১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০২ মাঘ ১৪৩১, ১৫ রজব ১৪৪৬
`

পদবিহীন পদোন্নতি অনাচার নয় কি?

-

অনাচারের বিপরীত শুদ্ধাচার। অনাচার অর্থ অপবিত্র আচরণ বা অনৈতিক চর্চা অপর দিকে শুদ্ধাচার অর্থ পবিত্র আচরণ বা নৈতিক চর্চা। শুদ্ধাচার সততা ও নৈতিকতা দ্বারা তাড়িত আচরণগত উৎকর্ষ। ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক উভয় পর্যায়ে শুদ্ধাচারের অনুশীলনের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন সৎ, কর্তব্যনিষ্ঠ ও ন্যায়নিষ্ঠ হয়ে দেশের আইনের যথাযথ অনুশীলনের মাধ্যমে সব নাগরিকের জন্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিতে সচেষ্ট হয়ে কাজ করা। সরকার কর্তৃক সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল’ প্রণয়ন করা হলেও সরকারের শুধু একটি ক্যাডারের চাকরিজীবীদের তথাকথিত হতাশা প্রশমনে প্রচলিত আইন ও বিধিবিধানের ব্যত্যয়ে পদবিহীন পদোন্নতির অভিনব পন্থায় একের পর এক অনৈতিক পদোন্নতি কার্য সমাধায় জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল মলিনতায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়।

আমাদের দেশের প্রশাসন বলতে সচিবালয়ের সহকারী সচিব হতে সচিব অবধি পদগুলোকে বোঝায়। সচিবালয়ের প্রারম্ভিক পদ সহকারী সচিব। সহকারী সচিব এর পরবর্তী উচ্চতর পদ যথাক্রমে সিনিয়র সহকারী সচিব, উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব। অতীতে আমাদের প্রশাসনে সিনিয়র সচিব নামক কোনো পদের অস্তিত্ব ছিল না। বিগত কয়েক বছর পূর্বে এ পদটি সৃষ্টি করে অষ্টম বেতন স্কেলের গ্রেড ১-২০ বহির্ভূত উচ্চতর বেতন নির্ধারণ করা হয়। সচিবালয়ের প্রারম্ভিক সহকারী সচিব পদে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের সহকারী কমিশনার পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের পদায়ন করা হয়। মাঠ প্রশাসনে বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বিভাগীয় কমিশনার, অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও সহকারী কমিশনার পদে পদায়ন করা হয়। মাঠ প্রশাসনে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা পালন করে থাকেন। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা সরকারের নির্বাহী বিভাগের অন্তর্ভুক্ত।

আমাদের দেশে বর্তমানে সচিবালয় ও মাঠ প্রশাসনে যে প্রশাসনিক কাঠামো রয়েছে তা ব্রিটিশ ও পাকিস্তান শাসনামলের ধারাবাহিক উত্তরাধিকার তবে; উভয় শাসনামলে এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদ্বয় পরবর্তী তিন যুগেরও অধিক সময় অবধি শূন্য পদ ব্যতিরেকে পদোন্নতি প্রদানের কোনো নজির নেই। পৃথিবীর সর্বত্র শূন্য পদের বিপরীতে পদোন্নতি প্রদান করা হয়। আমাদের সচিবালয়ের উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব, সচিব ও নব সৃষ্ট সিনিয়র সচিব পদগুলো উচ্চতর চাকরি কাঠামোর পদ। সরকারের নির্বাহী আদেশ দ্বারা এ পদগুলো ২৮টি ক্যাডারের মধ্যে বিভাজন করা হলেও এর বড় অংশজুড়ে রয়েছে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য। সচিবালয় ব্যতীত আমাদের সরকারের অন্য কোনো বিভাগ, অধিদফতর, পরিদফতর, দফতর বা সংস্থায় শূন্য পদবিহীন পদোন্নতি কার্যকর করা হয়েছে তা ধারণার অতীত।

প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা যে সরকারের নির্বাহী বিভাগের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত এটি কারো অজানা নয়। সরকারের ক্ষমতার শীর্ষস্থান যেমন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং সচিবালয়কেন্দ্রিক মন্ত্রণালয়গুলোর নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত ও সার্বিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার পেছনের চালিকাশক্তি হলো প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর সারসংক্ষেপ বা কার্যপ্রণালী প্রস্তুতের সার্বিক দায়িত্ব প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের উপর ন্যস্ত। এসব কার্যালয়ের শীর্ষ পদধারীদের সাথে সার্বক্ষণিক ওঠা-বসা এবং যেকোনো নথিতে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ এদের মাধ্যমে কার্যকর হয় বিধায় তাদের অন্যায় আবদার উপেক্ষা করা অনেক সময় শীর্ষ পদধারীদের জন্য কঠিন হয়ে দেখা দেয়। এরই সুযোগ গ্রহণ করে প্রশাসন ক্যাডারের এসব কর্মকর্তা পদোন্নতিবিহীন হতাশার কথা ব্যক্ত করে অযৌক্তিকভাবে সংবিধান, আইন, বিধিবিধান ও নিয়মনীতির অবজ্ঞায় ও উপেক্ষায় পদবিহীন পদোন্নতির এক অভিনব অনাচারের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। এতে সরকারের বিপুল রাজস্ব ক্ষতি হলেও এ ব্যাপারে এদের কাউকে কখনো উৎকণ্ঠিত হতে দেখা যায়নি।

আমাদের সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত কর্মচারীদের নিয়োগ ও কর্মের শর্তাবলি সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইনের দ্বারা নির্ধারণের কথা বলা হলেও এতদসংক্রান্ত পরিপূর্ণ আইন প্রণয়ন দীর্ঘদিন যাবৎ উপেক্ষিত হয়ে আসছে। সংবিধানে সরকারি চাকরিজীবী তথা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত জাতীয় বেতন স্কেলের গ্রেড-২০ হতে গ্রেড-১ অবধি ব্যক্তিদের কর্মচারীরূপে আখ্যা দেয়া হলেও সরকারের বিভিন্ন প্রশাসনিক আদেশে কর্মকর্তা ও কর্মচারী বিভাজন সৃষ্টি করা হয়েছে। জাতীয় বেতন স্কেলের গ্রেড-৯ হতে গ্রেড-১ অবধি কর্মচারীরা বিভিন্ন প্রশাসনিক আদেশে কর্মকর্তা নামে অভিহিত হন অপর দিকে গ্রেড-১০ হতে গ্রেড-২০ অবধি কর্মচারীরা কর্মচারী নামেই অভিহিত হন।

সরকারি চাকরিজীবীরা রাষ্ট্রের নাগরিক। সংবিধানে সব নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করা, প্রত্যেক নাগরিককে যোগ্যতা অনুসারে পারিশ্রমিক প্রদান, কোনো গোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্য না করা এবং প্রজান্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সুযোগের সমতার কথা বলা হলেও কার্যত এ বিধানগুলো সচিবালয়কেন্দ্রিক প্রশাসন ক্যাডারের উপসচিব হতে সিনিয়র সচিব অবধি কর্মচারীদের ক্ষেত্রে অকার্যকর।
দীর্ঘদিন যাবৎ সচিবালয়কেন্দ্রিক অযৌক্তিক, অনৈতিক ও বেআইনি পদবিহীন পদোন্নতির যে ধারা অব্যাহত রয়েছে তাতে সচিব পদের ক্ষেত্রে এ ধরনের পদবিহীন পদোন্নতিধারী ব্যক্তির সংখ্যা গুটিকয়েক হলেও অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিবের ক্ষেত্রে এ সংখ্যা চারগুণেরও অধিক।

আগেকার বেতন স্কেলে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিভুক্তরা বর্তমান বেতন স্কেলের গ্রেড ১১-১৬ এবং গ্রেড ১৭-২০ ভুক্ত। এ ১০টি গ্রেডভুক্ত কর্মচারীদের অধিকাংশই পদোন্নতিযোগ্য নয় এমন পদে যোগ দিয়ে দীর্ঘ চাকরিকাল অতিবাহিত করে একই পদ থেকে অবসর গ্রহণ করতেন। কিন্তু অতীতে টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেডের সুবিধা থাকার কারণে তারা উচ্চতর স্কেলে ও গ্রেডে উন্নীত হওয়ার সুযোগ পেতেন। এ সুযোগের কারণে তাদের হতাশা ও বঞ্চনার প্রশমন হতো। বর্তমানে এসব গ্রেডে কর্মরত অনেককেই আক্ষেপ করে বলতে শোনা যায় সচিবরা যদি একই পদে কর্মরত থেকে সিনিয়র সচিব হয়ে উচ্চতর বেতন স্কেল পেতে পারেন, সে ক্ষেত্রে আগেকার পিয়ন, সুইপার, নাইট গার্ড, ড্রাইভার যারা বর্তমানে অফিস সহায়ক, পরিচ্ছন্নতা কর্মী, নিরাপত্তা প্রহরী, ড্রাইভার নামে অভিহিত তারা কেন সিনিয়র অফিস সহায়ক, সিনিয়র পরিচ্ছন্নতা কর্মী, সিনিয়র নিরাপত্তা প্রহরী, সিনিয়র ড্রাইভার পদে উন্নীত হয়ে উচ্চতর গ্রেডে বেতন প্রাপ্ত হবেন না?

সচিবালয়বহির্ভূত বিভিন্ন বিভাগ, অধিদফতর, পরিদফতর, দফতর বা সংস্থায় কর্মরত কর্মচারীদের একটি বড় অংশ চাকরিতে প্রারম্ভিক পদে যোগদান পরবর্তী পদোন্নতিবিহীন অবসরে চলে গেলেও এদের হতাশা, বঞ্চনা, ক্ষোভ, দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের বিষয়ে এ যাবৎকাল পর্যন্ত কোনো সরকারের পক্ষ হতেই কার্যকর ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। এসব কর্মচারীর দীর্ঘ হতাশা ও বঞ্চনা প্রশমনে সাম্প্রতিক যদিও একটি কমন নিয়োগ বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে কিন্তু তাতে শুভঙ্করের ফাঁকি পরিলক্ষিত হয়। বর্তমানে এমন কোনো কার্যালয় নেই যাতে হিসাব শাখা ও হিসাবরক্ষক পদ নেই। তা ছাড়া অধুনা সময় ও যুগের চাহিদা মতে প্রতিটি কার্যালয়ে পরিসংখ্যান সহকারী পদ সৃজন করা হয়েছে। এ পদদ্বয় কমন পদ হলেও উল্লিখিত নীতিমালায় এদের পদোন্নতিযোগ্য করা হয়নি। সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কার্যক্রম সম্পন্নে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, প্রতিবেদন প্রস্তুত ও নথি আদান-প্রদানে গ্রেড-১০ থেকে গ্রেড-২০ভুক্ত কর্মচারীদের অনন্য অবদান থাকলেও পদোন্নতির ব্যাপারে এদের একটি বড় অংশই উপেক্ষিত।

পদবিহীন পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মচারীরা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সরকারি কর্ম কমিশন কর্তৃক আয়োজিত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত। চাকরিতে যোগদান পরবর্তী উচ্চতর বেতন স্কেলের জন্য তাদের সরকারি কর্ম কমিশনের আয়োজনে শুধু বিভাগীয় পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়। এ বিভাগীয় পরীক্ষাটি ৩০০ নম্বরের, যার মধ্যে পুস্তকবিহীন ১০০ ও পুস্তকসহ ২০০ নম্বর। এসব কর্মচারী পরবর্তী পদোন্নতি যেমন উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব, সচিব ও সম্প্রতি সৃষ্ট সিনিয়র সচিব পদে পদোন্নতিপ্রাপ্তিতে কোনো ধরনের লিখিত, মৌখিক বা বিভাগীয় পরীক্ষার সম্মুখীন হন না। প্রশাসন সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের অভিমত প্রতিটি পদোন্নতির ক্ষেত্রে মেধা, যোগ্যতা ও দক্ষতা যাচাইয়ের জন্য শুধু বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর না করে সরকারি কর্ম কমিশনের মাধ্যমে যোগ্যতা নির্ধারণী পরীক্ষার আয়োজন করে উত্তীর্ণদের বিবেচনায় নেয়া হলে প্রশাসনের প্রতিটি পর্যায়ে সততার পাশাপাশি মেধাবী, যোগ্য ও দক্ষ কর্মচারী প্রকৃত মূল্যায়নের মাধ্যমে পদোন্নতির সুযোগ লাভ করবে।

সরকারি কর্মচারীরা একটি নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। চাকরিতে যোগদানকালীন প্রত্যেকেরই আশা থাকে অবসরের সময় প্রশান্তির সাথে বিদায় নেবেন কিন্তু সে প্রশান্তিতে ছেদ পড়ে যদি সম্পূর্ণ চাকরিজীবনের দীর্ঘ সময়ের ব্যাপ্তিতে তার ভাগ্যে একটি পদোন্নতিও না জোটে। আবার একই সচিবালয়ে নন-ক্যাডার হিসেবে কর্মরত অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় পদোন্নতির প্রয়োজনীয় যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও পদবিহীন পদোন্নতিপ্রাপ্তদের অবৈধ ক্ষমতার দৌরাত্ম্যে উপসচিবের নিম্ন পদধারীদের পদোন্নতির কার্যক্রম কালক্ষেপণের মাধ্যমে অসার যুক্তিতে বাধাগ্রস্ত করে তাদের উপসচিব পদে পদোন্নতিতে বঞ্চিত করা হয়। প্রতিটি সরকারি কর্মচারীর অভাব-অভিযোগ, দুঃখ-দুর্দশা, হতাশা-বঞ্চনা লাঘবের দায়িত্ব জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে যারা সরকার পরিচালনায় নিয়োজিত তাদের ওপর ন্যস্ত।

সরকার পরিচালনায় নিয়োজিত জনপ্রতিনিধিরা শপথের আওতাধীন। শপথ গ্রহণ করাকালীন তাদের সুস্পষ্টরূপে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি ব্যক্ত করতে হয় তারা সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করবেন এবং ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হয়ে সবার প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করবেন। সরকারি কর্মচারীদের একটি বড় অংশকে পদোন্নতি বঞ্চিত রেখে অপেক্ষাকৃত সুবিধাভোগী অংশটিকে পদবিহীন পদোন্নতি দেয়া হলে এ প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা যেমন অন্যায় ও অনিয়মের দোষে দুষ্ট অনুরূপ শপথধারীদের যে শপথের বিচ্যুতি হয় এ বিষয়টি ভাবনায় নেয়া হলে দেশ ও জাতিকে এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত অন্যায় কাজ প্রত্যক্ষ করতে হতো না।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail: [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement