২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী

বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী - ছবি : নয়া দিগন্ত

১৬ ডিসেম্বর। বিজয়ের দিন। মুক্তির দিন। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ‘বাংলাদেশ’ নামে একটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এ ভূখণ্ডের মানুষের নিজের ভাগ্য নিজের হাতে তুলে নেয়ার আকাক্সক্ষা পূর্ণ হয় এই দিনে।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ২০২১। আমাদের গৌরবময় বিজয়ের ৫০ বছর পূর্ণ হলো। অন্যভাবে বলতে গেলে, বাংলাদেশের বয়স ৫০ বছর পূর্ণ হলো। এটা আমাদের স্বাধীন সূর্যোদয়ের সুবর্ণজয়ন্তী, বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী।

মহান মুক্তিযুদ্ধের উজ্জ্বলতম তারিখ ১৬ ডিসেম্বর। কারণ এদিন আমাদের সাথে যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয় হয়েছিল। ১৯৭১ সালের এই দিনটিতে স্বাধীন হওয়ার আনন্দে আমরা উদ্বেলিত ছিলাম। এদেশের মানুষের এর আগের ২৬৬টি রুদ্ধশ্বাস দিন কেটেছে ঠিক এই ১৬ ডিসেম্বরের দিনটির প্রতীক্ষায় কাতর হয়ে। বিজয়ের খবর পেয়ে তাই এই দিন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ঢাকায় আসতে শুরু করে ঝাঁকে ঝাঁকে মুক্তিযোদ্ধা। পথে শত শত উল্লসিত জনতা স্বাগত জানায় তাদের। আনন্দে উদ্বেলিত মানুষ সেদিন মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে, বুকে বুক জড়িয়ে এবং উল্লাসে ফেটে পড়ে তাদের নামে জয়ধ্বনি দিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে।
১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের দিন সম্পর্কে বালক বয়সের আমার স্মৃতিও অম্লান আছে। সেই স্মৃতি ভুলবার নয়। দিনটি নিয়ে শুধু আমার নয়, এদেশের সব বয়সী মানুষেরই আছে নানা স্মৃতি। বিজয়ের মুহূর্তটি সেদিন মুক্তিযুদ্ধের নায়কেরা কিভাবে উপভোগ করেছিলেন? মুক্তিযুুদ্ধের উপপ্রধান সেনাপতি এয়ার ভাইস মার্শাল একে খন্দকার তার স্মৃতি আত্মপক্ষ (ভোরের কাগজ, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৯৩) লেখায় উল্লেখ করেন, ‘কলকাতা থেকে আমি যখন ঢাকা বিমান বন্দরে অবতরণ করি, তখন আমার একটিমাত্র অনুভূতিই ছিল। সেটি কোনো ব্যক্তিগত গৌরবের বা অর্জনের নয়, আল্লাহ তা’য়ালার প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতার যে, আমি স্পর্শ করতে পেরেছি আমার স্বাধীন দেশের মাটি। আমরা যখন রমনা ময়দানের দিকে যেতে থাকি, তখন রাস্তার দুই পাশের বহু মানুষকে আক্ষরিক অর্থেই মুক্তির আনন্দে আকুলভাবে কাঁদতে দেখেছি। তাদের মুখে যে অভিব্যক্তি ছিল, সেটি মুক্তির। একটি আতঙ্কিত অবস্থা থেকে একটি নিশ্চিত অবস্থায় উত্তরণের। রেসকোর্স ময়দানে অসংখ্য লোকের সাথে আমাকে কোলাকুলি করতে হয়েছে। এরমধ্যেও ছিল মানুষের অনাবিল আনন্দ এবং স্বস্তির অভিব্যক্তি। বেশ ক’জন সেদিন আমাকে বলেছেন, ‘আজ রাত থেকে আমি নিশ্চিন্তে ঘুমোব।’

ডিসেম্বরে স্মরণীয় আরো তারিখ
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একাত্তরের প্রতিটি দিনই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি দিবসই রক্তের অক্ষরে লেখা। তারপরও এমন কয়েকটি দিন, এমন কয়েকটি তারিখ রয়েছে যা গৌরবের মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে আছে। সবচেয়ে স্মরণীয় দিনটিই ১৬ ডিসেম্বর।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ৩ ডিসেম্বর একটি উল্লেখযোগ্য দিন। এটি প্রত্যক্ষ লড়াইয়ের পরিণতি নির্ধারক দিন। পাকিস্তান এদিন ভারতীয় বিমান ঘাঁটিগুলোতে এবং পশ্চিম সীমান্তে সরাসরি আক্রমণ করে বসে। ফলে চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। পূর্ব রণাঙ্গণে বাংলাদেশ-ভারত মিলিত বাহিনীর আক্রমণ চূড়ান্ত পর্বে প্রবেশ করে।
৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ ছিল আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিন। মুজিবনগর সরকারের অনুরোধে এদিন বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় ভারত। বাংলাদেশকে ভারতের আইনগত স্বীকৃতি দেয়া খুব জরুরি হয়ে পড়েছিল।
একাত্তরের ৩ ডিসেম্বর থেকে যখন চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, তখন নিউ ইয়র্কের জাতিসঙ্ঘ সদর দফতরেও চলতে থাকে এক কূটনৈতিক লড়াই। ৪ থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে প্রবল উত্তেজনাকর এ লড়াই। পাকিস্তানের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। বাংলাদেশের পক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়ন। তখন ছিল স্নায়ুযুদ্ধের যুগ। দুই পক্ষের তুমুল বিতর্কের মুখে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে জাতিসঙ্ঘ। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ সম্পন্ন হয়ে গেলেও নিরাপত্তা পরিষদ মতৈক্যে আসতে পারেনি। আমাদের বিজয়ের চার দিন পর ২১ ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদ যে প্রস্তাব গ্রহণ করে তাতে বলা হয়, “ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ‘যুদ্ধ বিরতি’ স্থায়ী হতে হবে এবং ভারত ও পাকিস্তানকে নিজেদের সেনা যার যার সীমান্তের পেছনে ফিরিয়ে নিতে হবে”।

১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ এর দিনটি ছিল একটি কালিমালিপ্ত দুঃখময় দিন। পরাজয় আসন্ন জেনে ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকাসহ সারা দেশে বেছে বেছে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল। এ হত্যা ছিল পাকিস্তানি সামরিক জান্তার শেষ মরিয়া আঘাত। তাদের এই নৃশংসতার শিকার হয়েছিলেন শিক্ষক, সাংবাদিক, শিল্পী, লেখক ও পেশাজীবীসহ দেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীরা।

খালেদা জিয়ার জীবনে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১
১৬ ডিসেম্বরের দিনটি সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জীবনেও এক অনন্য দিন। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরে তিনি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়েছিলেন। এর আগে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দুই শিশু সন্তানসহ তাকে ক্যান্টনমেন্টের একটি বাড়িতে গৃহবন্দী করে রাখে।
আজ বাংলাদেশের বিজয়ের ৫০ তম বার্ষিকী এমন এক সময়ে উপস্থিত হয়েছে, যখন খালেদা জিয়া হাসপাতালে তার জীবনের সবচেয়ে দুঃসময় পার করছেন। তিনি গুরুতর অসুস্থ, তিনি মুক্তও নন। স্বাধীনভাবে চলাফেলার অধিকার তার নেই। চিকিৎসকরা খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার সুপারিশ করলেও সেই সুযোগ থেকে তাকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে। একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী, একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট, সেনাপ্রধান এবং মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারের স্ত্রী হিসেবে তো নয়ই, দেশের একজন সাধারণ নারী, বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিক হিসেবেও উন্নত চিকিৎসা পাওয়া তার মৌলিক মানবিক অধিকার। কিন্তু তাকে স্থায়ী জামিনে মুক্তির মাধ্যমে চিকিৎসার সুযোগ এখন পর্যন্ত দেয়া হয়নি।

একাত্তরের ২৬ মার্চ স্বামী তৎকালীন মেজর জিয়াউর চট্টগ্রামে দুই সন্তানসহ খালেদা জিয়াকে রেখে মুক্তিযুদ্ধে চলে যান। খালেদা জিয়া চট্টগ্রাম থেকে দুই শিশুপুত্রকে নিয়ে প্রথমে নারায়ণগঞ্জে এবং সেখান থেকে বড় বোন খুরশীদ জাহান হকের ঢাকার বাসায় আসেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ২ জুলাই ১৯৭১ ঢাকা থেকে দুই শিশুসহ তাকে গ্রেফতার করে ক্যান্টনমেন্টের একটি বাসায় নিয়ে গৃহবন্দী করে রাখে। গৃহবন্দী থাকাকালে খালেদা জিয়াকে কারো সাথে সাক্ষাৎ করতে দেয়া হয়নি। বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগ ছিল একেবারে বন্ধ। রেডিও নেই, সংবাদপত্র নেই। এ সময়ের কোনো ঘটনাই তার জানা নেই। এ বাসাতেই ক’দিন পরে এসে উঠেন জিয়াউর রহমান। মুক্তিযুদ্ধ শেষে বিজয়ীর বেশে মুক্ত স্বদেশ ভূমিতে তার গৌরবময় প্রত্যাবর্তন। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে খালেদা জিয়াও মুক্ত হন। তখন তার পরিচিতি মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী জেড ফোর্সের প্রধান মেজর জিয়ার স্ত্রী হিসেবে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের কথা বলা আছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য বেগম খালেদা জিয়া আজ মৌলিক, মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। এমন একজন মানুষের, গণতন্ত্রপ্রিয় দেশপ্রেমিক মানুষের জীবন কি এভাবেই শেষ হয়ে যাবে? সেটা কোনোভাবেই হওয়া উচিত নয়। ব্যক্তিগতভাবে কিছুই তার করার নেই। মানুষ তো মানুষেরই জন্য। তাই মুক্তিযুদ্ধের কথা, ১৬ ডিসেম্বরের কথা এবং বিজয়ের ৫০তম বার্ষিকীর কথা বিবেচনায় নিয়ে খালেদা জিয়াকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার সুযোগ দেয়া হোক। মানবতার জয় হোক।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেসক্লাব


আরো সংবাদ



premium cement
কুমিল্লায় ট্রেনে কাটা পড়ে নারীর নিহত জামায়াতের সাথে ইইউ অন্তর্ভূক্ত ৮টি দেশের প্রতিনিধিদের বৈঠক মনিরামপুরে শ্রমিক দলের সভাপতির উপর হামলা ‘যৌক্তিক সময়ের মধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচন চায় বিএনপি’ দেশব্যাপী দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসজনিত রোগে ভুগছে ৬৫ লাখ মানুষ গ্রেড-১ এ পদোন্নতি পেলেন প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের ডিজি ডা. রেয়াজুল হক ‘বড় কোনো পরিকল্পনা না থাকলে এক দিনে এতগুলো ঘটনা ঘটতো না’ জুলুমের দায়ে মতিউর রহমান ও মাহফুজ আনামকে পদত্যাগ করতে হবে : হেফাজত আমির স্বর্ণের দাম ভরিতে ১,৮৯০ টাকা কমেছে খালেদা জিয়ার সাথে সৌদি রাষ্ট্রদূতের বৈঠক মাওলানা আতাহার আলীকে বাদ দিয়ে দেশের ইতিহাস রচিত হতে পারে না : ধর্ম উপদেষ্টা

সকল