এসব শিরোনাম কী কথা বলছে
- ড. মাহবুব হাসান
- ১৯ নভেম্বর ২০২১, ২১:০৫, আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৫:২৬
ভেবে দেখলাম যদি চার-পাঁচটি পত্রিকার শিরোনাম তুলে আনি, তাহলে তার আকার হবে অনেক বড়। শুধু শিরোনামেই লেখার জায়গা ভরে যাবে। তাই অন্তত একটি পত্রিকার কিছু নিউজের শিরোনাম তুলে ধরলেই সারা দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ছবি সুস্পষ্টভাবেই দৃশ্যমান হয়ে উঠবে।
‘এই সরকার নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছে : মির্জা ফখরুল’
‘উৎসবমুখর পরিবেশে সুষ্ঠু ভোট হয়েছে : ইসি’
এই পরস্পরবিরোধী শিরোনাম পড়ে যে কারো মনে এই প্রশ্ন জাগবে যে, আসলে সত্য কোথায় লুকিয়ে আছে? মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্য যদি সত্য ও অকাট্য মনে করি, তাহলে তার বক্তব্যের মর্ম উদ্ধারে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে হবে। সেই সাথে সন-তারিখ মিলিয়ে নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস করার উপাদানগুলো তুলে আনতে হবে।
আবার চলমান স্থানীয় সরকারব্যবস্থার নির্বাচন (ইউনিয়ন পরিষদ-ইউপি) নিয়ে নির্বাচন কমিশন (ইসি) যে কথা বলেছেন, তার সত্যাসত্য প্রমাণের জন্যও উপাত্ত সংগ্রহ করতে হবে। তার মানে, উভয়পক্ষের কথার মর্মোদ্ধারে আমাদের অনেক সময় ব্যয় করতে হবে। এসব নিয়ে মূলত কাজ করে কিছু সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান এবং রাজনৈতিক ও সামরিক থিংকট্যাংক নামক গবেষণা প্রতিষ্ঠান। তাদের কাজই আমাদের শেখায়, কেমন করে ঘটনাপ্রবাহের সত্য ও সঠিক উপাত্ত বের করে আনতে হবে।
সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ইলেকশন কমিশনের পক্ষে এমন কথা বলা উচিত নয়, যা তাদের সাংবিধানিক অধিকার ও কাজের মধ্যে প্রকৃত তথ্য-উপাত্ত নিয়ে সন্দেহের উদ্রেক করে। এ জন্য তারা এমন কথা বলবেন, যেখানে প্রকৃত সত্য প্রতিফলিত হয়।
আর রাজনৈতিক নেতারা জনগণের মন-পাঠের শিক্ষায় শিক্ষিত ও রাজনৈতিকভাবে প্রশিক্ষিত। তারা তাদের লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য সত্যকে আরো একটু বাড়িয়ে বলবেন, এটিই আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের অগণতান্ত্রিক রাজনীতির উপরি-কাঠামো। তারা চান, প্রকৃত সত্য প্রকাশ পাক।
স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের কয়েকটি শিরোনাম তুলে আনা যাক।
‘পিস্তল ঠেকিয়ে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আবেদনপত্রে সই নেয়ার ঘটনায় তাঁতীলীগ নেতা গ্রেফতার’, ‘সামনের নির্বাচনে যদি ১০ মার্ডারও হয়, আমি সিরাজুল মাঠ ছাড়ব না’, ‘রূপগঞ্জে নির্বাচনোত্তর সহিংসতায় এক নারী গুলিবিদ্ধ, আহত ৩০’, শরিয়তপুরে পরাজিত প্রার্থীর হামলায় নির্বাচন কর্মকর্তা আহত’, ‘ফলাফল ঘোষণার পর নানা স্থানে সংঘর্ষ, আহত ২০’, ‘বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের ৪০ বাড়িতে হামলা ও লুটপাটের অভিযোগ’, তেঁতুলিয়ায় ইউপি নির্বাচনে কুপোকাত আওয়ামী লীগ’, ‘বেগমগঞ্জে ১৪টির মধ্যে ৮টি ইউপিতেই স্বতন্ত্রপ্রার্থী জয়ী’, ‘ঠাকুরগাঁওয়ে পোলিং এজেন্ট দিতে পারেননি নৌকাপ্রার্থী’, ‘নাসিরনগরে নির্বাচনের ফল পাল্টানোর অভিযোগ’। আমরা যদি প্রথম পর্যায়ে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনের উপাত্ত খুঁজি, তা হলে এরকম আরো নগ্ন-নিষ্ঠুর রাজনৈতিক পরিস্থিতির সংবাদ পাবো, যা আমাদের গ্রামবাংলায় রাজনৈতিক সন্ত্রাস ও হিংসার রক্তপাত ও লাশের দেখা পাবো। আপাতত সে পথে আমরা যাবো না।
রাজনীতিকে বহু আগেই সহিংসতার দিকে ঠেলে নিয়ে গেছেন রাজনীতিকরা। তাদের রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা ও মাসলম্যানের ওপর রাজনীতির দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ায় এমনটি ঘটেছে। আমরা যদি পরিসংখ্যান নিই, বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশে কতটা রক্তাক্ত হানাহানির ঘটনা ঘটেছে এবং সেগুলো কোথায় ঘটেছে, তা হলেই সত্য বেরিয়ে আসবে।
ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে, রাজনৈতিক সহিংসতায় মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে সন্ত্রাসীরা, তার জন্য তো অন্য কোনো আদর্শের রাজনৈতিক কর্মী জড়িত নয়। ওই সব সহিংসতার সাথে ওতপ্রোত আওয়ামী লীগেরই মফস্বল স্তরের নেতাকর্মীরাই এবং তাদেরই ইঙ্গিতে ও প্ররোচনায় এবং অস্ত্রের সহযোগিতায় ওই সব প্রাণ ঝরে গেছে, আহত হয়েছে কর্মী নামক রাজনীতিকদের সমর্থক। বুঝতে কষ্ট করতে হচ্ছে না যে আওয়ামী রাজনীতির নিচের তলায় বসবাসকারী রাজনৈতিক কর্মীরা কতটা সশস্ত্র, কতটা প্রাণ হরণে সিদ্ধহস্ত। এ হত্যার রাজনীতির সূচনা কেমন করে হলো বাংলাদেশের মাটিতে, কারা এর পেছনের কলকাঠি নাড়ানোর লোক, কারা অস্ত্রবাজিতে ইন্ধন জোগাচ্ছে, কারা সরবরাহ করছে অস্ত্র, কী তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য - সেসবই খুঁজে বের করতে হবে। তা না হলে আগামী দিনে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে না, সন্ত্রাসী-রাজনীতিকরাই প্রতিপক্ষ হয়ে উঠবে। সৃষ্টি হয়ে উঠতে পারে গৃহযুদ্ধের মতো ভয়ানক পরিস্থিতি। আমরা যে নীতি-আদর্শেরই মানুষ হই না কেন, ক্ষমতার লোভ পরিত্যাগ করতে হবে। রাজনৈতিক শিক্ষায় ক্ষমতায়নের চলমান নীতি পরিত্যাগ করে ‘মানব সেবা’ই ধর্ম হয়ে উঠতে হবে। এ জন্য গণতান্ত্রিক রাজনীতির শিক্ষা ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি, মানুষের সেবা, অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক পরিবেশ ও সুস্থ রাজনীতি চর্চার ভেতর দিয়ে স্বাভাবিক হয়ে উঠতে হবে।
কথাটা বলা সহজ কিন্তু সেই পথে যাওয়া অত্যন্ত কঠিন। কারণ যারা যাবেন, তারা তো একটি নারকীয় পরিস্থিতির ভেতরে বাস করছেন। এই মোহময় ও ক্ষমতার নিষ্ঠুর কক্ষপথ ছেড়ে যাওয়া অত্যন্ত দুরূহ।
২.
মূলত বাংলাদেশকে একটি রাজনৈতিক যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করার লক্ষ্যেই পরিচালিত হচ্ছে রাজনৈতিক সন্ত্রাসের এই নোংরা খেলা। কেন ও কারা এসব করছে তা এখনো পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। তবে আমরা যে একটি অন্ধকার সুরঙ্গের ভেতরে ঢুকে পড়েছি, সেটি অনুধাবন করা কঠিন নয়। লক্ষ করা যাচ্ছে, এই স্থানীয় স্তরের নির্বাচনের নিয়ন্তাশক্তি, নির্বাচন কমিশন, স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা, পুলিশ ও রাজনৈতিক দল, এদের মধ্যে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ, সন্ত্রাসমুক্ত, ভোট প্রদানে সহায়ক পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য তেমন কোনো তৎপরতাই নেই। ধারাবাহিকভাবে ইউপি নির্বাচনে যে সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসীরা ঢুকে পড়েছে, তা জানা সত্তে¡ও সরকার এ নিয়ে উদ্বিগ্ন নয় বা ছিল না। প্রথম ধাপের পরই উচিত ছিল কিভাবে সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় সেই ব্যবস্থা নেয়া।
১৯৮৮ সালে ৮০ জন (এরশাদের শাসনামল), ১৯৯৭ সালে ৩১ জন (হাসিনা সরকারের আমল), ২০০৩ সালে ২৩ জন (খালেদা সরকারের আমল), ২০১১ সালে ১০ জন (হাসিনা সরকারের আমল), ২০১৬ সালের ৬ জুনের ইউপি নির্বাচনে ১০৯ জন, ভিন্ন মতে ১৪৩ জন মারা গিয়েছিল (হাসিনা সরকারের আমল) এবং সর্বশেষ ২০২১ সালের এপ্রিল মাস থেকে ইউপি নির্বাচনে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে চলমান নির্বাচনে যেসব মৃত্যুর ঘটনা ঘটে চলেছে, তা এটিই প্রমাণ করে যে ক্ষমতা ও সন্ত্রাস সহোদরের ভ‚মিকায় নেমে এসব নৃশংসতা করছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ১৯৭৩, ১৯৭৭, ১৯৮৩, ১৯৯২ সালে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে কোনো রকম হত্যার ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু ১৯৮৮ সালে এরশাদের শাসনামলে ইউপি নির্বাচনে ৮০ জন হত্যার শিকার হয়। ১৯৮৭ সালে ৩১ জন, ২০০৩ সালে ২৩ জন, ২০১১ সালে ১০ জন প্রাণ হারান।
এই পরিসংখ্যান কী প্রমাণ করে? প্রমাণ করে যে স্বাধীনতার পর গ্রামপর্যায়ে রাজনীতিতে ক্ষমতার রাজনৈতিক হিংস্র থাবার বিস্তার তেমনভাবে ঘটেনি। কারণ কি সেসব নির্বাচন অরাজনৈতিক প্রার্থীদের ছিল? ব্যতিক্রম কেবল ১৯৮৮ সালে, এরশাদের আমলে তা ছড়িয়ে পড়ে। জনগণের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস না থাকলে, রাজনীতি জনগণসম্পৃক্ত না হলে খুনি-সন্ত্রাসীরাই সেই জায়গা দখল করে নেয়। তবে সেই নির্মমতার পেছনের শক্তি হিসেবে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক হাত থাকে। আর ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের মধ্যে জনসম্পৃক্ততা থাকলে (১৯৯২) ইউপি নির্বাচনে কোনো রকম হত্যার ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু আবারও দেখা যায়, রাজনীতিতে জনসম্পৃক্ততার অভাব। ১৯৯৭ সালের হত্যার ঘটনাই তার প্রমাণ।
গোটা বিষয়টি পর্যালোচনা করলে এটিই দাঁড়ায় যে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জনগণমনস্কতার অভাব রয়েছে। গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও রাজনৈতিক গণভিত্তি কমতে থাকায়, সন্ত্রাস সেই শূন্যস্থানে জায়গা করে নিয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। এবার ইউপি নির্বাচনে প্রতিপক্ষ হিসেবে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল প্রকাশ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেই। এবার সরকারি দলের মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থী ও মনোনয়ন না পাওয়া ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীদের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এটি হতে পারত না, যদি ক্ষমতাসীন দলের ভেতরে গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারা চলমান থাকত। ফলে মনোনয়নগুলো হয়েছে ব্যক্তিগত পছন্দ ও অপছন্দের মধ্যে। প্রত্যেক প্রার্থীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছে বিদ্রোহী প্রার্থী। দল তাদের থামাতে পারেনি। ঠিক একই কারণে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদেরও থামাতে পারেনি প্রশাসন, পুলিশ ও নির্বাচন কমিশন। আমরা জানি, নির্বাচনের সময় স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ ইসির অধীনে থাকে। ইসি যেভাবে তাদের পরিচালনা করবে, তারা সেভাবেই কাজ করবে। ইউপি নির্বাচনে ইসির ভ‚মিকা ঠুঁটো জগন্নাথের মতো। একটি বিতর্কিত ও ব্যর্থ সিইসি ও ইসির কারণেই যে গ্রামস্তরের নির্বাচনে এমন নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চলেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা, ইসির গড়িমসি, সিদ্ধান্তহীনতা, নিরাপত্তা বিধানে নির্বাচনী বিধিবিধানের আরোপ না করা, অর্থাৎ ইসির ভূমিকা কঠোর না হওয়ায় এসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে মনে করা যায়। ইসির কঠোর ভূমিকা নির্বাচনী পরিবেশ অনেকটাই শান্ত ও সহজ করে আনতে পারত। কিন্তু ইসি এটি করেনি।
এর ফলে আমাদের স্থানীয় নির্বাচনে যারা নির্বাচিত হলেন, তাদের বেশির ভাগই রাজনৈতিকভাবে ‘দুর্ধর্ষ’ প্রকৃতির মানুষ। শোনা যায়, কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে এরা ইউপিতে বিজয়ী হয়েছেন। এরা গ্রামের মানুষদের কিভাবে সেবা দেবেন? তারা নিজেরাই তো অন্যায়, অপকর্ম ও সন্ত্রাসের সাথে প্রকাশ্যে ও পরোক্ষে জড়িত। এদের কাছে থেকে কী জনসেবা পাওয়া যাবে? কোটি টাকা খরচ করে যারা ক্ষমতায় গেছে তারা তাদের বিনিয়োগ আগে তুলে নেবে। এটি জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতি ও নির্বাচনেরই অপচ্ছায়া!
এই সন্ত্রাসকবলিত বাংলাদেশ আমরা চাই না।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা