সংসারের ব্যয় এবং জাতীয় স্মৃতিসৌধের রূপকার
- ড. মাহবুব হাসান
- ১৭ ডিসেম্বর ২০২১, ১৯:২৬, আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৫:২১
কাঁচাবাজারের হাল কেমন সেটা জানার জন্য কি সংবাদপত্রের খবর দেখতে হয়? প্রতিদিন যারা বাজারে যান বা কাজ শেষে বাড়ি ফেরেন, তারা সংসারের জন্য চাল-ডাল-নুন, মরিচ, শাক-সবজি, আদা-রসুন এবং পেঁয়াজ নিয়ে ফেরেন। আগে যারা সপ্তাহে এক দিন বাজার করতেন, তারা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ। তারা এখন সপ্তাহে দুদিন বাজারে যান। কিন্তু যারা দিন এনে দিন খান, এমন অগণন মানুষ রোজই কাঁচাবাজারে যান। কারণ তাদের হাতে জমে থাকে না কোনো টাকাপয়সা। ব্যয় বাড়ছে। ব্যয় বড়ছে মানে কাঁচাপণ্যের দাম বাড়ছে।
এই সত্য কি লুকিয়ে রাখার মতো? নাকি এই সত্য লুকানো যায়? এ সত্য যে ক্রেতাসাধারণকে নিত্য খোঁচায় তারা গরিব মানুষ। অর্থনীতিবিদরা বলবেন তারা নিম্নবিত্তের, অতি নিম্নবিত্তের। আর যাদের বিত্ত নাই, বেসাত নাই, তারা হাত পেতে থাকে মসজিদের সামনে, ফুটপাথে, চলতি পথে আর আমরা যেতে আসতে প্রতিদিনই এদের দেখি। পারলে যৎসামান্য টাকাপয়সা দেয় মানুষ, না পারলে মাফ চায়। এই সংস্কৃতি তো আমাদের চিরচেনা।
৫০ বছরে আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি মন্দ নয়। সুরম্য অট্টালিকার সারি রাজধানীতে যেমন বেড়েছে, পাল্লা দিয়ে বিত্তহীন মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে। কিন্তু সেটা আমরা বলি না। গড় করে আমরা বলি, আমাদের ক্ষধার্ত মানুষের সংখ্যা কমেছে। যেমন গড় করে আমরা বলি আমাদের শিক্ষার হার বেড়েছে। আগে বলা হতো শিক্ষিতের হার ৬২ শতাংশ। এখন কত বলা হয়, জানি না। নিশ্চয় আমাদের শিক্ষার হার বেড়েছে, কিন্তু সেই সঙ্গে নিরক্ষরতার হার কি কমেছে? আমাদের সব শিশু কি শিক্ষার আলো পাচ্ছে? দেশের সব গ্রামে কি শিক্ষার জন্য প্রাইমারি স্কুল স্থাপিত হয়েছে? সেই সব স্কুলে কি সব বিষয়ের নির্ধারিত শিক্ষক আছে? সেই সব স্কুলে কি শিশুদের বসার বেঞ্চ আছে? তারা কি সত্য সত্যই পড়ার জন্য পুস্তক পায়? পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, ডিসেম্বরের ১৫ তারিখ পর্যন্ত প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ২৫ শতাংশ বই ছাপাই হয়নি। বিদ্যমান প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের সব শিশু যে পয়লা জানুয়ারি বিনামূল্যের বই হাতে পাবে না, তা বলাই বাহুল্য।
শুধু শিক্ষা ক্ষেত্রেই নয়, সব ক্ষেত্রেই ঘাটতি আছে। সংবাদপত্রগুলো কোনটা রেখে কোনটা লিখে জানাবে? এ যেন এক অন্তহীন ‘নাই’ এর মিছিল। তারপরও তো আমরা হতাশ নই। এই জীবন সংগ্রামকেই আমাদের নিয়তির সঙ্গে তাল মেলাতে শিখিয়েছে। সরকার যেমন সেটা বলেন, গর্ব করেই বলেন যে আমরা লড়াকু জাতি, সর্বক্ষেত্রেই আমরা লড়াই করে চলেছি, সেই সত্য ধরে নিজেদের বাহবা পাওয়ার বা ভাবনার কোনো যুৎসই উপমা আমরা সংগ্রহ করতে পারবো না। কিন্তু আমরা বলবো, সরকারের উচিত সেই কাজটি প্রথম করা, যেখানে গণস্বার্থ রয়েছে, রয়েছে সাংবিধানিক অধিকার। খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান, মতপ্রকাশের অধিকার, কাজের অধিকার, উৎপাদনের ক্ষেত্রে সহায়তা দেয়া সরকারের কেবল রাজনৈতিক অঙ্গীকারই নয়, সাংবিধানিক বিধি-বিধানও। কৃষি সেক্টরে যে সব মানুষ জাতির খাদ্যশস্য উৎপাদনের নিয়ামক শক্তি তাদের প্রণোদনা দেয়াটা তাদেরই অধিকারের অন্তর্গত।
যখন একজন রিকশাচালক, ঠেলাওয়ালা, খুচরো দোকনি, চা-বিক্রেতা, সবজিবিক্রেতা, ফলবিক্রেতা, মৌসুমি ফলের জোগানদার তার সংসারের খরচ নির্বাহ করতে হিমশিম খায়, তখন এ কথা বলা কি অন্যায় হবে যে সরকার তার ম্যানেজারিয়াল দায়িত্ব পালনে সফল হচ্ছে না। আমরা জানি, সরকারের রয়েছে যুৎসই যুক্তি, যা দিয়ে প্রমাণ করবেন, সংগ্রামী মানুষদের জন্য তারা সব সময় সজাগ এবং তারা তাদের সর্বশক্তি দিয়েই কাজ করে চলেছেন। সরকার তার উন্নয়নের তালিকা তুলে ধরে বলবেন, এ সবই জনগণের জন্য করছেন। সরকারগুলো সব সময়ই কাজ করে, পরিকল্পনা আঁটে জনগণের জন্য, জাতির বৃহত্তর স্বার্থে, সেটা মিথ্যা নয়। কিন্তু পরিকল্পনায় ত্রুটি-বিচ্যুতির কথা একবারও বলে না। পরিকল্পনার ত্রুটির কারণে যে প্রতি বছর কত হাজার কোটি টাকা জলে যাচ্ছে, সে তথ্যও ঊহ্য থাকে । সেই টাকার অঙ্কটি আসলে কত? আমরা জানি না। আমাদের জানানো হয় না। মানে জবাব দেয়ার যে রীতি, গণতন্ত্রের প্রধান শোভাও বটে, তা আমাদের রাজনৈতিক চরিত্রে বিরল বা নেই।
কাঁচাবাজারে দ্রব্যমূল্য বাড়ার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, পরিবহনের ভাড়া বেড়ে যাওয়া। পরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধির কারণ ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বেড়ে যাওয়া। ডিজেলের দাম বেড়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে। এই যে চেইন মূল্যবৃদ্ধির, তাকে ঠেকা দেয়ার উপায় কী? কোনো উপায়ই নেই। তবে সরকার যদি ভর্তুকি দেয়, তাহলে তা ঠেকানো যেত। সরকারের উচিত সেই পথই গ্রহণ করা যাতে জনগণ যেন ভুক্তভোগী না হয়। সরকার যদি ব্যবসা করতে চায় তাহলে তো ভর্তুকি না দিয়ে তা ভাগ-বাটোয়ারা করে দেবে সর্বত্র মানে পরিবহন খাতের ওপর। এবারও সেটাই করা হয়েছে। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে ডিজেলের দাম কমে এলেও সেই অনুযায়ী দেশে ডিজেলের দাম কমানো হয়নি, কেরোসিনের দামও কমেনি। এতে যে উৎপাদক (শিল্পপণ্য ও কৃষিপণ্য) পর্যায়ে ব্যয় বেড়ে যায় এবং তারা পণ্যের দাম বাড়িয়ে রাখতে পারে। সে কাজটাই করে তারা। ভোজ্যতেলের দাম বাড়ার কারণ এটা। পরিবহন খাতের লোকেরা এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের গ্রাসে যায় উৎপাদকের লাভ ও তাদের পাওনা।
সংসারের ব্যয় বেড়ে গেলেও জনগণের জন্য পরিবহনব্যয় কমানোর চিন্তাভাবনা ও উদ্যোগ নেই। কাঁচাবাজারে আগুন লাগলেও জনগণের সরকারের যেন কোনো দায় নেই। এই যে লাখ লাখ গরিব মানুষ মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার রাজনৈতিক সংগ্রামে নেমেছে, তাদের জন্য সরকারের প্রণোদনা কোথায়? এ জন্য নিম্ন ও নিম্নমধ্যম আয়ের মানুষ যারপরনাই ক্ষুব্ধ। তাদের আয় বাড়ছে না, কিন্তু ব্যয় করতে নাভিশ্বাস উঠছে। এক সয়াবিন তেলের দাম গত এক বছরে মাত্র সাতবার বাড়ানো হয়েছে। ব্যবসায়ীদের এই যে লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি, তার লাগামটা কেন টেনে ধরা হলো না?
‘বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার লোকদের সঙ্গে কথা বলে হিসাব কষে দেখা গেছে, এক বছরের ব্যবধানে চার সদস্যের পরিবারে মাসে গড়ে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা খরচ বেড়েছে। চাল ১০০ টাকা, তেলে ২০০ টাকা, ময়দায় ৮০ টাকা, চিনিতে ৭০ থেকে ৮০ টাকা এবং গুঁড়োদুধে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে। শাক-সবজি, মাছ, মুরগির ডিম ও গোশত বাবদ মাসে অতিরিক্ত ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা লাগছে। বাসভাড়া বাড়ানোর পর মাসিক যাতায়াত খরচ বেড়েছে ৩০০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা। বেড়েছে টুথপেস্ট, পাউডার, সাবান, ডিটারজেন্টের মতো নিত্যদিন সংসারে ব্যবহার হয় এমন পণ্যের দামও। পোশাক-পরিচ্ছদের খরচও বেড়েছে।’ [সমকাল/ ১৭ ডিসেম্বর]
এই রিপোর্টের সত্যতা এদিক সেদিক হতে পারে সামান্যই, তবে তাতে জনগণের সংসারের ব্যয় যে বেড়েছে, সেটা বাতিল করার কোনও সুযোগ নেই। এ-নিয়ে সরকারি ভাবনা গদাইলস্করি, সেটা আমরা জানি। জনগণের শ্বাসটা চলে যাওয়ার আগেই যদি মূল্য বাড়ার লাগামটা টেনে ধরা হয়, সেই অনুরোধই আমরা করি।
২.
জাতীয় স্মৃতিসৌধের ডিজাইন কে করেছিলেন বলতে পারবেন? আমি জানি, পারবেন না। পারবেন কেমন করে, তাকে তো লাইমলাইটেই আনা হয় না, আনা হয়নি। সাভারে, আমাদের জাতীয় স্মৃতিসৌধে আমরা তো যাই ওর রূপ আর নান্দনিকতা দেখতে, কিন্তু বুঝতে পারি না, ওতে ডিজাইনার কেন সাতটি স্তম্ভ রেখেছেন। আপনারা তো জানেন যে, এই সৌধটি নির্মাণ করা হয়েছে ১৯৮২ সালে। তখন ক্ষমতায় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তিনিই এর উদ্বোধন করেন। সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এই বেদনা ও আনন্দের সুরম্য সৌধের রূপকার শিল্পী সৈয়দ মাইনুল হোসেনকে দাওয়াত করা হয়নি। এমনকি তাকে যে সম্মানী দেয়ার কথা দিয়েছিলেন মাত্র দুই লাখ টাকা, তাও দেয়া হয়নি। এরশাদ গত হয়েছেন। ৯ বছর দেশ শাসন করেছেন। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছেন নানা প্রকল্পের জন্য, কিন্তু জাতির হৃদয়ের প্রতীক জাতীয় স্মৃতিসৌধের রূপকারের প্রাপ্য সম্মানী পরিশোধ করেননি। একে কী বলবো? সামরিক মেজাজের রাষ্ট্রপতি এবং কর্তৃত্ববাদী সরকার বলেই কি তিনি একজন সম্মানিত শিল্পীর পাওনা পরিশোধ করেননি? বা বলতে পারি ভুলে গিয়েছিলেন।
আমরা মনে করি বঙ্গবন্ধুর কন্যা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিল্পীর সম্মানী পরিশোধের উদ্যোগ নেবেন। এ-আশা কি আমরা করতে পারি না?
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা