২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ

-

বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর দেশ। কৃষিতে কিছু সফলতা এলেও কাক্সিক্ষত শিল্প গড়ে না ওঠায় বাংলাদেশে বেকার সমস্যা বিশেষ করে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বিপুল। এখনো দেশের যুবসমাজ জীবিকার অন্বেষণে ছোট ছোট নৌকায় পাড়ি দিতে গিয়ে তাদের সমুদ্রে সলিল সমাধি হচ্ছে। জীবিকার অন্বেষণে অনেক নারী গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার কথা জেনেও বিদেশে যাচ্ছে। মাথাপিছু প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি হওয়ার কথা সরকার বললেও প্রকৃতপক্ষে সাধারণ খেটেখাওয়া মানুষের জীবন খুব একটা বদলায়নি। কলকারখানা গড়তে ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে প্রচুর অর্থঋণ নিয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ইনভয়েসের মাধ্যমে মানিলন্ডারিং করছেন। দেশের টাকা চলে যাচ্ছে বিদেশে।

দেশের বেকার সমস্যা দূর করতে শিল্পবিপ্লবের এখন বিকল্প নেই। আঠারো শতাব্দীর শেষাংশে এবং ঊনবিংশ শতাব্দী প্রথমাংশে প্রথম শিল্পবিপ্লব ব্রিটেনে শুরু হয়ে গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। ১৭০৫ সালে ব্রিটিশ নাগরিক থমাস নিউকোমেন প্রথম স্টিম ইঞ্জিন আবিষ্কার করেন, যা কয়লাখনি থেকে পানি উত্তোলন কাজে ব্যবহৃত হয়েছিল। এমনিভাবে পর্যায়ক্রমে শিল্পকারখানা গড়ে ওঠে। শিল্পকারখানা অতিমাত্রায় গড়ে ওঠায় ১৮২৫ সালে উদারপন্থী সংসদ সদস্যরা ট্রেড ইউনিয়নকে স্বীকৃতি দিয়ে আইন পাস করতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রস্তাব আনেন।

১৮৮০ সালে জার্মানি শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা আইন পাস করে। শিল্পবিপ্লব একটি উৎপাদনমুখী ব্যবস্থা ১৭৬০ ও ১৮২০ থেকে ১৮৪০ সালের মধ্যে বেশি প্রসার লাভ করে। হাতে তৈরি উৎপাদনের পরিবর্তে মেশিনে উৎপাদন, কেমিক্যাল উৎপাদন, লোহা উৎপাদনের মাধ্যমে ব্রিটেনে শিল্পবিপ্লব এগিয়ে যেতে থাকে, যা কিছু দিনের মধ্যেই পশ্চিম ইউরোপ ও আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে। তখন নোভেলবিজয়ী রবার্ট ই লুকাস মন্তব্য করেন, ‘এই প্রথম পৃথিবীতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হয়েছে।’

পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশ ভ‚খণ্ডে পাটকলের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ওই সময় নারায়ণগঞ্জ ও খুলনার দৌলতপুরে এশিয়া মহাদেশের মধ্যে পাটকলের জন্য প্রসিদ্ধি লাভ করে । অবাঙালি ধনকুবের যথা আদমজী, বাওয়ানি প্রভৃতি ব্যবসায়ীর স্থাপিত পাটকলের জন্য পূর্ব পাকিস্তান পাট ব্যবসার জন্য রোল মডেল হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। পাট ব্যবসার জন্য নারায়ণগঞ্জকে প্রাচ্যের ড্যান্ডি হিসেবে অবহিত করা হতো। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পশ্চিম পাকিস্তানি ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ বন্ধ ও বড় জুটমিলসগুলো জাতীয়করণ করায় এগুলো লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় এবং ২০২০ সাল থেকে সরকারি সিদ্ধান্তে পর্যাক্রমে জুটমিলগুলো ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। সরকারি ঘরানার ধনকুবরা পানির দরে জুটমিলসগুলো ক্রয় করে নিচ্ছে। ফলে জাতীয় সম্পদের অপচয় হচ্ছে বৈ আর কিছুই নয়। দেশে শিল্পবিপ্লব ঘটানোর জন্য কম পুঁজিতে যেসব কলকারখানা গড়ে তোলা যায় সে দিকে সরকারের মনোনিবেশ করে বেকার যুবকদের মধ্যে উদ্যোক্তা সৃষ্টি করা দরকার।

বড় বড় শিল্পকারখানা সুষ্ঠুভাবে না চলার পেছনে দু’টি কারণ দেখা যাচ্ছে- ১. মালিকের অস্বচ্ছতা ও ২. প্রশিক্ষণবিহীন ট্রেড ইউনিয়ন এবং অবহেলিত ও অনিয়ন্ত্রিত শ্রমিক সমাজ। বাংলাদেশে ট্রেড ইউনিয়নগুলো সরকারি লেজুরবৃত্তিতে ব্যস্ত থাকায় শুধু মালিককে অসহায় করে দাবি আদায় করাকে একমাত্র দায়িত্ব মনে করে। প্রকৃতপক্ষে কারখানার উৎপাদন বাড়ানোর বিষয়ে যেটুকু মনোনিবেশ ট্রেড ইউনিয়নের পক্ষ থেকে করা দরকার সে পরিমাণ মনোনিবেশ করতে দেখা যায় না। পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হলো সুইডেনের ভলভো কোম্পানি। ওই কোম্পানি বাস, টেক্সি, জাহাজ, রেলগাড়ি, উড়োজাহাজ প্রভৃতি নির্মাণ করে।

সুইডেনের প্রতিটি নাগরিক ওই কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার। ভলভো কোম্পানির ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিনিধি ওই কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের সদস্য; অর্থাৎ মালিক শ্রমিক সমন্বয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি এবং মার্কেটিং প্রশ্নে পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে পরিকল্পনা প্রস্তুত করে। অথচ আমাদের দেশে মালিক শ্রমিক সম্পর্কটি পরস্পর বিরোধপূর্ণ, একপক্ষ অপরপক্ষকে প্রতিপক্ষ মনে করে। মালিকরা নিজেদের কর্মে স্বচ্ছ মনোভাবের পরিচয় দেন না। ব্যাংক থেকে কারখানা ও উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ঋণ নিয়ে কৌশল করে অন্যত্র সরিয়ে মানি লন্ডারিং করেন। মানি লন্ডারিং বন্ধ করতে অনেক আইন ও বিধি প্রণয়ন করা হয়েছে, কিন্তু রাষ্ট্রের সব কৌশলই মানি লন্ডারিংয়ের কাছে ব্যর্থ হচ্ছে। ‘সর্ষের মধ্যে ভ‚ত’ থাকলে যে অবস্থা হয় সে অবস্থায়ই পড়েছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা, বিশেষ করে মানি লন্ডারিং, মাদক, চোরাকারবার, অবৈধ অস্ত্র ব্যবসা প্রভৃতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে। সর্বগ্রাসী মাদক কারবার তো বন্ধ হয়ইনি; বরং দেখা যাচ্ছে- অভিজাত ক্লাবগুলোতে বসছে এর জমজমাট আসর।

গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজগুলো নিম্নআয়ের পরিবারকে আলোর সন্ধান দেখিয়েছে। পোশাক প্রস্তুতকারী একটি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ এক দিকে সুনাম অর্জন করেছে, অন্য দিকে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে বিশেষ করে নিম্নবিত্ত পরিবারের নারীদের কর্মসংস্থানের অভাবনীয় অবদান রাখছে। নারীর ক্ষমতায়নের কথা বিশ্বব্যাপী বিশেষ করে জাতিসঙ্ঘের একটি প্রকল্প থাকলেও পরিবারের ভেতরে যদি নারী ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠিত না হয় তবে সমাজে কিভাবে নারীসমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে? আমাদের সমাজে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারে নারীরা নিগৃত হয় অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার কারণে। দেশে গড়া ওঠা গার্মেন্ট এ ক্ষেত্রে সহায়ক ভ‚মিকা পালন করছে। গার্মেন্ট শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে। গার্মেন্টের জন্য প্রসিদ্ধ নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে তৈরী পোশাক কারখানার শ্রমিকরা বেতন-বোনাসের দাবিতে প্রায়ই রাস্তাঘাট অবরোধ করেন। অনেক গার্মেন্ট ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে প্রতিষ্ঠানকে ‘রুগ্ণশিল্প’ হিসেবে ঘোষণা দিচ্ছেন।

এ শিল্পকে কলকাতাকেন্দ্রিক করার জন্যও একটি মহল আগে থেকেই কলকাঠি নাড়ছে। ফলে রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই এ শিল্পকে ধরে রাখাসহ বিদেশী কোনো গোয়েন্দা সংস্থার কারসাজিতে অন্য কোনো রাষ্ট্রের হাতে চলে না যায়; সে জন্য চোখ-কান খোলা রেখে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার, এ কথা ভুলে থাকলে চলবে না।

দেশপ্রেমের প্রশ্নে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতি প্রশ্নবিদ্ধ। তবে দুঃসময়ে জাতি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার অনেক প্রমাণ রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি-বৈদেশিক রেমিট্যান্স, গার্মেন্টশ্রমিকদের অবদান এবং কৃষকদের অবদানের ওপর নির্ভরশীল। কৃষি উৎপাদন সফল হওয়ার পেছনের কারণ হলো, সেখানে মানি লন্ডারিংয়ের কোনো সুযোগ সুবিধা নেই। জাতীয়করণ করা ব্যাংকগুলোও লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার সংবাদ প্রায়ই পত্রিকায় আসছে। ব্যাংকের ভল্ট থেকেও কোটি কোটি টাকা উধাও হয়ে যাওয়ার সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে। এ টাকা যায় কোথায়? ব্যাংক ঋণের শক্ত মনিটরিং না থাকায় দুর্নীতিপরায়ণ ঋণগ্রহীতারা পাবলিক মানি লুটপাট করছে। আর লুটপাটের সুযোগ করে দিচ্ছে সরকার। এক ব্যাংকের ডিফলটার অন্য ব্যাংকের ডাইরেক্টর। একই পরিবারভুক্ত পরিবারের সদস্যরাও একই ব্যাংকের ডাইরেক্টর হওয়ার বিধিবিধান সরকারই করে দিচ্ছে। বাংলাদেশে পরিসংখ্যানের মধ্যে সঠিক তথ্য নির্ণয় হয় না। কারণ ভুল তথ্যসংবলিত রিপোর্ট এখন সত্যতার সাথে সাংঘর্ষিক হচ্ছে বটে।

একটি জাতিকে তখনই স্বনির্ভর করা যায় যখন জাতি অর্থনীতিভাবে সমৃদ্ধিশালী অর্থাৎ গণমানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হয়। একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ জনগোষ্ঠীকে বেকার রেখে গোটা জাতিকে সমৃদ্ধিশালী বলা যাবে না। একটি জাতির অর্থনীতিতে তখনই ঘুণে ধরে যখন নির্দিষ্টসংখ্যক কর্মীর হাত বেকারের হাতে পরিণত হয়, অন্য দিকে দেশের গোটা সম্পদ একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশের সম্পদে পরিণত হয়। সম্পদের সুষম বণ্টনের দাবিতে স্বাধিকার আন্দোলন অন্তে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জাতি পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু কাক্সিক্ষত সেই সম্পদের সুষম বণ্টন হয়েছে কি?

লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail : [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement