০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩ মাঘ ১৪২৩১, ৬ শাবান ১৪৪৬
`

নির্বাচনী তর্ক

-

দেশে এই মুহূর্তে রাজনৈতিক অঙ্গনে তর্কের প্রধান বিষয় হচ্ছে আগামী জাতীয় সংসদের নির্বাচন প্রসঙ্গ। সেই তর্কের শুরুটা রাজনৈতিক ময়দানে এখনো ডালপালা ছড়ায়নি বটে; তবে ঘরে বসে ভার্চুয়াল সভায় যোগ দিয়ে নেতারা তাদের প্রত্যাশিত নির্বাচন নিয়ে কথা বলছেন, কিংবা টিভির ক্যামেরার সামনে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচির সময় নির্বাচন নিয়ে বক্তব্য রাখছেন। এসব বক্তব্যের মুখ্য উপজীব্য হলো আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কারা কনডাক্ট করবেন। বর্তমান নির্বাচন কমিশনই বহাল থাকবেন নাকি নতুন কোনো কমিশন নিয়োগ পাবে। বর্তমান কমিশনের মেয়াদ ফুরিয়ে আসছে আমরা জানি। নতুন কমিশন আসবে। তার আগেই বিরোধী দলগুলো দাবি তুলেছে যে, আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে নিরপেক্ষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। সরকারি তরফে বিভিন্ন মন্ত্রী বলছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে। তারা কোনো অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন হতে দেবে না। বিরোধী দল কেন নির্বাচিত সরকারের অধীন নির্বাচন করতে চায় না তার কারণ হিসেবে বলছে, ২০১৮ সালের নির্বাচন ইতিহাসের সবচেয়ে নিকৃষ্ট, কারণ ওই বার নির্বাচনের আগের রাতেই সব ভোটারের ভোট রিগিংয়ের শিকার হয়েছে। পাল্টা যুক্তি হিসেবে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বলছেন, ২০০৮ সালে তারা ক্ষমতায় বসার পর থেকে দেশে যত নির্বাচন হয়েছে, তা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন হয়েছে। ২০১৪ সালে বিএনপি প্রার্থী দিয়েছিল ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে। তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা নতুন করে বর্ণনার প্রয়োজন নেই। তাই তারা ২০১৮ সালের নির্বাচন বর্জন করেছিল। আবার নির্বাচন আসছে ২০২৩ সালে। এখন থেকেই সেই নির্বাচন নিয়ে আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়ে গেছে রাজনীতিক ও নাগরিক সমাজের মধ্যে। বিশেষ করে টিভির টকশোগুলোতে এ বিষয়টি নিয়ে জোরালো তর্ক-বিতর্ক চলছে।

সাবেক বিচারপতি এম আবদুল মতিন এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, আমাদের সংবিধানে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য আইন করতে হবে। আইনটি জাতীয় সংসদে পাস করে সেই আইনের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। যেহেতু নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক সংস্থা, জাতির ভোটারদের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে গণতান্ত্রিক শাসনধারা বলবৎ করতে এবং তা অব্যাহত রাখার জন্য সংবিধানের সব বিধিবিধান কার্যকরভাবে অনুসরণ করতে হবে।

সংবিধানের নির্দেশ তো জাতির আকাক্সক্ষারই প্রতিফলন বলা যেতে পারে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন গঠন সম্পর্কিত আইন প্রণয়ন বিষয়ে এই সাংবিধানিক নির্দেশটি আমাদের জাতীয় নেতারা গত ৫০ বছর ধরে উপেক্ষা করে এসেছেন এবং এখনো করে চলেছেন। ফলে যে সংস্থার মাধ্যমে রাজনীতিকরা জাতির প্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন, তারাই মূলত আইনি সমর্থনবিহীন প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত। এভাবে গঠিত নির্বাচন কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যারা সংসদ সদস্য হচ্ছেন তারা কি প্রকৃতপক্ষে নির্বাচিত এবং বৈধ? এই প্রশ্ন সঙ্গতকারণেই উত্থাপনযোগ্য।

বর্তমান নির্বাচন কমিশনটি কোনো আইন বলে গঠিত হয়নি, বোধহয় রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার বলে হয়েছে। কিন্তু তার চেয়েও বড় সমস্যা হচ্ছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনে যারা কমিশনার নির্বাচিত বা মনোনীত হন, তাদের সব আচরণ ও কর্মকাণ্ড ক্ষমতাসীন দলের প্রতি অনুগত বলেই মনে হয়। বর্তমান সিইসি নুরুল হুদা অনেকবারই বিভিন্ন বক্তব্যে ও আচরণে প্রমাণ করেছেন তিনি সরকারের তল্পিবাহকমাত্র। অতীতে বিভিন্ন সময়ের প্রধান নির্বাচন কমিশনও তৎকালের সরকারের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন, কিন্তু নুরুল হুদার মতো প্রকাশিত ছিলেন না। হুদা কমিশনের মতো একটি কমিশন কোনোভাবেই নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, রিগিংলেস করতে পারে না। দ্বিতীয়ত, ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগের রাতে পুলিশসহ আওয়ামী কর্মীবাহিনী ভোট সম্পন্ন করে বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছে বলে ব্যাপকভাবে অভিযোগ রয়েছে, যা অপ্রমাণ করতে পারেনি বর্তমান ইসি। বরং এই ভোট লুটের কাহিনী সিইসি নুরুল হুদা জানার পরও নির্বাচন বাতিল না করে তার বৈধতা দেন। তবে তিনি অনেক পরে এ কথা বলেছেন যে, তিনি ও তার সহকর্মীরা আর কোনো ভোট রাতের বেলা হোক, তা দেখতে চান না। কথা সত্য, তিনি আর দেখবেন না যে ‘ভোট রাতের বেলা হচ্ছে’ এবং সব ভোট ক্ষমতাসীন দলই পাচ্ছেন। আগামী নির্বাচনে কোনো ভোটারের উপস্থিতি থাকবে না। আগামী নির্বাচনের আগেই তিনি বিদায় নেবেন। কিন্তু তিনি যে নজির স্থাপন করে গেলেন জাতীয় নির্বাচনের, তা ইতিহাসে এক অমোচনীয় কলঙ্ক হিসেবেই থাকবে।

২.
অতীতে আমরা দেখেছি, রাজনৈতিক সঙ্ঘাতে অস্ত্রের ব্যবহার। সাধারণত অপ্রকাশ্যেই সেসব অস্ত্রের হুমকি মোকাবেলা করত বিরোধী দল ও অন্যান্য পক্ষ। কিন্তু প্রকাশ্যে অস্ত্র প্রদর্শন ও মহড়ার পর হত্যার ধারাটি চালু হয় এরশাদের আমলে। তিনি ক্ষমতায় আসেন অস্ত্রের জোরে, সামরিক শাসন জারি করে। তাই তার কাছে অস্ত্রই ছিল রাজনীতির নিয়ামক শক্তি। কিন্তু সেই অস্ত্র কী করে, কেন গণতান্ত্রিক রাজনীতিকদের রাজনৈতিক তরিকায় এলো এবং পরমপ্রিয় হয়ে উঠল, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই বললেই চলে। এতকাল রাজধানী ও দেশের বড় বড় শহরে অস্ত্র রাজনীতির নিয়ামক শক্তি ছিল, এখন তা গ্রামে গ্রামে পৌঁছে গেছে। আমরা স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে দেখতে পাচ্ছি পাঁচ-সাতজন করে হত্যার শিকার হচ্ছে প্রতিদিন। প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থী ও কর্মীদের হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র কিভাবে পৌঁছাল, কিভাবে সেগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে মানুষ হত্যায়, এই প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? আজ গোটা দেশের রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক দুর্বৃত্ত সমাজের হাতে অস্ত্র পৌঁছে যাওয়ায় গোটা দেশ এমন এক সন্ত্রাসের মধ্যে পড়েছে, যা থেকে বেরিয়ে আসা সত্যই কঠিন।

এমনটি ভাবার কারণ আছে যে, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে বা তাকে কেন্দ্র করেই দেশের স্বাভাবিক সামাজিক পরিস্থিতি ঘোলা করে তোলা হচ্ছে, যাতে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করা সহজ হয়। কিন্তু কারা করছে এটি, সেটিই আমাদের প্রশ্ন?

বিএনপি যদি স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে অংশ নিত, তা হলে ধরে নিতে পারতাম তারা প্রতিপক্ষের প্রার্থীর বিরুদ্ধে নেমে এমনটি করছে। তারা মাঠে নেই, নির্বাচনেও নেই। আছে কেবল আওয়ামী লীগ ও তাদের বিদ্রোহী প্রার্থীরা। নির্বাচন হচ্ছে নিজেদের বিরুদ্ধে নিজেদের। শাসকগোষ্ঠী যাদের নির্বাচনে মনোনয়ন দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে তাদেরই দলের বিদ্রোহী প্রার্থীরা। নির্বাচনে বিজয় ছিনিয়ে আনতে উভয়পক্ষই অস্ত্রবাজির মাধ্যমে গোটা উপজেলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি নরক করে তুলেছে। ক্ষমতা যে মধুর হাঁড়িতে পরিণত হয়েছে, তা এ পরিস্থিতি দেখলেই বোঝা যায়। নিজ দলের নেতাকর্মীদের এই নরক গুলজার অবস্থার পরও আওয়ামী নেতারা কেন নিশ্চুপ বসে আছেন, তা আমাদের বিস্মিত ও হতবাক করছে। তাদের এই নিষ্ক্রিয়তাকে আমরা সন্দেহের চোখে দেখি। কারণ সাধারণভাবে গণমনস্ক বলে ধরে নেয়া একটি গণতান্ত্রিক দলের ভেতরে এমন অস্ত্রের ঝনঝনানি দেখে জনমনে ভয়ের শেকড় গেড়ে বসেছে। আর গ্রাম স্তরের রাজনীতিকদের মধ্যে অস্ত্রবাজি ও হত্যার ভাবভঙ্গি সত্যিকারভাবেই জনমনে সন্দেহ প্রগাঢ় করে তুলছে। আমরা যেন এমন এক নরকের ভেতরে প্রবেশ করতে যাচ্ছি, যেখানে আইনের শাসন নেই। আইন সেখানে কার্যকর হচ্ছে না।

আমরা দেখতে পাচ্ছি, নির্বাচনী সেন্টারে সেন্টারে পুলিশ উপস্থিত, তারা যথাসাধ্য চেষ্টাও করছে, কিন্তু তাদের সেই আইনি তৎপরতা নস্যাৎ করে অস্ত্রবাজরা মানুষ হত্যা করে চলেছে। এই যে ধারাবাহিকভাবে হত্যার মিছিল চলছে, সেই মিছিলের শেষ কবে, কোথায়, তা কেউ বলতে পারবে না।

আমরা কোথায়, কোন গহ্বরে ঢুকে পড়ছি, তা যদি পরিষ্কারভাবে জানা যেত, তা হলে হয়তো তা থামানোর চেষ্টা করতে পারতাম।


আরো সংবাদ



premium cement