২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

তথ্য-বাণিজ্যের যুগ ও নয়া দিগন্ত

-

২৫ অক্টোবর দৈনিক নয়া দিগন্ত ১৭তম বর্ষপূর্তি পালন করেছে। এ উপলক্ষে সীমিত পরিসরে যে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় তাতে যোগ দেয়ার সুযোগ হয়েছিল। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার নেতারা ফুলেল শুভেচ্ছা জানান পত্রিকাটির সম্পাদকসহ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও সর্বস্তরের কর্মীদের। সংক্ষিপ্ত যে আলোচনার আয়োজন ছিল তাতে প্রায় সবাই অভিন্ন কণ্ঠে গণমাধ্যমের এই দুর্দিনে নয়া দিগন্ত সীমিত সামর্থ্য নিয়ে দেশ ও জনগণের পক্ষে যে ভূমিকা রাখছে তার প্রশংসা করেছেন। আগামী দিনগুলোতেও তা অব্যাহত থাকবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। আমিও শুভেচ্ছা জানিয়ে বলার চেষ্টা করেছি, কেন নয়া দিগন্তকে আর ১০টি সংবাদপত্রের চেয়ে আলাদাভাবে দেখি।

অষ্টাদশ বর্ষে পদার্পণ উপলক্ষে পত্রিকাটির প্রথম পাতায় বর্ষীয়ান সম্পাদক আলমগীর মহিউদ্দিন যে বিশেষ সম্পাদকীয় লিখেছেন তাতে তিনি সত্য প্রকাশের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন। জাতীয় কবির বিখ্যাত পঙ্ক্তি ‘দুলিতেছে তরি ফুলিতেছে জল ভুলিতেছে মাঝি পথ/.../ কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ’ উল্লেখ করে বস্তুত চরম বৈরী ও দুর্গম পথে তাদের যাত্রায় সঙ্গী হয়ে সাহস জোগানোর আহ্বানই জানিয়েছেন। ‘সত্যের সঙ্গে প্রতিদিন’ এ সেøাগান ধারণ করে ২০০৪ সালে যাত্রা করা নয়া দিগন্ত বরাবরই কঠিনেরে ভালোবেসে টিকে থাকার সংগ্রাম করছে। গোটা গণমাধ্যমজুড়ে এক যুগ ধরে যে অমানিশার ঘোর অন্ধকার বিরাজমান তার মধ্যে টিকে থাকাটাই বড় সাফল্য হিসেবে দেখতে হয়।

সংবাদ প্রতিষ্ঠানের সামাজিক দায়িত্ব বা দায়বদ্ধতার বিষয়টি বিংশ শতাব্দীতে সারা বিশ্বে গুরুত্ব পেতে শুরু করে। রয়েল কমিশন অন দ্য প্রেস (১৯৪৯- গ্রেট ব্রিটেন) এবং অ্যা ফ্রি অ্যান্ড রেসপন্সিবল প্রেস (১৯৪৭-ইউএসএ) রিপোর্ট দু’টি নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে জনগণের সামনে তথ্য উপস্থাপনে সাংবাদিকদের উদ্বুদ্ধ করে। ওই সময় সাংবাদিকতা পেশাকে আদর্শবাদের আলোকে দেখতে শুরু করেন সাংবাদিকরা। একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে এসে বাংলাদেশের মিডিয়া জগতে টেকনোলজি ও পুঁজির ব্যাপক পরিবর্তনের ফলে নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। সামাজিক দায়িত্বের প্রসঙ্গটি ক্রমে চাপা পড়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞাপনদাতার ভাষা হয়ে উঠছে সাংবাদিকের রিপোর্টের ভাষা। এ প্রক্রিয়ায় প্রতারিত হচ্ছেন পাঠক-দর্শকরা। স্পন্সরের যাঁতাকলে সংবাদ হয়ে উঠছে পুঁজি জোগানদাতার নানান কার্যক্রমের বিবরণ। হাউজিং, প্রসাধনসহ কনজিউমার প্রডাক্টস এবং রাজনীতি জনস্বার্থের বিপক্ষেই বেশি উপস্থাপন করা হচ্ছে মিডিয়ায়। এ প্রক্রিয়াটা মূলত তথ্য-বাণিজ্য, সাংবাদিকতা নয়। সে কারণেই মিডিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা আজ কাঠগড়ায়। এমন পরিস্থিতিতে নয়া দিগন্তের মতো আদর্শবাদী ও নৈতিকতা-নির্ভর সংবাদমাধ্যমের চ্যালেঞ্জটা একটু বেশিই।

সারা বিশ্বে প্রতিদিন অগণিত ঘটনা ঘটে। কেন মাত্র কিছুসংখ্যক ঘটনা সংবাদে পরিণত হয়? কেন জনগণ এসব ঘটনা জানতে আগ্রহী হয়, আবার কোনো কোনো ঘটনা একেবারেই উপেক্ষিত থেকে যায়? এসব ঘটনার সংবাদমূল্য নির্ধারণ করে কে? অন্তর্নিহিত সত্তাগতভাবেই এসব ঘটনার মধ্যে কোনো কোনোটি সংবাদে পরিণত হয় আর কোনোটি হয় না? সাংবাদিকতা ও সংবাদ শিল্পকে সম্যকভাবে উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে এ রকম বহুবিধ প্রশ্ন আমাদের বিবেক ও চেতনাকে যদি আলোড়িত করে তবেই সত্যিকারের সাংবাদিকতা সম্ভব।

সাংবাদিকতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ ও সমাজ বিজ্ঞানীরা অনেক কথাই বলেছেন। কেউ মনে করেন সংবাদমাধ্যম সমাজের আয়না, সংবাদপত্রের পাতায় বা টেলিভিশনের পর্দায় সমাজচিত্রের প্রতিফলন থাকবে, যা দেখে মানুষ সচেতন হবেন। অনেকের কাছে সাংবাদিকতা পাঠকের জন্য বার্তা, এ বার্তা সমাজকে কলুষমুক্ত রাখতে উদ্বুদ্ধ করবে। প্রায় আড়াই শ’ বছর আগে ব্রিটিশ পার্লামেন্টারিয়ান এডমন্ড বার্ক বলেছিলেন, ‘সাংবাদিকরা হচ্ছে রাষ্ট্রের চতুর্থ ইন্দ্রিয়’। প্রায় সমসাময়িক কালে সম্র্রাট নেপোলিয়ান কিন্তু বলেছিলেন অন্য কথা। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি চারটি সংবাদপত্রকে এক লাখ বেয়োনেটের চেয়েও বেশি ভয় করি’।

আভিধানিকভাবে সংজ্ঞায়িত করলে- জার্নালিজম হলো জার্নাল ও ইজম শব্দ দু’টির মিলিত রূপ। জার্নাল শব্দের অর্থ- কোনো কিছু প্রকাশ করা আর ইজমের অর্থ অনুশীলন বা চর্চা করা। এ হিসেবে কোনো কিছু প্রকাশ করতে যে চর্চা বা অনুশীলন করা হয় তার নাম সাংবাদিকতা বা জার্নালিজম। ঊনবিংশ শতাব্দী কিংবা বিংশ শতাব্দীর গোড়াতে বাংলা সংবাদপত্রের আদিযুগে এমনটাই ছিল সাংবাদিকতা ও সংবাদমাধ্যম।

কিন্তু হাল আমলের কর্পোরেট মিডিয়া টাইকুনদের কাছে ব্রিটিশ পার্লামেন্টারিয়ান বার্কের দেয়া সাংবাদিকতায় নৈতিকতার সংজ্ঞা বা অন্য মিডিয়া বিশেষজ্ঞদের সংজ্ঞা একটি বাতিল বিষয়। এটা ঠিক, সমাজের নৈতিকতার কাঠামো বা মাপকাঠি পরিবর্তিত হয়ে এখন অন্য রকম। এই সামাজিক কাঠোমোতে কর্পোরেট মালিকানায় সংবাদপত্র বা মিডিয়া হচ্ছে কর্পোরেট ব্যবসার বহুমুখী মাধ্যমগুলোর একটি। কর্পোরেট সংবাদমাধ্যম একদিকে ব্যবসার প্রসার ও ব্যবসায়ীর নিরাপত্তার হাতিয়ার, অন্যদিকে প্রতিযোগী বা শত্রুকে ঘায়েল বা বিনাশ করার অস্ত্র। তাই কর্পোরেট মালিকানাধীন মিডিয়ার সাংবাদিকরা এখন আর আদৌ ‘রাষ্ট্রের চতুর্থ ইন্দ্রিয়’ নয়, বরং তারা এখন সিসিটিভির মতো কর্পোরেট মালিকদের ‘চতুর্থ ইন্দ্রিয়’ এবং অনেক ক্ষেত্রে কর্পোরেট স্বার্থ রক্ষার আন্ডার কভার ‘ডেথ স্কোয়াড’।

এখানে নেপোলিয়ানের উক্তিটিও প্রণিধানযোগ্য। তিনি কি তাহলে সেই আমলেই সাংবাদিকতার অনৈতিক উপাদানগুলো সম্পর্কে আঁচ করতে পেরেছিলেন যে, এক লাখ বেয়োনেটের চেয়েও বেশি ভয় পেতেন? আজ যেমন কর্পোরেট স্বার্থ মিডিয়া জগৎকে প্রধানত নিয়ন্ত্রণ করছে, তখন হয়তো সামন্ত প্রভুদের এবং গির্জার স্বার্থও প্রকটভাবে মিডিয়ার নিয়ন্ত্রক ছিল। সমাজ বিবর্তনের ধারায় দিনে দিনে এভাবেই মিডিয়া জগতের নৈতিকতাকে প্রতিস্থাপন করেছে ব্যবসা আর ব্যবসার প্রধান উপজীব্য হয়ে উঠেছে মনের মাধুরি মেশানো কেচ্ছা। তাই আজকের এ সমাজ কাঠামোর অধীনে সাংবাদিকতা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নৈতিকতা নির্ভর নয়, মতলবি কেচ্ছা নির্ভর।

গত ১৬ আগস্ট ২০২১ বাংলাদেশের উচ্চ আদালত সংবাদপত্র, সংবাদ সংস্থা ও সাংবাদিকদের উচ্চ মানসম্পন্ন পেশাদারিত্বের জন্য একটি ‘নৈতিক আচরণবিধি’ প্রণয়নের জন্য রুল জারি করেছেন। প্রেস কাউন্সিল আইন-১৯৭৪-এর ১১(২)(খ) অনুযায়ী একটি নৈতিক আচরণবিধি প্রণয়নে নিষ্ক্রিয়তা কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চাওয়া হয়েছে রুলে। আপাতদৃষ্টিতে এটাকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখাই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু বর্তমান রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামোতে নৈতিক আচরণবিধি মানার সুযোগ কতটুকু বিদ্যমান? আজকের বাংলাদেশে নৈতিকতা তো হলো ধুলো পড়া বইয়ের ভেতরের উপজীব্য।

অনেকেই হয়তো জানেন, সংবাদমাধ্যমে বহুল আলোচিত ‘হলুদ সাংবাদিকতা’র জন্ম হয়েছিল সাংবাদিকতা জগতের অন্যতম দুই ব্যক্তিত্ব যুক্তরাষ্ট্রের জোসেফ পুলিৎজার আর উইলিয়াম র‌্যানডলফ হার্স্টের মধ্যে পেশাগত অসুস্থ প্রতিযোগিতার ফল হিসেবে। এ দুই সম্পাদক তাদের নিজ নিজ পত্রিকার ব্যবসায়িক স্বার্থে একে অন্যের অপেক্ষাকৃত যোগ্য সাংবাদিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত কর্মীদের বেশি বেতনে নিজেদের প্রতিষ্ঠানে নিয়ে আসার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিলেন। একপর্যায়ে ব্যক্তিগত কেলেঙ্কারির চাঞ্চল্যকর খবর ছেপে তারা পত্রিকার কাটতি বাড়ানোর চেষ্টা করেন। পুলিৎজারের নিউ ইয়র্ক ওয়ার্ল্ড ও হার্স্টের নিউ ইয়র্ক জার্নালের পারস্পরিক প্রতিযোগিতা এমন এক অরুচিকর পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতার পরিবর্তে পরস্পরকে ঘায়েল, পত্রিকার বাহ্যিক চাকচিক্য আর পাঠকদের উত্তেজনা দানই তাদের কাছে মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়।

আজকের বাংলাদেশের প্রথম সারির অনেক সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলের দিকে তাকালে পুলিৎজার আর হার্স্টের সেই হলুদ লড়াইয়ের প্রতিচ্ছবি দেখা যাবে। কর্পোরেট বিজনেস হাউজের মালিকরা সংবাদপত্রকে কিভাবে নিজেদের কর্মকান্ড আড়ালের বর্ম হিসেবে ব্যবহার করছেন তা হরহামেশাই চোখে পড়ছে। সাধারণ মানুষের হাজার কোটি টাকা লোপাট করে মিডিয়ার মালিক বনে সেগুলোকে অনাচার অপকর্মের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করার অপচেষ্টাও দেখতে হচ্ছে।

অনেকেই বলছেন, এখন তথ্য-বাণিজ্যের যুগ। সত্যিকারের সাংবদিকতা তাই নির্বাসিত। বিষয়টা সাংবাদিকদের অনেকে বুঝতে পারলেও তারা অনেকটাই যেন অসহায়। একদিকে সাংবাদিকদের ইউনিয়ন দ্বিধাবিভক্তি ও সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানের অনুপস্থিতি, অন্যদিকে বৃহৎ পুঁজির দাপটে অনেকেই কেবল সুযোগ সন্ধানী। অনেক সাংবাদিক নেতা এমনকি সম্পাদকও বিত্তবৈভবের নেশায় আপস করছেন, তাঁবেদারি করছেন। ফলে একটা অস্বস্তিকর ও শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। নতুন পত্রিকা বেরুচ্ছে, নতুুন টিভি কেন্দ্র চালু হচ্ছে কিন্তু সাংবাদিকতার মানসে নয়- শুধু মুনাফা কিংবা বাণিজ্যিক অপকর্ম প্রোটেকশনের লক্ষ্যে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে ব্যবসায়িক সুবিধা গ্রহণ বা নিজের সুবিধা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে রাষ্ট্রকে প্রভাবিত করা এখন অনেক মিডিয়া মালিকের প্রধান লক্ষ্য। এটাকে তাই বলা হচ্ছে ‘মিডিয়া-বাণিজ্য’ বা তথ্য-বাণিজ্য। এতে পাঠক, দর্শক বিভ্রান্ত ও অসহায়।

সাংবাদিকতা ও তথ্য-বাণিজ্যের একটি সরল সোজা পার্থক্য হলো- তথ্য-বাণিজ্যে তেমন দায়িত্ব নেই; কিন্তু সাংবাদিকতায় দায়িত্ব রয়েছে। অর্থাৎ সাংবাদিকতায় অবজেক্টিভিটি থাকবে, তথ্য-বাণিজ্যে যা অপরিহার্য নয়। এভাবেও বলা যায় যে খবর মানুষ বেশি পড়বে বলে মনে হয় তা প্রকাশ করাই তথ্য-বাণিজ্য। আর খবর প্রকাশের পর এর কী প্রভাব সমাজের ওপর পড়বে সেটি ভেবে সংবাদ প্রকাশ করা হলো সাংবাদিকতা। যৌন লাঞ্ছনার শিকার কোনো নারীর নাম প্রকাশ না করে সংবাদ প্রকাশ করা সাংবাদিকতার নীতি। তথ্য বণিকরা এ নীতিমালার ধার ধারেন না। তথ্য-বাণিজ্যের মুখ্য উদ্দেশ্য হলে তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে যায়। এখন হচ্ছেও তাই। এক পত্রিকা বা এক চ্যানেলের খবরে পাঠক-দর্শক নিশ্চিন্ত হন না, কয়েকটি মিডিয়ার খবর মিলিয়ে দেখতে চান।

দেশপ্রেমিক ও গণতন্ত্রমনা মানুষের কণ্ঠস্বর হিসেবে নয়া দিগন্ত পরিণত বয়স আঠারোতে পা দিয়েছে। পত্রিকাটি তথ্য-বণিকের ভূমিকা পালন না করে সত্যিকারের ন্যায়নীতি ও সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকতার চর্চা করে যাবে এ প্রত্যাশা করি।

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে)


আরো সংবাদ



premium cement