১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ৩০ পৌষ ১৪৩১, ১৩ রজব ১৪৪৬
`

বাংলাদেশে ছদ্মাবরণ সংস্কৃতি

-

প্রতিটি জাতির একটি ট্রেডিশন, ঐতিহ্য বা পরম্পরা থাকে। মন, মেজাজ, অনুভ‚তি, একজনের প্রতি অন্যজনের মমত্ব বোধ বা কর্তব্য বোধ, নিষ্ঠা, জাতির প্রতি দায়িত্ববোধ, মিথ্যার সাথে আপসকামিতা বা মিথ্যার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করা প্রভৃতিসহ আনুষঙ্গিক নিজস্ব নিয়মানুবর্তিতা থেকেই শুরু হয় একটি জাতির সংস্কৃতির গোড়াপত্তন। এ গোড়াপত্তন ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ করে গেøাবাল বিশ্ব পরিক্রমায় দৌড় প্রতিযোগিতা রয়েছে। এ প্রতিযোগিতা কোথাও কোথাও থমকে গেছে বা কোথাও কোথাও গতি পেয়ে অনেক উচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত হওয়ার পরও ক্ষয়িষ্ণু রোগে ধ্বংস হয়েছে। একসময় বলা হতো, ব্রিটিশ রাজ্যে সূর্য অন্ত যায় না। এখন ব্রিটিশ বাধ্য হয়ে গণরোষে নিজেকে অনেকখানি খাপিয়েছে বটে, কিন্তু তাদের ট্রাডিশন পৃথিবীব্যাপী প্রতিষ্ঠা করেছে। ব্রিটিশ একটি দখলকার জাতি, কিন্তু নিজেদের একটি সভ্য জাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছে যাদেরকে পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্রেই অনুকরণ করে, বিশেষ করে ব্রিটিশের লিগ্যাল সিস্টেম পৃথিবীব্যাপী সমাদৃত।

বহুজাতির সংমিশ্রণে বাঙালি একটি জাতিতে পরিণত হয়েছে। সংবিধানের ৬(২) নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙালি এবং নাগরিকরা বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন।’ ভ‚তত্ত¡বিদদের মতে, বঙ্গোপসাগর থেকে সৃষ্টি হওয়া একটি বদ্বীপের ভ‚খণ্ডের মধ্যেই বর্তমান বাংলাদেশ। ভ‚তত্ত¡বিদরা আরো আশঙ্কা করছেন যে, জলবায়ু জটিলতার কারণে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে সাগরে বিলীন হয়ে যেতে পারে, যদিও এতে ভিন্নমত রয়েছে; কারণ বাংলাদেশের সমুদ্রসীমানায় নতুন করে এত বড় চর জাগছে, যা একটি বাংলাদেশের চেয়ে কম হবে না। যদি তাই হয় তবে বাংলাদেশের খাদ্য অভাব তো থাকবেই না, বরং পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ রাষ্ট্র হিসেবে পরিণত হবার একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনা আশা করা যেতে পারে। বাংলাদেশকে ভবিষ্যৎ একটি সমৃদ্ধিশালী রাষ্ট্র হিসেবে চিন্তা করার পাশাপাশি এ জাতিকে গুণগতভাবে উচ্চ শিখরে পৌঁছার নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার বিষয়ে প্রজন্মকে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। বাঙালি জাতির যেমন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রয়েছে, রয়েছে মায়ের ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আদায়, অন্য দিকে জাতির সাথে বেঈমানির ইতিহাসও কম নয়। এই জাতির ইতিহাসে সিরাজদ্দৌলার জন্ম হয়েছে, মীরজাফরের দৃষ্টান্তও অনেক রয়েছে। বর্তমানে সত্যের সাথে যুদ্ধ করে মিথ্যা জয়লাভ করছে এবং এটিই এখন বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি।

বিভিন্ন সংগঠনের স্মরণিকা প্রকাশ করার জন্য বিশেষজনের ‘বাণী’ আনতে গেলে, সবাই বলেছেন ‘বাণীটি লিখে নিয়ে এসো’। আজানগাছী দরবার শরিফের স্মরণিকা প্রকাশ করার জন্য একবার আমার ওপর দায়িত্ব পড়ে। এতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের বাণী ছাপা হয়েছে, যা উদ্যোক্তাদের লিখে দিতে হয়েছে, দায়িত্বশীল স্বনামধন্য ব্যক্তিরা শুধু স্বাক্ষর করেছেন। আমি বিআরটিসির চেয়ারম্যান থাকাবস্থায় ২০০৪ সালে ৪৫ বছর উদযাপন উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকায় রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সচিবদের বাণী ছিল, যার সবই বিআরটিসি থেকে লিখে দিতে হয়েছে। ফলে স্বনামধন্য ব্যক্তিরা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কী চিন্তাভাবনা করেন এবং জাতির প্রতি তাদের দিকনির্দেশনা সম্পর্কে জনগণ ও উদ্যোক্তা সংগঠন কিছুই জানতে পারেনি। স্মরণিকাতে বাণী প্রকাশে বিআরটিসি বা স্বনামধন্য ব্যক্তিরা মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন বলে আমি মন্তব্য করব না। তবে এটুকু বলতে চাই একটি মিথ্যার বহিঃপ্রকাশ, নাকি দায়িত্ব যথাযথ পালনে অনীহা, আমার বোধগম্য নয়। প্রবাদ রয়েছে, মানুষ হাসতে হাসতে পাপ করে। এখন দেখছি যে, মিথ্যা বলতে বা মিথ্যাকে সত্যে পরিণত করার প্রক্রিয়া দিনে দিনে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।

সত্যের ওপর অধিষ্ঠিত থেকে নিষ্ঠার সাথে নিজ দায়িত্ব পালন করার শপথ নিয়ে সাংবিধানিক পদ যারা দখল করে আছেন তারাও শুধু নিজ উদ্দেশ্যচরিতার্থ করার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে জনগণকে ধোঁকা দিচ্ছেন, বিনিময়ে শাসকগোষ্ঠীর আজ্ঞাবহ হয়ে ভবিষ্যৎ বংশধরসহ সুখে শান্তিতে জীবন কাটানোর নিশ্চিয়তা আদায় করে নিচ্ছেন এবং একটাই জাতির অন্যতম একটি ট্র্যাজেডি। দায়িত্বশীল বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারে বসে মিথ্যা বলা বা মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করার যে প্রবণতা বা সংস্কৃতি শুরু হয়েছে তা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কারণ দেশপ্রেমের পরিবর্তে চলছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় নিজেদের অধিষ্ঠিত রাখার প্রবণতা। একটি মিথ্যাকে প্রমাণ করার জন্য ১০টি মিথ্যা কথা বলা হয়, তার পরও মানুষ মিথ্যা বলে, অহরহ বলে এবং যেখানে মিথ্যা বলার প্রয়োজন নেই সেখানেও বলে। ফলে কোনটি সত্য, কোনটি মিথ্যা বা কোনটি অর্ধ মিথ্যা তাও নির্ণয় বা নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। প্রায় ২০ বছর আগে একটি আলোচনায় শুনেছিলাম যে, জাপানে গণিকাবৃত্তিতে নিয়োজিত পতিতারা তাদের সাথে চুক্তিভিত্তিক মজুরি গ্রহণ করে, কিন্তু বকশিশ নেয় না। অন্য দিকে বাংলাদেশে প্রকারান্তরে ঘুষ ছাড়া একটি টেবিলের ফাইল অন্য টেবিলে যায় না। ইনকাম ট্যাক্স অফিসের লোকেরা এর নাম দিয়েছে ‘টেবিল মানি’। ‘টেবিল মানি’ এখন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে, ব্যতিক্রম কিছু থাকলেও চোখে পড়ার মতো নয়। যারা টেবিল মানি ছাড়া কাজ করে না তাদের মধ্যে অনেকেই বছর বছর হজ করছে অথচ ঘুষ নিতে বিবেক এতটুকু দংশন করে না।

মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ পাক বলেছেন যে, ‘সূর্য ও চন্দ্র নির্ধারিত কক্ষপথে ভ্রাম্যমাণ। তারকা ও গাছপালা তাকেই (আল্লাহকে) সেজদারত’ অর্থাৎ আল্লাহর দেয়া নিয়মেই সমর্পিত অর্থাৎ আল্লাহ প্রদত্ত দায়িত্ব পালন করে (সূত্র : সূরা আর রহমান আয়াত ৫/৬) মানুষকেও সৃষ্টি করা হয়েছে দায়িত্ব পালনের জন্য এবং সৃষ্টির সময় এ দায়িত্ব পালনের জন্য মানুষ সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ। দায়িত্ব ও কর্তব্যের পাশাপাশি বিবেকই জীবন ধারণের একমাত্র চালিকাশক্তি। বাংলাদেশে খাদ্যে যে পরিমাণ ভেজাল দেয়া হয়, সে পরিমাণ ভেজাল দেয়ার প্রবণতা পৃথিবীর অন্য কোনো রাষ্ট্রে নেই। আমাদের দেশে মানুষের জটিল রোগ হওয়ার অন্যতম কারণ ভেজাল খাদ্য ও নিম্নমানের মাদকাসক্ততা।

আদালতে সাক্ষ্য দেয়ার আগে মিথ্যা সাক্ষ্য দেবে না বলে শপথগ্রহণ করার পরও মানুষজন অহরহ মিথ্যা সাক্ষ্য দিচ্ছে। মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া নৈতিকতাবিরোধী বা জনগণের কাছে হেয় হতে হয়, এ কথা যেন মানুষ ভুলে গেছে। সরকারি আমলারা জনগণকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে মিথ্যা কথা বলে। রাজনীতিবিদদের মধ্যে অনেকেই রয়েছেন যারা জনগণকে ধোঁকা দিতে আস্থাহীনতায় পড়েছেন। জনগণের আস্থা বনাম ক্ষমতার দাপট এখন সমান্তরাল গতিতে চলছে না, বরং বিপরীতমুখী অবস্থানে রয়েছে।

বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার হত্যা মামলায় ২০ জন ছাত্রের ফাঁসি ও পাঁচজনের যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে। যাদের সাজা হয়েছে তারাও মেধাবী ছাত্র। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে একজন ছাত্রকে বুয়েটে ভর্তি হতে হয়। একজন অভিভাবক তার সন্তানকে বুয়েট পর্যন্ত পৌঁছাতে জীবনের সর্বস্ব ব্যয় করতে হয়। আবরার হত্যায় শাস্তি হয়েছে সন্তুষ্ট হয়েছি, কিন্তু আনন্দিত হইনি এ কারণে যে, দেশের ২৫টি পরিবার থেকে ২৫ জন সম্ভাবনাময় প্রকৌশলী ঝরে গেল। রাজনীতিতে লেজুড়বৃত্তি প্রকট আকার ধারণ করায় ছাত্র-শিক্ষকরা এখন লেখাপড়া বা গবেষণায় আত্মনিয়োগ করার পরিবর্তে নেতা বা নেত্রীদের খুশি রাখার কাজে বেশি আত্মনিয়োগ করে বিধায় শিক্ষাঙ্গনে খুন খারাবির গোড়াপত্তন হয়েছে।

সৃষ্টিকর্তা ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার জন্য শুধু তাগিদ নয়, বরং নির্দেশনা দিয়েছেন। মানুষ প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে এটাও নৈতিকতা। কিন্তু প্রতিশ্রুতি বা ওয়াদা করার সময়ই চিন্তা করে কিভাবে ওয়াদা ভঙ্গ করা যায়। কাগজ কলমে লিখিত দলিল করার পরও দলিলকে অস্বীকার করে। অন্য দিকে আলোচনায় শর্ত দেয়া হয়নি, কিন্তু কথার মারপ্যাঁচ দিয়ে দলিলের ভিন্নতর ব্যাখ্যা দিয়ে জটিলতার সৃষ্টি করে। মিথ্যা যে নৈতিকতা পরিপন্থী একটি বিষয় তা কেউ উপলব্ধি করে না, বরং এটিকে কৌশল মনে করে নিজেকে বুদ্ধিমান বা ইনটেলেকচুয়াল মনে করে।

শুধু দালানকোঠা বা অবকাঠামোর উন্নয়নই জাতির উন্নয়ন নয়। অবকাঠামোর উন্নয়ন একটি গোষ্ঠী যারা ক্ষমতার ছত্রছায়ায় থাকে তারাই ভোগ করে। কিন্তু আমজনতা ভোগ করতে পারে না। কিন্তু সার্বিকভাবে নৈতিকতার প্রশ্নে একটি জাতির যদি গুণগত উন্নয়ন হয় তবে দু’বেলা খেয়ে পরে একটি জাতি সম্মানজনক সহ-অবস্থানে সম-অধিকারে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপত্তার চাদরে বেষ্টিত বসবাসযোগ্য একটি বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারে।

লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী
(অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
বায়ু দূষণে বিশ্বের শীর্ষে ঢাকা ভারত-শাসিত কাশ্মিরে গুরুত্বপূর্ণ সুড়ঙ্গপথের উদ্বোধন করলেন নরেন্দ্র মোদি জাপানে সুনামি সতর্কতা প্রত্যাহার মিরসরাইয়ে বাণিজ্য মেলায় কথা কাটাকাটি : যুবদল কর্মী নিহত, আহত ১০ আ’লীগের নির্যাতনের সময় প্রতিটা দিন বছর মনে হয়েছে : রিতা সিলেট পর্ব শেষে শীর্ষে রংপুর, তলানিতে ঢাকা চলতি বছরের মাঝামাঝিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি তুলবে বিএনপি রাজধানীর উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণে বিশৃঙ্খলা শ্রমিকদের মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা চাইলেন প্রধান উপদেষ্টা অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে রেফারেন্স প্রক্রিয়া নিয়ে রিট খারিজ চীনা রাষ্ট্রদূতের সাথে বৈঠক মির্জা ফখরুলের

সকল





up