রাজনীতির বাসর রাত
- তৈমূর আলম খন্দকার
- ০৮ অক্টোবর ২০২১, ২০:১০
বর্তমান বিশ্বে প্রতিটি মানুষ রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। রাজনীতি করে না বলে যে দাবি করে, সেও রাজনীতির আওতামুক্ত নয়। রাজনীতির প্রভাবের আওতার মধ্যেই প্রতিটি শিশু জন্মগ্রহণ করে। স্বর্ণের চামচ নিয়ে জন্মগ্রহণ করা শিশুটিকেও বাংলাদেশে ঋণের বোঝা মাথায় নিয়েই জন্মগ্রহণ করতে হয়। এ দেশের প্রায় সব মানুষই ঋণের বোঝা মাথায় নিয়েই মৃত্যুবরণ করছে। সরকার গালভরা বুলি আওড়িয়ে বলে বেড়াচ্ছে যে, মানুষের জনপ্রতি আয় বৃদ্ধি পেয়েছে, যা সত্যের অপলাপ মাত্র। প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রের সব অর্থ সরকারি ঘরানার একশ্রেণীর মানুষের মুষ্টিবদ্ধ হয়েছে। ফলে সাধারণ জনগণের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি, বরং নিম্নমুখী। বস্তিবাসীর সংখ্যা বেড়েছে, বৃদ্ধি পেয়েছে শিক্ষিত বেকার যুবকের সংখ্যা। সরকার নিজেও ঋণের ওপর চলছে। জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে যে শিরোনাম ছিল ‘সরকারকে ঋণ দিয়ে বিপদে ব্যাংকগুলো’ (তাং- ০৩/১০/২০২১ইং)। দেশের গণমানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা পরিমাপের জন্য অর্থনীতিবিদ হওয়া বা অর্থনীতিবিদের মন্তব্য বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন পড়ে না। গ্রামগঞ্জে বিভিন্ন পরিবারে খোঁজখবর নিলেই বোঝা যাবে যে, কতজনের নুন আনতে পানতা ফুরিয়ে যায় বা শতকরা ক’টি পরিবার সচ্ছলতার মুখ দেখছে? প্রতিটি পরিবারে কতজন উপার্জনক্ষম মানুষ রয়েছে? বেকার জীবনযাপন করছে কতজন? পরিবারের পাঁচজনের মধ্যে একজন যদি উপার্জন করে এবং বাকিরা যদি নির্ভরশীল হয়, তবে পরিবারটিকে অর্থনৈতিকভাবে ‘সচ্ছল’ বলা যাবে কি? আমি মনে করি, গোটা বাংলাদেশে গ্রামগঞ্জে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত প্রতিটি পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা একই ধরনের। সরকারি ঘরানার লোকেরা যারা এমপিদের ছত্রছায়ায় আছেন, তাদের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, জমি দখল, ব্যবসা দখল প্রভৃতি মিলিয়ে সচ্ছলতার অবস্থা চলমান রয়েছে; সমস্যায় রয়েছে যারা সে ঘরানায় পৃষ্ঠপোষকতা পায়নি। অন্য দিকে সরকারি দল করলে সবাই যে দলীয় পৃষ্ঠপোষকতা পাবে তাও নিশ্চিত নয়; কারণ প্রতিটি এলাকায় এমপিদের বলয়ে নিজস্ব বাহিনী গড়ে উঠেছে এবং সে বাহিনীই নিয়ন্ত্রণ করছে সংশ্লিষ্ট এলাকা ও বিভিন্ন প্রশাসনিক দফতর।
ভোটাধিকার, স্বাধীনতার সুফল পাওয়ার অধিকার, মৌলিক অধিকার, সাংবিধানিক অধিকার, জন্মগত অধিকার, মানবাধিকার- সব মিলিয়ে দেশের মানুষ কি নিজ অধিকার প্রয়োগ করতে পারছে? দলমত নির্বিশেষে দেশের মানুষ কি স্বাচ্ছন্দ্যে বা নিরাপত্তায় রয়েছে যতটুকু ভালো থাকার বুলি তোতা পাখির মতো বলে যাচ্ছেন সরকারি দল ও দলীয় ঘরানার বুদ্ধিজীবীরা, বিশেষ করে ‘কলকাতামনস্ক’রা। ব্রিটিশ আমলেও সরকারের অত্যাচার-নির্যাতনকে সমর্থন করে কথা বলার লোকের অভাব ছিল না এবং সে ধরনের লোকের অভাব এখনো নেই। ‘রায় বাহাদুর’, ‘খান বাহাদুর’, ‘স্যার’ প্রভৃতি উপাধি দিয়ে ভারতীয় অনেক প্রভাবশালীকেই ব্রিটিশরা তাদের খয়ের খা (চামচা) বানিয়ে ছিল। এ ধরনের বুদ্ধিজীবী আইয়ুব খান বা ইয়াহিয়া খানের পক্ষেও কম ছিল না। ‘সত্য’ যখন ‘স্বার্থের’ কাছে হার মানে তখন নিজের নিরাপত্তার কারণেই মানুষ বিশেষ করে সুযোগ সন্ধানী ও সুবিধাভোগী মানুষ ‘হক’ কথা বা ‘সত্য’ কথা বলা থেকে বিরত থাকে এবং এ সংস্কৃতি সর্বক্ষেত্রে যেন দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েই চলছে। সাম্প্রতিককালে এদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে জ্যামিতিক হারে।
রাজনীতিবিদদের দায়িত্ব জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। রাজনীতির কারণেই রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়ার দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার বিধান সংবিধানে সংযুক্ত হয়েছে। আবার রাজনীতির কারণেই সংবিধান থেকে তা উচ্ছেদ হয়ে গেছে। তবে সংবিধান সংশোধনের কোন প্রভিশনটি ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে, ভবিষ্যৎই বলে দেবে। তদুপরি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির বিরোধিতা করার মানুষের অভাব হচ্ছে না। রাজনীতির কারণেই স্বাধীনতার পর একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম হয়েছিল, হালে দেশ ও রাষ্ট্র ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রণে সে দিকেই বোধহয় যাচ্ছে, গণতন্ত্র থাকছে শুধু মুখে মুখে ও বইপুস্তকের পাতায়।
রাজনীতির উদ্দেশ্য যদি ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করাকে বোঝায় তবে ক্ষমতাসীন দল তাদের দৃষ্টিতে ভুল করছে বলে মনে হয় না। ইংল্যান্ডে একটি প্রবাদ রয়েছে, ‘কিং কেন নট ডু রং’ অর্থাৎ ক্ষমতাসীনরা যখন কোনো কাজ করে তখন মনে করে যে তারা কোনো ভুল করেনি। যখন ভুল ধরা পড়ে, তখন আর শোধরানোর সময় থাকে না। প্রেক্ষাপট বলে যে, রাজনীতি চলে গেছে ব্যাংক লুটেরা ব্যবসায়ী, আমলা ও দেশী বিদেশী গোয়েন্দাদের নিয়ন্ত্রণে। ফলে রাজনীতির ‘মজা’ দলীয় নেতাকর্মীরা এখন সেভাবে পাচ্ছে না; ফলে হতাশার বেদনা নিয়েই রাজনীতিকে ধরে রাখার চেষ্টা করছেন সেসব কর্মী, যারা শত বঞ্চনার মধ্যে রাজনীতির প্লাটফর্মে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতে চান। একটি সময় ছিল যখন একটি দল সাংগঠনিক দক্ষতা বৃদ্ধির বিষয়টি প্রথম কাতারের বিবেচনায় রাখত। এখন সে মন-মানসিকতার বিলুপ্তি ঘটেছে। মুখে মুখে অনেকেই বলে যে, সংগঠনকে শক্তিশালী করতে হবে, যা শুনতে ভালো লাগে। কিন্তু বাস্তবতায় এর কোনো প্রস্তুতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না। স্বাধীনতার সুফল যেমন জনগণের দরজায় পৌঁছেনি, তেমনি রাজনীতির মূল্যবোধ বা প্রকৃত স্বাদ দলগুলো তাদের বৃষ্টিতে ভেজা ও রোদে পোড়ানো ত্যাগী নেতাকর্মীদের দিতে পারেনি। দলগুলো ক্ষমতায় থাকলে চলে ভাগবাটোয়ারার প্রস্তুতি, বিরোধী দলের হলে থাকতে হয় দৌড়ের ওপর। ফলে একজন দৃঢ়চেতা, মানবিক জ্ঞানসম্পন্ন দেশপ্রেমিক কর্মীবাহিনী গড়ে তোলার কর্মসূচি রাজনৈতিক দলগুলোতে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এসব কারণেই দলে যখন দুর্যোগ আসে, তখন তা উত্তরণের রাস্তা খোঁজা কঠিন হয়ে পড়ে।
রাজনীতির প্রতি সাধারণ মানুষের মন-মানসিকতার কি পরিবর্তন ঘটেছে? নাকি জনগণ বিভিন্নভাবে প্রতারিত হয়ে রাজনীতিবিমুখ হচ্ছে এবং এ ফায়দাটি লুটে নিচ্ছে ক্ষমতাসীন দল? এসব বিষয়ও মাথায় রেখে রাজনীতিবিমুখতার কারণ অনুসন্ধান করাই হতে হবে বিরোধী রাজনীতির বর্তমানে প্রধান কর্মসূচি। রাজনীতির অধিক্ষেত্র হলো জনগণ। অতএব জনগণের মন-মানসিকতার মাপকাঠি বিচার বিশ্লেষণ এখন সময়ের দাবি। অন্য দিকে রাজনীতি অর্থ, আমলা ও গোয়েন্দাদের কারসাজি থেকে মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত রাজনীতির যে একটি নিজস্ব স্বাদ রয়েছে তাও জনগণ ভোগ করতে পারছে না এবং পারবে না।
প্রতিটি মানুষই দোষ-গুণের মানবিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে গঠিত। জাতি হিসেবেও আমাদের আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস রয়েছে। কিন্তু এ দেশের মাটি কখন কোন রঙ ধরে, তাও আঁচ করতে সময় লাগে; তবে চ‚ড়ান্ত খেলায় ‘প্রকৃতি’ তার স্বাভাবিক রূপের বাইরে যায় না। এ দেশে যেমন জন্ম হয়েছে সিরাজ-উদদৌলার, তেমনি জন্ম হয়েছিল মীরজাফরের। এ ধরনের বহু উপমা দেয়া যাবে যারা জনগণের অধিকার ছিনিয়ে নেয়ার পরও সাময়িক জয়লাভ করেছে, কিন্তু শেষটা ভালো হয়নি; হয়েছে অপমানজনক পরিণতি।
একটি ‘বাসর রাত’ নাকি একজন মানুষের সারা জীবনের অপেক্ষা। এ রাতের সংস্কৃতি হলো সত্য-মিথ্যার সব প্রতিশ্রুতি দিয়ে যেকোনোভাবে একে অপরকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করা। বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন। চাঁদের স্নিগ্ধ আলোতে দেয়া সে প্রতিশ্রুতি একসময় ঝলসানো রুটিতে পরিণত হয়, যা হয় না তা হাতেগোনা মুষ্টিমেয়। তখন প্রত্যাশা যেমন মুখ থুবড়ে পড়ে যায়, ঠিক তেমনি আমাদের দেশের রাজনীতিও চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। অতি আশা নিষ্ফলে পরিণত হয়েছে। স্বাধীনতার চেতনাকে অবমূল্যায়িত করছে তারাই যারা স্বাধীনতার নেতৃত্বের দাবিদার।
বিভিন্ন কারণে জনগণ বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে। সময়ের সন্ধিক্ষণে প্রয়োজনে জাতি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ইতিহাস থাকলেও অনেক সময় বিষয়টি সময়সাপেক্ষ বটে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা এখন একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন, যা নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া এ দেশে মোটেও সম্ভব নয় এবং ভবিষ্যতেও হওয়ার সম্ভাবনা নেই। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে।
কথাটি শুনতে ভালো লাগলেও সার্চ কমিটিও প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ারভুক্ত। সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ বলে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা অপরিসীম; অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ ছাড়া রাষ্ট্রপতি কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারেন না। ফলে ‘যাহা বায়ান্ন তাহাই তেপান্ন’। ক্ষমতার কাছে ভিকটিম হচ্ছে জনগণ। আশাহত হচ্ছে জনগণ, ঠিক বাসর রাতের ‘প্রতিশ্রুতি’ রণে ভঙ্গ করার মতো।
লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail : [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা