি কি গণমানুষের সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চনা নাকি রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কুফল? রাজনীতির জন্য, রাজনৈতিক অর্থনীতির জন্য, গণমানুষের প্রত্যাশা কায়েমের জন্য খুবই ভালো একটা পদক্ষেপ হতে পারত, শিক্ষাকে যদি আমরা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়ে তাদের সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে পারতাম।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস গত মঙ্গলবার যশোরে বলেছেন, ‘তারা আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না, এমন কি ঘরেও বসে থাকবে না। একতরফা নির্বাচন প্রতিহত করা হবে।
কথা তো মন্দ বলেননি। এই সরকার কোনো নির্বাচিত সরকার নয়, এই সরকার ভোটডাকাতি করে নির্বাচিত হয়ে জোর করে ক্ষমতায় বসেছে, এই সরকার অবৈধ- ইত্যাদি বলে আসছেন বহুদিন ধরেই। কিন্তু কোনো গণ-আন্দোলন গড়ে তুলেননি তারা। বলা যেতে পারে পারেননি। সেটা কি দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা নাকি রাজপথে ঘাম ঝরানোর কথা ভেবেই পিছিয়ে গিয়ে কথার রাজনীতিতে সীমিত থাকছেন? সেই সাথে সরকার যেসব ক্ষেত্রে ভয়ের সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে, সেই গুম, খুন, অপহরণ ইত্যাদিকে ভয় করছে? গণ-আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য চাই রাজনৈতিক সাহস। কিন্তু সেই রাজনৈতিক সাহস কি তারা নিজেদের ভেতরে লক্ষ করছেন? বেগম খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিয়ে যাওয়ার তদবির করছেন। সরকারের কাছে তদবির করে কোনো বিরোধী রাজনৈতিক দল কি তাদের প্রত্যাশিত ফল পেয়েছে? উপমহাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি হচ্ছে জনসমাবেশের মাধ্যমে সরকারকে বোঝানো যে, তারা প্রস্তুত। বেশ কয়েকজন আওয়ামী নেতাও সেই বাণীই করেছেন। বলেছেন, আপনারা কি সত্যই বেগম জিয়ার মুক্তি চান, তাহলে ঘাম ঝরাতে হবে। অর্থাৎ রাজপথ গরম করে তুলতে হবে। বাসায় বসে, অফিসে বসে বা সংবাদ সম্মেলন করে কোনো ফল হবে না। আপনারা কি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শোনেননি? তিনি তো স্পষ্টই বলেছেন, তিনি যা করেছেন তা সর্বোচ্চ মানবিকতা, তার পক্ষ থেকে। একজন কনভিকটেড আসামিকে এর চেয়ে বেশি কিছু দিতে পারবেন না তিনি। তিনি আমাকে মারতে চেয়েছিলেন, আমি তাকে বাসায় এনে চিকিৎসা নেয়ার সুযোগ দিয়েছি। আর কি চান তিনি? আমরা দেখছি, নানাভাবেই তাকে বিদেশে পাঠিয়ে চিকিৎসার চেষ্টা করছেন বিএনপি নেতারা। সরকার যে বেগম খালেদা জিয়ার ওপর রুষ্ট সেটা তো বহুকালের ঘটনা। এ দেশে প্রকৃত গণতন্ত্রের যে সামান্য সুগন্ধিটুকু উৎপাদিত হয়েছিল, তা বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলেই। সেই গণতান্ত্রিকতার সূত্রেই আমরা কয়েকটি নির্বাচন সুষ্ঠু হতে দেখেছি। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সেই ব্যবস্থা বাতিল করে আওয়ামী লীগ। কারণ তারা গণতন্ত্রকে দলীয় বন্দিশালায়ই রাখতে চান। দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না এ দেশে। কারণ আমাদের রাজনীতিকদের মধ্যে গণতান্ত্রিক শিক্ষা, কালচার, পরমতসহিষ্ণুতা, শিষ্টাচার, জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে যে আশ্রয় ও লালন করে বড় করতে হয়, সেই বিদ্যাবুদ্ধি-জ্ঞান নেই। তারা কেবল দলীয় রাজনৈতিক ঘুলঘুলির মধ্যে মাথা সেঁধিয়ে দিয়ে নিজেদের ক্ষমতায় থাকার ও ক্ষমতায় যাওয়ার কসরতে ব্যস্ত।
আমাদের রাজনৈতিক কালচারই হচ্ছে এন্টি ডেমোক্র্যাসির। দেশের কোনো রাজনৈতিক দলেই গণতান্ত্রিক চেতনা নেই। কোনো দলের মধ্যেই ন্যায় ও কল্যাণ চিন্তা নেই। জনগণও নেই দলগুলোর রাজনৈতিক কীর্তিকলাপে। রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের সমন্বয়ে গঠিত জনতাই তাদের চিহ্নিত এবং কথিত জনগণ। এদেরই পকেটে ভরে নিয়ে তারা বুক ফুলিয়ে হাঁটেন। এই যে দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সাধারণ গরিব মানুষ, যাদের বেশির ভাগেরই নুন আনতে পান্তা ফুরানোর গল্পে ঠাসা, সেটা ক্ষমতাসীন দল স্বীকার করবে না। কারণ, তারা বলে, ফসলের বাম্পার ফলনের পর সেই গরিবরা পান্তা ফুরানোর গল্পে আটকে থাকবে কেন? সত্যই বলে তারা। যদিও পরিসংখ্যান এটা বলে না। পরিসংখ্যান বলে, এশিয়ার মধ্যে চীনের পরই বাংলাদেশ বেশি চাল আমদানি করেছে।
গরিব মানুষের দুঃখ-কষ্ট ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজনীতিকরা বোঝেন না। বুঝলেও তাদের জন্য কিছু করার কথা ভাবেন না। কারণ, তাদের উন্নয়নের জন্য মেগা মেগা প্রকল্প নিলেও তা বাস্তবায়নের দীর্ঘসূত্রতা আমাদের কৃষি সেক্টরকে চোখ ধাঁধানো রূপ এনে দেয়া যায় না। এর জন্য চাই রাজধানীতে থাকা সুবিধাভোগী অপরচুনিস্ট শিক্ষিত মানুষ, যাদের কাজই হলো সুযোগ সন্ধান করা, দেশের মানুষের জন্য তারা মোটেই ভাবিত ও কাতর নয়। এদেরই সন্তানরা ১৯৭১ সালে জন্ম নিয়েও মুক্তিযোদ্ধা হতে পেরেছে। বর্তমান সরকার সেই নতুন মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্মের হোতা, নাকি অন্য কেউ। বিএনপি? নাকি জাতীয় পার্টি?
দোষারোপের রাজনীতির অন্ধ গলি থেকে বেরিয়ে দেখুন দেশের প্রকৃত অবস্থা। গণমানুষের চাপাকান্না শোনার জন্য আমরা রাজনীতিকদের আহ্বান জানাই। কারণ তারাই জাতির দিকনির্দেশক, তারাই জাতির ভাগ্যোন্নয়নের রূপকল্প নির্মাতা। দায়িত্ব তাদেরই। আমরা তাদেরই অপেক্ষায়।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা