২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

চিরন্তন কৃতজ্ঞতা-অকৃতজ্ঞতাবোধ ও ভারত

-

এই সেদিন ৬ ডিসেম্বর ২০২১ ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উৎসব হয়ে গেল। উভয় পক্ষ দাবি করছে, দু’দেশের সম্পর্ক অতি উষ্ণতায় পৌঁছেছে। অতি উষ্ণতায় বরফ গলে, পানি হাওয়া হয়ে উবে যায়। এই মুহূর্তের বাস্তবতাও তাই। বিজয়ের ৫০ বছর উৎসবে যোগ দিয়ে ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশকে তারা সব সময় সমর্থন করে যাবেন। ক‚টনীতির মারপ্যাঁচে যে মেসেজটি তিনি দিয়েছেন তা হলো, আপামর, সাধারণের, শাশ্বত ও স্বাভাবিক বাংলাদেশকে তারা সমর্থন করেন না। সমর্থন করেন সেই বাংলাদেশকে যে বাংলাদেশ তাদের কথিত স্বাধীনতার চেতনাকে ধারণ করে।

খোলামেলা বললে ভালো দেখায় না বলে তিনি কথাটি ঘুরিয়ে বললেন। বাংলাদেশের মানুষ স্বব্যাখ্যাত মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী একটি দলকেই চেনে, আর তা হলো, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তারা কথায় কথায় উঠতে-বসতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে। আর বলাই বাহুল্য, এই চেতনা ১৯৭১ সালে ভারত থেকে আমদানিকৃত চেতনা। ওই সব আরোপিত চেতনার সাথে বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের সম্পর্ক নেই। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার তথা মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনার কথা ঘোষণায় বলা হয়েছিল, তা ছিল, ‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিতকরণের ঘোষণা।’
শুধু রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য স্বাধীনতার ঘোষণাকে রূপ-রস-গন্ধ দিয়ে তারা পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করেছে। এমনকি সংবিধানে অন্য রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর কিছু না করার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। প্রকারান্তরে এটি যে বৃহৎ প্রতিবেশীকে সন্তুষ্ট করার জন্য করা হয়েছে, তা সহজেই বোধগম্য। অতিসাম্প্রতিককালে এই সম্পর্কের জটিল ও কুটিল সমীকরণ মানুষ প্রত্যক্ষ করছে। এরই প্রতিধ্বনি লক্ষ করা গেছে বাংলাদেশের একজন প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবী, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, সাবেক সচিব ও মুক্তিযোদ্ধা আকবর আলি খানের কণ্ঠে।

বাংলাদেশের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে গত সোমবার রাজধানীর একটি হোটেলে একটি গবেষণা সংস্থা আয়োজিত সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, চিরন্তন ও কৃতজ্ঞতাবোধ পৃথিবীর কোথাও নেই। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য ভারতের কাছে আমরা অবশ্যই কৃতজ্ঞ; কিন্তু তাদের কাছে আমাদের চিরকৃতজ্ঞ থাকা উচিত নয়। এ কথা কিন্তু ১৯৭১ সালে শোনা যেত না। সম্প্রতি উঠেছে। আমি সোজা জবাব দিতে চাই। ভারতও জানে, বাংলাদেশও জানে যে, চিরন্তন কৃতজ্ঞতাবোধ পৃথিবীর কোথাও নেই। এটি ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব নয়। এটি জাতির সাথে জাতির, রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের বন্ধুত্ব। রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের বন্ধুত্ব তখনই হবে, যখন আমাদের স্বার্থ অভিন্ন হবে। আর যদি স্বার্থের ক্ষেত্রে সঙ্ঘাত থাকে, তাহলে চিরন্তন কৃতজ্ঞতাবোধ কোনোদিনই হবে না। আকবর আলি খান তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে আমার দেখা হয়েছিল। প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সাথেও দেখা হয়েছিল। তারা স্পষ্টভাবে বলেছেন, তোমরা স্বাধীনভাবে বাঁচো। সেটিই আমরা চাই। তারাও কখনো কল্পনা করেনি যে, বাংলাদেশ কারো কাছে চির পদানত হয়ে থাকবে। যারা এ ধরনের চিন্তা করেন, তারা কল্পনার জগতে বসবাস করছেন।’ মূলত আকবর আলি খান পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের ও বাস্তবায়নের একটি মৌলিক দিকের প্রতি গোটা জাতির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।

ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী (পরে প্রধানমন্ত্রী) লর্ড পামারস্টোন বলতেন, ‘গ্রেট ব্রিটেন ডাজ নট হ্যাভ এনি পার্মানেন্ট ফ্রেন্ড ওর ফো, বাট হেজ গট পার্মানেন্ট ইন্টারেস্ট।’ এই স্থায়ী স্বার্থকে পররাষ্ট্রনীতিবিশারদরা ‘ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট’ বা জাতীয় স্বার্থ বলে অভিহিত করে থাকেন। বিশেষ করে রিয়েলিস্ট বা বাস্তববাদী তাত্তি¡করা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিন্যাসে এই প্রপঞ্চকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। বিশ্ববিশ্রæত তাত্তি¡ক হেন্স মর্গেনথু বলেন, জাতীয় স্বার্থ শব্দটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ‘পাবলিক ইন্টারেস্ট’ বা জনস্বার্থের প্রতিশব্দ। যা অভ্যন্তরে জনস্বার্থ রূপে বিবেচিত। এর মর্মার্থ হচ্ছে, অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক নির্ণয়ে নিজ দেশের স্বার্থের অনুক‚লে উত্তম সিদ্ধান্ত গ্রহণ। পরস্পর বিপরীত স্বার্থের সঙ্ঘাতে সংক্ষুব্ধ বিশ্বে রাষ্ট্রের স্বার্থ সংরক্ষণ সহজ বিষয় নয়। বৈদেশিক চাপ রয়েছে। রাষ্ট্রের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এমন কিছু বিষয় রয়েছে যা অনতিক্রম্য।

ভৌগোলিক অবস্থান এর মধ্যে একটি। এমনিতেই বলা হয়, রাষ্ট্র তো প্রতিবেশী পরিবর্তন করতে পারে না। ভৌগোলিক অবস্থানের তাৎপর্য অনেক। নগররাষ্ট্র বা সমুদ্ররাষ্ট্র সিঙ্গাপুর ক্ষুদ্র হলেও তার কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আবার রুশ ফেডারেশন উষ্ণ পানির সান্নিধ্য না থাকার কারণে বাণিজ্যে যথাযথ ভ‚মিকা রাখতে পারে না। পোল্যান্ডের অবস্থানই দেশটিকে বারবার উলুখাগড়ায় পরিণত করেছে। নেপাল দুই আঞ্চলিক শক্তির টানাপড়েনে ভারসাম্য রক্ষায় হিমশিম খায়। এর কেতাবি নাম ‘বাফার স্টেট’। এই ভৌগোলিক অবস্থান আবার ন্যাশনাল সিকিউরিটি বা জাতীয় নিরাপত্তার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। পররাষ্ট্রনীতিবিশারদরা একমত যে, নির্দিষ্ট সরকারের যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, ক‚টনৈতিক দক্ষতা ও নেতৃত্বের ওপর জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণ এবং জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের বিষয়টি নির্ভর করে। এই তত্ত্বগত কাঠামোর ভিত্তিতেই বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বিগত ৫০ বছরের হিসাব-নিকাশ করা যায়।

সন্দেহ নেই, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের আলোকেই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক বিবেচ্য। দু’টি পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি বিবেচনার অপেক্ষা রাখে। প্রথমত, ভারত-পাকিস্তানের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট। ভারত ও পাকিস্তান চিরবৈরী দেশ। জন্ম থেকেই বৈরিতার আবর্তে সে সম্পর্ক নির্ণীত। ফলে বাংলাদেশের মানুষের স্বাধিকার অস্বীকার, গণতান্ত্রিক রায়কে অস্বীকার ও গণহত্যার বিষয়টি ভারতের হস্তক্ষেপের আগমনে ফেলতে চায় পাকিস্তান। কিন্তু ক্রমেই জাগ্রত বিশ্ববিবেক, ভারতের ক‚টনৈতিক তৎপরতা এবং অবশেষে রক্ষক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের বিজয়কে অনিবার্য করে তুলে। বাংলাদেশের এই অভ্যুদয় স্নায়ুতাড়িত পৃথিবীতে বিশেষত এই উপমহাদেশে নতুন সমীকরণের জন্ম দেয়। চিরায়ত মার্কিন-পাকিস্তান প্রভাব বলে শূন্যের কোঠায় দেয়। তৎকালীন ভারত-সোভিয়েত সম্পর্ক বাস্তবতা লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ ধরনের চুক্তি মূলত সামরিক চুক্তি হলেও সোভিয়েতরা বরাবরই একে শান্তি ও মৈত্রীর খোলস দেয়। স্বাধীনতার পরবর্তীকালে ভারতে সাথে বাংলাদেশের অনুরূপ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তাহলে সমীকরণটি দাঁড়ায়, মস্কো, দিল্লি, ঢাকা এক্সিস। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত এই বাস্তবতার আলোকেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষণ করতে হয়।

১৯৭১ সালে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ভারতের অনিবার্য ভূমিকাকে ছোট করে দেখা যাবে না। ভারত বাংলাদেশের জনগণকে আশ্রয়, খাদ্য, চিকিৎসা দিয়েছে। এক কোটি উদ্বাস্তুর দায়ভার বহন করেছে। মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্রশস্ত্র দিয়েছে। তাদের সেনারা রক্ত দিয়েছে। মূলত মুক্তিযুদ্ধ ছিল ভারতকেন্দ্রিক। ৯ মাস অল্পসময়; কিন্তু ঘটনাবহুল। তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। এ সময়কালে খুব স্বাভাবিকভাবেই অস্থায়ী সরকারকে কাক্সিক্ষত অথবা অনাকাক্সিক্ষত পরিবেশ পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়েছে। প্রকাশ্য ও গোপন অনেক চুক্তি স্বাক্ষর অস্বাভাবিক কিছু নয়। এর মধ্যে বহুল আলোচিত ২৫টি গোপন চুক্তি। অসমর্থিত অথচ প্রকাশিত এ চুক্তির ধারামতে, বাংলাদেশ ভারতের কাছে আবদ্ধ-নিবদ্ধ থাকার কথা। গুজবটি এরকম ছিল যে, সমাগত ২৫ বছর বাংলাদেশে সব কিছু পরিচালনা করবে ভারত। অথচ এসব গুজবকে উল্টে দিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ ত্যাগ করে। সহসা সচকিত হওয়ার মতো এ সিদ্ধান্তের পটভ‚মি কী? স্বীকৃত সত্যটি এই যে, শেখ মুজিবুর রহমানের সাহসী সিদ্ধান্তের কারণে তাদের চলে যেতে হয়েছিল।

বিভিন্ন তথ্যবিবরণী, স্মৃতিকথা ইত্যাদি থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু প্রথম সাক্ষাতেই ইন্দিরা গান্ধীকে সেনা প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়েছিলেন। দৃশ্যমানভাবে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরপরই কলকাতায় যে জনসভা হয়, তাতে মিসেস গান্ধীর উপস্থিতিতেই তিনি সেনা প্রত্যাহারের প্রসঙ্গটি অন্যভাবে উল্লেøখ করেছিলেন। বিষয়টি ছিল সংবেদনশীল। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন, বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করা না হলে স্বীকৃতি অর্জন সহজ হবে না। বাস্তবতা ছিল এই যে, প্রত্যাহারের অল্প দিনের মধ্যে বাংলাদেশ বেশির ভাগ দেশের স্বীকৃতি লাভ করে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রথম নেতিবাচক ঘটনাটিও সেনাসংশ্লিষ্ট। ভারতীয় সেনাবাহিনী যখন আত্মসমর্পণ ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র ও সম্পদাদি ভারতে নিয়ে যায় তখন জনমত প্রথমবারের মতো বিরূপ হয়। মেজর জলিল এরকম একটি বিরূপ পরিস্থিতিতে গ্রেফতার হন।

বাংলাদেশের জনমনস্তত্ত¡ বলা হয়, ‘দে ডোন্ট অ্যাক্ট বাট রিঅ্যাক্ট’। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও অপরাধের মোকাবেলায় মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে জনগণ ভারতীয় সেনাবাহিনীকে স্বাগত জানিয়েছে; কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শেষ হতে না হতেই জনমত বিরূপ হয়ে ওঠে। বসন্ত চ্যাটার্জি মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পরেই বাংলাদেশ সফর করেন। তার গ্রন্থটির নাম ‘ইনসাইড বাংলাদেশ’। এতে তিনি জনগণের ভারতবিরোধী মনোভাব তুলে ধরেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর উপদেষ্টা মুসকুন্দ দুবে লিখিত ‘নাইনটিন সেভেনটি ওয়ান অ্যান্ড বিয়ন্ড’ গ্রন্থেও এর প্রতিফলন ঘটে। ভারতীয় জনমতেও প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। আচার্য কৃপানলি তখন বলেছিলেন, ‘উসকা বাপ এক পাকিস্তান বানায়া, লেকিন উসকা লারকি দো পাকিস্তান বানায়ে তা’। বাংলাদেশ থেকে সেনা প্রত্যাহার ভুল ছিল বলে পরবর্তীকালে উচ্চপর্যায়ের অবসরপ্রাপ্ত সেনানায়ক ও রাজনীতিবিদরা মন্তব্য করেন। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু যখন ১৯৭৪ সালে ভারতের বিরোধিতা সত্তে¡ও লাহোরে ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দান করেন, তখনো ভারতীয় গণমাধ্যম ও সুশীলসমাজ বিরূপ মনোভাব দেখায়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা বিধানে ব্যর্থতার জন্যও অনেকে ভারতীয় গোয়েন্দা অ্যাজেন্সিগুলোকে পরোক্ষভাবে দায়ী করেন। অবশ্য নিজ রাষ্ট্রিক দায়দায়িত্বের চেয়ে অন্যদের দায় বেশি নয়।

১৯৭৫ সালে বিয়োগান্তক পরিণতির পর উপমহাদেশের রাজনৈতিক সমীকরণে পরিবর্তন সূচিত হয়। বাংলাদেশ দিল্লি-মস্কো এক্সিস থেকে বেরিয়ে আসে। ওয়াশিংটনমুখী পররাষ্ট্রনীতি অনুসৃত হতে থাকে। পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি পায়। মুসলিম জাহানের সাথে বিশেষ সম্পর্ক স্থাপিত হয়। খন্দকার মোশতাক আহমেদ ১৯৭৫-এর পরিবর্তনের পর ভারতকে আশ্বস্ত করতে সক্ষম হয় বলে ক‚টনৈতিক মহল মনে করে। ভারত গভীর প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও সংযমের নীতি অনুসরণ করে। জিয়াউর রহমানের সময়কালে ভারত ও বহির্বিশ্বের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি অনুসৃত হয়। জিয়া পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করেন। সার্ক গঠনে ভারত সহযোগিতা লাভ করেন। এরশাদ আমলে কমবেশি ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করা হয়। ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার সরকার ক্ষমতায় এলে জিয়ার ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতির প্রত্যাবর্তন ঘটে। ১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ভারসাম্যের ব্যতিক্রম ঘটে। আওয়ামী লীগ সরকার দিল্লিমুখী পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণে সচেষ্ট হয়। অবশ্য এ ক্ষেত্রে তারা সংযম ও সতর্কতার পরিচয় দেয়। ২০০১ সালে আবার বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এলে পুনরায় ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি পরিলক্ষিত হয়।

২০০১ সালে পৃথিবীব্যাপী ঝঞ্ঝা সৃষ্টিকারী নাইন-ইলেভেনের ঘটনা ঘটে। সন্ত্রাসীরা মার্কিন টুইন টাওয়ার ধ্বংস করে। মার্কিন সেনাসদর পেন্টাগনও আক্রান্ত হয়। এটি ছিল ১৭৭৬ সাল থেকে স্বাধীনতা লাভের পর মার্কিন মূল ভূখণ্ডে কোনো আক্রমণ। অবশ্য ১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়কালে মার্কিন নৌসদর পার্ল হার্ভারে জাপানিরা বোমাবর্ষণ করে। নাইন-ইলেভেনের ঘটনা গোটা বিশ্বে যুদ্ধাবস্থার সৃষ্টি করে। আক্রান্ত হয় আফগানিস্তান। বাংলাদেশে তখন জামায়াত-সমর্থিত বিএনপি সরকার থাকায় মার্কিনিদের বিরূপ দৃষ্টির সম্মুখীন হয়। এ সময় বাংলাদেশে বাংলাভাই ও জেএমবিসহ কিছু সন্ত্রাসী উৎপাত লক্ষ করা যায়। সরকার উৎখাতে ভারত-মার্কিন যৌথ রণকৌশল গ্রহণের কথা শোনা যায়। বাংলাদেশের ৬৩ জেলায় বোমা বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটে। সরকারের সময়কাল শেষে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অরাজকতার সুযোগে সেনা হস্তক্ষেপ ঘটে।

সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠায় মার্কিন দূতাবাস তথা ‘টুয়েসডে গ্রুপ’ বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ভারত সামরিক সরকারকে সার্বিক সমর্থন দেয়। সেনাবাহিনীপ্রধান দিল্লি সফর করলে তাকে ছয়টি ঘোড়া উপহার দেয়া হয়। অনেকে এই ঘোড়া দেয়াকে প্রাচীন প্রথা ‘অশ্ব মেধযজ্ঞ’ বলে উপহাস করে থাকেন। যা হোক, ২০০৮ সালের নির্বাচনে ভারত-মার্কিন সমর্থিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ‘ইসলামী মৌলবাদ’ দমনে কঠোর নীতি গ্রহণ করা হয়। সন্ত্রাস দমনে জিরো টলারেন্স অনুসৃত হয়। ২০১৪ সালে আরেকটি জাতীয় নির্বাচন সমাগত হলে ক্ষমতাসীন সরকার জনবিরূপতার সম্মুখীন হয়। নির্বাচন প্রাক্কালে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ একরকম প্রকাশ্যে বাংলাদেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদ পরবর্তীকালে এ তথ্য ফাঁস করেন। একই রকমভাবে ২০১৮ সালে যখন আরেকটি নির্বাচন সমাগত হয়, তখন অনৈতিকভাবে সরকার নির্বাচনটি করিয়ে নেয়। প্রচ্ছন্নভাবে ভারত সরকারকে স্বীকৃতি ও সমর্থন দিয়ে যায়। বিগত ১৩ বছর ধরে একই ধারার পররাষ্ট্রনীতি অনুসৃত হচ্ছে। সার্ক অকার্যকর হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ভারতের সাথে বহুমুখী সমস্যার খুব কমই এ সময়ে সমাধান করতে পেরেছে।

মিত্রতার দাবি সত্তে¡ও সমুদ্রসীমা নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হতে হয়েছে। ২০১৫ সালে ইতোমধ্যে অবশ্য স্থলচুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে ছিটমহল সমস্যার সমাধান হয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু বেরুবাড়ি হস্তান্তর করে ছিলমহল সমস্যা সমাধানের সূচনা করেন। পরে ভারতীয় পার্লামেন্ট সুপ্রিম কোর্টের মামলার দোহাই দিয়ে চুক্তিটি নবায়নে অস্বীকৃতি জানায়। বিগত এক যুগে উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রী সফর বিনিময় করেছেন। অনেকগুলো বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমানকালের বড় সমস্যা, রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু সমাধানে ভারতের দৃঢ় সমর্থন পাওয়া যায়নি। তিস্তাসহ ৫৪টি নদীর পানি বণ্টনের সুরাহা হয়নি। প্রায় প্রতিদিন বাংলাদেশী নাগরিকের রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে সীমান্ত। বাণিজ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বাংলাদেশের প্রয়োজনে ভারত পেঁয়াজ রফতানিতেও অনীহা দেখায়। সর্বশেষ নেতিবাচক কোভিড-১৯-এর জন্য প্রতিশ্রুত টিকাদানে ব্যর্থতা।
এরকম হাজারো সমস্যায় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আকীর্ণ। সাম্প্রতিককালে দুই দেশের জনমনে সাম্প্রদায়িকতার বিষয়টি প্রবল হয়ে উঠেছে। ভারতের মোদি সরকার অনুসৃত মুসলিম স্বার্থবিরোধী নীতিও কার্যক্রম বাংলাদেশের জনমনে প্রবল ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অতিসম্প্রতি একটি বিদেশী পত্রিকার সাথে বলেছেন, সাম্প্রদায়িকতা দু’দেশের সম্পর্কের ব্যাপারে প্রভাব রাখছে। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সীমান্তে হত্যা বন্ধ না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। দু’দেশের সম্পর্ক এর বাইরেও চীনের সাথে ব্যাপক অর্থনেতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের কারণে টানাপড়েনের সৃষ্টি হয়েছে। দ্বৈধতার সৃষ্টি হয়েছে সন্দেহ নেই। রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহল মনে করে, রাজনৈতিক ক্ষমতার স্বার্থে বর্তমান সরকারের ভারতের কাছে ফিরে যাওয়া ব্যতীত গত্যন্তর নেই। কারণ ক্ষমতাই সম্পর্কের নিয়ামক।

বাংলাদেশের জনগণ তথা বিরোধী দল সবসময় বলে আসছে, ভারতের সাধারণ মানুষের সাথে তাদের শত্রæতা নেই। সাম্প্রদায়িকতা এখানে অথবা সেখানে সাধারণ মানুষের সমর্থনপুষ্ট নয়। একটি বিশেষ মহল এই সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প লালন করছে। একজন সত্যিকার ধার্মিক ব্যক্তি যেমন সাম্প্রদায়িক হতে পারেন না, তেমনি কোনো ধর্মও হিংসা-প্রতিহিংসার কারণ হতে পারে না। সত্যিকার মানবিকতা ও নৈতিকতা অনুসৃত হলে দু’দেশের সাধারণ মানুষই উপকৃত হবে। অবশেষে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে অনুসৃত সেই চিরায়ত উদ্ধৃতি, ‘চিরন্তন শত্রুতা-মিত্রতা বলে কিছু নেই। আছে চিরন্তন স্বার্থ।’ বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কও এই শাশ্বত নীতিমালার সূত্রে গ্রথিত। বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণের সাধারণ স্বার্থে যখন সম্পর্ক নির্ণীত হবে, তখনই তা হবে জাতীয় স্বার্থের পরিপূরক।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement