আমি, ওবায়দুল কাদের এবং কাহলিল জিবরান
- গোলাম মাওলা রনি
- ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, ২০:২১, আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, ২০:৪৮
যে সময়ের কথা বলছি, তখন আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের দিনকাল ভালো যাচ্ছিল না। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের ডাঁকসাইটে আরো অনেক নেতার মতো কাদের ভাইও মন্ত্রিত্ব না পেয়ে এক অস্বস্তিকর এবং বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়েন। ১/১১ পূর্ববর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর সাথে তার সুসম্পর্ক, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় আহত হওয়া এবং দলীয় রাজনীতিতে সক্রিয় ভ‚মিকার কারণে সবাই আশা করেছিলেন, তিনি মন্ত্রী হবেন; কিন্তু বাস্তবে যখন সেটি তার ভাগ্যে জুটল না তখন তিনি নিজে কতটা বেদনাহত ছিলেন তা বলতে পারব না কিন্তু আওয়ামী লীগের মধ্যে তাকে কেন্দ্র করে যে একটি শক্তিশালী নিউক্লিয়াস গড়ে উঠেছিল তা রাতারাতি বিলীন হয়ে যায়। ফলে তিনি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন।
এই পরিস্থিতির মধ্যে তিনি তখন খুবই সংযত হয়ে চলতেন এবং কথাবার্তায় বেশি মাত্রার সতর্কতা অবলম্বন করতেন। অধিবেশন চলাকালীন চুপচাপ অধিবেশনকক্ষে প্রবেশ করতেন এবং তার স্বভাবসুলভ হাসি-তামাশা-খোশগল্প পরিহার করে একাকী থাকার চেষ্টা করতেন। তোফায়েল ভাই, সুরঞ্জিত দাদা অথবা আমু ভাইও মন্ত্রিত্ব বঞ্চিত ছিলেন। কিন্তু তারা সেটি গায়ে মাখতেন না। একইভাবে শেখ সেলিম, মঈনউদ্দিন খান বাদলসহ অন্য সিনিয়র রাজনীতিবিদরাও পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিয়েছিলেন। ফলে অধিবেশন চলাকালীন বা বিরতিকালে তারা সংসদ লবিতে বসে তুমুল আড্ডা জমিয়ে ফেলতেন। তরুণ সংসদ সদস্যদের মধ্যে একমাত্র আমারই সৌভাগ্য হতো সেসব আড্ডাতে বড়দের সাথে তাল মিলিয়ে সমানতালে খোশগল্প করার।
একদিন সংসদ লবিতে বসে তোফায়েল ভাই, সুরঞ্জিত দাদাসহ আরো কয়েকজনের সাথে যখন আড্ডা দিচ্ছিলাম তখন কথা প্রসঙ্গে তোফায়েল ভাই আমার একটি লেখার উচ্ছ¡সিত প্রশংসা করলেন। আর সেটি শুনে সুরঞ্জিত দাদা তার স্বভাবসুলভ উচ্চমার্গের কৌতুক বাক্যের তীর তোফায়েল ভাইয়ের দিকে ছুড়ে দিলেন। তিনি বললেন, সাবধান রনি! তোফায়েলের প্রশংসা শুনে খুশি হইয়ো না। কারণ তোফায়েল যার প্রশংসা করে তার সর্বনাশ ঘটতে খুব বেশি দেরি লাগে না। তার কথা শুনে তোফায়েল ভাই উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠলেন এবং আমি আশা করলাম যে, তিনি হয়তো সুরঞ্জিত দার কথার একটা উপযুক্ত জবাব দেবেন; কিন্তু আমার সেই আশা পূর্ণ হলো না। কারণ হঠাৎ অনুভব করলাম, পেছন থেকে কে যেন আমার ঘাড়ের উপর একখানা হাত রেখে মৃদু চাপ দিলো। তাকিয়ে দেখি ওবায়দুল কাদের ভাই!
কাদের ভাই ইঙ্গিতে তাকে অনুসরণ করতে বললেন এবং আমি তা করলাম। সংসদ লবি থেকে বের হয়ে আমরা সোজা তার রুমে গেলাম। লবি থেকে তার রুমে পৌঁছাতে অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হয়। তিনি চুপচাপ হাঁটা শুরু করলেন এবং কারো দিকে না তাকিয়ে সোজা গিয়ে লিফটে উঠলেন। তারপর নির্দিষ্ট ফ্লোরে নেমে তিনি অতি দ্রুত নিজের কামরার দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন। পুরোটা পথ তিনি নীরব থাকলেন এবং লোকে লোকারণ্য সংসদ ভবনের বিভিন্ন স্থানে যেসব লোকের সাথে তার দেখা হলো তারা যেমন তাকে দেখে কোনো প্রতিক্রিয়া জানাল না তেমনি তিনিও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। নিজের কামরায় ঢুকে, চেয়ারে বসে আমাকে বসতে বললেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন আছি। তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলাম- আপনি কেমন আছেন কাদের ভাই?
আমার প্রশ্নের জবাবে তিনি একই সাথে অনেক কথা বললেন। জানালেন, মন্ত্রিত্ব্ না পেয়েও তিনি খুশি। কারণ অখণ্ড অবসরে তিনি প্রাণভরে লেখাপড়া করতে পারছেন। লক্ষ করলাম, তার টেবিলে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন নামকরা লেখকের বহু জনপ্রিয় বই সাজানো। তিনি যে সেগুলো অধ্যয়ন করছেন তা বুঝতে আমার কষ্ট হলো না। কারণ প্রতিটি বইয়ের মধ্যেই একাধিক কাগজ ঢুকিয়ে কিছু পৃষ্ঠা নির্দিষ্ট করা আছে। এসব কাজ তারাই করে যারা একই সাথে অনেক বই পড়েন। একটি বইয়ের হয়তো দশ পৃষ্ঠা পড়ার পর পাঠকের মনে হলো অন্য আরেকটি বই পড়া দরকার তখন তিনি দশম পৃষ্ঠাতে একটি চিহ্ন সংযুক্ত করে অন্য বইয়ে মনোনিবেশ করেন। পাঠকের যদি কোনো বইয়ের নির্দিষ্ট অংশে বর্ণিত কোনো ঘটনা-আপ্তবাক্য ইত্যাদি পছন্দ হয় তবে সে ক্ষেত্রেও তিনি তা দ্বিতীয়বার পড়ার জন্য কোনো চিহ্ন সংযুক্ত করে রাখেন।
আমি যখন তার বইগুলোর দিকে নজর বুলাচ্ছিলাম তখন তিনি যে কথাগুলো বলছিলেন তা এখনো আমার কানে বাজছে। তিনি জীবনের প্রতি কোনো খেদোক্তি না করে জ্ঞানচর্চায় কী কী সুফল পাচ্ছেন তা সবিস্তারে বলছিলেন এবং কাহলিল জিবরানের একটি বই নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন। অনুমান করলাম, তিনি হয়তো এই শতাব্দীর অন্যতম কবি বা লেখক কাহলিল জিবরানের বইটি পড়ছেন এবং বইয়ের অন্তর্নিহিত ভাবার্থগুলো যাতে মস্তিষ্কে ধারণ করতে পারেন সে জন্য বইয়ের বিষয়বস্তু সম্পর্কে তিনি যা বুঝেছেন তার আঙ্গিকে দার্শনিক কথাবার্তা বলছেন। আমি এও অনুমান করলাম যে, আমার মধ্যকার লেখকসত্তার জন্যই তিনি হয়তো শ্রোতা হিসেবে আমাকে তার কামরায় নিমন্ত্রণ করে এনেছেন। কারণ কাহলিল জিবরানের কবিতার ভাবার্থ এবং মন্ত্রিত্ববঞ্চিত একজন শীর্ষ রাজনীতিবিদের দার্শনিক চিন্তাধারার সংমিশ্রণের স্বগতোক্তিমূলক উচ্চমার্গের কথা শোনার শ্রোতার আকাল যে কত প্রকট তা তিনি খুব ভালো করেই জানতেন।
আমি জনাব ওবায়দুল কাদেরের কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতে চেষ্টা করলাম। কারণ অনুধাবন করলাম, চলমান অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য তিনি তার হৃদয় মন এবং মস্তিষ্কের ওপর যে মেডিটেশন করেন সেগুলো তিনি আত্মস্থ করতে পেরেছেন কি না তা আমার মতো শ্রোতাকে সামনে বসিয়ে নিজেই নিজের পরীক্ষা নিচ্ছিলেন। আমি তার কথাগুলো অনুধাবনের চেষ্টা করলাম কিন্তু প্রভাবিত হলাম না- অন্য কথায় তার বক্তব্য আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো বটে কিন্তু আমাকে মোটেও আকর্ষিত করল না। কারণ কাহলিল জিবরান সম্পর্কে জানতাম; কিন্তু তার কবিতা বা নিবন্ধকে হৃদয়ে ধারণ করার জন্য যে পরিবেশ দরকার তা তখনো আমার হয়ে উঠেনি। অর্থাৎ আমি তখন সবদিক থেকেই সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলাম এবং এই ধরনের পরিস্থিতিতে মানুষের অবস্থা হয় ফোলানো ফাঁপানো বেলুনের মতো। তারা নিজের আকৃতির চেয়েও নিজেকে বড় মনে করে এবং বাতাসের চাপে ওজন হারিয়ে হাওয়ায় উড়তে পছন্দ করে।
বেশ কিছুক্ষণ আডডার পর যথারীতি ফিরে এলাম। অভ্যাস অনুযায়ী কাহলিল জিবরানের কিছু নিবন্ধ পরবর্তীকালে পড়লাম। কিন্তু ওবায়দুল কাদের যেভাবে বলেছিলেন এমন কোনো তত্ত¡ খুঁজে না পেলেও কবির নামটি অন্তরে গাঁথা হয়ে গেল। আমি সেই ২০০৯ সালে যে মন মানসিকতা ধারণ করতাম অথবা ইংরেজি সাহিত্য ও ভাষা সম্পর্কে আমার যে বোধবুদ্ধি ছিল তা হয়তো চলমান শতাব্দীর একজন শ্রেষ্ঠতর কবির রচনাশৈলী দ্বারা আকর্ষণ অনুভব করার পর্যায়ে ছিল না। লেবাননে জন্মগ্রহণকারী কাহলিল জিবরান বেড়ে উঠেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। মাত্র ৪৮ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবন, কিছু কবিতা, কিছু গল্প, কিছু রচনা, দু’টি নাটক এবং কিছু উপদেশমূলক বাণী দ্বারা বিশ্বসাহিত্যের ভাণ্ডারে যা কিছু সঞ্চিত রেখে গেছেন তা বুদ্ধিবৃত্তিক দুনিয়ার সৃষ্টিতম সম্পদ বলে পরিগণিত হচ্ছে।
কাহলিল জিবরানের রচনায় মানবজীবনের গুরুত্বপূর্ণ মর্মার্থ এতটা সূ²ভাবে ফুটে উঠেছে, যা সাধারণত অন্য কোনো সাহিত্যকর্মে খুঁজে পাওয়া যায় না। মানুষের জয়-পরাজয়, অর্জন-বর্জন, দ্রোহ এবং যন্ত্রণার সময়ে মানবহৃদয়ে যেসব বিক্রিয়া ঘটে তা তিনি নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলার পাশাপাশি সার্বিক পরিস্থিতির সাথে নিজেকে কিভাবে খাপ খাওয়াতে হয় তাও বর্ণনা করেছেন। বিরূপ পরিস্থিতিতে আশাহত না হওয়া এবং সুবিধাজনক পরিস্থিতিতে উত্তেজিত না হয়ে কিভাবে বেঁচে থাকার সার্থকতা খুঁজে পাওয়া যায় সেসব বিষয় কিভাবে লিখে গেছেন তা অনন্তকাল ধরে পাঠকদের অনুপ্রাণিত করবে।
কাহলিল জিবরানের মতে, মানুষের জীবনের দুটো পরস্পরবিরোধী স্তর রয়েছে। একটি স্তর হলো হাজারো বিপদ-বিপত্তির মাঝেও মানুষ নিজেকে পরিপূর্ণ সুখী ভাবে। মানুষ যখন নিজেকে এমন স্তরে কল্পনা করে তখন বাইরের দুনিয়া মনে করে লোকটি ভালো নেই। অর্থাৎ মানুষের অন্তর্লোক যখন সুখী তখন দর্শকরা তাকে অসুখী ভাবে। মানুষের দ্বিতীয় স্তরটি হলো দর্শকরা যখন মনে করে যে লোকটি সুখী তখনকার বাস্তবতা হলো লোকটি অসংখ্য বাহ্যিক সুখ স্বাচ্ছন্দ্য, ক্ষমতা-বৈভব, বিত্ত, বিলাস ইত্যাদি দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকার পরও অন্তর্লোকে নরকযন্ত্রণা অনুভব করতে থাকে। মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সহজাত এই দৃশ্যের বাইরে যা কিছু ঘটে তা ব্যতিক্রম- ক্ষেত্রবিশেষে অস্বাভাবিক এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে মিরাকল বা অলৌকিক বলে বিবেচিত।
আজ বহু বছর পরে হঠাৎ করেই কাহলিল জিবরান এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কথা মনে হলো কাহলিল জিবরানের একটি কবিতা পড়ার পর। নিবন্ধের শুরুতে ওবায়দুল কাদেরের সংসদ ভবনের কামরায় যে কথোপকথনের উদ্ধৃতি দিয়েছিলাম সেসব কথার মর্মবাণী আমি এতদিন খুঁজে না পেলেও কাহলিল জিবরানের Defeat কবিতাটি শোনার পর মনে হলো, তিনি হয়তো এই কবিতাটি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই সে দিন কথাগুলো বলেছিলেন। এতবড় কবির কবিতার বঙ্গানুবাদ আমার দ্বারা সম্ভব নয় বিধায় Defeat কবিতার কয়েকটি লাইন আপনাদের উদ্দেশে নিবেদন করে আজকের নিবন্ধের ইতি টানব। কাহলিল জিবরান লেখেন- Defeat, my defeat, my deathless courage, you and I shall laugh together with the storm, and togeter we shall dig graves for all that die in us, and we shall stand in the sun with a will, and we shall be dangerous.
‘পরাজয়, আমার পরাজয়, মৃত্যুহীন সাহস আমার, তুমি ও আমি একত্রে ঝড়ের সাথে হাসবো, আর একত্রে সমাধি খনন করবো আমাদের মাঝে যারা মরে গেছে তাদের জন্য, আর আমরা একটি আর্জি নিয়ে রোদে দাঁড়াবো, আর আমরা ভয়ানক হয়ে যাবো।’
[পাঠকের জন্য মীম মিজানের অনুবাদ থেকে অংশটুকু তুলে দেয়া হলো। বি.স )
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা