দাসত্বের ইতর-সভ্য ও পুঁজিবাদের মুখ
- মুসা আল হাফিজ
- ১১ অক্টোবর ২০২১, ২০:২৩
কবি ফিলিস হুইটলি বন্দী ছিলেন দাসত্বে। মুক্তির আকুতি ছিল তার বেঁচে থাকার প্রদীপ। এ ছিল তার শক্তি ও স্বপ্ন। তিনি একে জানতেন এবং জানতেন এর প্রতিপক্ষকে।
একটি কবিতায় মুক্তির পক্ষ-বিপক্ষকে হাজির করেন ১৭৭৪ সালে। তার ভাষায়, ‘প্রতিটি মানুষের বুকের গহিনে একটি স্বপ্নবীজ রোপণ করে দেন ঈশ্বর। আমরা ভালোবেসে এর নাম দিয়েছি মুক্তি, যারা শোষক, নিপীড়ক, তাদের জন্য এই বীজ, এই ভালোবাসা এক অস্বস্তিকর ঝামেলা।’
যে মুক্তি ঈশ্বর ও মানুষের পরম অভিপ্রায়, মানুষকে তা থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টা পৃথিবীতে কম হয়নি। মুক্ত মানুষকে জোর করে দাস বানানো হয়েছে এবং এর মধ্যে দেখা হয়েছে সভ্যতার অগ্রগতি!
২০১৯ এর ২৩ আগস্ট নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত হয় মেরি ইলিয়ট ও জাজমিন হোগাসের এক নিবন্ধ। শিরোনাম ছিল Brief History of Slavery You Didn't Learn in School. মেরি ও হোগাস পশ্চিমা দাসব্যবসার ইতিবৃত্তে রাখেন পাখির চোখ। দেখান, জবরদস্তি করে দাস বানানো মানুষদের জন্য কী নির্মমতা বরাদ্দ রেখেছিল পশ্চিমা ভোগবাদ, বর্ণবাদ।
ইলিয়ট ও হোগাস আমাদের নিয়ে যান ১৬১৯ সালে, সাও জোয়াও বাতিস্তা নামের জাহাজে। দাসভর্তি এই পর্তুগিজ জাহাজের আছে বিশেষ খ্যাতি। সে কালো মানুষকে আটলান্টিকের ওপারে পাঠানোর অন্যতম জলযান। কালো মানুষে পূর্ণ হয়ে স্প্যানিশ-পর্তুগিজ জাহাজগুলো এ সময়ে ক্রমাগত যেতে থাকবে আমেরিকায়। জাহাজগুলো যখন চলত, বন্দী, আহত, জখমে কাতর এবং সর্বহারা মানুষের কাতরানি শোনা যেত, আর শোনা যেত চাবুকের আঘাতের শব্দ, কর্তাদের হুঙ্কার আর হাঁকডাক, অট্টহাসি।
এ জাহাজ বিক্রির জন্য মানুষদের নিয়ে যায়। এমন মানুষ, যারা ছিলেন স্বাধীন। কঙ্গোয়, এঙ্গোলায় তাদের ছিল পরিবার, সমাজ, সাজানো নিজস্ব জীবন। ছিল বাগান, পশুপাল, চাষাবাদ প্রভৃতি। স্প্যানিশ-পর্তুগিজ নাবিকরা তাদের দেখত কাঁচামাল হিসেবে। এদের ধরতে পারলেই মালিক হওয়া যাবে। মালিক হওয়া মানে, রক্ত, গোশতসহ সব জীবনের মালিক হওয়া। অতএব জাহাজ নিয়ে তারা আসত আফ্রিকায় আর কিভাবে তাদের ধরা যায়, মারা যায়, সে কৌশলের প্রয়োগ করত নিষ্ঠুরভাবে। স্বর্ণ যেভাবে লুট করার জিনিস, এরাও তেমনি। এরা কালো, অখ্রিষ্টান; অতএব অসভ্য। যেহেতু তারা আত্মরক্ষায় অসমর্থ, অতএব চাইলেই এই অসভ্যদের ওপর মালিকানা প্রয়োগ করা যায়; কারণ ঈশ্বরের স্প্যানিশ-পর্তুগিজ সন্তানরা ইউরোপ ছাড়া বাকি বিশ্বের শাসনাধিকার পেয়েছে। রোমান ক্যাথলিক চার্চের ঘোষণায় পর্তুগাল পেয়েছে আফ্রিকায় আক্রমণ, লুটতরাজ ও চিরস্থায়ী দাসপ্রথার মাধ্যমে স্থানীয় অধিবাসীদের সংখ্যা কমিয়ে ফেলার অনুমতি। স্পেন পেয়েছে সরাসরি আফ্রিকা থেকে বন্দী মানুষদের আমেরিকায় স্পেনের উপনিবেশে পণ্য হিসেবে পরিবহন ও বেচা-বিক্রির অধিকার। কিন্তু অচিরেই ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স নিজেদের ‘অধিকার’ বুঝে নিতে চাইল। তারাও দখলদারি, দাস বানানো, লুটতরাজের এ যজ্ঞে অংশ নিলো। এর মধ্য দিয়ে নিজেদের অর্থনৈতিক ও ভ‚রাজনৈতিক অবস্থানকে শক্তিমান করতে চাইল। কেননা শিল্পবিপ্লব অবধি পশ্চিমা দুনিয়ার অর্থনীতির মূল চালিকা ছিল দাসব্যবস্থা। আফিকার দেশে দেশে স্বাধীন মানুষকে জোর করে দাস বানানোর মহাযজ্ঞ চলল বর্বরদের সভ্য বানানোর অভিযানের হাত ধরে। বেশির ভাগ পাদ্রি বিশ্বাস করেছিলেন এবং প্রচার করেছিলেন যে দাসত্ব আফ্রিকানদের খ্রিষ্টবাদে প্রভাবিত করার জন্য ঈশ্বরের তৈরি একটি প্রগতিশীল ব্যবস্থাপনা।
জোয়াও বাতিস্তা জাহাজ ‘অসভ্যদের’ এলাকায় এলো। গ্রামে হানা দিলো ‘ঈশ্বরের সন্তানরা’। খুন হলো, রক্তপাত হলো। যারা বেঁচে থাকল বা জীবন নিয়ে পালাতে চাইল, সবাই বন্দী হলো। সর্বোচ্চ মাত্রার অমানবিক অবস্থায় তাদের জাহাজে রাখা হলো। নেয়া হলো মেক্সিকোতে, বিক্রি করা হলো গরু-ছাগলের মতো। পথে অবশ্য বন্দীদের ছিনিয়ে নিতে চাইছিল ইংরেজ দুই জাহাজ। তারা এই দাসদের মালিকানা পেতে চাইছিল। আক্রমণের মুখে মানবঢাল হিসেবে পর্তুগিজরা এসব কালোর ব্যবহার করে। তাদের অর্ধেকই এতে নিহত হন।
মৃত্যু এ-জাতীয় জাহাজে জীবনের চেয়ে বেশি প্রার্থিত ছিল বন্দীদের জন্য। প্রকৃত চিত্র বোঝানোর জন্য ইলিয়ট ও হোগাস ওলাউদা ইকুইনো নামক বন্দীর আত্মকথা ধার করেন। তিনি লিখেন, ‘আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো জাহাজের পাটাতনের নিচে; যা ছিল এক নরক। দুর্গন্ধ ছিল ভয়াবহ; নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, এমনটির মুখোমুখি কখনো হইনি ইহলোকে। মলমূত্র, মানুষের রুদ্ধশ্বাস ভিড়ে রোদনই আমার সঙ্গী, তীব্র অসুখে খাবার বন্ধ হয়ে গেল। কোনো কিছু মুখে নেবারও রুচি থাকল না। আমার তখন পরমতম কামনা ছিল একটাই; যদি মৃত্যু আসত আর আমি মুক্তি পেতাম!’
সবারই ছিল এমনই বাস্তবতা। হাতে ভারী হাতকড়া, পায়ে শক্ত বেড়ি, প্রচণ্ড রোদ-বৃষ্টি, হাত-পায়ের ভারী লোহা চামড়া কেটে মাংসে ঢুকে পড়ছে, লোহার সাথে লোহার ঘষায় হাত-পা ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে, জখমে পচন ধরছে! জাহাজে কত টন ওজনের মানুষ নেয়া যাবে, তা আইন করে স্থির থাকায় শিশুদের নেয়া হতো বেশি; কারণ তাদের ওজন কম, অল্প জায়গায় অনেকজনকে রাখা যায়, তবুও ভিড় এত বেশি, নড়াচড়া করা যায় না।
বিদ্রোহ করত বন্দীরা, তাদের জন্য বরাদ্দ ছিল ছড়ির প্রহার, আগুনের ছেঁকা, লোহার এমন সূচাগ্র শলাকা, যা শরীর ভেদ করত। প্রতিটি জাহাজেই মারা যেত প্রায় ১৫ শতাংশ বন্দী। আত্মহত্যার চেষ্টা হতো খুব। জাহাজ থেকে লাফিয়ে পড়ত বন্দীরা। কিন্তু জাহাজের চারধারে জাল লাগিয়ে রাখা হতো; যাতে উঠিয়ে আনা যায় তাদের। বন্দীদের ওপর অত্যাচারের কোনো সীমা ছিল না। এসব দেখতে দেখতে আত্মধিক্কার জাগত কোনো কোনো ইউরোপিয়ানের। তারা আত্মহত্যা করত বা সুযোগ পেলে পালাত।
দাসত্ব যদিও অনেক পুরনো; খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০০ থেকে ৩০০০ সালে মেসোপটেমিয়ায় পাওয়া যায় ক্রীতদাস প্রথার নিদর্শন, কিন্তু ১৪৯২ সাল থেকে যে ট্রান্স আটলান্টিক দাসবাণিজ্য শুরু হয়, এ ছিল মানবেতিহাসের বর্বরতম এক অধ্যায়। এ বাণিজ্যের ভুক্তভোগী ছিল আফ্রিকা-এশিয়ার প্রবঞ্চিত ও মজলুম মানুষেরা। এর নির্মম শিকার হয়েছিল প্রধানত বেনিন, টোগো ও নাইজেরিয়ার পশ্চিম উপক‚ল। একে চালিয়ে নিচ্ছিল সভ্যতাগর্বী পাশ্চাত্য। ১৯৪৮ সালে দাসত্ব নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার আগ অবধি যে আফ্রিকানদের ধরে নিয়ে দাস বানানো হয়, তাদের সংখ্যা প্রায় দুই কোটি। যাদের তিন ভাগের এক ভাগ সাগরপথে মারা যায় রোগে, ক্ষুধায়, অত্যাচারে, নৌযুদ্ধে ব্যবহৃত হয়ে কিংবা কঠিন খাটুনিতে। যাদের আনা হতো আমেরিকায়, তাদের সাধারণত সিজনিং ক্যাম্পগুলোতে রাখা হতো।
সেখানে ইতরতম এক বাস্তবতা তাদের জন্য তৈরি ছিল। না মানুষের জীবন, না মনুষ্য খাবার বা চিকিৎসা। লাখ লাখ মানুষ মারা যেত ডায়রিয়া, আমাশয়, প্লেগ প্রভৃতিতে। কেউ কেউ চরম অপমান ও গ্লানি থেকে বাঁচতে করত আত্মহত্যা। সবচেয়ে নিম্নতম, দুঃসহ ও জটিল কাজগুলো তাদের জন্য ছিল বরাদ্দ। তাদের জীবন ছিল মালিকের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। অরণ্যময় ব্রাজিলকে উপনিবেশ বানিয়েছিল ইউরোপীয়রা। সেখানে ধরে এনেছিল প্রায় ৮০ লাখের মতো দাস।
এসব হতভাগা কালো রঙের মানুষ। বংশপরম্পরায় তাদের বানানো হয় ক্রীতদাস। তুলার কলে, আখের কলে, ঘানি টানায়, জলে-স্থলে শিকার করায়, কৃষির ক্ষেতে উদয়াস্ত পরিশ্রমের কোনো বিরতি ছিল না। বিভিন্ন খনি ও সংঘর্ষে তারা ছিল মৃত্যুর প্রথম খাবার। থাকতে হতো গরু-ছাগলের সাথে, বাতানে কিংবা উঠোনে, মেজেতে। তাদের জীবন ছিল শ্রমের জন্য, মালিকের সব ইচ্ছা পূরণের জন্য। তাদের দিয়ে অপরাধ করানো হতো, যার জন্য আবার শাস্তি পেতে হতো তাদেরই। পাশবিক ব্যবস্থার মধ্যে অমানবিক কাজ এবং দানবীয় সব যন্ত্রপাতির মধ্যে তাদের জীবন আটকা পড়ত। এ শ্রমের যেহেতু পারিশ্রমিক ছিল না, ফলে উৎপাদিত পণ্যের উদ্বৃত্ত মূল্য ইউরোপে অভিজাত শ্রেণীকে দেয় বিশেষ বিকাশ। তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান এমন এক উচ্চতা পায়, যেখান থেকে সে নিজেকে প্রভু ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারে না। যারা তার মতো নয়, যারা কালো, গরিব কিংবা তাদের বিচারে অপর, তাদের দাস হিসেবে দেখা এবং তাদের সাথে দাসের মতো আচরণের ন্যায্যতা তারা অনুসন্ধান করছিল; যা ঔপনিবেশিকতায়, সাম্রাজ্যবাদে প্রতিফলিত। যাকে নানা প্রচেষ্টায় এমনকি বিশ্বপ্লাবী বিশ্বায়নের বিজ্ঞাপন দিয়েও আড়াল করা যাচ্ছে না।
দাসব্যবস্থার মাধ্যমে আরো শক্তিশালী হয় বর্ণবাদী মন ও ব্যবস্থা। নিশ্চিত হয় পশ্চিমা সমাজের নতুন প্রকৃতির শ্রেণীবিন্যাস। এ নিশ্চিত করে ব্যক্তি, শাসকগোষ্ঠী ও চার্চের রাজনৈতিক শক্তি, সামাজিক সম্মান ও অঢেল সম্পদ। বিরাট, বিপুল এক অভিজাত শ্রেণী গড়ে ওঠে পশ্চিমা দুনিয়ায়, যাদের অর্থনৈতিক সম্পন্নতা দাঁড়িয়েছিল দাসদের ওপর। আর তাদের নানা মাত্রিক সম্পন্নতার ওপর দাঁড়িয়েছিল পশ্চিমা জাতিরাষ্ট্রগুলোর ভবিষ্যৎ!
দাসব্যবস্থা এখন নিষিদ্ধ ঘোষিত। কিন্তু পুঁজিবাদ কি দাসত্বকে জারি রাখেনি? এখনো চলমান জোরপূর্বক শ্রম চাপানো, কম বেতনে, বিনা বেতনে বা মানুষকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করার দাসপ্রথা। এটি যে দাসত্ব, তা নিশ্চিত করেছে পশ্চিমা দুনিয়ায় ‘ওয়াক ফ্রি ফাউন্ডেশন’ বা মুক্ত হয়ে চলার প্রতিষ্ঠানের আন্দোলন। এ আন্দোলন দেখাচ্ছে, দাসপ্রথা এখনো গভীরভাবে কাজ করছে। এ আন্দোলন আধুনিক দাসত্বকে দু’টি দিক থেকে দেখছে। এক. সরাসরি দাসত্ব, দুই. দাসত্বরূপ কর্মকাণ্ড। দ্বিতীয়টিতে আছে ঋণে জর্জরিত করে শ্রম আদায়, জোরপূর্বক বিয়ে, নাবালকদের কেনাবেচা, মানবপাচার (শিশু-নারীসহ) ও জোরপূর্বক শ্রম আদায়। নাবালক বিয়েকেও দাসত্বরূপ প্রবণতায় শামিল করেছে ওয়াক ফ্রি। কিন্তু দাসত্ব টিকিয়ে রাখার যেসব মৌলিক উপাদান, সেগুলোকে প্রশ্ন করেনি সেভাবে। ভোগবাদ, পুঁজিবাদের বিপরীতে তার সুনির্দিষ্ট কোনো প্রস্তাবনা নেই।
গ্লোবাল স্লেভ ইনডেক্সের জরিপ জানায়, সারা বিশ্বে আধুনিক দাসত্বের শিকার চার কোটির বেশি মানুষ। আর বিশ্বের অন্যতম উন্নত দেশ যুক্তরাষ্ট্রের এই সংখ্যা চার লাখের বেশি। মহাদেশ হিসেবে এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি মানুষ আধুনিক দাসত্বের কবলে রয়েছেন। সবচেয়ে বেশি উত্তর কোরিয়ায়। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারতে সবচেয়ে বেশি মানুষ এই দাসপ্রথার শিকার।
১৬৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৯২ নম্বরে। এখানে প্রায় পাঁচ লাখ ৯২ হাজার মানুষ আধুনিক দাসত্বের কবলে রয়েছেন। এশিয়া মহাদেশে আধুনিক দাসপ্রথা সবচেয়ে বেশি। উত্তর কোরিয়ায় সর্বোচ্চ। দেশটির ২৬ লাখ জনসংখ্যার প্রতি ১০ জনের একজন এই দাসত্বের শিকার।
রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেয়া শ্রমের পাশাপাশি যৌননিগ্রহ ইত্যাদি এ দাসত্বের কেন্দ্রে রয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেয়া শ্রমের এক বাস্তবতা উন্নত বিশ্বে, আরেক বাস্তবতা গরিবদের দুনিয়ায়। তার ধরন এমন, আপনি চাইলেও বেরিয়ে আসতে পারছেন না। একে দাসত্ব জানছেন, কিন্তু মনে করছেন ভালো।
চলমান বিশ্ব অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুতর প্রসঙ্গ হচ্ছে লাভজাত। শিল্প বা ব্যবসায় যে শ্রমের প্রয়োজন হয়, তার মূল্য না দিয়ে বা কম দিয়ে মালিক বেশি লাভ করতে পারেন। এই লাভের জন্য গ্রিক-রোমান সভ্যতা বা মেসোপটেমিয়া সভ্যতায় ভিন্ন বর্ণের ও জাতির নর-নারীকে বলপূর্বক খাটানোর অন্যায় জারি ছিল। চুক্তিভিত্তিক শ্রমব্যবস্থার আশ্রয়ে বিনা বেতনে বা কোনোমতে আহার জোগানোর মতো অর্থের বিনিময়ে শ্রম আদায়ের চেষ্টা এখন করেন পুঁজিপতিরা। এক রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের কাছে কিংবা বহুজাতিক কোম্পানির কাছে শ্রম বিক্রি করে। চুক্তি করে। শ্রমিকরা এখানে গরহাজির। যেন তারা কাঁচামাল। কেউ বিক্রি করবে, কেউ কিনবে।
পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো সাধারণত নিজ দেশে শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতনের আইন রাখে। এমনকি ইমিগ্রেন্ট হলেও তা দিতে হয়। কিন্তু এ বেতন দিলে লাভ কমে যায়। অতএব পুঁজিকে তারা পাঠিয়ে দেয় অনুন্নত দেশে, যেখানে কম মূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে শ্রম পাওয়া যাবে। লাভ পকেটে যাবে বেশি। গরিব জনগোষ্ঠীর জন্য একে মনে করা হয় আশীর্বাদ। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে শ্রমিকের ভাগ্য সাবেক দাসদের অনুরূপ এক চক্রে আটকা পড়ে। পুঁজিপতি বেতন কম দিয়ে লাভ বাড়ান, নিজের সমৃদ্ধি নিশ্চিত করেন। শ্রমিক জীবন ধারণের যে মরিয়া লড়াইয়ে ছিল, সর্বোচ্চ শ্রম দিয়েও সেখানেই থাকে। জুলুম তার শ্রমশক্তি শুষে নেয়। বাঁচতে দেয়, উঠে দাঁড়াতে দেয় না। এই শ্রম তার উঠে দাঁড়ানোকে নিশ্চিত করত, যদি তা ন্যায্যমূল্য, অবস্থান ও সম্মান লাভ করত।
পশ্চিমা সভ্যতা দাসত্বরূপ সিলসিলা জারি না রাখাকে অসম্ভব করে তোলে। কারণ মানবমূল্য ও ইনসাফ যে অবধি জীবনদৃষ্টিকে ভিত্তি না দেবে, সে অবধি নিজেকে ও নিজেদের প্রভু এবং অন্যকে দাস ভাবা ও সে হিসেবে ব্যবহার করা কোশেশ থামবে না। পশ্চিম এখন দাসত্বের গরম ও বর্বর ধরনে হাজির থাকে না, কিন্তু নরম ও পরিশীলিত ধরনে বিশ্বময় ক্রিয়াশীল। প্রক্রিয়াটি যেন সভ্য, ইতর নয় যা গরিবদের দুনিয়াকে গাদাগাদিময় সাও জোয়াও বাতিস্তা জাহাজ বানিয়েই রাখে। লাথি দিয়ে নয়, আদরে-আবদারে তাদের ফেলে রাখে পাটাতনের নিচে, দুর্গন্ধময় অসহনীয়তায়। কিন্তু তুলে রাখে আপন ব্যবস্থার জাহাজে, যেন সে মুক্ত হতে না পারে! কারণ পুঁজিবাদের চোখে মানবমুক্তি এক অসহনীয় ব্যাপার।
লেখক : কবি, গবেষক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা