দয়া করে পানি নিয়ে ভাবুন
- সালাহউদ্দিন বাবর
- ০৪ ডিসেম্বর ২০২১, ১৯:৪৮, আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০২১, ১৯:৫২
এই নিবন্ধের যে উপজীব্য বিষয়, সে বিষয়টি নিয়ে যথাস্থানে উপনীত হওয়ার আগে কিছু পূর্বকথা বলে নেয়া আবশ্যক বলে মনে করছি। বলা যায়, তা এই নিবন্ধের প্রারম্ভিক পর্ব। তবে পাঠকদের আশ্বস্ত করতে চাই লেখার এই প্রারম্ভিক কাজে নিবন্ধের মূল সুরটি গুঞ্জরিতই হয়েছে। হয়ত লেখার কেন্দ্রে পৌঁছার আগে পাঠক এই প্রারম্ভিক অংশটুকুকে খুব একটা প্রাসঙ্গিক বলে মনে না-ও করতে পারেন। তবে আমাদের প্রত্যয়, বক্তব্যের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় বা ‘থিম’ থেকে আমরা বিচ্যুত হবো না বা পথ হারাব না।
মনে করি না, এমন কোনো অভিযোগ উঠতে পারে যে, পাঠক বক্তব্যের বিষয় নিয়ে বিরক্তবোধ করবেন। আমাদের এ-ও আকাঙ্ক্ষা, সব পাঠক যেন তার মনোযোগ না হারিয়ে ফেলেন।
সবাই জানেন, যেখানে পানি সেখানেই জীবন ও তার জাগরণ। যেখানে পানি নেই সেখানে জীবনের কোনো স্পন্দন নেই, এটাই ধ্রুব সত্য। বিশ্বের অনেক দেশ, যাদের ধনসম্পদের কমতি নেই, তারা গ্রহান্তরে পানির সন্ধানে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। তবে তারা এখনো চাতকের মতোই হয়ে আছে। জীবনের জন্য সব চেয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর অন্যতম হচ্ছে পানি। অথচ সেই পানিই আজ এক দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে পানি জীবনবৎ ছিল। তা এখন মানব সভ্যতার ধ্বংসের ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে আবির্ভূত; বাংলাদেশসহ বিশ্বের শত শত কোটি মানুষ ও প্রাণিকুলের জন্য বিভীষিকায় পরিণত হয়েছে, সব কিছুর জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সংবাদপত্রের সচেতন পাঠক আগে থেকে ওয়াকিবহাল এই সমস্যা নিয়ে। বহুদিন থেকেই বিজ্ঞানীরা বিচলিত ও শঙ্কিত। দায়িত্বশীল মিডিয়া তা খবরের কাগজ হোক কিংবা অন্য কোনো গণমাধ্যমই হোক বিজ্ঞানীদের সেই বিচলিত হওয়ার কথা প্রচার করছে; সাংবাদিকের দায়িত্ব অভিজ্ঞতা যা দৃশ্যমান হয় তার আলোকে তা প্রচার করা। মিডিয়াকর্মী কখনো কল্পনাপ্রসূত কিছু প্রচার করে না। এই নিবন্ধকার একটি জাতীয় দৈনিকের সংবাদকর্মী। সেহেতু এ লেখায় খবরের কাগজের কথাই বেশি প্রাধান্য পেতে পারে। তবে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই, অন্যান্য মিডিয়াকে আমরা খাটো করে দেখছি। সব সাংবাদিকের তো একটাই মোটো ‘সত্যের খেদমত করা’; এই তার ধর্ম। পানি নিয়ে ওপরে যা বলা হয়েছে, মিডিয়া তা প্রথম থেকে সবাইকে হুঁশিয়ার করে আসছে। সংবাদপত্রে তথা দায়িত্বশীল সংবাদপত্রে যা কিছু প্রকাশিত হয়, তার কিছু কল্পনার রাজ্য থেকে চয়ন করা বা মনের মাধুরী মেশানোকে গর্হিত ও নীতির পরিপন্থী বলে বিবেচনা করা হয়। তা ছাড়া সংবাদপত্রের নিজস্ব একটা ব্যাকরণ রয়েছে, তা যদি লঙ্ঘিত হয়, তবে প্রবীণ বোদ্ধা সম্পাদকের কাঁচি তো রয়েছে। দেশ বিদেশের চলমান ঘটনা এবং পরিস্থিতি যা হওয়ার যোগ্য তাই কেবল প্রকাশের জন্য নির্বাচন করা হয়। সেখানে মানুষের রুচি মূল্যবোধ সভ্যতার বিকাশ, জনগণের ধর্মানুভূতির মতো স্পর্শকাতর বিষয়গুলো যথেষ্ট বিবেচনায় নেয়া হয়। আর সম্পাদকীয় পাতায় খবর, বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনা এবং সমস্যা নিয়ে যে ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ প্রকাশ পায়, তা অত্যন্ত সতর্কতা ও সততার সাথেই করা হয়। লেখকের শুভ বোধ, সৎ বিবেচনা বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনা থেকেই উৎসারিত হয়ে থাকে। লেখক এটাও দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস করেন, সত্যটাই বিবেচনার বিষয়। সংবাদকর্মী মানেই গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাবান। তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের সাথে সবাই একমত হবেন, তা তারা মনে করেন না। তবে সত্য ঘটনার কোনো যমজ নেই।
সত্যিকথা গণতান্ত্রিক সমাজে, দ্বিমত করা গণতন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাই দায়িত্বশীল মিডিয়ায় কিছু প্রকাশ পাওয়া আর প্রচারিত হওয়ার ক্ষেত্রে বিধিবিধান আছে, তা বলেছি। গণতন্ত্র অর্থ ‘ফ্রি স্টাইল নয়’। কারো অভিমতের সাথে সবাইকে অভিন্ন মত পোষণ করতে হবে; তা-ও সঠিক নয়। ধৈর্য ও পরমত সহ্য করার মানসিকতা গণতন্ত্রের শর্ত।
বলা প্রয়োজন বোধ করছি, আজ বিশ্বে পানি নিয়ে যতটুকু সতর্কতা, সৃষ্টি হয়েছে, তা মিডিয়ার নিরলস প্রচেষ্টার কারণে। সমাজের অন্য শ্রেণীর মানুষের মধ্যে তা লক্ষ করা যায় না। আমাদের দেশের কথাই বলছি, রাজনীতিবিদসহ কেউ এ সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন না। অথচ মিডিয়া অনবরত এ নিয়ে তৎপর রয়েছে, একে তারা দায়িত্ব-কর্তব্য বলে বিবেচনা করছে। আমরা এ লেখার পূর্বকথা তথা প্রারম্ভিক বিষয় নিয়ে যা বলেছি তার অবসান ঘটিয়ে মূল আলোচনায় যেতে চাই।
অনেককাল আগের কথা। তখন শহীদ জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন। সে সময় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর দিন যেন ফুরিয়ে আসছিল। গণতন্ত্রের চেতনা ধীরে ধীরে বিকাশ পাচ্ছে গোটা বিশ্বে। আমাদের কথা বলা বা কথা শোনানোর একটা পরিবেশ যেন সৃষ্টি হচ্ছিল। আর বিশ্বে গণতন্ত্রের প্রতি আগ্রহ বাড়ছিল। সে সময় আমার সাংবাদিকতার বয়সও খুব বেশি দিন হয়নি। তখন যে পত্রিকায় কাজ করতাম, সেখানে লেখার খুব একটা বাধার সম্মুখীন হচ্ছিলাম না। এই উপমহাদেশের অপর এক রাষ্ট্র পাকিস্তানে জেনারেল জিয়াউল হকের কঠিন শাসনের অবসান হয়, তার মৃত্যুর পর। এক সময় পাকিস্তানে নির্বাচনের ঘোষণা দেয়া হয়। বিশ্বের সর্বত্রই তখন সেই নির্বাচন নিয়ে উৎসাহ সৃষ্টি হয়েছিল; সবাই জানতে বুঝতে চাচ্ছিল, পাকিস্তানের নির্বাচনের ধরনটি কেমন হবে। এ সময় একদিন আমাদের পত্রিকার সম্মানিত সম্পাদক মহোদয় আমাকে নির্দেশ দিলেন পাকিস্তান ন্যাশনাল অ্যাম্বেলির আসন্ন নির্বাচনের খবর সংগ্রহের জন্য পাকিস্তানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে। যথারীতি প্রস্তুতি সম্পন্ন করে পাকিস্তান যাত্রা করলাম। এর আগে আরেকবার সে দেশে গিয়েছিলাম। আফগানিস্তানে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসনের খবর সংগ্রহের জন্য। তাই দ্বিতীয়বার পাকিস্তানে এসে খুব একটা সমস্যাবোধ করিনি। করাচি, লাহোর, পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের পূর্ব সীমান্ত জেলা সেকুপুরার সীমান্ত সংলগ্ন শহর নানকানা সাহেব, শিখ ধর্মের প্রবর্তক গুরুনানকের সমাধি এই ছোট্ট শহরেই অবস্থিত। রাওয়ালপিন্ডি, ইসলামাবাদ ও পেশোয়ার গিয়ে ১৯৮৮ সালের সেই নির্বাচন কভার করেছিলাম। স্মরণ করা যেতে পারে, সে নির্বাচনে পর বেনজির ভুট্টো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন। দেশে ফেরার সময় আসন্ন হলে ভাবলাম, লাহোর হয়ে করাচি থেকে দেশে ফেরার জন্য ফ্লাইট ধরব। লাহোরে এসে ইচ্ছা হলো এই ঐতিহাসিক শহরটিকে একটু ঘুরে দেখার। ট্যাক্সিতে করে ঘোরা ব্যয়সাপেক্ষ বলে সেখানে এক ঘোড়ায় টানা গাড়ি ‘টাঙ্গা’য় চাপলাম। আমি বৃদ্ধ চালকের পাশেই বসলাম, কেননা পেছনে একাকী বসে থাকলে শুধু শহর দেখাই হবে, কিছু জানা বোঝা যাবে না। টাঙ্গা চলতে থাকল। আমি বৃদ্ধ চালককে নানা প্রশ্ন করতে লাগলাম, ‘চাচাজি ইয়ে কেয়া হ্যায়’ ‘ও য়ো কেয়া হ্যায়’? একপর্যায়ে বৃদ্ধচালক কৌতূহলী হয়ে আমাকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘বেটা তুম কেয়া করাচিকে রয়নে ওয়ালা হো?’ আমি জবাব দিলাম, জি-নেহি চাচাজি, মেরা মুল্লুুক বাংলাদেশ, ম্যায় আখবর ওয়ালা হুঁ (সাংবাদিক)। আপলোগোকা যো চুনাই (নির্বাচন) হো চুকা, ওসকা খবর বাংলাদেশ মে হ্যায় যো আখবরমে ম্যায় কাম করতে। ভেজনেকে লিয়ে পাকিস্তান আয়া। আপলোগোকা যো চুনাইকে খবর ভেজনেকে লিয়ে পাকিস্তান আয়া হু। টাঙ্গা চালক খানিকক্ষণ নীরব থেকে বলেন, আচ্ছা! আবার কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। এরপর বললেন, বেটা, সিয়াসৎ (রাজনীতি) বহুৎ বুড়া চিজ হ্যায়। মেরা একিন হোতা, কেয়া আগার শেখ সাহাবকো পাওয়ার দে দেনেছে কেয়া বুড়াই হোতা থা। শুনো, বেটা ভুট্টোনে বাড়া গাদ্দার থা। আমি নীরবতা অবলম্বন করলাম। তবে অশিক্ষিত টাঙ্গওয়ালার বিবেচনাবোধ আমাকে হতভম্ব করেছিল রাজনীতির ‘খল নায়কদের’ ব্যাপারে তার মূল্যায়ন শুনে। উচ্চ বোধের জন্য মনে মনে তার প্রশংসা করলাম।
বহুদিন পর দেশের অতি সাধারণ এক ব্যক্তির সাথে কথা হচ্ছিল। নানা কথার মধ্যে হঠাৎ করে রাজনীতির প্রসঙ্গ তুলে তিনি বললেন, ‘বাবা রাজনীতি তো ‘ধাপ্পাবাজি’। রাজনীতি নিয়ে মানুষের এমন বীতশ্রদ্ধ হওয়া শুধু এই দুই দেশেই নয়। তৃতীয় বিশ্বের প্রায় সব দেশেই এমনটি। কেননা এসব দেশের রাজনীতির সাথে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা নেই বলা চলে। রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মন-মানস কর্মকাণ্ড সবাইকে হতাশ ও ক্ষুব্ধ করে। তবে বহু মানুষের এই বোধ ও মনোভাব মুদ্রার একটা পিঠ বটে। এই বোধকে অবমূল্যায়ন করছি না। তবে মুদ্রার আর একটি পিঠও আছে যারা রাজনীতি থেকে ‘ওম’ তথা উষ্ণতা লাভ করেন। তাদের সাধারণের মতো দুঃখ কষ্ট বেদনা স্পর্শ করে না। তাদের স্বাচ্ছন্দ্য আর চাওয়া-পাওয়া তো কখনই ঠেকে থাকে না। সে জন্য রাজনীতি নিয়ে তাদের একেবারেই ভিন্ন অনুভূতি।
এখানে রাজনীতির বোধ বিবেচনার পার্থক্য নিয়ে একটা উদাহরণ তুলে ধরতে চাই। জেনারেল এরশাদ তখন রাষ্ট্রপতি, প্রবীণ রাজনীতিক মিজানুর রহমান চৌধুরীকে সরিয়ে জেনারেল এরশাদ বিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান তুখোড় বক্তা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে দিলেন। তার কিছু দিন পর জনাব মওদুদকে তার ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নিলেন। মওদুদের স্থলাভিষিক্ত করলেন সাবেক প্রখ্যাত শ্রমিকনেতা, মন্ত্রিপরিষদের প্রভাবশালী এক সদস্যকে যিনি তার রাজনীতি শুরু করেছিলেন শ্রমিকনেতা হিসেবে। সেই থেকে রিপোর্টার হিসেবে তার সাথে আমার দীর্ঘ সখ্য। জানলাম না, কিভাবে তিনি হঠাৎ শ্রমিকদের উত্তাল তরঙ্গ ছেড়ে ক্ষমতার রাজনীতিতে ঢুকে পড়লেন। যোগ দিলেন এরশাদ সাহেবের জাতীয় পার্টিতে। দলে যোগ দিয়েই দ্রুত সংগঠনের প্রথম সারির নেতা, সংগঠনের নীতিনির্ধারকদের একজন হয়ে উঠলেন। পরে মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, শেষে তো প্রধানমন্ত্রী হলেন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর যেদিন তিনি প্রথম জাতীয় সংসদে ভাষণ দিলেন, আমার অতি ঘনিষ্ঠ ও শ্রদ্ধাভাজন সেই প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শুনতে গভীর আগ্রহ নিয়ে সংসদে গেলাম। ভাষণের শুরুতে তিনি আনন্দে উদ্বেলিত এবং আবেগ-আপ্লুত হয়ে পড়লেন। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে ভাষণের শুরুতে বললেন, আজ মনে হচ্ছে আসলে রাজনীতি কত সুন্দর, কত মনোহর। সংসদের সাংবাদিকদের গ্যালারিতে বসে তার ভাষণ শুনলাম; তবে সে ভাষণ আমাকে আহত করেছিল। একজন প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা হিসেবে তার বহু বক্তৃতা আমি শুনেছি। সেসব বক্তব্য ছিল ক্ষোভ-বিক্ষোভ আর শ্রমিকদের অধিকার বঞ্চনা নিয়ে কথা থাকত। প্রচণ্ড জ্বালা ও সরকারের প্রতি থাকত হুমকি। অথচ যা আজ শুনলাম তাতে ব্যক্তির তোয়াজ বন্দনা প্রশংসা, আর আত্মপ্রসাদ, সরকারের যত প্রশংসা। অতীতের কথার সাথে সংসদে দেয়া বক্তব্যের ব্যবধান ছিল আকাশ পাতাল।
তবে এ কথা কেউ অস্বীকার করবেন না। ক্ষমতার সুঘ্রাণে এ দেশের বহু বিখ্যাত রাজনীতিক মোহিত হয়েছেন, কোথায় দল কোথায় দলীয় আদর্শ সব নিমেষে আলেয়ায় পরিণত হয়েছে। তাই জাতীয় পার্টির এই নেতা তথা প্রধানমন্ত্রী দল-আদর্শ বদলের ক্ষেত্রে প্রথম বা শেষ ব্যক্তি নন। হরহামেশাই রাজনৈতিক নেতাকে দলবদলের নাটকে অনেকে ক্লাউন বলেছেন। নেতাদের এমন রঙ বদল ও ব্যক্তিজীবনের হাজারো বৈপরীত্য, নানা ওলট পালটের বিষয় নিয়ে জনগণ রাজনীতি ও রাজনীতিকদের ব্যাপারে হতাশ, ক্ষুব্ধ এবং বিরূপ মনোভাব পোষণ করেন। তবে এও সত্য যে, শত প্রলোভনের হাতছানি উপেক্ষা করে বহু নেতাকর্মী সমর্থক দলের প্রতি নিষ্ঠা আর প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থেকেছেন, এতটুকু টলেননি।
দুর্ভাগা এই দেশের রাজনীতিকদের সম্পর্কে সামান্য কিছু কথা শুনলাম। এই দেশকে বিশ্বের মানুষ জানে, দুর্যোগ আর দুর্বিপাকের জনপদ হিসেবে। এমন ধারণা আসলে তেমন ভুল কিছু নয়। প্রকৃতপক্ষে আমাদের এই মাতৃভূমি যেন দুর্যোগেরই এক ভূখণ্ড। হাজার বছর ধরে মারাত্মক সব প্লাবন ঝড়-ঝঞ্ঝা সাইক্লোন, নিয়ত নদীভাঙনসহ সময়ে সময়ে মহামারী হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছে। আজো এমন দুর্যোগ থেমে নেই। কিন্তু এই দুর্যোগে অভয় দেয়া, মোকাবেলা, এসব দুর্যোগে কখনো অভয় দেয়ার কিংবা মোকাবেলা করতে কখনই কাউকে দৃঢ়চিত্তে আর অকুতোভয়ে কোনো ব্যক্তিকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি। আজকে সম্মুখে যে মহাবিপদ ঘরের দুয়ারে এসে গেছে সে পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় কবি নজরুলের বিখ্যাত কবিতা, ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার! এর কয়েকটি চরণ বারবার মনে পড়ছে। ‘দুর্গম গিরি কান্তার-মরু দুস্তর পারাবার, লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার! দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ, ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ? কে আছ জোয়ান, হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ। এ তুফান ভারী দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার!!’ তবে এখন ভয়াবহ দুর্যোগের যে বার্তা পাওয়া গেছে, তা এতটাই ভয়ঙ্কর সর্বগ্রাসী এতে ভীত বিহ্বল সন্ত্রস্ত হওয়া ভিন্ন গত্যন্তর নেই। কেবল আল্লাহই জানেন আমাদের বিধিলিপিতে কী লিখিত রয়েছে। তা মূলত পানিসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে ভয়াবহ এক অশনিসঙ্কট।
আজকে বিশ্বব্যাপী এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। কারণ পানি নিয়ে যত ভীতকর খবর। আর আমাদের এই পানিসংক্রান্ত সঙ্কট মূলত দ্বিবিধ। এই সঙ্কট এতটা ভয়াবহ যে, তা এই জনপদের মানুষ প্রাণিকুলকে মৃত্যুর দুয়ারে নিয়ে দাঁড় করিয়েছে। এক দিকে চরম বৈরী আবহাওয়া বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জের হিসেবে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি যার ফলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বিরাট এলাকা সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার ব্যাপার। বিশ্বে যে সকল দেশ সমুদ্র পানির উচ্চতাজনিত কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
আমাদের নেতাদের বোধ-বিবেচনা পরখ করে, বর্তমানে দেশের পানি নিয়ে যে ভয়াবহ দুর্যোগ আর সমস্যা তা নিয়ে তাদের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা কতটুকু তা বোঝা যাচ্ছে না। অথচ গণতান্ত্রিক দেশেই রাজনীতি ঘিরে থাকে জনগণের দুঃখ-কষ্ট সমস্যাকে নিয়ে। সে বিবেচনায় আমরা কোথায় অবস্থান করছি? সবারই এই বোধ জাগ্রত থাকা বাঞ্ছনীয়, সমস্যা যদি সর্বগ্রাসী হয় তবে তা কোন ব্যক্তিভেদে ছোবল দেবে না, সে রাজনীতির কেউকেটা হলেও রেহাই পাওয়ার জো থাকবে না। সবাইকে আগে থেকেই সতর্কতা অবলম্বন ও সাধ্যমতো প্রিকশন নেয়া দরকার। তাই আমাদের অনুরোধ, রাজনীতিকরা যেহেতু ক্ষমতার কেন্দ্র অথবা যারা রাজনীতিকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম। অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে নিজের অবস্থান থেকে তৎপর হয়ে ওঠা উচিত। রাজনীতিকরা দেশের সমস্যাকে কিভাবে মূল্যায়ন করেন তার কিছু আভাস ইঙ্গিত তো দিয়েছি।
দেশের নেত্রী পরিশ্রম করছেন; এটা দেখে তার সহযোগীদের এগিয়ে আসা এবং পাশে থাকা তাদের নৈতিক দায়িত্ব।
জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্তঃসরকার সংস্থা ‘ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল ফর ক্লাইমেট চেঞ্জেস’ (আইপিসিসি-এর এক গবেষণাপত্র বলেছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা আর ১ মিটার (৩৯.৩৭ ইঞ্চি) বাড়লে বাংলাদেশের মুল ভূ-খণ্ডের ১৭ দশমিক ২০ শতাংশ স্থলভূমি পানিতে তলিয়ে যাবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর বাংলাদেশের জাতীয় কৌশলনীতি অনুসারে, এর ফলে আড়াই কোটি মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। সংখ্যার ঘনত্ব ও সীমিত সম্পদের কারণে পরিবেশ উদ্বাস্তুদের অন্য জায়গায় স্থানান্তর করতে হবে এবং এতে ব্যয় হবে বিপুল অর্থ।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে মানুষের জীবিকার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। লোনা পানি সংক্রমণের কারণে বিভিন্ন ধরনের শস্য উৎপাদন ব্যাহত হবে, ফসলের গুণগত মানে পরিবর্তন ঘটবে। গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, সমুদ্রের পানি বৃদ্ধি পাওয়া গভীরতর সঙ্কট এবং এর মানের পরিবর্তনের ফলে অসংখ্য প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নে সামগ্রিকভাবে দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। এর প্রত্যক্ষ প্রভাব বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে এবং সামগ্রিকভাবে মানুষের শরীরে নির্দিষ্ট পরিমাণ লবণের প্রয়োজন আসে খাদ্য ও পানি থেকে। কিন্তু উপকূলীয় এলাকায় পানিতে লবণের পরিমাণ অনেক গুণ বেশি। এই পানি শরীরে প্রবেশ করলে স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যাবে। বিশেষ করে গর্ভবতী নারীদের জন্য তা হয়ে ওঠে অনেক বেশি বিপজ্জনক। গর্ভাবস্থায় নারীরা বেশি লবণাক্ত পানি পান করলে খিঁচুনি ও উচ্চ রক্তচাপ হয়। এ কারণে নারীদের গর্ভাবস্থায় সন্তান মারা যাওয়ার হার এসব এলাকায় বেশি।
আমরা বলে এসেছি, আমাদের দেশে এখন পানির দ্বিবিধ সমস্যা। এক দিকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে সমুদ্র থেকে ধেয়ে আসছে লবণাক্ত পানি। আর উত্তর পশ্চিম অঞ্চল থেকে মিষ্টি পানির উৎস ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। বাংলাদেশের ভূখণ্ডে নদীর সংখ্যা কত যা মিষ্টি পানি বহন করে নিয়ে আসে? কেউ কি বলতে পারবেন দেশের নদীর প্রকৃত সংখ্যা কত? আসলে কারো কাছে সঠিক হিসাব নেই। আর সব নদী দখল হচ্ছে অনবরত। কিছুকাল আগে সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির ১৩তম বৈঠকে যে তথ্য জানানো হয়েছে, তাতে নদ-নদী দখলদারির সংখ্যা ৪৯ হাজার ১৬২ জন বলে উল্লেøখ করা হয়েছে। তাই স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে এত বিপুলসংখ্যক নদ-নদী যদি দখলে চলে যেতে থাকে, আগামীতে নদীর হাল অবস্থা কী হবে?
নদী গবেষকরা মনে করেন একাদশ শতাব্দীতে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে নদীর সংখ্যা ছিল প্রায় এক হাজার ৫০০। তখন নদীগুলো ছিল প্রশস্ত গভীর ও পানিতে টইটুম্বুর। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সংগঠনের দেয়া তথ্যমতে দেশে এখন নদীর সংখ্যা মাত্র ২৩০টি। যে দেশকে নদীমাতৃক বলা হয়, সেখানে নদীর সংখ্যাও যদি ক্রমাগত কমতে থাকে তবে তার অর্থ, এ দেশ একসময় মরু অঞ্চলে পরিণত হবে।
পরিবেশের প্রধান চারটি উপাদানের মধ্য অন্যতম হচ্ছে পানি, আর সেই মিষ্টি পানির পরিমাণ যদি হ্রাস পায় তবে বাংলাদেশের মানুষ কোথায় যাবে? এ নিয়ে কোনো ভাবনা উদ্বেগ উৎকণ্ঠা তো কর্তৃপক্ষীয় পর্যায়ে দেখা যায় না।
আমরা বলে আসছি পানি আমাদের দক্ষিণ দিক এবং উত্তর দিকে হামলা চালাচ্ছে। দক্ষিণের বিষয় নিয়ে সামান্য কিছু বলেছি কিন্তু উত্তর দিক কিভাবে বিপদে পড়ছে তা নিয়ে অবশ্যই কথা বলতে হবে। বহু আগে একটা গান মুখে মুখে ফিরত ‘হায়রে কপাল মন্দ, চোখ থাকিতে অন্ধ’। আমাদের শুভাকাক্সক্ষী বলে যাদের গদ গদ ভাব, তারা আমাদের নদীর উজানে ৫০টির বেশি বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন।
এখানেই শেষ নয়। তারা আরো নদীতে এমন বাঁধ তৈরি করছেন, পানি প্রত্যাহার করে তাদের দেশে অন্যত্র পানি নেয়ার জন্য। গঙ্গার বাঁধ নির্মাণ করেছেন। অপর দিকে যমুনা নদীর উজানে ‘শংকোচ’ ক্যানেল খনন করে ভারতের উত্তরাঞ্চলে পানি নিয়ে যাচ্ছেন। অথচ আন্তর্জাতিক আইন হচ্ছে, ভাটির দেশের সম্মতি ব্যতিরেকে উজানে কোনো বাঁধ নির্মাণ করা বেআইনি।
নদী বস্তুত এ দেশের জীবনস্পন্দন। পানিই এই জনপদের প্রাণিকুল, বনবনানী, জীববৈচিত্র্যের অন্তর আত্মা। স্বাভাবিক কারণে পানির সাথে জড়িত জাতীয় অর্থনীতি, জীবনের বিকাশ। এমন কিছু এখানে নেই যার সাথে পানির গভীর সম্পর্ক নেই। অথচ পানি নিয়ে আমাদের সমস্যার কোনো শেষ নেই। পানির যত উৎস তা দিন দিন এভাবে কমছে, দূষিত হচ্ছে, নদী ব্যক্তির দখলে যাচ্ছে, ভরাট হচ্ছে। দেশের মধ্যমণি হচ্ছে ঢাকা, দেশের রাজধানী। সেই রাজধানী ঘিরে থাকা নদী- বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগ। এসব জলাধার আজ এতটা দূষিত, সেগুলোর পানি এখন ব্যবহারের অযোগ্য। পানির সৌন্দর্য হচ্ছে মৎস্য। এসব নদীতে এখন আর মাছ বাঁচতে পারে না। এই মহানগরীতে একসময় বহু খাল ছিল। তা আজ সব ভরাট হয়ে গেছে। সব দেশের শহরে যেসব নদী রয়েছে, সেসব নদীর পানির আধার নগরীর সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দেয়। লন্ডন মহানগরীর সৌন্দর্যের একটা বড় বিষয় হচ্ছে টেমস নদী। একসময় এই নদী দূষণে সব মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তাকে পরিচর্যা করে টেমসের পানিকে টলটলে করা হয়েছে।
কিছুকাল আগে আমাদের একজন কর্তাব্যক্তি বলেছিলেন, বুড়িগঙ্গাকে টেমসের মতো করা হবে। কিন্তু কোথায় সে প্রতিশ্রুতি? আমরা যে বাকসর্বস্ব, এসব বক্তব্য তারই প্রমাণ।
কিছু বিষয় রয়েছে যা রাজনীতি তকবিতর্কের ঊর্ধ্বে। সেখানে কোনো পক্ষ বিপক্ষ থাকে না। সে বিষয়ে সবাই একপক্ষ। অন্য বিষয়ে তর্কবিতর্কের লক্ষ্য হওয়া উচিত সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার। কিন্তু আমাদের দেশে পক্ষ-বিপক্ষের লক্ষ্য- ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও দলের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা। অত্যন্ত পরিতাপ ও নিজেদের নির্বুদ্ধিতার বিষয় আর সমস্যার স্বরূপ এত গভীর; জাতীয় নেতৃত্ব তা দলমত নির্বিশেষে সবার। যে পানি নিয়ে জাতি যখন জীবন মরণের সন্ধিক্ষণে, কেউ শুনেছে কি রাজনীতির অঙ্গনে সেটি নিয়ে কোনো আলোচনা!
লেখা শেষ করতে চাই এ কথা বলে যে, এক দিকে লোনা পানির ধেয়ে আসা অপর দিকে মিষ্টি পানির প্রাপ্যতা কমছে। তাই সুপেয় পানির যাতে এতটুকু অপচয় না হয়, তা বোঝা। এ প্রসঙ্গে রাসূল সা:-এর একটি বক্তব্যের মর্মকথা উল্লেখ করব। তিনি বলেছেন, ‘বহমান নদীর তীরে বসে কেউ যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটি কুলি করে সেটিও হবে পানির অপচয়।’ একজন বিশ্বাসী মুসলিম হিসেবে এর অনুসরণ করা আমাদের জন্য অপরিহার্য।
ndigantababor@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা