২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

তালেবান : অস্বস্তি ও প্রচারণা

- ফাইল ছবি

আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় ফিরে আসার পর নিদারুণ অস্বস্তি শুরু হয়েছে ঘরে-বাইরে। এর কারণ আসলে নির্বাচনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে সে দেশে একটি সরকার গঠন না করা নয়। দেশটিতে দীর্ঘ দিন যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তার চূড়ান্ত পরিণতি এটি। ঘটনাক্রমে বহুল আলোচিত তালেবানরা এখন সে দেশে ক্ষমতাসীন, তাই ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’। অনেকেই এ মুহূর্তের ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চাচ্ছে তালেবানকে ‘বলির পাঁঠা’ বানিয়ে। তারাও চাপে পড়ে মাঝে মধ্যে ভিন্ন সুর প্রকাশ করছে। এ ক্ষেত্রে কাবুলের বিমানবন্দরে সাম্প্রতিক বোমাবাজির কথা অনেকেই বলছেন।

দিন কয়েক আগে মিডিয়ার খবর- আফগান রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সঙ্কটের হেতু কয়েকটি; যেমন সে দেশে দীর্ঘমেয়াদি খরা হয়েছে। কোভিড মহামারীর ব্যাপক সংক্রমণ তো আছেই। তার সাথে যোগ হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা, যা দেখা যাচ্ছে তালেবানের বিজয়ে ত্বরান্বিত হয়েছে। জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস উল্লিখিত কারণগুলোর সাথে যোগ করেছেন বন্যার কথাও; অর্থাৎ আফগান দেশের বিরাজমান বিশেষ করে আর্থিক সঙ্কটের পেছনে একটি বড় কারণ হলো প্রাকৃতিক বিপর্যয়, যা এখন দেশটিতে মানবিক বিপর্যয়ের একটি বড় কারণ হতে চলেছে।

দেশটি একে তো গরিব, তদুপরি বিগত সরকারগুলোর অদক্ষতা, অসততা ও সঙ্কীর্ণতা, গোষ্ঠীপ্রীতি এ অবস্থার আরো অবনতি ঘটিয়েছে। বিশ্ব সংস্থার মতে, এখন আফগানিস্তানের প্রতি পরিবারেই অভাব অনটন এবং তারা খাদ্যের অভাবে দুর্গতির সম্মুখীন।

তাই কাতারের মতো ‘মার্কিনপন্থী’ দেশও বলছে, তালেবান হোক আর যে-ই হোক, আফগান সরকার থেকে সাহায্যদাতারা দূরে সরে গেলে তারা আরো হতাশ ও উগ্র হয়ে উঠবে। তাই কাতার বলেছে, আফগান রাষ্ট্রের জনগণের আন্তর্জাতিক সাহায্য পাওয়ার পথ খোলা রাখতে হবে। উল্লেখ্য, আমেরিকা (যুক্তরাষ্ট্র) আফগান সরকারি অর্থ থেকে এখন কাবুল সরকারকে বঞ্চিত রাখার পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ সে দেশে সাহায্য দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এমনকি তাদের প্রতিশ্রুত অর্থও যা কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলায় ব্যবহার্য ।

তালেবানকে নিয়ে একটি অস্বস্তি বা অস্থিরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এর বিভিন্ন কারণ রয়েছে। তালেবানের ঘোর ‘দুশমন’ থেকে দৃশ্যত ‘দোস্ত’ পর্যন্ত এ প্রবণতার শিকার। যারা একান্ত বিরোধী, তাদের সাফ কথা, ‘ওরা গণতন্ত্রের শত্রæ এবং মৌলবাদের বন্ধু। তালেবানরা উগ্র, গোঁড়া ও সাম্প্রদায়িক। তালেবান নারী-সংখ্যালঘু-সাংবাদিক কাউকে মানবাধিকার দেয় না।’ যারা তালেবানকে ব্যবহার করতে চায়, তাদের কথা হলো- “এরা মাথা গরম সশস্ত্র সংগঠন। তাই তাদের ‘ম্যানেজ’ করা না গেলে বিপদ ডেকে আনা হতে পারে।” এমনকি যারা আদর্শিকভাবে তালেবানের ঘনিষ্ঠ এবং যাদের ‘তালেবান সমর্থক’ বলে পরিচিতি রয়েছে, তারা বলে থাকেন, ‘এরা নিজেদের ইসলামের প্রতীক মনে করে এবং বাড়াবাড়ি করে ইসলামের জন্য দুর্নাম ডেকে এনেছে। তালেবান ভালো পরামর্শও নেয় না। তারা শত্রæ ও শুভাকাক্সক্ষীর মধ্যে পার্থক্য করতে জানে না।’ যে যেভাবে তালেবানকে দেখতে চান, তারা তা না হওয়াই- এসব দৃষ্টিভঙ্গির হেতু। এটি ঠিক, বিশ্বে ‘ইসলামপন্থী’ আছেন বহুলোক। কিন্তু তারা সন্ত্রাস, সহিংসতা কিংবা আত্মঘাতী হামলা অথবা নিরীহ নরনারী হতাহত করাকে সমর্থন করেন না। এটি সবারই বোঝা জরুরি বিশেষত মুসলিমবৈরী বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায়।

তালেবানের জন্ম ১৯৯৪ সালে। তখন কাবুলের চরম দুঃসময়। কারণ তদানীন্তন সোভিয়েত পরাশক্তিকে ঐক্যবদ্ধ যে শক্তি দীর্ঘ আট বছরের লড়াইয়ে হারিয়ে দিয়েছিল, সে মুজাহিদিনের রক্তাক্ত কোন্দল ও সহিংস হানাহানি কেবল তাদের ইমেজ ক্ষুণ্ন করা নয়, আফগান জনগণের ভবিষ্যৎই ধ্বংস করেছিল। এ সময়ে ১৯৯৬ সালে তালেবানরা রব্বানি বনাম হেকমতিয়ার দ্ব›দ্ব, বৃদ্ধ প্রেসিডেন্ট মোজাদ্দেদির ‘সাক্ষীগোপাল’ ভ‚মিকা আর আহমদ শাহ মাসুদের রহস্যময় অবস্থানের অবসান ঘটাতে এগিয়ে এসে আফগান জাতিকে আশাবাদী করে তোলে। তবে তারাও শেষাবধি জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয় এবং শেষ পর্যন্ত ২০০১ সালে মার্কিন হামলায় হলো বিতাড়িত। দৃশ্যত উগ্রতা ও সঙ্কীর্ণতা ছিল তালেবানের বৈশিষ্ট্য। এসব কারণে তারা মিডিয়াবান্ধব হয়নি কখনো। তালেবানের মধ্যে মিডিয়া উদারতা ও মানবাধিকারের বদলে ‘অন্য কিছু’ দেখতে পেয়েছিল, যার জের আজো অনেকটা রয়ে গেছে। দু’পক্ষের ব্যবধান আর কমেনি। এ জন্য মিডিয়ার গৎবাঁধা দৃষ্টিভঙ্গি এবং তালেবানের বিভ্রান্তিকর আচরণ-উভয়ই দায়ী।

এখন তালেবানবিরোধী প্রচারের মধ্যে টিভিতে তাদের নেতিবাচক খবরের সাথে ইতিবাচক ছবি এবং একই ফুটেজ দিনের পর দিন সম্প্রচার আর নিবন্ধের শিরোনাম ও তথ্যের অসামঞ্জস্য প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এ দিকে তালেবানের একজন শীর্ষনেতা আবদুল গনি বারাদারের রাজধানী কাবুল ত্যাগের ঘটনা শেষ পর্যন্ত তার ইহজগৎ ত্যাগের ‘খবর’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তালেবানরা বিশেষ করে পাঞ্জশিরে প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে অতীতের মতো। সেখানকার প্রচণ্ড সংঘর্ষে প্রতিপক্ষের সৈনিকদের সাথে বেশ কয়েকজন বেসামরিক লোক মারা যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এখন তালেবানের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ ব্যবহৃত হচ্ছে। একইভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে উত্তর সীমান্তের পাঞ্জশিরসহ বিভিন্ন স্থানের মহিলাদের মিছিলকে। তারা নারীদের অধিকার দাবি করে বিক্ষোভ করেছে।
তালেবানের অর্থ ছাত্র বা শিক্ষার্থী। হয়তো এ জন্য সবাই সুযোগ পেলেই তালেবানকে অনেক কিছু শেখাতে চায়। কবি তো অনেক আগেই বলে গেছেন, ‘বিশ্ব জোড়া পাঠশালা মোর, সবার আমি ছাত্র;/এই পৃথিবীর পাঠশালাতে শিখছি দিবারাত্র।’ খুব সম্ভবত এ কারণে
রেডিও-টিভি-নিউজপেপার মিলে দুনিয়ার মিডিয়া জগতও বসে নেই। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার চ্যানেলগুলো ও প্রিন্ট মিডিয়ার কাগজগুলো যথাসাধ্য তালেবানকে পরম জ্ঞানদানে চরম তৎপর। আর ‘তালেবানি মোল্লারা’ যাচিত-অযাচিত জ্ঞান পেতে পেতে ‘অজ্ঞান’ হয়ে যাচ্ছেন, তাই বোধহয় এত সতর্কবাণী, পরামর্শ, উপদেশেও তাদের ‘নট নড়ন চড়ন’। তালেবানের কাজ তালেবান করে চলেছে। আর মিডিয়াও তার ক্ষোভ-অসন্তোষে যতি টানছে না। বাংলাদেশের একজন প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও লেখক অনেক বছর আগেই বলে দিয়েছেন, ‘সাংবাদিকরাও একধরনের শিক্ষক।’ অনেকে বলছেন, তালেবানকে যত শিক্ষা দেয়া হয়েছে ও হচ্ছে, আমেরিকা-রাশিয়া-ভারত-চীনসহ অন্যদেরও মিডিয়া এমন শিক্ষা নিরন্তর দেয়া দরকার; অন্যথায় এটি হবে বিশেষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও পরিকল্পিত। প্রসঙ্গক্রমে বলছি, মার্শাল ম্যাকলুহান একজন কানাডিয়ান গণযোগাযোগ বিশেষজ্ঞ। তার একটি কথা অনেকটা এরকম- ‘মিডিয়া আইডিয়া কেবল পরিবেশন করে না, তারা এটি তৈরিও করেন।’ তালেবানের বেলায় দরকারে-বেদরকারে কেন এত আইডিয়া বিতরণ, তার অবশ্য কারণ কেউ খুলে বলেননি।

আফগানিস্তানে মূল্যস্ফীতি, দারিদ্র্য, তারল্য সঙ্কট মিলে অর্থনীতি ভেঙে পড়ার অবস্থায় বলে মিডিয়ার খবর। এ অবস্থায় দেশটির জনগণের প্রতি অমানবিক আচরণ সেখানে কেবল মানবিক বিপর্যয় ঘটাবে। আর এমন দুঃখজনক আচরণ করছে পাশ্চাত্যের কথিত প্রগতিশীল রাষ্ট্রগুলো এবং তাদের অনুসারী কয়েকটি ‘দাতা’ সংস্থা। এর দেখাদেখি আধুনিক অনেক বুদ্ধিজীবী এমন সব উক্তি করছেন; যা অর্থহীন, অযৌক্তিক ও হাস্যকর। যেমন- সেদিন ঢাকার এক টিভি চ্যানেলে একজন সিনিয়র ভার্সিটি শিক্ষক বিশেষজ্ঞের ভঙ্গিতে বললেন, ‘আফগানিস্তানে জঙ্গিরা এখন ক্ষমতায়। তা হলে মানবিক বিশ্ব কারা গড়বেন?’ কাবুলের বর্তমান ক্ষমতাসীনদের যদি ‘জঙ্গি’ ধরাও হয়, তা হলে কি সে সরকার ও দেশের প্রতি অমানবিক আচরণ ন্যায়সঙ্গত হতে পারে?

সরকারই দেশ চালায় এবং সে দেশের জনগণের কাছে পৌঁছার মাধ্যম এ সরকারই। তাই আফগানিস্তানের মানুষ বাঁচাতে কাবুল সরকারের ওপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় নেই। সে সরকার কোন দল বা কারা চালাচ্ছে, তা দেশটির ব্যাপার। আমরা বিদেশে বসে কেন সাহায্য বন্ধ করে তাদের নিয়ে রাজা উজির মারব? নিজেরা কতটা মানবিক ও সহৃদয়, তার হিসাব নিয়ে সংশোধিত হয়ে এরপর দরকার মতো তালেবানকে উপদেশ দিলে আপত্তির কারণ থাকে না। দেখতে হবে আমরা যে পূজারী, তা সর্বজনীন কতটা? নাকি তার প্রয়োগ একপাক্ষিক? সেটির নাম সুবিচার নয়; বঞ্চনা। কাতারের সে কথাই মনে করতে হয়, ‘আফগানিস্তানের এখন দরকার যোগাযোগ ও সাহায্য। তা না হলে সেখানকার মানুষ দুর্ভোগ পোহাবে।’


আরো সংবাদ



premium cement