২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

সোনালি সেই দিনগুলো কোথায় হারালো

-

উত্তেজনাহীন, শান্ত সুস্থ আলোচনা অন্যের মতের প্রতি সহনশীল সংলাপ সব সময়ই ইতিবাচক আবহ সৃষ্টি করে। সমাজের যেকোনো সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে মহৎ উদ্দেশ্য হয়ে যদি কোনো সংলাপ হয়; তাতে মতপার্থক্য কমবে এবং ইতিবাচক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার তা হবে একটি উত্তম প্রয়াস। বহু ক্ষেত্রে ব্যক্তি ও সমাজজীবনে পুষে রাখা ক্ষোভ, ভুলের ওপর অটল থাকার মতো একগুঁয়েমি পরিহার করে খোলা মন নিয়ে সংলাপ করা হলে বহু সঙ্কটের অবসান ঘটা সম্ভব।

বিদ্যমান বাস্তবতায় সমাজে এ মুহূর্তে একটি প্রশ্ন তৈরি হয়েছে যে, দেশে এখন কিসের সঙ্কট বিদ্যমান, তথা কী আমাদের নেই এবং কী আছে। এ নিয়ে যদি কোনো আলোচনার সূত্রপাত করা হয়, তবে বিভিন্ন মানসিকতা, মত ও পথের ব্যক্তিরা উৎসাহের সাথে সে সংলাপে অংশ নিতে চাইবে।

তবে এ ক্ষেত্রে সমাজের রাজনৈতিক মনস্ক ব্যক্তিরা অবশ্যই সবার আগে এমন সংলাপকে লুফে নেবেন। জাতি হিসেবে আমরা কথা বলতে ভালোবাসি এবং কাউকে কাউকে বাচাল বলেও চিহ্নিত করা হয়। রাজনীতি নিয়ে আমাদের উৎসাহের তো কোনো ঘাটতি নেই। এর প্রমাণ দেশে নাম ও সাইনবোর্ডসর্বস্ব রাজনৈতিক দলের সংখ্যা বেশুমার। আর আমাদের প্রিয় সাবজেক্ট রাজনীতি। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও বাংলাদেশীরা রাজনীতিতে মশগুল তো থাকেই, দলবাজি করে হুজ্জুত হাঙ্গামা পর্যন্ত বাধায়।

বেশুমার রাজনৈতিক দল গঠনের কারণ কোনো আদর্শিক চেতনা নয়, সমাজে কেউকেটা হিসেবে গণ্য হওয়াটাই মুখ্য উদ্দেশ্য।
যাই হোক, আমরা সংলাপ প্রসঙ্গে ফিরে যাই। যেকোনো আলোচনায়ই একাধিক পক্ষ সৃষ্টি হয় মত ও দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। রাজনীতিমনস্ক ব্যক্তিরা আলোচনায় অংশ নিয়ে বলতে শুরু করবেন, দেশে এখন রাজনীতির সুস্থ পরিবেশ নেই, গণতন্ত্র লোপাট হয়ে গেছে, গণতন্ত্রের প্রকৃত চেতনা তথা গণতন্ত্রের অন্তর আত্মা যে নির্বাচনী ব্যবস্থা তার অস্তিত্ব বিলুপ্ত করে দেয়া হয়েছে। গণতন্ত্রের শুদ্ধ প্রক্রিয়া তথা গণমানুষের ভোটদানের যে মৌলিক অধিকার, সেটি গুটিকতক দলান্ধ রাজনৈতিক মাস্তান প্রশাসনের সহায়তায় ছিনতাই করে নিয়েছে। এই ভ‚খণ্ডের মানুষ যে রাষ্ট্রের ‘মালিক’ এই সাংবিধানিক চেতনা ধুয়ে মুছে ফেলা হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার যে মূল নীতি যা শাসনতন্ত্রে সংযোজিত রয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র’ এহেন পবিত্র মূল্যবোধ এখন অর্থহীন আর বিবর্ণ। মৌলিক মানবাধিকার ধুলায় মিশিয়ে দেয়া হয়েছে, রাষ্ট্রের স্থপতির যত স্বপ্নসাধ, তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের কোনো আন্তরিক প্রয়াস নেই, গোটা সংবিধান এখন শিঁকায় তুলে রাখা হয়েছে। দেশের সম্পদ লুটে নেয়া হচ্ছে।

অপরপক্ষ পাল্টা যত যুক্তিতর্ক তুলে প্রতিপক্ষের বক্তব্যকে খণ্ডন করতে নানা তথ্য-উপাত্ত ও উদাহরণ টেনে ‘যুতসই’ উত্তর দেয়ার চেষ্টা তো করবেই। তারা নিশ্চয়ই বলবে, এ দেশের প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের সংগঠনের পূর্বসূরিরা প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন; তাদের দেশের প্রতি ভালোবাসা আর প্রতিশ্রুতি প্রশ্নাতীত। আমাদের সরকার সব প্রতিবন্ধকতা, প্রতিক‚লতা সরিয়ে দেশকে উন্নয়নের পথে নিয়ে চলেছে। কোভিড নিয়ন্ত্রণে উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখিয়েছে। বিশ্বে দেশের ভাবমর্যাদা উজ্জ্বলতর করা হয়েছে। উভয়পক্ষের বক্তব্যে সারবর্তা নেই, তা অস্বীকার করা যাবে না। এমন সংলাপে মতপার্থক্য থাকলে দু’পক্ষই ধৈর্যধারণ ও সহনশীলতা রক্ষা করতে পারবেন কি না, জানি না। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, রাজনীতির ময়দানে সংগঠনের নেতারা পরস্পরের প্রতি যে জ্বালা ধরানো আক্রমণাত্মক ভাব-ভাষা প্রয়োগ করে থাকেন, তাতে না থাকে গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতা শালীনতা, না থাকে ভব্যতার লেশ। এসব বক্তব্যে বেশির ভাগ সময়ই হয়ে থাকে প্রতিহিংসামূলক ও সত্য-অসত্যের মিশ্রণ। এ জন্য দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সব সময় উত্তাপ-উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। তা মূলত তাদের অগণতান্ত্রিক বক্তব্যে আচার-আচরণের কারণেই। এর পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিতে এমন পরিবেশ সৃষ্টি হয় যেখানে রাজনীতিকদের মধ্যে সাধারণ সৌজন্য বিনিময় এমনকি তাদের পক্ষে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানেও মিলিত হওয়া আদৌ সম্ভব হয় না। অথচ অতীতে এমন ছিল না। নিজেদের মত ও বিশ্বাসে অকৃত্রিম নিষ্ঠা থাকা সত্ত্বেও অপরপক্ষের আদর্শের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখাতেন না।

রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিস্টদের বাইরে যারা গুণীজন, প্রজ্ঞা আর ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন মানুষ, তারা কোনো রাজনৈতিক ডামাডোলে গা ভাসিয়ে চলেন না। স্বাধীন নির্মোহভাবে কোনো বিষয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে পরিমিত কথা বলেন। তাদের সব বক্তব্য মাঠেঘাটে বাজিমাৎ করার মতো হয় না। তাদের বক্তব্যের মূল্যায়ন সবাই করবে। এমন আশাও তারা পোষণ করেন না। তাদের সংক্ষিপ্ত কথা দেশ গত ৫০ বছরে যতটুকু পেয়েছে। তা নিয়ে প্রীত হওয়া, তৃপ্তি বোধ করাও সুবিবেচনাপ্রসূত নয়। বরং গত ৫০ বছরে আমরা অনেক কিছু হারিয়েছি বা ধরে রাখতে পারিনি, তা হলো মূল্যবোধ, সুনীতি, নৈতিকতা, সৌজন্য, মমত্ব, নারীসমাজের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, স্নেহ, সম্মান। হৃদয়ের যত শান্তি, তৃপ্তি, ঐতিহ্য, অল্পে তুষ্ট থাকার মানসিকতা, আইনকানুনের প্রতি সমীহ, প্রবীণদের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার হিসেবে বিবেচনা করে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা সমীহ প্রদর্শন ইত্যাদি। এ ছাড়াও আরো অনেক মানবিক গুণ আমরা খুইয়ে ফেলেছি। বোদ্ধাদের এমন বিবেচনা প্রকৃতপক্ষে আমাদের সমাজে এ মুহূর্তের প্রকৃত প্রতিচ্ছবি।

উপরে রাজনীতিমনস্ক ব্যক্তিদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য থেকে দেশের অনেক সমস্যা আর সম্ভাবনার বিষয় চিহ্নিত করা হয়েছে। তাকে ধর্তব্যে নিয়ে আসা এবং সেগুলোর প্রতিবিধানের চেষ্টার আশা করা আসলে সুদূরপরাহত। কিন্তু এসব ক্রনিক ডিজিজ থেকে মুক্তির কোনো বিকল্প নেই। তা না হলে জাতিকে বিকলাঙ্গ হয়ে থাকতে হবে; যার দুঃখ-গ্লানি অপরিসীম। যদি কিছু করা না হয়, তবে মানুষের ও দেশের প্রতি যে প্রীতি ও মমতার কথা ওপর থেকে বলা হয়; তাকে তো মেকি বলে ভাবতে চাই না।

বোদ্ধাদের মূল্যবান অভিজ্ঞতাসঞ্জাত বক্তব্য আর অনুভূতি, মূল্যবান উপলব্ধিগুলো বোঝার চেষ্টা হবে বা যা কিছু হারানোর কথা বলা হয়েছে, তা নিয়ে কোথাও আন্তরিকভাবে আত্মবিশ্লেষণ হবে- সে আশা নেই। অতীতে জীবনে স্বস্তি সমাহিত ভাব অনুরণিত হতো। আজকে সেখানে বিদেশীদের হই-হুল্লোড়কে সঙ্গীত বলে নতুন প্রজন্ম তাতে মত্ত হয়ে থাকে। আমাদের চিরায়ত গান, মরমি সঙ্গীত শুদ্ধ সংস্কৃতি এখন হুমকির মুখে পড়েছে। অতীতে আইনের সীমালঙ্ঘনকারীদের সংখ্যা খুঁজতে দূরবীক্ষণ যন্ত্র লাগত। এখন তো সীমালঙ্ঘনকারীরা সমাজে মিছিল করে বেড়ায়।

উপরে পশ্চিমের সঙ্গীত নিয়ে বাধ্য হয়ে মন্দ শব্দ উচ্চারণ করেছি বটে। তবে পশ্চিমে এখনো অনেক কিছু আছে, যা আমাদের নেই। সেসব দেশে আইন ঐতিহ্যের প্রতি এখনো শ্রদ্ধা অটুট রয়েছে। মানুষ ও সমাজের প্রতি কোনো বৈরী মনোভাব নেই। পশ্চিমে নিজেদের স্বার্থের কথা বিবেচনা প্রথমেই থাকে। তবে তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনা গবেষণার ফল আর যত উদ্ভাবন তা অন্যদের সাথে শেয়ার করে।

উপরে রাজনীতিমনস্ক ব্যক্তিদের সার নির্যাস নিয়ে কর্তৃপক্ষ বিবেচনায় নেবে কি না, সে সম্পর্কে কিঞ্চিৎ বলেছি। তবে তৃতীয় পক্ষের কথা তথা বোদ্ধা সমাজের কথাগুলোকে নিছক অতীতের কচকচানি বলেই ধরে নেবে। এ কথা হয়তো একবারও ভাববে না, সত্যিই তো আমরা যা হারিয়েছি তা পুনরুদ্ধার করা যায় কি না।

যারা যখন ক্ষমতায় থাকেন, তারা যদি এমনটি ভাবেন যে, রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে কেবল তারাই যোগ্য, তাদের কোনো বিকল্প নেই। এমন অহংবোধ অবশ্যই দলতন্ত্রের জন্ম দেয়; বরং ক্ষমতাসীনদের উচিত দেশের যে নীতি আদর্শ ও দিকনির্দেশনাগুলো সংবিধানে বর্ণিত রয়েছে; তাকে পুরোপুরি অনুসরণের মানসিকতায় উজ্জীবিত হওয়া। দেশের সর্বোচ্চ আইন গ্রন্থকে একমাত্র বিচার্য বিষয় হিসেবে মেনে নিতে হবে। দেশের মানুষকেই সব মৌলিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়ার অধিকারী হিসেবে জনগণকে গণ্য করা না হলে এই মানসিকতা যদি পোষণ করা হয়, ‘বিচার মানি তবে তালগাছটা আমার’ তবে কিছুরই সুরাহা হবে না, দেশ ভুগতেই থাকবে।

কল্যাণধর্মী রাজনীতি দেশের জন্য অনেক কিছু। তবে সেই সাথে ধর্ম-দর্শন, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, ইতিহাস-ঐতিহ্যসহ আরো অনেক কিছু আছে। এসব বিষয়কে আর দূরে সরিয়ে রাখা ঠিক হবে না। জীবনের পূর্ণাঙ্গতার জন্য এসব আবশ্যকীয় উপাদান হিসেবে গণ্য করতে হবে।

কৈশোরে অনেকের মতোই স্কুলে আমাদের পাঠ্যক্রমে একটি কৃশকায় পুস্তক অন্তর্ভুক্ত ছিল। যতদূর মনে পড়ে, ইংরেজি ভাষায় লিখিত সেই পুস্তকটির নাম ছিল ‘মরাল এথিক্স’ সেখানে নীতি-নৈতিকতার যে দীক্ষা বাণীবদ্ধ ছিল, অনেকের মতো আজো তা মনমানস থেকে হারিয়ে যায়নি। আজকে সমাজের দৈন্য ও করুণ পরিণতি দেখে সেই ক্ষুদ্র পুস্তকের বাণীগুলো আর যেন নীরব থাকতে চাইছে না। তা সরব হয়ে সমুদ্রের বিশাল তরঙ্গের মতো গর্জন করে সমাজে আছড়ে পড়ে সুনামির মতো কলঙ্ক কালিমাকে ভাসিয়ে নিতে চায়। পুস্তকটির বাণীতে ছিল শুদ্ধতার সার্বজনীন আবেদন। স্বভাবমন মগজকে সেই আবেদনে মথিত করে কঠিন শীলার মতো দৃঢ় করে তুলতে চাইত সেই পুস্তকের বাণীগুলো।

আমাদের ধর্মানুভূতি তথা ইসলামের শিক্ষা যা সর্বকালের সৎচিন্তা, সদাচরণের আধার। অপরাধ অপকর্ম থেকে দূরে থাকার যাবতীয় বিষয় তাতে সংযুক্ত রয়েছে। এই বোধ যেন পরশপাথরের মতো। যে এর ছোঁয়া পেয়েছে যথাযথভাবে, এর অন্তর্নিহিত মর্ম উপলব্ধি করেছে, সে এক অনন্য অনুসরণীয় চরিত্রের অধিকারী হয়ে উঠেছে। যদি এই চেতনায় দেশের বিপুল শক্তিকে উদ্বুদ্ধ করে তোলা যেত; তবে যে জনশক্তি এখন বিশৃঙ্খল জনতায় পরিণত হয়ে আছে, তারাই বিপুল সম্ভাবনা সৃষ্টিকারী সৎ মানুষ আর জনসম্পদে পরিণত হতে পারত। দুঃখ এ দেশের ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ মুসলিম। সেই ধর্মের দীক্ষা অনুশীলন খুব স্বল্পসংখ্যক মানুষের মধ্যে দেখা যায়। এসবই আমাদের যত জিল্লতির কারণ। এসব মানুষকে ইসলামের আলোয় আলোকিত করার প্রচেষ্টা তো নেই।

যাই হোক সমাজ-রাষ্ট্রের নেতৃত্বে যারা অধিষ্ঠিত, তাদের রাজনীতির ক্যারিয়ার অনেক দিনের। তাদের সবারই রাজনীতির সাথে যুক্ত হওয়ার উদ্দেশ্য শুধু মানুষের কল্যাণ করার চিন্তা থেকে নয়। তাদের কিছুসংখ্যকের অভিলাষ হচ্ছে ক্ষমতার উষ্ণতা ওম পাওয়া। দেশের মানুষের নয়, স্বীয় স্বার্থ উদ্ধারের জন্য রাজনীতিকে হাতিয়ার করা। সব সময়ই ক্ষমতাসীনদের মধ্যে কেউ কেউ এতটা উদাসীনতায় ভোগেন যে, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর যে মহৎ চেতনা সেটি বিবেচনায় থাকে না। তা ছাড়া তাদের অধীনস্থ কর্মকর্তাদেরও এমন বিষয়গুলো তদারকিও করেন না। দেশের সংবিধানের ২১(২) অনুচ্ছেদে সন্নিবেশিত রয়েছে- ‘সকল সময় জনগণকে সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।’ অথচ একশ্রেণীর সরকারি কর্মচারীদের এমন কর্তব্য পালনের ব্যাপারে অবহেলার কোনো শেষ নেই।

দেশের এক বিপুলসংখ্যক মানুষ চরম বৈষম্যের শিকার, সংবিধান তা যত দ্রুত সম্ভব দূর করা চেষ্টার কথা বলেছে। কিন্তু সে উদ্যোগের গতি কচ্ছপের গতিরই মতো।

আজকের বাস্তবতার নিরীক্ষে সমাজ-রাষ্ট্র পরিশুদ্ধ করার নৈতিক ভিত্তিটা এমন হতে হবে; যা অকুতোভয়ে সৎ ও অসৎ মানুষের মধ্যে সীমা রেখে টানা সম্ভব নয়। ভালো-মন্দের ধারণা স্পষ্ট করার শিক্ষা দেয়ার ব্যাপারে আর দেরি করা ঠিক নয়। মানুষের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা অস্বীকার করা যাবে না। তাই ধর্মীয় বোধ বিবেচনার সহায়তা নিতে হবে। ইসলামের যে নীতি-নৈতিকতার শিক্ষা তা মানুষের সেট করা পলিসি নয়। ঐশী গ্রন্থ আল কুরআনে স্রষ্টা নীতি-নৈতিকতার স্থায়ী ও মৌল বিষয়গুলো সন্নিবেশিত করে দিয়েছেন।

মানুষকে হিতোপদেশ দেয়ার দায়িত্ব কেবল কোনো শ্রেণিবিশেষের ওপর এমন নয়। সমাজের অগ্রসর বিজ্ঞ আলোকিত মানুষ যাদের চিন্তাভাবনায় সারাক্ষণ দোল খায় মানবিকতা, সততা, আদর্শ; যা তারা নিজেদের জীবনাচরণে প্রতিফলিত হয়। তাদেরই সমাজকে পরিশুদ্ধ করার ক্ষেত্রে নিজ অবস্থান থেকে অবদান রাখা নৈতিকতার দাবি। যেহেতু ইসলাম পৃথিবীর সব মানুষকে সৎ পথ দেখানোর দায়িত্ব নিয়ে এসেছে এবং মানুষকে উৎকৃষ্ট জীবনযাপন করার দীক্ষা দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ। ইসলামের জ্ঞান অভিজ্ঞান আর ব্যুৎপত্তির অধিকারীদের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই দায়িত্ব জাগ্রত থাকা বাঞ্ছনীয়। ইসলামের কালজয়ী শিক্ষা সৌন্দর্য, মানবতাবোধ, ন্যায়পরায়ণতা। সবার মধ্যে সঞ্চারিত করা গুণীজনদের অবশ্য কর্তব্য।

যাদের মধ্যে ইসলামের এমন আলো প্রজ্বলিত রয়েছে; তা দিয়ে আরো অনেককে আলোকিত করার অদম্য স্পৃহা থাকতে হবে। পবিত্র কুরআন জ্ঞানময় প্রঙ্গাময় সে বিবেচনা এর আলোচনা উপস্থাপনায় সে কথা মনে রাখতে হবে। আজকাল অনলাইনে ইসলাম নিয়ে আলোচনা শুনতে পাই। তবে তা যেন বুদ্ধিদীপ্ত মানুষের খোরাক হয় এবং ইসলামের খণ্ডিত বিষয় নিয়ে কোনো আলোচক বক্তব্য যেন না হয়। সে যাক, এমন স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে আর কিছু বলা আমাদের মতো মানুষের সাজে না।

আজকের বিশ্বের হাই প্রোফাইলের মুসলিম স্কলারগণ বিশ্বব্যাপী ইসলামের মূল এসেন্স মহত্ত¡ তথা এর কালোত্তীর্ণ আদর্শ প্রচার করছেন এবং ইসলাম নিয়ে কিছু অজ্ঞান অর্বাচীন ব্যক্তি যে ভ্রান্ত প্রচার করছে; তার যথাযোগ্য যুক্তিসমৃদ্ধ প্রতি উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের দেশেও বেশ কিছু স্কলার জ্ঞানসমৃদ্ধ নানা নিবন্ধ পত্রিকায় প্রকাশ করে ইসলাম সম্পর্কে দেশের মানুষকে সমৃদ্ধ করছেন, তাদের জানার পরিধি বিস্তৃত করছেন।
ভিন্ন ধর্মের মুক্তমনের বহু বিজ্ঞজন ইসলাম নিয়েও চিন্তাভাবনা করেন। তারা এর মর্ম, সৌন্দর্য মানব কল্যাণে তার লক্ষ্য সম্পর্কে অবহিত। এমন ভিন্নধর্মী বিজ্ঞজনদের মধ্যে একজন ভারতের নবম রাষ্ট্রপতি ড. শঙ্কর দয়াল শর্মা। গভীর জ্ঞানের অধিকারী ড. শর্মা পবিত্র কুরআন নিয়ে একটি কবিতা লিখেছিলেন। সে সম্পর্কে অনেকেই হয়তো অবহিত। এ কবিতাটি ভারতে বহু মানুষকে বিস্মিত করেছিল। হিন্দি ভাষায় লিখিত কবিতাটি শিরোনাম ‘আল কুরআন’ কবিতাটি এখানে উদ্ধৃত করছি : ‘যা ছিল কর্মসঞ্চালনের গ্রন্থ, হয়ে গেল প্রার্থনা পুস্তক, যা ছিল অধ্যয়নের জন্য, রয়ে গেল আবৃত্তির জন্য। জীবন্তদের বিধান ছিল, হয়ে গেল মৃতদের ছাড়পত্র, জ্ঞান-বিজ্ঞানের শাস্ত্র ছিল, পড়ে গেল মূর্খদের হাতে। সৃষ্টিকে বশ করার আহ্বান ছিল, থেমে গেল মাদরাসার পাঠ্যক্রমে, প্রাণহীনকে চেয়েছিল প্রাণবন্ত করতে, লেগে গেল বিদেহীদের পরিত্রাণকল্পে, ওহে মুসলমান, এ কী তুমি করলে? চোখ মেল, আর ভেবে দেখ।’

ভারতের এই নবম রাষ্ট্রপতি প্রায় পাঁচ দশক আগে এই কবিতাটি লিখেছেন। ইন্টারনেট থেকে এই কবিতাটি বের করা হয়েছে। আকিদা বিশ্বাসের দিক হয়তো কারো কারো মনে কিছু খটকা লাগতে পারে কবিতাটি নিয়ে। ভিন্নধর্মী কবির কাছ থেকে সব কিছু আশা করাও বোধহয় ঠিক নয়।

বাংলাদেশে যেসব ক্ষেত্রে সঙ্কট রয়েছে, সে সম্পর্কে ওপরে সামান্য কিছু বলা হয়েছে। রাজনীতিমনস্ক ব্যক্তিদের বাইরে সমাজ নিয়ে যারা ভাবেন, তারা দেশের নীতি-নৈতিকতার অবক্ষয়কেই বহু সমস্যার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তারা অবশ্য সব খুলে বলেননি। যাই হোক এটি ঠিক আজকে সমাজে যে অবক্ষয়, তা আমাদের দূষিত করছে; যা কিনা সমাজকে বহু বিচিত্র সঙ্কটের মুখোমুখি করছে যার প্রভাব রাষ্ট্রের ওপর পড়তে বাধ্য। এখন তো নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়ে, যুবক-যুবতীর মধ্যে নৈতিকতার মারাত্মক অধোগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের যৌন হয়রানি করা হচ্ছে। তা ছাড়া যুবকদের মধ্যে মাদকাসক্তি বেড়ে চলেছে। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, এমন পদস্খলনের কারণ কী? সমাজবিজ্ঞানীদের অভিমত, এর পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, পারিবারিক শিক্ষার অভাব। যেখানে মূল্যবোধের চর্চার প্রথম পাঠ হয়। কোনটা ন্যায়, কোনটা অন্যায় এসব দীক্ষার সূতিকাগার হচ্ছে পরিবার। কিন্তু সত্য কথা বলতে কি, এ ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান দুর্বল। তা ছাড়া অভিভাবকরাও এ নিয়ে খুব একটা চিন্তাভাবনা করেন বলে মনে হয় না। অভিভাবকরা নিজের পেশা আর আনুষঙ্গিক বিষয় নিয়ে এতটা ব্যস্ত, সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের অনেক উদাসীন রয়েছে। এ কথা বলা হয়তো বেশি বলা হবে না। কিছু কিছু অভিভাবকের নিজের জীবনেও নীতি-নৈতিকতার প্রতিফলন নেই।

সমাজে খারাপ জিনিসটা যদি গা সহা হয়ে যায় এবং বিনা বাধায় হামেশাই চলতে থাকে, যেমন মাদকের ব্যবহার। এমন নেশাজাতীয় দ্রব্যের ব্যবহার ভয়াবহ মাত্রায় বেড়ে গেছে। নিত্যনতুন সব মাদক আসছে, একটার চেয়ে অপরটা আরো মারাত্মক। কখনো যদি সমাজ-রাষ্ট্রের উচ্চাসনে নতুন প্রজন্মের এসব এডিকটেডরা বসে যায়; সে ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ ছেলের হাতের মোয়ার মতো হয়ে পড়বে।

সমাজের আর এক ভয়াবহ সমস্যা হচ্ছে নারীর প্রতি যৌন হয়রানি। মেয়েশিশু, কিশোরী, যুবতী, গৃহবধূ এমনকি বিধবা নারীরা পর্যন্ত যৌন উন্মাদের কাছ থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। যৌন নির্যাতিতাদের খুন পর্যন্ত করা হচ্ছে। এদের শাস্তি দেয়ার জন্য কঠোর আইন, পুলিশি তৎপরতা সত্তে¡ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এসব কুকর্মের জন্য তরুণদের উসকে দিচ্ছে ইন্টারনেটের যত অশ্লীল ভিডিও।

লেখা শেষ করতে চাচ্ছি অতীতের কিছু কথা বলে। সে অতীত, সুদূর অতীত নয়। বড়জোর দুই যুগ হবে। তবে আজকের প্রজন্মের কাছে হয়তো তা কল্পকাহিনী মনে হতে পারে। এখন যা নেই, সে দিন তা ছিল। যেমন সদাচরণ-শিষ্টাচার, গুরুজনদের শ্রদ্ধা-সম্মান দেখানো। তাদের অভিজ্ঞতা থেকে নিজেদের সমৃদ্ধ করা। এসব ছিল সমাজের সাধারণ নীতি। তখন ছিল না মাদকসেবীদের মাতলামি; নারী নির্যাতন, বরং ছিল নারীর প্রতি সম্মান করার রেওয়াজ। তখন কর্তৃপক্ষের আজকের মতো পরিবেশ পরিস্থিতি নিয়ে মাথাব্যথার কোনো কারণ ছিল না। তবে আজকের মতো জীবনে তেমন স্বাচ্ছন্দ্য ছিল না বটে, তবে শান্তি-স্বস্তি ছিল।

যাই হোক, অতীতের দিনগুলো হারিয়ে গেছে। আজ প্রবীণরা কেবল অতীতের সুখস্মৃতিগুলো রোমন্থন করেন, কষ্ট বোধ করেন। অতীতে খুব গাওয়া হতো একটি গান। সেই সঙ্গীতের কাছাকাছি কয়েকটি চরণ এখানে তুলে ধরে লেখা শেষ করছি। ‘সোনালি সেই দিনগুলো কোথায় হারিয়ে, জানি তারে আর খুঁজে পাবো না।’
ndigantababor@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement

সকল