২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

শক্তি নয় সম্প্রীতি দিয়ে মোকাবেলা হোক

- ফাইল ছবি

সম্প্রতি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার খবর বিবেকবান মানুষদের বিচলিত না করে পারে না। নিঃসেন্দেহে এটি আমাদের চিরায়ত সম্প্রীতিকে আঘাত করেছে। ১৯৪৭-এর পর থেকে পাকিস্তানের এই পূর্বাঞ্চলে তুলনামূলকভাবে যে সহিষ্ণুতা বিরাজ করেছে, ছোটখাটো ঘটনা বাদ দিলে তা ছিল রীতিমতো সম্প্রীতির। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী সাম্প্রদায়িকতায় শান দিলেও এ অঞ্চলের মানুষ সবসময় ছিল উদার ও নৈতিক। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর রাষ্ট্রীয় ঘোষণা মোতাবেক সম্প্রীতি আরো পাকাপোক্ত হওয়ার কথা। বিস্ময়করভাবে তা না হয়ে হয়েছে তার বিপরীত। ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত বসন্ত চ্যাটার্জির ‘ইনসাইড বাংলাদেশ’-এর কিঞ্চিৎ বয়ান পাওয়া যাবে। তখন আচার্য কৃপালনী নাকি বলেছিলেন, ‘উসকা বাপ (নেহরু) এক পাকিস্তান বানায়া থা, লেকিন উসকা লার্কি দু’পাকিস্তান বানায়া’।

ব্যারিস্টার তমিজুল হক লিখিত ‘প্যাটার্ন অব সেক্যুলারিজম ইন বাংলাদেশ অ্যান্ড ইন্ডিয়া’ আরেকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থনা। এ ধরনের বিস্তর ডিসকোর্সের প্রাধান্য লক্ষ করা যাবে আমাদের রাজনৈতিক আকাশে। মনোবিজ্ঞানীরা আমাদের সম্পর্কে বলেন, ‘উই ডোন্ট অ্যাক্ট বাট রিঅ্যাক্ট’। ব্রিটিশ আমলে হিন্দু আধিপত্যকে প্রতিহত করতে গিয়ে চরম মুসলমান হয়ে এ অঞ্চলে পাকিস্তান কায়েমে নেতৃত্ব দেয় এ দেশের মানুষ। তারাই আবার পশ্চিমা মুসলমানদের প্রতি ত্যক্ত-বিরক্ত ও বিভক্ত হয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানের কবর রচনা করে। জনগণের ক্ষোভ ছিল পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে- ইসলামের বিরুদ্ধে নয়। কিন্তু বাংলাদেশের শাসক এলিটরা পাকিস্তান ও ইসলামকে এক ও একাকার করে ফেলে। এরা জনগণের নাড়ির টান বুঝতে ব্যর্থ হন। পাকিস্তানিরা যেমন জোর করে আমাদের ইসলামী সংস্কৃতি শেখাতে চেয়েছে, তেমনি নতুন শাসকগোষ্ঠী বাঙালিত্ব চাপাতে চেয়েছে। ফলে সতত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের মানুষের মনোজগতে ইসলাম ফিরে এসেছে। (প্রামাণ্য প্রতিবেদনের জন্য দেখুন, এম. আবদুল হাফিজ ও আবদুর রব খান সম্পাদিত- ন্যাশন বিল্ডিং ইন বাংলাদেশ-রেট্রোসপেক্ট অ্যান্ড প্রসপেক্ট, বিআইআইএসএস, ১৯৮৬)।

সে সময়ে মুসলিম বাংলার আবেদন ফিরে আসে দেয়ালে দেয়ালে। অভিযুক্ত হয়ে প্রাণ দিলেন বামধারার ত্যাগী নেতা সিরাজ শিকদার। এ কথা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, জিয়াউর রহমানের সাংবিধানিক পরিবর্তন ছিল আরোপিত। বরং তা ছিল জনসমর্থনসম্পৃক্ত। ১৯৭৭ সালে গণভোটে তা সমর্থিত হয়েছিল। যদিও সেখানে অতি-উৎসাহীদের আতিশয্য ছিল। স্মর্তব্য যে, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি ও মোজাফফর ন্যাপ সে গণভোটে জিয়াকে সমর্থন দিয়েছিল। জিয়াউর রহমান সূচিত সে মধ্যপন্থী নীতি এরশাদ এবং পরবর্তী বিএনপি আমল পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জন করেছে। জিয়া সতর্কতার সাথে মোল্লাতন্ত্র ও নাস্তিকতন্ত্র থেকে দূরে থাকেন। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো- বাংলাদেশে এ সময়ে তেমন কোনো সাম্প্রদায়িক সঙ্ঘাত লক্ষ করা যায়নি।

বিগত ১২ বছর ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিপজ্জনক মিশ্রণ নিয়ে কাজ করছে। একদিকে তারা ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলছে, অপরদিকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে বহাল রেখেছে। এই বৈপরীত্য জনগণের কাছে তাদের দ্বৈধতাকে প্রকটভাবে প্রমাণ করেছে। খুব সঙ্গতভাবেই দেশের পীর-মাশায়েখ ও আলেম-ওলামা তথা ধর্মীয় জনগোষ্ঠী তাদের ওপর নাখোশ হয়ে আছে। এই নাখোশকে খোশ প্রমাণ করার জন্য তাদের চেষ্টার কমতি নেই। যে হেফাজতে ইসলাম দমনে রক্ত ঝরানো হয়েছে, তাদেরই আবার গণভবনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তাদের কওমি জননী খেতাব যে কৃত্রিম, তা বুঝতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠ করতে হয় না। ধর্মপ্রাণ মানুষের সাথে এর বিন্দুবিসর্গ সংযোগ নেই। হেফাজতে ইসলামের দ্বিতীয় উত্থান ঠেকানোর জন্য অতিসাম্প্রতিককালে যে নিপীড়নের নীতি গ্রহণ করা হয়েছে, তা এই ধর্মপ্রাণ গোষ্ঠীকে সরকারের প্রতি বৈরী করে তুলেছে। সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে এর অনিবার্য প্রভাব পড়েছে। সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িকতা রোধে সরকার সম্প্রীতির নীতি গ্রহণ না করে সন্ত্রাসের নীতি গ্রহণ করেছে।

কুরআন অবমাননার মতো বিষয় সংবেদনশীলতার সাথে মোকাবেলা করার পরিবর্তে শক্তি প্রয়োগের ফলে এটি আগুনে ঘৃতাহুতির মতো ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। ঘটনার পর দেশের সর্বত্র এক ধরনের নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে। প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী মামলার সংখ্যা-৮৫। আসামি ২৩ হাজার ৯১১ জন। গ্রেফতারকৃতদের সংখ্যা ৬৮৩। এ কলাম প্রকাশিত হওয়ার পর হাজতিদের সংখ্যা হাজারে হিসাব করতে হবে।
সাম্প্রতিককালে আরেকটি দৃশ্যমান সত্য হচ্ছে, সরকারি দল ও প্রধান বিরোধীদল বিএনপির পারস্পরিক দোষারোপ। সরকার বলছে, বিএনপি-জামায়াত দায়ী। বিরোধীরা বলছে, সরকার ক্ষমতায় থাকার কৌশল হিসেবে এসব করছে। গোটা বিশ্বে সরকারের অবস্থা যখন নাজুক তখন তারা সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানে তাদের প্রয়োজনীয়তা প্রমাণ করার জন্য এসব সহিংস ঘটনা ঘটাচ্ছে। বস্তুনিষ্ঠভাবে ব্যাখ্যা করলে দেখা যাবে- কারণটি হেথা নয় হোথা নয়, অন্য কোথা! আওয়ামী লীগ বা বিএনপি বা জামায়াত দলগতভাবে দায়ী নয়। ষড়যন্ত্রমূলকভাবে কোনো দল এটা করেছে- এমন মনে করার কারণ নেই। এটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় এনোমিক ভায়োলেন্স বা আকস্মিক গণপ্রতিক্রিয়া। আগেই বলা হয়েছে, এ পৃথিবীতে যত সংবেদনশীল বিষয় আছে তার মধ্যে ধর্ম হচ্ছে সর্বপ্রথম ও প্রধান। একজন মুসলিম যখন শুনে কুরআনে আগুন দেয়া হয়েছে, তখন তার ঈমান ঘরে থাকতে দেয় না। প্রতিবাদে অংশগ্রহণ করে সে। এই প্রতিবাদ করতে গিয়ে ব্যক্তি সমষ্টিকে উন্মত্ত করতে পারে। নেতা বা নেত্রীর আবেদন ঘটনার আকস্মিকতায় হারিয়ে যায়। মিছিলে বা দাঙ্গায় নেতৃত্বদানকারীরা সূচনাকারীদের চেয়ে অপরাধী নয়।

এ ধরনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন- গুজরাটে মুসলিমপ্রধান অঞ্চল দিয়ে যখন হিন্দু তীর্থযাত্রীরা যাচ্ছিল তখন আক্রমণ করা হয়। দায়টা পড়ে মুসলিমদের ঘাড়ে। অথচ ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই এর শুরু। যাই হোক, আকস্মিক ঘটনায় নেতৃত্বের কাজ হচ্ছে জনতাকে নিবৃত্ত-নিষ্ক্রিয় ও নিরপেক্ষ করা। আমাদের সামাজিক বা রাজনৈতিক নেতৃত্ব যুক্তির চেয়ে আবেগে বেশি গুরুত্ব দেয়। আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষাকারীরা নির্যাতন করলে আরো ক্ষুব্ধ হয় জনতা। এসব ক্ষেত্রে শক্তি প্রয়োগের চেয়ে আবেগ, কৌশল ও বুদ্ধি দিয়ে জনতাকে মোকাবেলা করতে হয়। জনতার সামনে যদি কোনো বর্ষীয়ান আলেম অথবা জনগণের শ্রদ্ধেয় নেতাকে নিয়ে আসা হয় তাহলে জনতা হয়তো নিবৃত্ত হতে পারে। আবার প্রশাসন বা রাজনীতির প্রধান ডিসি বা এমপি সাহেব যদি জনতাকে আশ^স্ত করার চিন্তা করেন তাহলে ভালো ফল হতে পারে। তা না করে গুলিবর্ষণ বা হাজার হাজার মানুষকে গ্রেফতার দেখানো মানেই জনতার মনে স্থায়ী সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ তৈরি করা। যেকোনো সমাগত সুযোগে তারা বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ার পরিবর্তে অনিশ্চিত হয়ে ওঠে। বলা হয় ‘পাপে পাপ আনে পুণ্যে আনে সুখ’। কোনো পাপ বা অন্যায় দ্বারা পুণ্যের আশা করা যায় না। অশান্তির দ্বারা শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। সরকার তার অন্যায় আচরণের মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িকতা উসকে দিতে চাচ্ছে। এর ফলাফল বুমেরাং হতে বাধ্য।

এ অবস্থা থেকে সরকার ফায়দা তুলতে চায়। বিরোধী দলকে নিপীড়নের বাহন হিসেবে ব্যবহৃত হয় ঘটনাগুলো। এটি মিথ্যা নয় যে, আমাদের একাংশ বিধর্মী ও আরেক অংশ আলেম নির্যাতনে উল্লসিত হয়। এই সাম্প্রদায়িকতার পরিবর্তে সম্প্রীতির জন্য সমঝোতার সমাজ গঠন করা প্রয়োজন। এই সমঝোতার ভিত্তি হচ্ছে বিশ্বাস। পারস্পরিক বোঝাপড়া। একে অপরকে জানা। এটা দুঃখের বিষয় যে, হাজার বছর ধরে পাশাপাশি বসবাস করা সত্তে¡ও আমরা একে অপরকে চিনি না। এই উপমহাদেশে অনেক আগে থেকেই ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’-এর কথা বলা হচ্ছে। এটি যদি নীতি হিসেবে সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত করা যায় তাহলে শান্তি সম্ভব। এই সেদিন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি তাৎপর্যপূর্ণ অপ্রিয় উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এমন কিছু যেন না করা হয় যার প্রভাব বাংলাদেশে এসে পড়ে’। এ কথার দ্বারা তিনি মূলত ভারতের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। মোদি সরকার আসার পর নির্যাতনের নির্বিপাকে মুসলমানরা নিপতিত হয়েছে। ভারতে যদি মুসলমানদের প্রতি অন্যায়-অত্যাচার হয়, তাহলে পাশর্^বর্তী বাংলাদেশে তার প্রভাব পড়বেই। ‘বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের আহত আবেগের টুঁটি চেপে ধরা অতি কঠিন কাজই বটে।’

পৃথিবীর প্রায় ৮৪ শতাংশ মানুষ ধর্মবিশ্বাসী। এ সংখ্যা ২০৫০ সাল নাগাদ আরো বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাই ধর্মকে উপেক্ষা করে সমঝোতার সমাজ গড়ে তোলা যাবে না। ধর্ম মানুষকে অধর্ম করতে শেখায় না। কোনো ধার্মিক মানুষ দাঙ্গা বাধায় না। প্রকৃত ধার্মিকতার সাথে সাম্প্রদায়িকতার কোনো সম্পর্কে নেই। সব ধর্মের আবেদন যে, মানুষের কল্যাণ ও সুখী জীবনের জন্য তা অনুধাবন করতে হবে। স্বার্থ, সুবিধা ও ক্ষমতার দ্ব›দ্ব অতিক্রম করে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে নিয়ে যেতে হবে সমাজকে আলোর পথে। ‘লেট দেয়ার বি লাইট’। আলো আরো আলো চাই।

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement