আফগানিস্তান দখলদারির পেছনের কারণ
- ড. এ কে এম মাকসুদুল হক
- ১৭ অক্টোবর ২০২১, ২০:২২, আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০২১, ০৬:৫৯
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার টুইন টাওয়ারে হৃদয়বিদারক হামলার প্রতিক্রিয়ায় তৎকালীন বুশ প্রশাসনের শক্তিধর সশস্ত্র বাহিনী আফগানিস্তানে আক্রমণ চালায়। ৭ অক্টোবর অভিযান শুরু করে মাত্র দুই মাসের মধ্যে তৎকালীন তালেবান সরকারের পতন ঘটিয়ে মার্কিনিরা আফগানিস্তান দখল করে নেয়। এরপর তারা সুদীর্ঘ ২০ বছর তাঁবেদার সরকারের মাধ্যমে এই দখলদারিত্ব কায়েম রাখে এবং নিজেদের পশ্চিমা ধাঁচের সংস্কৃতি ও জীবনাচার আফগান জনগণের ওপর চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করে। এই জন্য তারা অজস্র অর্থ-সম্পদ, অস্ত্র ও যন্ত্রপাতি এবং জনবল ক্ষয় করে। কিন্তু এই ব্যয়বহুল যুদ্ধে মার্কিনিরা চূড়ান্ত বিচারে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে পরাজয়ের গ্লানি মেনে নিয়ে একটি মুখরক্ষার চুক্তির আড়ালে গত ৩১ আগস্ট ২০২১ আফগানিস্তান থেকে শেষ সৈন্যটি প্রত্যাহার করে নিয়ে যায়। এখন প্রশ্ন দাঁড়ায় কেন যুক্তরাষ্ট্রের চারজন প্রেসিডেন্ট দুই দশক ধরে রক্তক্ষয়ী এই ব্যয়বহুল যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন? এই প্রবন্ধে সেই প্রশ্নেরই উত্তর বিশ্লেষণের চেষ্টা করা হবে।
(ক) দখলদারিত্বের প্রক্রিয়া : মার্কিন প্রশাসন তিন ধাপে আফগানিস্তানে দখল-দারিত্ব কায়েম করেছিল। প্রথম ধাপে মাত্র দুই মাসের মধ্যেই তারা তালেবান সরকারের পতন ঘটিয়ে আফগানিস্তান দখল করে নেয় ২০০১ সালের ডিসেম্বরে। দ্বিতীয় ধাপে ২০০২ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তারা তালেবান প্রতিরোধ যোদ্ধাদেরকে প্রতিহত করে আফগানিস্তানের মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠনের প্রচেষ্টা চালায়। ২০০৮ সাল থেকে তৃতীয় ধাপে কাউন্টার ইন্সারজেন্সি অপারেশন পরিচালনার মাধ্যমে তালেবান শক্তিকে সমূলে ধ্বংস এবং আফগান সেনাবাহিনীর ওপর নিরাপত্তার দায়িত্ব হস্তান্তরের পরিকল্পনা করে।
ওই তিন ধাপের দীর্ঘ অভিযানে মার্কিনিরা মাত্র দু’টি বিষয়ে সফলতা পেয়েছে। প্রথমত, তারা খুব দ্রুত তালেবান সরকারকে উৎখাত করতে সক্ষম হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ২০১১ সালে আলকায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করতে সক্ষম হয়। কিন্তু অন্যান্য বিষয়ে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে ওবামা প্রশাসন আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করে। ট্রাম্প প্রশাসন এসে তালেবানদের সাথে সৈন্য প্রত্যাহারের চুক্তি চূড়ান্ত করে এবং বর্তমান বাইডেন প্রশাসন ওই চুক্তি কার্যকর করে সব সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়।
(খ) যুক্তরাষ্ট্রের আফগান যুদ্ধে জড়িত হওয়ার পটভূমি : বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ১৯৭৯ সালে তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়া আফগানিস্তানে এক লাখ ১৫ হাজার সৈন্যসহ আক্রমণ চালিয়ে দখল করে নেয়। সে সময়ে চলমান ঠাণ্ডা লড়াইয়ের রাশিয়ার একমাত্র প্রতিদ্ব›দ্বী যুক্তরাষ্ট্র এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের ভিয়েতনামে পরাজয়ের ভাগ্য কমিউনিস্টদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার প্রকল্প হাতে নেয়। ইতোমধ্যে আফগানিস্তানের বিভিন্ন গোত্র-উপগোত্র ‘নাস্তিক্যবাদীদের’ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একত্র হয়ে মুজাহিদ বাহিনী গঠন করে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। একই সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সহযোগিতা ও সমন্বয়ের মাধ্যমে বিশ্বের মুসলিম রাষ্ট্রগুলো থেকে দলে দলে যুবকরা ‘নাস্তিক’ বাহিনীর বিরুদ্ধে জিহাদ করতে আফগানিস্তানে আসে। এতে সৌদি আরব আর্থিক সহযোগিতা এবং পাকিস্তান সেই সহযোগিতার করিডোর উন্মুক্ত করে দেয়।
মার্কিন অভিভাবকত্বে এই জিহাদকে সমন্বয় করে বিজয়ের বন্দরে নিয়ে যাওয়ার জন্য শিক্ষিত ধনকুবের এবং নিবেদিত প্রাণ ধার্মিক সৌদি যুবক ওসামা বিন লাদেনকে উড়িয়ে আনা হয় আফগানিস্তানে। ১০ বছরের যুদ্ধে প্রায় পাঁচ লাখ আফগান এবং ১৫ হাজার সোভিয়েত সৈন্যের জীবন ক্ষয় করে রাশিয়া পরাজয় বরণ করে আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যায় এবং পরিণতিতে সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র সফল তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানকে শতধা বিভক্ত গোত্রপতিদের হাতে ফেলে দ্রুত আফগানিস্তান ত্যাগ করে ১৯৯০ সালে। এই যুদ্ধে মার্কিনিরা এক ঢিলে তিন পাখি শিকার করে। প্রথমত, সোভিয়েত সাম্রাজ্যবাদীদেরকে এশিয়ার করিডোরে আস্তানা স্থাপনে প্রতিহত করে। দ্বিতীয়ত, তাদের ভিয়েতনামের ক্ষয়ক্ষতি ও পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয় কমিউনিস্টদের ওপর এবং তৃতীয়ত, একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তিকে দুর্বল করে বিশ্বে একক পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
এ দিকে অভিভাবকহীন আফগানিস্তানে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। কাবুলের মসনদে বসার জন্য একসময়কার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা মুজাহিদ নেতারা এবার নিজেদের মধ্যে অন্তর্কলহে লিপ্ত হয়। ফলে দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। এমতাবস্থায় পাকিস্তানের আফগান উদ্বাস্তু শিবিরগুলোতে মাদ্রাসার ছাত্ররা (মূলত পশতুন) তাদের ক্যারিসম্যাটিক শিক্ষক মোল্লা ওমরের নেতৃত্বে বিভিন্ন সামাজিক অপরাধগুলোর ন্যায় বিচার করতে এগিয়ে আসে এবং অপরাধে জড়িতদের নিষ্ঠুরভাবে শাস্তি দেয়। এতে তাদের নিরাপত্তার হুমকি দেখা দিলে তারা সশস্ত্র সংগঠন ‘তালেবান বাহিনী’ গড়ে তোলে। এই গোষ্ঠী দ্রুত সমাজে জনপ্রিয়তা পায় এবং ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে লিপ্ত হয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে ১৯৯৬ সালে মার্কিন তেল কোম্পানি ‘ইউনিকল’ মধ্য এশিয়ার সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলো থেকে খনিজ তেল আফগানিস্তানের মধ্যদিয়ে পাইপলাইনের মাধ্যমে পাকিস্তানের করাচি পর্যন্ত এনে বহির্বিশ্বে রফতানির পরিকল্পনা ও চুক্তি সম্পন্ন করে। আফগানিস্তানের ভেতর দিয়ে তেল রফতানি করে বিপুল অঙ্কের লাভের পাশাপাশি রাশিয়া ও ইরানকে কোণঠাসা করে রাখার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে মার্কিনিরা। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তালেবান গোষ্ঠী হয়ে ওঠে পশ্চিমাদের ট্রামকার্ড। ফলে ১৯৯৬ সালে দ্রুততার সাথে তালেবানরা কাবুল দখল করলে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন দেয় এবং পাকিস্তানের মাধ্যমে তালেবানদের সরাসরি সাহায্য পাঠাতে শুরু করে।
এ দিকে ১৯৯০ সালে উপসারীয় যুদ্ধে ইরাক আক্রমণের জন্য সৌদি মাটিতে আমেরিকান সৈন্যের উপস্থিতি নিয়ে সৌদি আরব এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ওসামা বিন লাদেনের বিরোধ শুরু হয়। নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে বিন লাদেন সুদানে আশ্রয় নেয় এবং সোভিয়েত বিরোধী সাবেক যোদ্ধাদের সংগঠিত করে গ্লোবাল জিহাদের ডাক দেয়। ফলে মার্কিন ও সৌদি চাপে সুদান থেকে বিতাড়িত হয়ে বিন লাদেন ১৯৯৮ সালে ফেব্রæয়ারি মাসে আফগানিস্তানে এসে আশ্রয় নেয়। এরপর বিন লাদেন বিশ্বজুড়ে আমেরিকান স্বার্থে আঘাত হানার জন্য বিভিন্ন চরমপন্থী ইসলামী দলগুলোকে আহ্বান জানায়। আগস্ট মাসে আফ্রিকায় তানজিনিয়া এবং কেনিয়ার মার্কিন দূতাবাসে বোমা হামলা করে বিন লাদেনের সমর্থকরা বহু নিরীহ মানুষ হতাহতের (নিহত ২২৪ এবং আহত ৪,০০০) ঘটনা ঘটায়। ফলে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী মার্কিন স্বার্থের নিরাপত্তার জন্য চিন্তিত হয়ে পড়ে এবং বিন লাদেনকে গ্রেফতারের বিষয়টি তাদের অগ্রগণ্য মিশন হয়ে দাঁড়ায়।
এইভাবেই বিন লাদেন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানদের মধ্যে মধুচন্দ্রিমা ভেঙে যায় এবং বন্ধুর সম্পর্ক শত্রæতায় রূপ নেয়। এরই মধ্যে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টনের পর জর্জ ডবিøউ বুশ ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসেন এবং একই বছর ১১ সেপ্টেম্বর মর্মান্তিক হামলা হয় আমেরিকার ‘টুইন টাওয়ারে’। বিন লাদেন এই হামলার দায়িত্ব অস্বীকার করলেও যুক্তরাষ্ট্র বিন লাদেনকেই দায়ী করে এবং তাদের পররাষ্ট্রনীতি বিন লাদেন কেন্দ্রিকই পরিবর্তিত হয়ে যায়। ফলে লাদেনের আশ্রয়দাতা তালেবানরা যুক্তরাষ্ট্রের পরম শত্রুতে পরিণত হয়।
(গ) প্রতিশোধস্পৃহা : বিন লাদেন ইস্যুতে তালেবানদের সাথে সম্পর্কের অবনতির সাথে সাথে আফগানিস্তানের ভেতর দিয়ে মধ্য এশিয়ার তেল রফতানির আশা শেষ হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে বুশ প্রশাসন আফগানিস্তানে প্রবেশের বিকল্প রাস্তা বেছে নেয়। তারা তালেবানদের একমাত্র বিরোধীশক্তি আহমাদ শাহ মাসুদের ‘নর্দান অ্যালায়েন্স’কে বেছে নেয়। ২০০১ সালের আগস্টে তারা চূড়ান্ত পরিকল্পনা করে যে, পরোক্ষভাবে ‘নর্দান অ্যালায়েন্সের’ মাধ্যমে আফগান দখলের পদক্ষেপ ব্যর্থ হলে সরাসরি তালেবান সরকারের পতন ঘটাবে। এরই মধ্যে ‘আহমদ শাহ মাসুদ’ এক আত্মঘাতী বোমা হামলায় ৯ সেপ্টেম্বর নিহত হয়ে যখন মার্কিনিদের আশার কফিনে শেষ পেরেকটি ঢুকে যায় ঠিক তখনই ‘৯/১১’-এর ভয়াবহ হামলার ঘটনা ঘটে যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে। প্রচারিত তথ্যমতে ১৯ জন সৌদি চরমপন্থী যুবক এই আক্রমণে অংশ নেয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সব ক্ষোভ আপতিত হয় আফগানিস্তানের ওপর। ১৯ জন এই আরবি নাগরিকের জন্ম, বেড়ে ওঠা এবং উড়োজাহাজ চালানোর প্রশিক্ষণের কাজ আফগানিস্তানে না হলেও বুশ তালেবানদেরই নির্দিষ্ট করে নেয় প্রতিশোধ নেয়ার জন্য। আফগানিস্তানে অবস্থানরত বিন লাদেন এই হামলার ব্যাপারে নিজের সংশ্লিষ্টতা বারবার অস্বীকার করলেও বুশ প্রশাসন একতরফাভাবে লাদেনকেই দায়ী করে এবং বিন তালেবান সরকারকে সরাসরি আদেশ দেয় লাদেনকে হস্তান্তরের জন্য।
তালেবান সরকার লাদেনের সংশ্লিষ্টতার বস্তুনিষ্ঠ প্রমাণ সাপেক্ষে তাকে হস্তান্তরের কথা জানায়। এমনকি লাদেন নিজে পাকিস্তানে গৃহবন্দী থেকে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে শরিয়া আইন দ্বারা বিচারের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত বলে জানালেও বুশ প্রশাসন তাতে সায় দেয়নি। ২ অক্টোবর পাকিস্তানের আফগান রাষ্ট্রদূত আব্দুল সালাম জায়িফ যুক্তরাষ্ট্রকে সমঝোতার আবেদন জানায়। কিন্তু প্রতিশোধস্পৃহায় অন্ধ প্রেসিডেন্ট বুশ বিন লাদেনকে হস্তান্তরের একমাত্র শর্ত আরোপ করে এবং অন্যথায় ‘তালেবান সরকারের প্রত্যেকটি স্তম্ভকে ধ্বংস করে ফেলা হবে’ বলে হুঙ্কার দেয় এবং ৭ অক্টোবর বিমান হামলার মাধ্যমে আক্রমণের সূচনা করে। প্রেসিডেন্ট বুশ আমেরিকার শক্তি ও সামর্থ্যরে অহমিকায় একরোখা হয়ে যাদের কোনো সংশ্লিষ্টতাই ছিল না ‘৯/১১’ আক্রমণের সাথে তাদেরকে ধ্বংস করাটাকেই প্রতিশোধের একমাত্র পথ হিসেবে বেছে নিলেন। এমনকি ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ ধ্বংসস্ত‚পের মধ্য থেকে তালেবান মুখপাত্র নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দিলেও বুশ প্রশাসন তা নাকোচ করে আক্রমণ অব্যাহত রাখে।
(ঘ) আলকায়েদা নির্মূল অভিযান : আলকায়েদাকে নির্মূলের জন্য অভিযানের উছিলায় আফগানিস্তানে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার এক দারুণ সুযোগ আমেরিকার কাছে এসে যায়। এ জন্য তারা প্রথমে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘সিআইএ’ এর মাধ্যমে কোভার্ট অপারেশন বা গোয়েন্দা অভিযান চালিয়ে ‘নর্দান অ্যালায়েন্স’-এর মাধ্যমে আফগান দখলের প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু ‘নর্দান অ্যালায়েন্সের’ নেতা আহমাদ শাহ মাসুদ নিহত হওয়ায় সেই অভিযান ব্যর্থ হলে তারা সরাসরি আগ্রাসন চালিয়ে আফগানিস্তান দখল করে নেয়। বিমান ও ভূমি হামলার মাধ্যমে তারা তালেবানদের হটিয়ে আলকায়েদার সব শিবির ধ্বংস করে ফেলে। কিন্তু অজানা কারণে প্রধান লক্ষ্যবস্তু লাদেন অক্ষত অবস্থায় ফসকে যেতে সক্ষম হয়। এরপর দীর্ঘ ১১ বছর বিন লাদেনকে দেখা না গেলেও হঠাৎ ২০১১ সালে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদের একটি বাসায় আমেরিকান ‘সীল (ঝঊঅখ) টিম সিক্স’ নিশি রাতের গোপন অভিযানের মাধ্যমে লাদেনকে হত্যা করে বলে প্রচার করে।
এই অভিযানের ভিডিও প্রচার করা হলেও বিন লাদেনকে জীবীত বা মৃত কোনো অবস্থায়ই তারা দেখাতে সক্ষম হয়নি। বরং বিন লাদেনের মৃতদেহকে সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়েছে বলে দাবি করে। দীর্ঘ ১১ বছর পর হঠাৎ লাদেনকে হত্যা করার ‘ন্যারেটিভ’ তাই চিন্তাশীল মহলে অনেক প্রশ্ন সৃষ্টি করে যদিও পশ্চিমাদের শক্তিশালী মিডিয়া কোনো প্রমাণ ছাড়াই বিন লাদেন হত্যার অভিযানের এই ‘ন্যারেটিভ’কে প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা চালিয়েছে। তবে আজ যখন যুক্তরাষ্ট্র সেনা প্রত্যাহার করেছে তখন কিন্তু আলকায়েদা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। ২০০১ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ইসলামের নামে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় চার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০১ সালে মধ্যপ্রাচ্য, হর্ন অব আফ্রিকা এবং সাহেল অঞ্চলে যেখানে চরমপন্থী সন্ত্রাসী অবস্থান ছিল মাত্র ২২ শতাংশ, ২০১৮ সালে এসে তা দাঁড়িয়েছে ৭৭ শতাংশে (ড. নাজানিন আজিজিয়ান, আগস্ট ২০২১)।
(ঙ) যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি : মার্কিনিদের আফগান আক্রমণ এবং ২০ বছর যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পিছনে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ঘনিষ্ঠ সংশ্লিষ্টতা ছিল বলে বিশ্লেষকগণ বিশ্বাস করেন। ‘টুইন টাওয়ারে’ এমন সময় আক্রমণটা হয়েছিল যখন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডবিøউ বুশ ভোটের জনপ্রিয়তার বিচারে কোনোক্রমে উতরে উঠে এসেছেন প্রতিদ্ব›দ্বী ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী আল গোরের বিপরীতে। পপুলার ভোটে হেরে গেলেও ইলেক্টরাল ভোটে তিনি বৈতরণি পার হয়ে আদালতের মাধ্যমে ক্ষমতারোহণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এমতাবস্থায় টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার বিপরীতে প্রতি-আক্রমণের মাধ্যমে জাতীয় ঐক্যের নামে তার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করে।
পরবর্তী সময়ে ডেমোক্র্যটিক প্রার্থী ওবামা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় বসেই আফগান যুদ্ধকে তার দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য ট্রাম্পকার্ড হিসেবে বেছে নিলেন। তিনি সৈন্যবৃদ্ধির মাধ্যমে আফগান যুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি করলেন এবং ২০১১ সালে আলকায়েদা নেতা বিন লাদেনকে প্রশ্নবিদ্ধ বিশেষ কমান্ডো অভিযানে হত্যার কৃতিত্ব অর্জন করার পর আফগান যুদ্ধে সৈন্য হ্রাসের ঘোষণা দিয়ে ২০১২ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে সফলতার সাথে ক্ষমতায় আরোহণ করেন। ইতোমধ্যে ২০০১ সাল থেকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ২৪টি দেশে যুদ্ধ করে প্রায় ৫.৫ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ এবং প্রায় ৬০ হাজার মার্কিনির নিহত অথবা আহত হওয়ার (প্রাগুক্ত) অভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়া তিনি বুঝতে সক্ষম হন। ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে জনমত জয়ের আশায় তিনি আফগানিস্তান থেকে সৈন্য সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের জন্য তালেবানদের সাথে নির্বাচনের আগেই চুক্তি সম্পাদন করেন। যদিও তার ব্যক্তিগত ভারসাম্যহীন আচার-আচরণ এবং বক্তব্য ও কর্মকাণ্ডের কারণে তার এই আফগান ট্রাম্পকার্ড সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থতার পর্যবসিত হয়।
চূড়ান্তভাবে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মার্কিন জনগণের মনোভাব বুঝেসুঝেই ট্রাম্পের সম্পন্ন করা চুক্তি অনুসারে সৈন্য প্রত্যাহার বাস্তবায়ন করেন। তবে তিনি একটু তাড়াহুড়ো করেই চুক্তিটি বাস্তবায়ন করেন যেন মধ্যবর্তী নির্বাচন আসতে আসতে সৈন্য প্রত্যাহারের নেতিবাচক প্রভাব ছাপিয়ে ইতিবাচক প্রভাবটিই দৃশ্যমান হয় বা অনুভূত হয়। এভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চারজন প্রেসিডেন্ট দীর্ঘ ২০ বছরব্যাপী আফগান যুদ্ধকে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক টাইমলাইনের সাথে জড়িয়ে রেখেছেন।
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক
Email: [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা