বাংলায় অন্ধকার যুগ : মিথ বনাম বাস্তবতা
- মুসা আল হাফিজ
- ২০ ডিসেম্বর ২০২১, ১৯:৪১, আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০২১, ১৯:৪১
(দ্বিতীয় কিস্তি)
অসীত-ভূদেবের বর্বরতার তত্ত্ব বনাম মুসলিম শাসন ও ধর্মপ্রচার :
এ দেশে ইসলাম প্রচার ও মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা নিয়ে বহু শতাব্দীর অব্যাহত গবেষণা এখন যে উপসংহারে উপনীত হয়েছে, তা ভ‚দেব-অসীতের দাবি প্রত্যাখ্যান করে। এটি ইতিহাসস্বীকৃত যে, বিনা রক্তপাতে বখতিয়ার খিলজির বঙ্গজয় ছিল একটি যুদ্ধবিহীন অধিকৃতি। মুসলমানদের এই বিজয় ঐতিহাসিকদের বিচারে বিস্ময়কর। বাংলা তো বটেই, তখনকার অনেক এলাকা ও শহর তারা জয় করেছিলেন। যার মধ্যে ছিল কলিঙ্গ, কামরূপ, পুরী ইত্যাদি। বাংলার সমরবিদ্যায় ইতঃপূর্বে অশ্বারোহণের প্রচলন ছিল না এবং অশ্বারোহী বাহিনী বাংলায় যুদ্ধকৌশল হিসেবে তেমন একটা বিবেচিত হয়নি। গৌড় এবং দিল্লি থেকে মুদ্রিত বখতিয়ার ও আলী মর্দান খিলজির উন্নতমানের প্রাথমিক স্মারক মুদ্রায় পাওয়া যায়। এতে ক্ষিপ্র গতিতে ধাবমান অশ্বের প্রতীকী ছাপগুলো স্পষ্ট করে যে, এ জয় সহজে সম্পন্ন হওয়ার পেছনে মুসলমান যোদ্ধাদের উন্নত কলাকৌশল ও অশ্বারোহী বাহিনীর ক্ষিপ্র গতির ভ‚মিকা ছিল প্রবল।
এ বিজয়ের মূল কারণ হলো, তখনকার সেন শাসকদের প্রতি জনগণের অনাস্থা ও ক্ষোভ। বাংলার আদিবাসী আধা-হিন্দু বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী সেন রাজাদের শাসন সর্বান্তকরণে গ্রহণ করেনি। সেন আমলের আগ থেকে বাংলায় ছিল বৌদ্ধদের প্রবল প্রভাব। প্রথম দিকের হিন্দু রাজাদের অনেকেই ছিলেন বৌদ্ধদের দ্বারা প্রভাবিত। রামপালের সংস্কৃত তাম্রলিপিতে জানা যায়, সুবর্ণচন্দ্র নামের জনৈক হিন্দু রাজা বুদ্ধের অনুসারী ছিলেন। পাল বংশ সরাসরি বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করে। তারা ছিল এখানকার স্থানীয় বাসিন্দা। কিন্তু সেনরা এ দেশে এসেছিলেন কর্নাটক থেকে। তারা ছিলেন উঁচু জাতের হিন্দু; শিবশক্তির উপাসক ব্রাহ্মণ -ক্ষত্রিয়। উত্তরবঙ্গের বরেন্দ্র এলাকায় তারা একটি জমিদারি স্থাপন করে এবং পাল বংশের শাসকদের দুর্বলতার কারণে তারা বাংলার ক্ষমতা নিজেদের হাতে নিয়ে নেয়। তাদের শাসনে বর্ণবৈষম্য পৌঁছেছিল চরমে এবং তা সাধারণ মানুষের জন্য হয়ে উঠেছিল চরম এক আপদ। সব সুযোগ-সুবিধা উচ্চবর্ণের স্বল্পসংখ্যকের হাতে ছিল কুক্ষিগত। এমনকি তারা সাধারণ মানুষের প্রভুর আসনে বসতে চেয়েছিল। সেন শাসন তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করছিল এবং সর্বত্র চাপিয়ে দিচ্ছিল তাদের আধিপত্য। ফলে সেন শাসনের পতন জনতার কাম্য ছিল। মুসলিম বিজয় যখন এ শাসনের অবসান আনল, সাধারণ মানুষ মোটেও বিচলিত হয়নি। এই বিচলিত না হওয়ার প্রমাণ মেলে মুসলিম বিজয়ের প্রতি তাদের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়ায়। এ প্রতিক্রিয়ার নমুনা রামাইপণ্ডিতের নিরঞ্জনের রুষ্মা বা কালিমাজালালে বিবৃত।
এ দেশে ইসলাম কিভাবে এসেছে এবং কিভাবে মুসলিম প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা নিয়ে ইতোমধ্যে অনেক মতামত সামনে এসেছে। সব মত ও বিতর্ক দিন শেষে পাঁচটি বয়ানে প্রবাহিত। এর মধ্যে সবচেয়ে সারবত্তাহীন বয়ান হচ্ছে জবরদস্তির মাধ্যমে ইসলামের প্রসার। যে মতের অনুসারীদের বক্তব্য কেমন হয়, তা আমরা লক্ষ্য করেছি ভূদেব-অসীতের ভাষ্যে। এমন ভাষ্য ঐতিহাসিক প্রতিটি নিরীক্ষায় ভ্রমাত্মক বলে প্রমাণিত। যদিও বহিরাগত মুসলমানরা এখানে এসে স্থায়ী হয়েছেন, আত্মীয়তা গড়েছেন এবং তাদের মাধ্যমে ইসলাম ছড়িয়েছে। কিন্তু এখানে মুসলিম সমাজ তৈরি হয়েছে মূলত স্থানীয় জনগোষ্ঠীর দ্বারা। যারা আগে ছিলেন হিন্দু ও বৌদ্ধ। বিশেষত হিন্দু নিম্নবর্ণের কৃষক, কাঠুরে, জেলে ও মাঝিরা ইসলাম গ্রহণ করেন ব্যাপকভাবে। তারা ইসলামকে এখানকার প্রধান ধর্ম ও মুসলিমদের গরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী করে তোলেন। তাদের পাশাপাশি উচ্চশ্রেণীর বহু হিন্দু ইসলামে দীক্ষিত হন, যাদের জোর করে মুসলিম বানাবার সুযোগ ছিল না। বাংলার মুসলিমদের মধ্যে বহিরাগত মুসলিম শতকরা ২৯.৬ ভাগ, স্থানীয় ধর্মান্তরিত মুসলিম শতকরা ৭০.৪ ভাগ। তাদের মধ্যে উচ্চশ্রেণীর হিন্দু ও বৌদ্ধ ছিলেন শতকরা ৩০ ভাগ, ৭০ ভাগ ছিলেন নিম্নবর্গের হিন্দু।
মুসলিমদের সংখ্যাগত বিপুলতা আকস্মিকভাবে হয়নি। খিলজির আমলে কিংবা তথাকথিত অন্ধকার যুগে তা হয়নি। লোকেরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন ধীরে ধীরে, বুঝে-শুনে। ফলে ১৮৭২ সালে ব্রিটিশদের আদমশুমারিতে দেখা যায়, গোটা বাংলায় হিন্দুদের সংখ্যা মুসলিমদের অধিক। মুসলিমদের সংখ্যাগত অনুপাত মাত্র ৪৮ ভাগ। পুরো মুসলিম শাসনামলে এ দেশে মুসলিমরা ছিলেন সংখ্যালঘু। তারা সংখ্যাগুরু হন ব্রিটিশ শাসনামলে। যখন তাদের শাসনক্ষমতা হারিয়ে গেছে এবং তারা ক্ষমতার সব কেন্দ্র থেকে নির্বাসিত।
মুসলিমরা যদি ইসলাম গ্রহণের জন্য জবরদস্তি করে থাকবেন, তাহলে এমনটি কেন হলো? বরং শুরুতেই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত হবার কথা। অত্যাচারে অমুসলিমদের নিশ্চিহ্ন হবার কথা। কারণ ভূদেব-অসীতের দাবি হলো, হয় ইসলাম গ্রহণ, নয় প্রাণে হত্যার নীতি বাস্তবায়ন করেছিলেন মুসলিমরা। কিন্তু সত্য হলো পূর্ববর্তী সেন শাসকদের পতনের পর আঞ্চলিক ক্ষমতায় ভারসাম্য আনার উদ্দেশ্যে বখতিয়ার অনার্য আদিবাসীদের জন্য ও বৌদ্ধ জনগণের জন্য একটি বিরাট বিহার নির্মাণ করেন। ফলে মুসলিম বিজয়ের প্রথম প্রহরেই স্থানীয় আদিবাসীদের সঙ্গে নবাগত মুসলিমদের এক ধরনের আস্থার সম্পর্ক তৈরি হয়। ব্যাপারটি তৈরি করে আনুক‚ল্যের বাতাবরণ, যা বখতিয়ারকে তার শাসনকেন্দ্র লখনৌতি (গৌড়ের নিকটবর্তী ল²ণাবতী) কিংবা নাওদা (বর্তমান মহদিপুর গ্রাম এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকা)-এর পরিবর্তে অধিকতর উত্তর দিকে দেবিকোটে নিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করে। এই এলাকা প্রধানত স্থানীয় আদিবাসী অধ্যুষিত ছিল। হিন্দু ও বৌদ্ধজনগোষ্ঠী এভাবে বিজয় পরবর্তী মুসলিম শাসনকে শুভেচ্ছার দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করে। এখানে রক্তপাত ও উৎপীড়নের কোনো ব্যাপার ঘটেনি। বখতিয়ার খিলজি সম্পর্কে অতএব ড. যদুনাথ সরকারের উপসংহার, ‘বখতিয়ার রক্তপিপাসু ছিলেন না, অকারণে প্রজাদের ওপরে উৎপীড়ন কিংবা ব্যাপক বিধ্বংসে তার কোনো আগ্রহ বা আনন্দ ছিল না।’
শুধু বখতিয়ারের সময়ে নয়, মুসলিম শাসনামলে বাংলার হিন্দুদের ওপর কখনোই নিপীড়নের পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়নি। চাইলেও তারা সেটি পারতেন না। কারণ তাদেরকে অব্যাহতভাবে দিল্লির কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে। নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্বের প্রয়োজনে হিন্দুদের সাথে শাসকশ্রেণীর সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হয়েছে। শাসনকাজে ধর্মান্তরিত মুসলমানদের চেয়ে বেশি সুবিধা পেতেন হিন্দুরা। অন্ধকার যুগের প্রচারে উৎসাহ সত্তে¡ও সুকুমার সেন স্বীকার করেন, ‘রাজ্য শাসনে ও রাজস্ব ব্যবস্থায় এমন কি সৈন্যাপত্যেও হিন্দুর প্রাধান্য সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। গৌড়ের সুলতানেরা মুসলমান হলেও রাজকার্য প্রধানত হিন্দুর হাতেই ছিল।’ সমাজবিজ্ঞানী বিনয় ঘোষ (১৯১৭-১৯৮০) জানাচ্ছেন একই কথা। তার মতে, ‘পাঠান রাজত্বকালে জায়গীরদারেরা দেশের ভেতরে রাজস্ব আদায়ের কাজে হস্তক্ষেপ করেননি। দেশে শাসন ও শান্তিরক্ষার জন্য হিন্দুদের ওপরই তাদের নির্ভর করতে হতো।’ (বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা; ১৯৬৮) ধর্মীয় সহায়তাও লাভ করেছেন হিন্দুরা, জায়গীর ও বাণিজ্যের অধিকাংশ সুবিধা ছিল তাদের হাতে। গবেষক, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ক্ষিতিমোহন সেন ( ১৮৮০-১৯৬০) লিখেছেন, এ দেশে এসে মুসলমান রাজারা সংস্কৃত হরফে মুদ্রা ও লিপি ছাপিয়েছেন, বহু বাদশা হিন্দু মঠ ও মন্দিরের জন্য বহু দানপত্র দিয়াছেন।’ (ভারতের হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত সাধনা; ১৯৪৯) চার্লস স্টুয়ার্ট (১৭৬৪-১৮৩৭) এর মতে, অধিকাংশ আফগানই তাদের জায়গীরগুলো ধনবান হিন্দুর হাতে ছেড়ে দিতেন। এই জায়গীরগুলোর ইজারা ধনশালী হিন্দুরা নিতেন এবং তারা ব্যবসা বাণিজ্যের সব সুবিধা ভোগ করতেন।
এ সময় শিক্ষিত ও যোদ্ধা হিন্দু, বিশেষত কায়স্থদের সামাজিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ও প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত হয়।
মুসলিম শাসনামল বাংলায় মূলত শান্তিপূর্ণভাবে শাসনকাজ চালনা করতে চেয়েছে, ধর্মপ্রচার নয়। ধর্মপ্রচার প্রধানত করেছেন সুফি-আলেম-দাঈরা। আরব বণিকদের ভূমিকাও ছিল; মূলত উপক‚লীয় অঞ্চলে ও স্থলপথে রংপুরে, বরেন্দ্র অঞ্চলে। ব্যক্তি পরিসরে শাসকদের কেউ কেউ প্রচারকদের সহায়তা করেছেন। কিন্তু শাসনক্ষমতা ধর্মপ্রচারে মনোযোগ দেননি, ধর্মান্তরকেও লক্ষ্য বানাননি। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভিপ্রায়ে কিছু হিন্দুর স্বেচ্ছায় ধর্মান্তর ঘটেছে। কিন্তু শাসক দরবারে এই ধারা সাধারণত প্রশ্রয় পায়নি। মুঘল সুবেদার ইসলাম খান (সপ্তম দশক) তার কর্মচারীদের শাস্তি প্রদান করেছিলেন হিন্দুদের মুসলিম ধর্মে ধর্মান্তরিত করার কারণে।
মুসলিম শাসনকেন্দ্রের আশপাশে মুসলিম জনগোষ্ঠী ছিল সবচেয়ে বেশি সংখ্যালঘু। হিন্দুরা ছিল সংখ্যাগুরু। শাসকরা যদি জবরদস্তি করতেন, তাহলে উল্টোটা ঘটত। ১৮৯৪ সালের সমীক্ষায় জেমস ওয়াইজ দেখান, ‘১৮৭২ সালের আদমশুমারিতে উদঘাটিত সবচেয়ে কৌত‚হলোদ্দীপক তথ্যটি হলো পুরনো রাজধানীগুলোর চারদিকে জড়ো হয়ে নয়, বরং বদ্বীপের পাললিক সমতলে’ নিম্নবাংলায় সুবিপুল সংখ্যক মুসলমান বসবাস করে।’
১৯০১ সালের আদমশুমারিতে দেখা যায় ‘ঢাকা ছিল প্রায় একশো বছরজুড়ে নবাবের আবাসস্থল, কিন্তু এর চার দিকের যেকোনো জেলার চেয়ে ঢাকাতে কম অনুপাতে মুসলমানের বাস, একমাত্র ব্যতিক্রম ফরিদপুর। মালদহ এবং মুর্শিদাবাদে রয়েছে পুরনো রাজধানী, যেগুলো সাড়ে চারশো বছর ধরে ছিল মুসলমান শাসনের কেন্দ্র, তথাপি সন্নিহিত দিনাজপুর, রাজশাহী এবং নদীয়ার চেয়ে এখানকার জনগোষ্ঠীর অপেক্ষাকৃত স্বল্প অংশ মুসলমান।’
এখানে যে প্রশ্নটা গুরুতর, তা হলো, সারা দেশে হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, রাজধানীতেও তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ, প্রশাসনেও তারা বিপুল অংশীদার, এমতাবস্থায় কীভাবে মুসলিম শাসকরা হিন্দুদের উপর অত্যাচার জারি রাখতে পারেন? অত্যাচার ও জুলুমের মাধ্যমে মুসলিম শাসকরা কোনোভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের ওপর শাসন চালিয়ে যেতে পারতেন না শত শত বছর। এ শাসন সম্ভব হয়েছে তাদেরকে আস্থায় নেয়ার মধ্য দিয়েই। এই স্বাভাবিক
বাস্তবতার প্রতি একান্তই উদাসীন ভূদেব-অসীতের তত্ত্ব।
কোন প্রেক্ষাপটে বাঙালিরা ইসলাম গ্রহণ করল? ইসলামের সত্যবাণী ও সহজাত’ মানবিক জীবনধারা তাদের অভিভ‚ত করেছিল। সত্য পিপাসা তাদের মধ্যে ছিল এবং মুক্তির কাতরতা তাদেরকে ইসলামের প্রতি আগ্রহী করেছিল। ইসলামী জীবনব্যবস্থা ফিতরাত বা মানবপ্রকৃতির একান্ত অনুক‚ল। এর সামাজিক, বৈবাহিক ও ধর্মীয় আচার ও ব্যবস্থা খুবই সহজ ও সরল। এর বাণী অনেকটা বৈপ্লবিক হলেও এর প্রচার ঘটছিল ধীর সুস্থিরতায়। সামাজিক-জাতিগত, পেশা ও বর্ণগত বৈষম্য ছিল না এখানে। ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে বর্ণহিন্দুদের তীব্র বিদ্রোহের সুযোগ তৈরি হয় এখানে ইসলাম আগমনের ভেতর দিয়ে। ফলে, নিম্নবর্ণ হিন্দুরা ইসলাম গ্রহণের ভেতর দিয়ে মুক্তি অনুসন্ধান করেন। এখানকার ব্রাত্য মানুষ ও জনস¤প্রদায়ের জন্য ইসলাম এসেছিল অভূতপূর্ব এক আশীর্বাদ হয়ে। রিচার্ড ইটন বিষয়টাকে ব্যক্ত করেছেন এভাবে’ ইসলাম এ দেশের আদিবাসী যাযাবর ধরনের উপজাতি সম্প্রদায়গুলোর জন্য একটি নতুন সভ্যতার বাণী নিয়ে এসেছিল, যা এ দেশের মাটি ও জনগণের জন্য উপযোগী জীবনব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল।
ইসলামের আধ্যাত্মিক চেতনায় জনগণ উদ্বুদ্ধ হয়েছিল যাবতীয় অমানবিকতার বিপরীতে। বাংলায় যখন মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন বেশির ভাগ লোক বৌদ্ধ ছিল। তারা হিন্দুদের দ্বারা অত্যাচারিত ছিল। ফলে, হিন্দুদের অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে থাকবে। তাদের সম্পর্ক শাসকদের সাথে ছিল না, ছিল সুফি, দরবেশ, পীরদের সাথে। যাদের ছিল উন্নত নৈতিকতা, মানবপ্রেম, সহজ ও ত্যাগী জীবনাচার, সেবাব্রত এবং অলৌকিকতার নানা দিক।
রিচার্ড এম ইটন দেখিয়েছেন, এসবের পাশাপাশি এই অঞ্চলের পীররা উদ্যোক্তা ছিলেন। তাদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি ছিল। তিনি বাগেরহাটের খান জাহান আলীর উদাহরণ টানেন। যিনি স্থানীয় জনগণের সহায়তায় বন পরিষ্কার করে ধানক্ষেত তৈরি করেন। লবণাক্ততা দূর করার জন্য বাঁধ তৈরি করেন। ফলে, দলে দলে লোক পীরের নেতৃত্বের গুণে ইসলাম গ্রহণ করে। কিন্তু সুফিদের এই প্রভাব ভারতের অন্য এলাকার চেয়ে বাংলায় কেন বেশি কাজ করল? বেভারলি এখানে যুথবদ্ধ গ্রমের ধারণা হাজির করেন। ভারতীয় হিন্দু গ্রামগুলো সাধারণত প্রবলভাবে যুথবদ্ধ থাকত। অন্য ধর্ম গ্রহণ বা মতামতের সুযোগও সেখানে ছিল না। কঠোরভাবে একঘরে হতে হতো। কিন্তু বাংলাদেশের গ্রামগুলো রৈখিক। একের উপর অপরের প্রভাব কম। ফলে, পীরদের দাওয়াত সমাজের গভীরে প্রবেশ করতে পেরেছে। এমন উন্মুক্ত গ্রামে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের চর্চা হয়। ধর্মান্তরেরও সুযোগ থাকে। স্বাধীন ইচ্ছার প্রয়োগ ঘটানোর অবকাশ থাকে। ফলে বাংলার সাধারণ হিন্দু ও বৌদ্ধরা স্বাধীন ইচ্ছা ও আন্তরিক আগ্রহে ইসলামে দীক্ষিত হয়। এখানে জবরদস্তির কোনো ব্যাপার ছিল না।
লেখক : কবি, গবেষক
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা