২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

মন্দের ভালো

-

অনেকের মনে হয়, আফগান জাতির দুর্দশার অবসানের চেয়েও বড় চিন্তা হলো সে দেশের বর্তমানে ক্ষমতাসীন সরকার, তথা তালেবানদের হটানো। তেমনি বাংলাদেশে প্রতীয়মান হয়, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চেয়েও সরকারকে এক হাত, ‘হুজুর’দের দু’হাত এবং বিশেষত ‘মৌলবাদীদের’ তিন হাত দেখানো অনেকের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

তেমনি সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের কিংবা অতীতের অঙ্গীকার পূরণের বদলে অনেকে বড় বড় কথা বলায় মেতে উঠছেন বলে জলবায়ু সম্মেলনে অভিযোগ উঠেছে। স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে ১২০টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের অংশগ্রহণে এবার অনুষ্ঠিত হলো বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক সম্মেলন কপ-২৬। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এতে অংশ নিয়েছেন। সম্মেলনে চীন ও ভারতের ঘোষণায় অনেকে হতাশ হলেও রাজনীতিবিদরা বলছেন, দেশ দু’টির ভূমিকা মন্দের ভালো। সম্মেলনস্থলের বাইরে রকমারি প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়েছে। বিশ্বের ফুসফুসতুল্য ব্রাজিলের আমাজন অরণ্য রক্ষার অঙ্গীকার ব্যক্ত হয়েছে। এদিকে, বাংলাদেশ বলেছে জলবায়ু অভিবাসীদের প্রতি দায়িত্ব বিশ্বকে ভাগ করে নিতে হবে।

জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনে বিপন্ন দ্বীপরাষ্ট্র পালাউয়ের প্রেসিডেন্ট করুণ আকুতি জানিয়ে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের আসন্ন বিপদের মানে হচ্ছে, এর চেয়ে আমাদের ওপর বোমা ফেলাও ভালো। আর সম্মেলনস্থলের বাইরে ছিল জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার সঙ্কটে ধনী দেশগুলোর ব্যর্থতার প্রতিবাদে বিক্ষোভ। পরিবেশদূষণের শীর্ষে আছে চীন, কিন্তু চীনের প্রেসিডেন্ট সি জিনপিং সম্মেলনে আসেননি। রাশিয়ার নেতা পুতিন যোগ দেননি, ভারতের নরেন্দ্র মোদিও অনুপস্থিত। অথচ এই তিনটি দেশই কার্বন নিঃসরণ ও বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানীয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন চীনের সমালোচনা করে বলেছেন, ‘তারা সুনির্দিষ্টি পদক্ষেপের পরিবর্তে বড় বড় কথা বলছে।’ আর রাশিয়া চুপ করে আছে। তবে চীন আগেই জানিয়েছিল, তারা ২০৬০ সালের মধ্যে নেট জিরো অর্জন করবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি ঘোষণা দিয়েছেন, ‘আমরা ২০৭০ সালে নেট জিরো অর্জন করব।’ চীন-ভারতের এই ঘোষণাকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মন্দের ভালো বলে উল্লেখ করেছেন। তবে পরিবেশবাদী ও বিক্ষোভকারীরা এসব ঘোষণায় হতাশ। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো অভিযোজনের জন্য বছরে ১০ হাজার কোটি ডলার সহায়তার অঙ্গীকার পূরণ করা হলে তা হবে ভালো অর্জন। তবে বিক্ষুব্ধ পরিবেশবাদীরা এসব ঘোষণায় মোটেও সন্তুষ্ট নন। তার প্রমাণ, বিখ্যাত সুইডিশ কিশোরী গ্রেটা থুনবার্গ বলেছেন, ‘নেতারা মোটেও আন্তরিক নন, তারা কেবল ভান করছেন।’ প্রতিবাদীরা পুঁজিবাদী লিপ্সার ওপর আলোকপাত করেছেন। তাদের দাবি, ফসিল জ্বালানি খাতে বড় বিনিয়োগকারী জেপি মরগানকে অবিলম্বে এ খাতে বিনিয়োগ বন্ধ করতে হবে। উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, চীন ও ভারতের পূর্বোক্ত ঘোষণা সত্তে¡ও শিল্পোন্নত দেশগুলো গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ আরো বেশি না কমালে ২০৫০ সালে নেট জিরো অর্জিত হবে না।

নেট জিরো হলো, চলতি শতাব্দীতে বিশ্বে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ধরে রাখার উদ্দেশ্যে ২০৫০ সালের মধ্যে ক্ষতিকর গ্রিনহাউজ গ্যাস উদগিরণ এবং বায়ুমণ্ডল থেকে তা সমপরিমাণে অপসারণের ভারসাম্য অর্জন।

দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুত মানুষের দায়িত্ব ভাগ করে নিতে বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘বিশ্বকে জলবায়ু অভিবাসীদের দায়িত্ব ভাগ করে নিতে হবে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট ক্ষতির বিষয়টি মোকাবেলা করতে হবে।

তিনি বলেন, ‘উচ্চাভিলাষী প্রভাব প্রশমন প্রচেষ্টা ছাড়া শুধু অভিযোজন ব্যবস্থা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূল প্রভাবগুলোকে ধীর, থামানো এবং পাল্টানোর জন্য যথেষ্ট নয়।’

শেখ হাসিনা আরো বলেন, ‘বাংলাদেশে ইতোমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুত হয়েছে ৬০ লাখ মানুষ। এর সাথে অতিরিক্ত ১১ লাখ মিয়ানমারের রোহিঙ্গার বোঝা যোগ হয়েছে। আর এ কারণে করোনা মহামারী মোকাবেলায় অতিরিক্ত চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। ৩ নভেম্বর স্কটিশ পার্লামেন্টে ‘কল ফর ক্লাইমেট প্রসপারিটি শীর্ষক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। স্কটিশ পার্লামেন্টে পৌঁছালে স্পিকার অ্যালিসন জনস্টোন শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা এবং সিভিএফ দূত সায়মা ওয়াজেদ হোসেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি, নদীভাঙন, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, বন্যা ও খরার মতো প্রাকৃতিক ঘটনায় প্রভাবিত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুত হওয়া জলবায়ু অভিবাসীদের দায়িত্ব বিশ্বকে অবশ্যই ভাগ করে নিতে হবে। ক্ষতির বিষয়টি অবশ্যই সঠিকভাবে সমাধান করতে হবে।

তিনি উল্লেখ করেন, কার্যকর ও পর্যাপ্ত জলবায়ু অর্থায়ন হবে সমৃদ্ধি অর্জনের মূল চাবিকাঠি। তিনি এমসিপিপি সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য কিছু প্রস্তাবনা পেশ করেন।

ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) এবং ভালনারেবল ২০ (ভি ২০) সভাপতি শেখ হাসিনা একটি প্রস্তাব উত্থাপন করে বলেছেন, প্রধান কার্বন নির্গমনকারী দেশগুলোকে অবশ্যই ব্যাপকভিত্তিক এনডিসি (জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান) পেশ এবং বাস্তবায়ন করতে হবে।

উচ্চাভিলাষী প্রভাব প্রশমন প্রয়াস ছাড়া শুধু অভিযোজন ব্যবস্থা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিক‚ল প্রভাবগুলোকে ধীর বন্ধ এবং পাল্টানোর জন্য যথেষ্ট নয়।

আরেকটি প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, উন্নত দেশগুলোকে জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর ওপর বিশেষ মনোযোগ দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার দেয়ার ব্যাপারে তাদের অঙ্গীকার অবশ্যই পূরণ করতে হবে। তিনি আরো বলেন, এই পরিমাণ অর্থায়ন হবে বিদ্যমান ওডিএ-এর (অফিসিয়াল উন্নয়ন সহায়তা) অতিরিক্ত এবং বিভিন্ন জলবায়ু অর্থায়নের মধ্যে সমন্বয় থাকা দরকার।

তিনি আরো বলেন, ‘অভিযোজন ও প্রভাব প্রশমনের ক্ষেত্রে জলবায়ু অর্থায়ন বিতরণের মধ্যে ৫০:৫০ অনুপাত থাকা উচিত।

সর্বশেষ প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী উন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সাশ্রয়ীমূল্যে প্রযুক্তির প্রসারের পরামর্শ দেন, যাতে মুজিব জলবায়ু পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল