২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ম্যাডাম জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা বনাম প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা

-

৭৭ বছর বয়সী একজন অসুস্থ নারী যিনি দেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, বিএনপির চেয়ারপারসন, বেগম খালেদা জিয়া মুমূর্ষু অবস্থায় এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তার বিরুদ্ধে ৩০টির বেশি রাজনৈতিক মামলা হয়েছে যার মধ্যে দুটিতে সাজাপ্রাপ্ত, যার একটিতে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত কর্তৃক প্রদত্ত সাজা হাইকোর্ট আপিলে পাঁচ বছর বৃদ্ধি করে ১০ বছর নির্ধারণ করেছেন। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪২৬ ধারায় উল্লেখ রয়েছে যে, ‘দণ্ডিত ব্যক্তির আপিল সাপেক্ষে আদালত লিখিতভাবে কারণ লিপিবদ্ধ করিয়া আদেশ প্রদান করিতে পারিবেন যে, আপিলকৃত দণ্ড বা আদেশ কার্যকরীকরণ স্থগিত থাকিবে এবং আসামি আটক থাকিলে আরো নির্দেশ দিতে পারিবেন যে তাহাকে জামিনে বা তাহার নিজের দেয়া বন্ডে মুক্তি দিতে পারিবেন।’ হাইকোর্টে আপিল চলাকালে ফৌজদারি কার্যবিধিতে ৪২৬ ধারায় প্রদত্ত সুযোগ বেগম খালেদা জিয়ার ভাগ্যে জোটেনি। সে সুযোগ তিনি প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন অ্যাপিলেট ডিভিশন থেকেও পাননি। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস কত প্রকার ও কী কী হতে পারে, জীবন সায়াহ্নে বেগম জিয়ার নিয়তি বনাম প্রধানমন্ত্রীর (শেখ হাসিনা) কৌশল দেশবাসী উপলব্ধি করছে।

উচ্চ আদালত কর্তৃক জামিন নিতে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন কারাবন্দী ছিলেন, অসুস্থতা বৃদ্ধি পাওয়ায় তাকে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি থাকা অবস্থায় পরিবারের আবেদনক্রমে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা মোতাবেক প্রধানমন্ত্রী তার নির্বাহী আদেশে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে বিদেশে না যাওয়ার শর্তসাপেক্ষে দণ্ডাদেশ স্থগিত করে নিজ বাড়িতে থাকার সুযোগ দিয়েছেন। বর্তমানে বেগম খালেদা জিয়া সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় আছেন। মেডিক্যাল বোর্ড উন্নতমানের চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠানোর জন্য সুপারিশ করেছে। সরকার দৃঢ়তার সাথে বলছে যে, বিদেশে চিকিৎসা নেয়ার প্রার্থনা যেহেতু ইতঃপূর্বে সরকার নামঞ্জুর করে নিষ্পত্তি করেছে সেহেতু এ বিষয়টি Re-open করে পুনর্বিবেচনার আইনগত কোনো বিধান নেই (সূত্র : জাতীয় সংসদে আইনমন্ত্রীর বক্তব্য)। আইনমন্ত্রীর বক্তব্য সঠিক বলে আমি মনে করি না। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় উল্লেখ রয়েছে যে, ‘কোনো ব্যক্তি কোনো অপরাধের জন্য দণ্ডিত হইলে সরকার যে কোনো সময় বিনা শর্তে বা দণ্ডিত যাহা মানিয়া নেয় সেইরূপ শর্তে যে দণ্ডে সে দণ্ডিত হইয়াছে, সেই দণ্ডের কার্যকরীকরণ স্থগিত রাখিতে বা সম্পূর্ণ দণ্ড বা দণ্ডের অংশবিশেষ মওকুফ করিতে পারিবেন।’ এ ছাড়াও উক্ত ৪০১ ধারায় উপ-ধারা ৬ এ উল্লেখ রয়েছে যে, ‘সরকার সাধারণ বিধিমালা বা বিশেষ আদেশ দ্বারা দণ্ড স্থগিত রাখা এবং আবেদনপত্র স্থগিত রাখা এবং আবেদনপত্র দাখিল ও বিবেচনার শর্ত সম্বন্ধে নির্দেশ দিতে পারিবেন।’

ওই আইনে শর্ত মওকুফ করা বা শর্ত শিথিল করার সম্পূর্ণ ক্ষমতা রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ অর্থাৎ সরকারের কাছে রয়েছে। আইনমন্ত্রী ওই আইন যেভাবেই ব্যাখ্যা করুক না কেন সরকারপ্রধান প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে বেগম জিয়ার উন্নতমানের চিকিৎসার প্রশ্নে আইন প্রয়োগের বিষয়াদি।

সরকারি দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, বাংলাদেশে চিকিৎসা বর্তমানে অনেক উন্নতমানের। যদি তাই হয় তবে আমাদের দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীসহ ধনী শ্রেণী সবাই চিকিৎসা বা শরীর চেক-আপ করানোর জন্য অহরহ বিদেশে যাচ্ছেন কেন? যাদের অর্থ-কড়ি নেই তারাও তো শেষ সম্বল বিক্রি করে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাচ্ছেন। বিদেশে বেগম জিয়ার চিকিৎসার আবেদনটি কি বিবেচনাযোগ্য নয়? চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার প্রধান কারণ ১. পরীক্ষা নিরীক্ষার নির্ভুল ফলাফল এবং ২. দেশের অভ্যন্তরে চিকিৎসাব্যবস্থার ওপর দেশবাসী আস্থা রাখতে পারছে না।

সরকার বলতে চায় যে, নিষ্পত্তিকৃত বিষয়টি পুনঃবিবেচনা করার আইনি বিধান নেই। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৭ ধারায় জামিনের অযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে জামিন মঞ্জুর করার বিধান রাখা হয়েছে। ওই ধারায় শর্ত দেয়া হয়েছে যে, ‘আদালত এই দোষে (জামিনের অযোগ্য অপরাধ) অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তি ১৬ বছরের নিম্নবয়স্ক বা স্ত্রীলোক বা পীড়িত অক্ষম হইলে তাহাকে জামিনে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দিতে পারিবেন।

মানহানির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে জামিনযোগ্য ধারায় জামিন নিতে বেগম জিয়াকে সুপ্রিম কোর্টের অ্যাপিলেট ডিভিশনের শরণাপন্ন হতে হয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট অহরহ জামিনযোগ্য ধারায় জামিন দিয়ে যাচ্ছেন। অথচ সে আইন বেগম জিয়ার ক্ষেত্রে কার্যকর হয়নি। তিনি অসুস্থ, নারী এবং শারীরিকভাবে কি অক্ষম নন? আইন কি তার প্রশ্নে স্বাভাবিক গতি পেয়েছে?

সংবিধানের ১০৩ অনুচ্ছেদ মোতাবেক হাইকোর্ট বিভাগের রায়, ডিক্রি, আদেশ বা দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল শুনানি ও তা নিষ্পত্তির এখতিয়ার আপিল বিভাগের রয়েছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০৫ মোতাবেক আপিল বিভাগ নিজ প্রদত্ত রায় বা আদেশ পুনঃবিবেচনা করার ক্ষমতা রয়েছে। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে যে, সরকার সংশ্লিষ্ট আইনের ৪০১ ধারায় প্রদত্ত আদেশ কেন পুনঃবিবেচনা করতে পারবে না? ফলে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছাই এখানে মুখ্য বিষয়।
সরকারের যদি সদিচ্ছার ঘাটতি না হয় তবে বেগম জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর আইনগত বহু রাস্তা খোলা আছে। আইনের কাছে মানবতা পরাস্ত হতে পারে না। The Probation of offenders Ordinaance 1960 এবং The Probation of offenders Rules 1975 মোতাবেক সরকার যেকোনো সময় যেকোনো সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে মুক্তি দিয়ে স্বচ্ছন্দ্যে চলাফেরার সুযোগ দিতে পারে। অনুরূপ আইন পৃথিবীর সব রাষ্ট্রেই রয়েছে।

রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের অধিকার সম্পর্কে সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ‘কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ প্রদত্ত কোনো দণ্ডের মার্জনা, বিলম্বনা ও বিরাম মঞ্জুর করিবার অধিকার এবং যেকোনো দণ্ড মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করিবার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকিবে।’ কিন্তু সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ মোতাবেক রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাকে সম্পূর্ণভাবে খর্ব করা হয়েছে। ওই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ‘এই সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাহার অন্য সব দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রী পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন। তবে শর্ত থাকে যে, প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে আদৌ কোনো পরামর্শ দান করিয়াছেন কি না এবং করিয়া থাকিলে কী পরামর্শ দান করিয়াছেন, কোনো আদালত সেই সম্পর্কে কোনো প্রশ্নের তদন্ত করিতে পারিবেন না।’ সংবিধানের অত্র অনুচ্ছেদ মোতাবেক রাষ্ট্রপতি কর্তৃক কোনো কারণেই প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ব্যতীত ৪৯ অনুচ্ছেদে ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতা প্রয়োগ করা যাবে না। ফলে ঘুরে ফিরে সব ক্ষমতাই প্রধানমন্ত্রীর উপরে বর্তায়। এ জন্যই সরকারি দল প্রধানমন্ত্রীকে রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে সম্বোধন করে।

প্রধানমন্ত্রী, বেগম জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে আদেশ দিতে কেন অনীহা বা বিলম্ব করছেন, এ বিষয়টি নিয়েও পাবলিক পারসেপশনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। পাবলিক মনে করে যে, (১) বিদেশে উন্নতমানের পরীক্ষা নিরীক্ষায় হয়তো এ মর্মে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসতে পারে যে, কারারুদ্ধ অবস্থায় সরকার বেগম জিয়াকে যথাযথ চিকিৎসা প্রদান না করে অপচিকিৎসা দেয়া হয়েছে, (২) সরকার হয়তো মনে করতে পারে যে, বেগম জিয়া এ দুনিয়া হতে যত তাড়াতাড়ি বিদায় নেবেন সরকারের জন্য ততই মঙ্গল, (৩) সরকারপ্রধান হয়তো ক্ষোভ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হয়ে বেগম জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে অনীহা প্রকাশ করছেন। তবে এখন যা হচ্ছে জাতির জন্য সৃষ্টি হবে একটি খারাপ দৃষ্টান্ত।

১/১১ সেনা সমর্থিত সরকারের সময় দুই প্রধানমন্ত্রীর সাথেই দীর্ঘ দিন কারাবন্দী ছিলাম। আমার যতটুকু মনে পড়ে যে, প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) কারামুক্ত হয়ে সে সময় বলেছিলেন যে, তাকে স্লো পয়জন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য মোতাবেক বোঝা যায় যে, আমলাতান্ত্রিক এই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য স্লো পয়জনের একটি গোপন পদ্ধতি কারাগার সংস্কৃতিতে বিদ্যমান রয়েছে। বেগম খালেদা জিয়া দীর্ঘ দিন কারাবন্দী থাকাবস্থায় তাকেও স্লো পয়জন করা হয়েছে কিনা তা অবশ্যই সরকার নিয়ন্ত্রণমুক্ত উন্নতমানের হাসপাতালে নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যাবে এবং এ বিষয়টির কারণেও ম্যাডাম জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা ব্যাহত হচ্ছে বলে জনগণের মধ্যে একটি ধারণা ধীরে ধীরে বদ্ধমূল হচ্ছে।

জেলকোড অনুযায়ী বন্দীর স্বাস্থ্যের চিকিৎসা করার দায়িত্ব সরকারের। অসুস্থ অবস্থায় কোনো ফাঁসির আসামিকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানোর নিয়ম আইনে নেই। কারাগারে অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কারা কর্তৃপক্ষ কোনো বন্দীকে মেডিক্যাল অফিসারের সার্টিফিকেট ছাড়া শাস্তি কার্যকর করতে পারবে না। জেলকোডের ৫০ ধারায় উল্লেখ রয়েছে যে,
‘(১) শাস্তিমূলক খাবার একক বা যৌথভাবে, কিংবা বেত্রাঘাত, কিংবা ৪৬ ধারার (২) উপ-ধারার অধীন শ্রমের পরিবর্তনের কোনো শাস্তি সেই পর্যন্ত আরোপ করা যাইবে না, যেই পর্যন্ত মেডিক্যাল অফিসার যে বন্দীকে শাস্তি দেওয়া হইবে তাহাকে পরীক্ষা না করেন, যিনি, যদি মনে করেন যে বন্দী উক্ত শাস্তি গ্রহণের জন্য উপযুক্ত, তাহা হইলে ১২ ধারায় বর্ণিত শাস্তি বইয়ের যথোপযুক্ত কলামে সেই অনুযায়ী সার্টিফিকেট প্রদান করিবেন।

(২) যদি তিনি মনে করেন যে, বন্দী শাস্তি গ্রহণের জন্য অনুপযুক্ত, তাহা হইলে তিনি যথোপযুক্ত রেকর্ডে তাহার মতামত লিপিবদ্ধ করিবেন এবং বর্ণনা করিবেন যে, বন্দীকে যে ধরনের শাস্তি প্রদান করা হইয়াছে তাহার জন্য সে একেবারেই অনুপযুক্ত বা তিনি কোনো পরিবর্তনের প্রয়োজন মনে করেন কিনা।

(৩) শেষের ক্ষেত্রে তিনি বর্ণনা করিবেন যে, কী ধরনের শাস্তি বন্দী কোনো প্রকার শারীরিক ক্ষতি ছাড়া গ্রহণ করিতে পারিবে।’

সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগ অসুস্থতার গ্রাউন্ডে যাবজ্জীবন সাজার অভিযোগে অভিযুক্ত এবং সাজাপ্রাপ্ত অনেক বন্দীকে জামিন দিয়েছেন, দায়িত্ব নিয়েই এ কথা বলছি। রাজনৈতিক কারণে রুজুকৃত মামলায় রাজনৈতিক সাজা হওয়ার কারণেই ম্যাডাম জিয়া আইনি অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। জীবন সায়াহ্নে আইন আদালত তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ফলে বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ উন্নতমানের বৈদেশিক চিকিৎসা এখন সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করছে প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছার ওপর, আইনি দোহাই একটি বাতুলতা মাত্র।

লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
e-mail: [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement