রাজনীতি জনসেবার উচ্চতর আর্টে পরিণত হোক
- সালাহউদ্দিন বাবর
- ১৩ নভেম্বর ২০২১, ২১:১৩
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র মাত্রই রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলের অপরিহার্যতা ও গুরুত্ব নিয়ে ভিন্ন কিছু ভাবার কোনো অবকাশ নেই। সেই সাথে নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার ও তার চর্চার অবাধ স্বাধীনতা স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা বিঘ্ন হলে যেখানে রাজনীতির বিকাশ নেই, রাজনৈতিক সংগঠনের বৈধ তৎপরতা টিকতে পারে না। তার সহজ-সরল অর্থ হচ্ছে সেটি স্বৈরতন্ত্র ব্যক্তিতন্ত্রের এক জনপদ। যেখানে শাসক বা শাসকগোষ্ঠী মধ্য গগনে সূর্যের মতো তার পূর্ণ কিরণ ছড়িয়ে সব কিছু ঝলমলে করে তোলার পরও যদি তারা বলে, এখন রজনী গভীর, চতুর্দিকে অমাবস্যার ঘোর নিশ্ছিদ্র অন্ধকার, তবে সবাইকে চোখ দুটি দুই হাতে চেপে মুদ্রিত করে বলতে হয়, আঁধারের কারণে নিজের শরীরে কিছুই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। এসব কথা শুনে বহু মানুষ বলতে পারে, এ কোন আজব উদ্ভট কথা। কিন্তু যারা বিশ্বের খোঁজখবর রাখেন, যাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সক্রিয়তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। তাদের কাছে অবশ্যই তা কোনো কারণেই অবাস্তব মনে হওয়ার কারণ নেই। তারা এমন বহু রাষ্ট্রের নামধাম সবকিছু মুখস্থ করে রেখেছেন। এই ভূখণ্ডের সেসব মানুষ তাদের তর্জনী প্রথমেই হয়তো বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে নাফ নদীর অপর তীরে মিয়ানমারের দিকে তুলে ধরবেন। সেখানে এখন সামরিক জান্তা ক্ষমতা গ্রহণ করে সে দেশকে ‘শাসন’ করছে। সেই শাসন চালানোর জন্য বহু নিবর্তনমূলক বিধিবিধান জারি করেছে, ফলে সেখানে মানুষকে মূক বধির করে রাখা হয়েছে। শাসকদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারে বা নিয়েছে, এমন হাজার হাজার মানুষকে কারারুদ্ধ করেছে জান্তা। জনগণের প্রায় সব মৌলিক অধিকার ফটকাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। এক সময় ব্রহ্ম দেশ হিসেবে পরিচিত সেই জনপদ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়েছিল, আজো সেই অবস্থা বিরাজ করছে।
আজকের শাসকরা যাদের সরিয়ে দিয়ে সে দেশের শাসন ভার গ্রহণ করেছে, তাদের পূর্বসূরিরাও গণতন্ত্রের লেবাস গায়ে চড়িয়ে দেশ চালানোর পরিবর্তে ‘শাসনই’ করছিলেন। এ কথা মনে রাখতে হবে, গণতন্ত্রের বহু বৈশিষ্ট্যের মধ্যে সেই ভ‚খণ্ডে বসবাসকারী মানুষের অধিকারের তালিকার অন্যতম হচ্ছে, নাগরিকরা শান্তি-স্বস্তি ও নিরাপদে বসবাস করবে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই সমান অধিকার ভোগের অধিকারী; কারো প্রতি বৈষম্য হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করা হবে না। কেউ এসবের শিকার হলে রাষ্ট্র স্বয়ং তার পূর্ণ নিরাপত্তা বিধান করবে। কিন্তু মিয়ানমারের সেই গণতন্ত্রের লেবাসধারীরা কী করেছিলেন? তা বাংলাদেশের জনগণ জানেন এবং স্বচক্ষে দেখেছেন। সেই সরকার শুধু গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যকেই তছনছ করেনি, আন্তর্জাতিক সব নিয়ম-কানুনকে রীতিনীতি ছুড়ে ফেলে দেয়। সে দেশের সেই সরকার মানবাধিকার, সার্বজনীন মূল্যবোধ, মানুষের প্রতি ভালোবাসা সম্মানকে ভ‚লুণ্ঠিত করেছিল। তারা মানুষের ধর্মবিশ্বাস, আদর্শিক চেতনা, সংস্কৃতি ও স্বতন্ত্র নৃতাত্তি¡ক মানব গোষ্ঠীকে সমূলে বিনাশ করতে হাজার হাজার ব্যক্তিকে পশু-পাখি শিকারের মতো গুলি করে হত্যা করেছিল। সেই মানব গোষ্ঠীর লাখ লাখ সদস্যকে শাক্তি প্রয়োগ করে তাদের শত শত বছরের বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ করেছে। প্রাণ রক্ষার জন্য তাদের সব অধিকার, সহায়সম্পদ ফেলে দুস্থ মানুষগুলো বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। এই শতাব্দীতে এমন মানবিক বিপর্যয়ের দ্বিতীয় কোনো উদাহরণ কেউ দিতে পারবে না। গণতন্ত্রের লেবাস পরেই এমন স্বৈরতান্ত্রিক পৈশাচিক কার্যক্রম চালানো হয়েছিল। বিশ্বে গণতন্ত্র মানবতা কখনো কখনো যে কত অসহায় নিপীড়িত হয়ে পড়ে, মিয়ানমারের ঘটনা তার একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে গণতন্ত্রের যথাযথ চর্চা সব সময়ই নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে থাকে। সেই বিশ্বের অধিকাংশ দেশে লোকদের দেখানোর জন্য গণতন্ত্রের সাইনবোর্ডটি খুব চকচকে করে রাখা হয় এবং অত্যন্ত উচ্চ কণ্ঠে শুতে-বসতে গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখার কথা বলা হয়। তবে তাদের বিশ্বাস ও অনুশীলনের বিষয়টি পুরোটাই খাদে ভরা। তৃতীয় বিশ্বের এসব দেশের গণতন্ত্রের পথ এতটাই অমসৃণ কণ্টকাকীর্ণ করে রাখা হয় যাতে ক্ষমতাসীনদের প্রতিপক্ষের যেন শত বার নানা দুর্ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়। ক্ষমতাসীনদের বদ্ধমূল ধারণা, তাদের কোনো বিকল্প দেশে নেই থাকতে পারে না। তাদের অহমিকা এতটাই যে, নিজেদের যোগ্যতা সক্ষমতার সমকক্ষ কেউ নেই। আরো মনে করে, এই মুল্লুকে তারাই উত্তম আর সবাই অধম। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, জনগণ তাদের কতটা যোগ্য মনে করে তা পরখ করতে কখনো সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করতে সাহসী হয় না। কেউ যদি তাদের ধারণার সাথে দ্বিমত করার সাহস দেখায়, তবে শাসকদের এতটা উষ্মার সৃষ্টি হয় এবং অধৈর্য হয়ে দ্বিমতকারী দুঃসাহসীদের ক্ষমতাসীনরা হিংসা-বিদ্বেষে তাদের ভাগাড়ে নিক্ষেপ করে। সেই সাথে শত অভিযোগ অনুযোগ তাদের বিরুদ্ধে তুলে নানা মামলায় জড়িয়ে তাদের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলে। জনগণের কাছে তাদের অর্বাচীন বলে জনগণের সম্মুখে তাদের হেয় প্রতিপন্ন করা হয়। গণতন্ত্রের যে অমিয় বাণী তারা বর্ষণ করে তা কত বিষাদপূর্ণ ও হৃদয়বিদারক। সেসব দেশের মানুষ মর্মে মর্মে তা উপলব্ধি করে। শুধু যে গণতন্ত্র নিয়ে তাদের কষ্ট এমন নয়। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর আরো দুঃখ-বেদনা হচ্ছে খাদ্য-বস্ত্র- চিকিৎসা ও আশ্রয় আর শিক্ষা নিয়ে নিদারুণ বঞ্চনা ভোগ করা। তবে সেখানে গোষ্ঠীবিশেষের সুখ ভোগের সব আয়োজনই থাকে। বাকি সবাই সব অধিকার থেকে বঞ্চিত ও বৈষম্যের হলেও কিছু বলার থাকে না।
বিশ্বের যেসব সংস্থা গোটা পৃথিবীর সব দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা, মানুষের জীবনমান, তথা সুখ স্বাচ্ছন্দ্য মৌলিক মানবাধিকার, শাসক শাসিতের সম্পর্ক, নাগরিকদের রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে কতটা সুযোগ বিদ্যমান, তথা সরকার প্রতিষ্ঠা ও বিদায় করার ক্ষেত্রে কতটা সুযোগ রয়েছে, ব্যক্তির বাকস্বাধীনতা, তথ্যের অবাধ প্রবাহ কতটা উন্মুক্ত এসবসহ আরো অনেক বিষয় তারা বিবেচনা করে। বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোকে উত্তম-মধ্যম আর নিম্ন - এমন শ্রেণিবিন্যাস করেছে। সেই বিন্যাস নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশ এই শ্রেণিবিন্যাসের কোন ধাপে অবস্থান করছে? আসলে এর জবাব দেয়ার যথাযোগ্য ব্যক্তিরা হচ্ছেন তারাই, যারা দেশের উপরিউক্ত ক্রাইটেরিয়াগুলো নিয়ে গবেষণা অনুসন্ধান করেন। পেশাদার সংবাদ কর্মীর ভূমিকা তো পুরোপুরি গবেষকের মতো। অথবা রাজনীতিকদের মতোও নয় বিশেষ করে যারা ক্ষমতায় থাকেন। ক্ষমতায় থাকা সেই রাজনীতিকরা তো মৌসুম বুঝে কথা বলেন, সেসব বক্তব্যে সত্য-অসত্যের অবাধ মিশ্রণ ঘটে। দেশের পক্ষে মানুষের প্রকৃত অবস্থার কথা বলার চেয়ে তাদের প্রিয় ও পছন্দের বক্তব্যের বিষয় হচ্ছে দল গোষ্ঠী ও তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ কত বেশি সংরক্ষিত হবে সেটি। আর মানুষকে কতটা ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখা যাবে।
সে যাই হোক, দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতির আলোকে আমরা তিন শ্রেণীর মধ্যে কোথায় অবস্থান করছি তা ঠিক ঠিক নির্ণয় করতে পারবেন সবাই। তবে একজন সংবাদকর্মী হিসেবে কিছু তথ্য-উপাত্ত মানুষের স্মৃতিকে কিছুটা ঝালাই করার ক্ষেত্রে সাহায্য করা যাবে হয়তো। যেমন আমাদের জীবনমান নিয়ে সন্তুষ্ট হওয়ার অবকাশ নেই, মানুষের সব মৌলিক চাহিদা মেটানো এখনো সম্ভব হয়নি, বেশির ভাগ মানুষের দুঃখ-কষ্ট রয়েই গেছে। সব সত্য বলার সাহস এখনো কেউ সঞ্চয় করতে পারেনি। এ দেশের মানুষের পরম প্রিয় হচ্ছে গণতন্ত্র; তা নিয়ে অসন্তুষ্টির কোনো শেষ নেই।
আধুনিক রাষ্ট্র মাত্রেই রাষ্ট্র পরিচালনা ব্যবস্থার আরাধ্য পদ্ধতি হচ্ছে গণতন্ত্র। আমরা বলে এসেছি এ দেশের পরম প্রিয় ও চাওয়ার বস্তু হচ্ছে গণতন্ত্র। একটু খোলাসা করে বলি, যে শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রের নাগরিকদের প্রাপ্তবয়স্ক ও সুস্থ অংশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা দেশ পরিচালিত হয় সেটারই পোশাকি নাম হচ্ছে গণতন্ত্র। এই গণতন্ত্রের জন্য দল-মত নির্বিশেষে সব রাজনৈতিক সংগঠন, দেশের সব শ্রেণীর জনতা আন্দোলন সংগ্রাম ও সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছে। স্বাধীনতার পর এ দেশের স্থপতি ও তার যোগ্য সহযোগীরা মানুষের পরম অভিব্যক্তি ও আত্মত্যাগের মূল্যায়ন, যথাযথ সম্মান দেখিয়েছেন। দেশের প্রধান আইন গ্রন্থগুলো তথা সংবিধান যেখানে রাষ্ট্র পরিচালনার সব সন্নিবেশিত রয়েছে; সেই সংবিধানে তার পূর্ণ প্রতিফলন ঘটিয়েছেন।
এই সংবিধানের প্রস্তাবনা যা রয়েছে সেটি এবং অন্যান্য অনুচ্ছেদে গণতন্ত্রের ব্যাপারে যে শাশ্বত ও স্পষ্ট নীতিনির্দেশনা রয়েছে, তাতে একটি আদর্শ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের সব আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছিল। সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সব আদর্শ এই সংবিধানের মূল নীতি হইবে।’ সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে প্রারম্ভে রয়েছে ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র...।’ এটা প্রণিধান যোগ্য যে, গণতন্ত্রের প্রাণবস্তু হচ্ছে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। এমন নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সংবিধানের ১১৮ (৪) অনুচ্ছেদে রয়েছে, ‘নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন...।’ এর ব্যাখ্যা এটাই যে, নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক করার ক্ষেত্রে কমিশন পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবে। কোনো চাপ বা হস্তক্ষেপ কমিশনের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। এটা নীতি। তবে দুর্ভাগ্য হচ্ছে, তার কোনো ‘প্র্যাকটিস’ হয় না। তা জনগণ দীর্ঘ দিন থেকে দেখে আসছে। এর ফলে দেশের নির্বাচনীব্যবস্থা এখন যে কতটা সঙ্গীন তা কাউকে বলে বোঝাতে হবে না। নির্বাচন এখন তো প্রহসনে পরিণত হয়েছে। এখন যারা নিজেদের জনপ্রতিনিধি বলেন, তারা তো আসলে নির্বাচনের যত অনিয়মের ফসল - এসব রাজনীতিকদের রাজনীতির ক্ষেত্রে দীর্ঘ ক্যারিয়ার আছে বটে। তবে সে ক্যারিয়ার ফাঁপা। রাজনীতির অর্থ এখন স্লোগানবাজি করে ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যে যোগ্যতা ধীমান হওয়া সক্ষমতা থাকা দরকার, তা তাদের অনেকেরই আছে কি না সন্দেহ। তবে এর যে ব্যতিক্রম রয়েছে তা অস্বীকার করব না। রাজনীতিকদের এখন আর পরখ করা তথা যোগ্যতার ভিত্তিতে তাদের বাছাই করার কোনো সুযোগ নেই। আগেই বলেছি নির্বাচন তো এখন প্রহসনে পরিণত হয়েছে। জনগণ তাদের ভোটাধিকার হারিয়ে ফেলেছে। তাই যোগ্যতার বিচার শিকায় উঠেছে।
এমন করেই ফাঁপা রাজনীতিকরা ক্ষমতার কেন্দ্রে পৌঁছে যাচ্ছেন বটে। কিন্তু এর প্রতিফলন হচ্ছে এমন যে, তারা আসলে আমলাদের হাতের খেলনায় পরিণত হয়ে পড়েন। কেননা আমলারা সুশিক্ষিত যোগ্য, তারা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করেই দায়িত্ব লাভ করেন। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রশাসন পরিচালনার যোগ্যতা অর্জনের জন্য সরকারের উচ্চমানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে থাকেন। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে বিদেশেও তারা প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকেন। তাই তারা আজকের অবস্থায় পৌঁছেছেন। আমলাতন্ত্র দিয়ে রাষ্ট্র চালানো ও সঙ্কট মোকাবেলায় তারা সক্ষমও হতে পারেন। তাতে জনগণের সীমিত সেবা হলেও জনগণের বৃহত্তর আকাক্সক্ষা পূরণ সম্ভব নয়। সাধারণ মানুষের নেতৃত্ব দেয়া কখনই আমলাদের পক্ষে সম্ভব নয়। বাস্তবতা হচ্ছে যোগ্য সৎ রাজনীতিবিদ বা সমাজের প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বকেই এগিয়ে আসতে হবে। দেশের নতুন প্রজন্মের আশা পূরণ তাদেরই করতে হবে।
বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র প্রকৃত পক্ষে দেশের জনগণের পূর্ণ ইচ্ছা চিন্তা অভিব্যক্তির প্রতিফলন। সুতরাং একে শ্রদ্ধা সম্মান দেখানো ও মান্য করা শাসক-শাসিতের নৈতিক ও আইনগত কর্তব্য। সর্বোচ্চ আইন হিসেবে সংবিধান দেশের আইনশৃঙ্খলার ভিত্তি। একে মান্য করা না হলে রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। উপরে একটা কথা বলেছি, সংবিধানকে মান্য করা ‘শাসক ও শাসিতের’ নৈতিক ও আইনগত কর্তব্য। সাধারণ মানুষকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে নিঃসন্দেহে বিনাদ্বিধায়। তবে যারা শাসক তারা এ ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যখন কোনো নাগরিক মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করতে প্রস্তুত হন তখন তাদের যে শপথ বাক্য পাঠ করতে হয় যেখানে এই মর্মে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, যা সংবিধানের তৃতীয় তফসিলে সন্নিবেশিত রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিম্নলিখিত ফরমে শপথ পাঠ করে থাকেন। ‘আমি... সশ্রদ্ধচিত্তে শপথ করিতেছি যে, আমি আইন-অনুযায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী (কিংবা ক্ষেত্রমত মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রী) পদের কর্তব্য বিশ্বস্ততার সহিত পালন করিব। আমি বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস আনুগত্য পোষণ করিব। আমি সংবিধানের রক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিব।’ এই বাক্যগুলোই উচ্চারণ করে শপথ নিয়ে থাকেন তারা।
কেউ এর ব্যত্যয় ঘটানোর অর্থ হচ্ছে, রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে পড়া। কিন্তু এমন কিছু কি ঘটছে না? সংবিধানে এমন বহু বিষয় রয়েছে, যা পুরোপুরি অনুশীলন করা হচ্ছে না। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫৩টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। এর মধ্যে ২৬ থেকে ৪৭ পর্যন্ত মোট ২২টি অনুচ্ছেদ জনগণের মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত। এসব অধিকার ভোগ করা নিয়ে নানা প্রশ্ন অভিযোগ রয়েছে। বিশ্বের মানবাধিকার লঙ্ঘন হওয়ার ব্যাপারে পর্যবেক্ষণ, অনুসন্ধান করে থাকে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বিশ্বে বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর দুই তিনটি দেশও মানবাধিকারের ব্যত্যয় ঘটা নিয়ে উৎদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এসব প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ও নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে বহুবার তাদের আপত্তির বিষয় উল্লেখ করেছে। উল্লেখ্য, উপরে বলা হয়েছে, সংবিধানের বহু বিধান কার্যকর করা ও সম্মান দেখানোর ব্যাপারে ঘাটতি রয়েছে। নির্বাচনসংক্রান্ত বিষয়েও তা প্রযোজ্য।
নির্বাচন কমিশনসহ কিছু সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাদেরকেও সংবিধানের আলোকে শপথবাক্য পাঠ করতে হয়। বাংলাদেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার যে শপথবাক্য পাঠ করেন, সেখানে তাদের অন্যান্য বিষয়সহ এ কথা দৃঢ়তার সাথে বলতে হয় ‘আমি সংবিধান রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করিব।’ অর্থাৎ প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ কমিশনারদের স্বীয় দায়িত্ব পালনকালে এই শপথের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে হবে। এটাই আইন। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করানো। এ ব্যাপারে সংবিধান যে স্বাধীনতা কমিশনকে দিয়েছে, সে পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন হচ্ছে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব পালনকালে সংবিধানের উপরিউক্ত চেতনার প্রতি নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততা দেখানো হয় কি না। এসব নিয়ে তো ঘোরতর অভিযোগ ও প্রশ্ন আছে। তাহলে কি সংবিধানের ব্যত্যয় ঘটছে না? এর জবাব কী?
যাই হোক, এসব ব্যত্যয় থেকে সবাইকে বেরিয়ে আসতে হবে। সব সাংবিধানিক বিধি ব্যবস্থার প্রতি হেলা করা হলে রাষ্ট্রের ভিত্তিতে প্রচণ্ড আঘাত পড়বে। এটা তো কাম্য হতে পারে না; বরং রাষ্ট্রের ভিত্তিকে মজবুত করতে সংশ্লিষ্ট সব দায়িত্বশীলদের ভূমিকা যথাযথ হওয়াই সাংবিধানিক চেতনা। যেখানে যতটুকু দুর্বলতা আমরা দেখছি তা দূর করতে হবে। মনে রাখতে হবে, যে দায়িত্ব পূর্বসূরিরা আজকের কমিশনের স্কন্ধে দিয়ে গেছেন, তাকে সততার সাথে উত্তরসূরিদের কাছে পৌঁছানো নির্বাচন কমিশনের নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তারা কি সততার সাথে সংবিধানের বিধিবিধান উচ্চকিত করেছেন? তাদের কর্তব্য পালন নিয়ে তো এন্তার অভিযোগ আছে। তবে কি তারা উত্তরসূরিদের হাতে তুলে দিয়ে যাবেন? আগামী বছর ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয়ার্ধেই তো তারা বিদায় নেবেন।
বাংলাদেশের জন্মের পর দেশে সাংবিধানিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা নিয়ে এতটুকু বিলম্ব করা হয়নি। বাংলাদেশের মহান স্থপতি ও তার বিশ্বস্ত সহযোগীরা মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ প্রতিষ্ঠার এক বছরের মাথায়ই সংবিধান রচনা ও কার্যকর করা এবং তার ভিত্তিতে বছর ঘুরতেই নির্বাচন অনুষ্ঠান এক বিরল ঘটনা। এটা গণতন্ত্রের প্রতি গভীর নিষ্ঠা আর প্রতিশ্রুতির প্রকৃষ্ট প্রমাণ। অবশ্যই এসব কাজ বিশ্বে দেশের মর্যাদাকে বৃদ্ধি করেছে। বাংলাদেশের স্থপতিকে এসব কারণেই বহির্বিশ্বে মর্যাদা ও সম্মানের আসনে উপবিষ্ট হতে সমর্থ করেছিল।
তবে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ওপর আঘাত আসে ১৯৭৪ সালে। এর পটভ‚মি রচনা করেছিল সে সময় কিছু উগ্রপন্থী রাজনীতিক ও তাদের সমর্থক একটি ছাত্রসংগঠন। তাদের যত অপতৎপরতা, নেপথ্য থেকে তথাকথিত অতিবামপন্থী সমাজতন্ত্রীদের একটি গ্রুপ সহায়তা দিয়েছে। তারা সারা দেশে মারাত্মক সব সন্ত্রাসী কার্যক্রম শুরু করেছিল। লুটপাট ডাকাতি, নানা রাষ্ট্রীয় স্থাপনায় হামলা ছাড়াও থানা আক্রমণ করে অস্ত্রপাতি লুটে নিচ্ছিল। গোটা দেশে চরম অস্থিরতা সৃষ্টি করাই ছিল সেসব সন্ত্রাসীর লক্ষ্য। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গণতন্ত্রের ওপর আঘাত নেমে এসেছিল। গণতন্ত্রের ওপর যে আঘাত হয়েছিল তার জন্য সেই সব সন্ত্রাসীকে দায় মুক্তি দেয়া যায় না।
তারপর দুই দফা সামরিক আইন জারি করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বিপদগ্রস্ত করা হয়। সংবিধানকে অকার্যকর করা হয়েছিল। দুই দফায়ই নিবর্তনমূলক বিধিবিধান জারি করা হয়, সামরিক আইনের বিভিন্ন প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। জনগণের সব মৌলিক অধিকার স্থগিত করা হয়। সংবিধানও স্থগিত করার ফলে বস্তুত মানুষের আইনের আশ্রয় নেয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। আইনেরর শাসন বিঘ্নিত হয়। বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে সামরিক আইনে মানুষকে একতরফাভাবে শাস্তি দেয়া হয়েছিল। আত্মপক্ষ সমর্থনের সব সুযোগ বিনষ্ট করে দেয়া হলো। সংবাদপত্র ও সংবাদমাধ্যমগুলোর ওপর সেন্সরশিপ আরোপ করা হয়েছিল। সত্য তুলে ধরার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।
এভাবে দেশে গণতন্ত্রের বিকাশের ধারাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছিল। রাজনৈতিক তথা গণতান্ত্রিক কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করার ফলে সব নির্বাচনী কার্যক্রম দীর্ঘ সময় বন্ধ করে রাখা হয়। সামরিক শাসকদের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের কারণে দেশের রাজনীতিতে টাউট শ্রেণীর পদচারণা শুরু হয়, যা আজ পর্যন্ত বহাল থাকায় এরা রাজনীতিকে কলুষিত করে রেখেছে। ফলে রাজনীতি এখন দেশ সেবার পরিবর্তে ক্ষমতার চর্চায় পরিণত হয়েছে। এ থেকে নিস্তার পাওয়ার পথ প্রায় রুদ্ধ হয়ে গেছে। যে নদী তার স্বাভাবিক গতি স্রোত হারায় সে যেমন হাজামজা খালে পরিণত হয়, তেমনি এখন অপরাজনীতির উচ্চমান বজায় থাকছে না। লক্ষ্যচ্যুতি ঘটছে। অথচ পশ্চিমের গণতান্ত্রিক দেশে রাজনীতি ক্রমেই হয়ে উঠছে জনসেবা করার উচ্চতর আর্টে। আমাদের দেশেও সে স্তরে পৌঁছার লক্ষ্য নির্ধারণ করা উচিত। সেখানে পৌঁছার যত দীক্ষা ও চেতনা, প্রতিপক্ষের প্রতি শ্রদ্ধা সহমর্মিতা ধৈর্য আত্মস্থ করে। সংসদকে কার্যকর করে এ লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারলে এ রাষ্ট্রের মহান স্থপতির স্বপ্ন সাধ পূরণ করা যেত।
দেশে এখন ব্রিটেন ও ভারতের অনুরূপ সংসদীয় শাসনব্যবস্থা ‘কায়েম’ রয়েছে। কিন্তু তা অন্তঃসারশূন্য। সংসদীয় শাসনব্যবস্থাকে বিশ্বের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা অধিকতর গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বলে মনে করেন। বিশ্বের যেসব দেশে সংসদীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, সেখানে পার্লামেন্টে তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে জনগণকে সেবা দেয়ার সঠিক সিদ্ধান্তটি বের হয়ে আসে। এর ফলে সর্বত্র রাজনীতি জনসেবার উচ্চতর এক আর্টে পরিণত হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে সে পথে হাঁটার চেষ্টা কি করা যায় না?
ndigantababor@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা