২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০ পৌষ ১৪৩১, ২২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

প্লেটোর ‘নিকৃষ্ট’ গণতন্ত্র এবং ‘উৎকৃষ্ট’ রাজনীতি

-

মহামতি প্লেটো যে সময়টিতে গ্রিসের এথেন্স নগরীতে বাস করতেন সেই সময়টি নানা কারণে ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। পশ্চিমা দুনিয়া বলতে যা বোঝায় অথবা পাশ্চাত্যের ধনসম্পদ-আভিজাত্যের যে গর্ব তার পিতৃভ‚মি ছিল এথেন্স। পশ্চিমাদের ভাষা, সাহিত্য, রাজনীতি, শিক্ষা-দীক্ষা, অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর ওপর আধিপত্য লাভের কৌশল এবং যুদ্ধ বা বল প্রয়োগের রীতিনীতির সূতিকাগৃহ হিসেবে এথেন্সের যে নামডাক তার মূলে যে তিনজন দার্শনিককে কৃতিত্ব দেয়া হয় তাদের মধ্যমণি হলেন প্লেটো। তার ভুবনবিখ্যাত শিক্ষক সক্রেটিস এবং কালজয়ী ছাত্র অ্যারিস্টটল ছাড়াও তার প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় ‘অ্যাকাডেমি’র কারণে তিনি মানবজাতির ইতিহাসে একক ব্যক্তি হিসেবে যতটা সুখ্যাতি অর্জন করেছেন অমন সুনাম আর সুখ্যাতি অন্য কোনো দার্শনিকের ভাগ্যে জোটেনি।

প্রাচীন গ্রিসের এথেন্স নগরীর অত্যন্ত অভিজাত ও ধনাঢ্য পরিবারে ৩৪৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে তিনি যখন জন্মেছিলেন এবং জন্মের আশি বছর পর যখন তার মৃত্যু হয়েছিল তখন সেখানে এক অদ্ভুত গণতন্ত্র বহাল ছিল। এথেন্সের অভিজাত সমাজে তিনি ছিলেন যথেষ্ট প্রভাবশালী এবং গণতন্ত্রের নামে যারা দেশ শাসন করতেন তারা তাকে খুব সমীহ করতেন। তার পরও তিনি সারাটি জীবন গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলে গেছেন। তার সুবিখ্যাত দু’টি উক্তি- গণতন্ত্র হলো নিকৃষ্ট শাসনব্যবস্থা যেখানে মন্দ ও অযোগ্য লোকেরা অনায়াসে জাতির ঘাড়ে চেপে বসে উত্তম ও যোগ্য লোকদেরকে শাসন করার সুযোগ পায়। দ্বিতীয়, রাজনীতি করো; অন্যথায় তোমার চেয়ে অযোগ্য লোক তোমাকে শাসন করার কর্তৃত্ব পেয়ে যাবে।

প্লেটোর উল্লিখিত উক্তিগুলো নিয়ে হাজার বছর ধরে আলোচনা-সমালোচনা এবং তর্ক-বিতর্ক চলছে। প্লেটো কেনো গণতন্ত্রকে অপছন্দ করতেন, আবার অন্য দিকে রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণের পরামর্শ দিলেন তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার আগে তার সময়ের রাজনীতি এবং সামাজিক প্রেক্ষাপট নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা আবশ্যক। প্লেটোর জীবৎকালকে ঐতিহাসিকরা ‘হেলেনীয় সময়’ বলে অভিহিত করেন। পৃথিবীর সর্বকালের সেরা মহাকবি হোমার রচিত ইলিয়াড মহাকাব্যের নায়িকা হেলেনের নামানুসারে প্রাচীন ইউরোপের প্রায় এক হাজার বছর সময়কালকে হেলেনীয় সময় বলা হয়। ইতিহাসের এবং ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্ররা খুব ভালো করেই জানেন যে, ট্রোজান যুদ্ধের পটভ‚মি নিয়ে হোমার তার অনবদ্য সাহিত্যকর্ম ‘ইলিয়াড’ রচনা করেছিলেন।

খ্রিষ্টের জন্মের সাড়ে সাতশত বছর আগে হোমার বর্তমান তুরস্কের সেই এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন যেটির আদি নাম ছিল আয়োনিয়া। ধারণা করা হয়, হোমার জীবিকার সন্ধানে আয়োনিয়া ত্যাগ করে বর্তমান গ্রিসের নিয়ো দ্বীপে যান, যার ঐতিহাসিক নাম আইওস। হোমার রচিত ইলিয়াড প্রাচীন গ্রিসের দু’টি নগররাষ্ট্রের মধ্যকার যুদ্ধের বর্ণনা এবং সেই যুদ্ধের পরিণতিতে সমগ্র গ্রিসে রাজতন্ত্রের পরিবর্তে ধীরে ধীরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। সেই গণতন্ত্র আবার জুলিয়াস সিজার কর্তৃক রহিত এবং সিজার কর্তৃক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যে নতুন যুগের সৃষ্টি করে তার পূর্বপর্যন্ত সময়কালকে হেলেনীয় যুগ বলা হয়।

হোমার রচিত ইলিয়াডের নায়িকা হেলেন ছিলেন নগররাষ্ট্র স্পার্টার রাণী। তার স্বামী ও স্পার্টার শাসক মেনেলাউসের বন্ধু ছিলেন পার্শ্ববর্তী রাজ্য স্পার্টার যুবরাজ প্যারিস। মেনেলাউসের আমন্ত্রণে যুবরাজ প্যারিস স্পার্টায় বেড়াতে আসেন এবং বন্ধুপত্নী হেলেনার সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন। তার সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরে পৌঁছালে প্যারিস ও হেলেন রাতের আঁধারে জাহাজযোগে স্পার্টা থেকে পালিয়ে অজানা গন্তব্যে চলে যান। এই ঘটনা ঘটেছিল হোমারের জন্মের এক শ’ বছর আগে অর্থাৎ ৮৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। পরে ইতিহাসের জনক হিরোডোটাস যখন মিসরে গিয়েছিলেন তখন তিনি শুনতে পেয়েছিলেন যে, প্যারিস ও হেলেনকে বহনকারী জাহাজ মিসরের সমুদ্র উপক‚লে আশ্রয় নিয়েছিল এবং তৎকালীন ফেরাউনের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করে। কিন্তু শক্তিশালী স্পার্টা রাজ্যের সাথে একটি সম্ভাব্য রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এড়ানোর জন্য ফেরাউন ট্রয়ের যুবরাজ প্যারিস এবং তার প্রেমিকা হেলেনকে আশ্রয় না দিয়ে মিসর উপক‚ল ত্যাগ করার নির্দেশ দেন।

যুবরাজ প্যারিসের সঙ্গে হেলেনের পরকীয়া এবং পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা পুরো গ্রিক সাম্রাজ্যকে অস্থির করে তোলে। স্পার্টার হর্তাকর্তারা পরকীয়ার বিষয়টি চেপে যান এবং প্রচার করতে থাকেন যে, যুবরাজ প্যারিস বিশ্বাস ভঙ্গ করে এবং রাজকীয় নীতি নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে বন্ধুস্ত্রী হেলেনকে অপহরণ করে ট্রয় নগরীতে নিয়ে গেছেন। প্রাচীন দুনিয়ার রীতি অনুযায়ী, রাজা-রাণী ছিলেন একটি জাতিগোষ্ঠীর সম্মান এবং মর্যাদার প্রতীক। ভিনদেশী যুবরাজ কর্তৃক স্পার্টার রাণি অপহৃত হয়েছেন- এই খবর প্রচারিত হওয়ার পর পুরো স্পার্টাতে যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। অন্য দিকে স্পার্টার তুলনায় দুর্বল ও দরিদ্র রাষ্ট্র ছিল ট্রয়। সেখানকার রাজা এবং অভিজাতবর্গ প্রাণপণ চেষ্টা করেও স্পার্টার রাজাকে বুঝাতে পারলেন না, হেলেন ও প্যারিস পালিয়ে অন্যত্র চলে গেছে এবং তারা ট্রয়ে আসেনি। তদুপরি ট্রয়ের রাজা ও জনগণ যুবরাজ প্যারিসের অপকর্মের সঙ্গে জড়িত নয়। ট্রয় রাজ্যের সব ক‚টনৈতিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলো এবং ক্ষুব্ধ স্পার্টাবাসী ট্রয় নগরী আক্রমণ করে তা জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে একদম মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিলো।

হোমার রচিত ইলিয়াড মহাকাব্যের উল্লিখিত কাহিনীর সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব পাক-ভারতের দুই মহাকাব্য মহাভারত ও রামায়ণের মতোই হাজার হাজার বছর ধরে সংশ্লিষ্ট দেশ কাল ও সমাজকে নিদারুণভাবে প্রভাবিত করে আসছে। প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে রচিত রামায়ণ কিংবা মহাভারতের বিভিন্ন কাহিনী যেমন আজো ভারতবর্ষের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতির নিয়ামক হয়ে ওঠে, তেমনি হোমার রচিত ইলিয়াড মহাকাব্য ছাড়াও তার আরেক মহাকাব্য ‘ওডিসি’র কাহিনী হাজার হাজার বছর ধরে পুরো ইউরোপের রাজনীতি-অর্থনীতি ও সমাজনীতিকে প্রভাবিত করে আসছে।

বেশির ভাগ পশ্চিমা ঐতিহাসিক বর্ণনা করেছেন যে, হোমার রচিত ইলিয়াডের কাহিনীর কোনো ঐতিহাসিক দলিল নেই। একটি প্রাচীন যুদ্ধ যার নেপথ্য কাহিনীর কোনো ঐতিহাসিক দলিল নেই, সেই যুদ্ধের পটভ‚মি নিয়ে একজন অন্ধ কবি যিনি লিখতে এবং পড়তে পারেন না, তার মনগড়া কবিতার ছন্দে রচিত কাহিনী বা গল্পকথা কিভাবে প্রাচীন গ্রিসের রাজতন্ত্রের কবর রচনা করেছিল তা গবেষণা করলে আধুনিক দুনিয়ার মানুষ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়ে। রাজতন্ত্রের অধীনে রাজা যেভাবে নিজেদের ঈশ্বরের অবতার হিসেবে পরিচয় দিতেন তার সাথে যুবরাজ প্যারিসের কুকর্ম নিদারুণ সঙ্ঘাত সৃষ্টি করেছিল। অন্য দিকে স্পার্টার রাজার ক্রোধ এবং ট্রয়ের পতনের মধ্যে যে বিচারহীনতা, নির্মমতা, অমানবিকতা, এসব পাশবিকতাকে হোমার কবিতার ছন্দে এমনভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যার কারণে প্রাচীন গ্রিসে রাজতন্ত্রের পরিবর্তে গণতন্ত্র চালু হয়ে গিয়েছিল।

প্লেটো যে সময়ে গণতন্ত্র সম্পর্কে হতাশা ব্যক্ত করেছিলেন সেটি ছিল হেলেনীয় যুগের ক্রান্তিকাল এবং গণতন্ত্রের বিকৃত কর্মকাণ্ডের ‘মধুমাস’। এথেন্সের শাসকরা যেভাবে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগকে একত্র করে ইচ্ছেমতো প্রতিপক্ষের ওপর বিচারের নামে প্রহসন চালাতেন তা এর আগের রাজতন্ত্রে কখনো ঘটেনি। ফলে সমাজের বিবেকবান মানুষ বিশেষত দার্শনিকরা সাজানো গণতন্ত্রের কুফল নিয়ে সোচ্চার হতে থাকেন এবং প্লেটোর শিক্ষক সক্রেটিস তৎকালীন সমাজে তার মতামতের জন্য এতটাই প্রভাবশালী হয়ে পড়েন যে, তাকে মেরে ফেলার জন্য তৎকালীন শাসকরা মানবজাতির ইতিহাসের সর্ববৃহৎ বিচারিক প্রহসনের আয়োজন করেন।

সক্রেটিসের বিচারের জন্য যে বেঞ্চ স্থাপন করা হয়েছিল, সেখানে পাঁচশত বিচারক নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। পৃথিবী সৃষ্টির পর কোনো রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালতের পাঁচ শ’ বিচারক একজন আসামির মৃত্যুদণ্ড দেয়ার জন্য যুগপৎভাবে কাজ করেছেন, এমন নজির সক্রেটিসের বিচারকার্য ছাড়া দ্বিতীয়টি নেই। এত বড় প্রহসন যখন চলছিল ঠিক সেই সময়ে সক্রেটিসের ছাত্র প্লেটো সমাজের অতি উঁচুতলার প্রতিনিধি হওয়া সত্তে¡ও কিছুই করতে পারেননি। এ অবস্থায় সক্রেটিসের বিচার এবং অন্যায়ভাবে তাকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করার দৃশ্য দেখে প্লেটোর অন্তরাত্মা কথিত গণতন্ত্র সম্পর্কে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। তার লেখনী, বক্তব্য এবং মতামতের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী কয়েক দশকের মধ্যে গ্রিসে গণতন্ত্রের কবর রচিত হয় এবং প্রাক হেলেনীয় যুগের মতো রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।

আমরা আজকের নিবন্ধের একদম শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। এবার বলব, কেন ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এসে সর্বকালের অন্যতম সেরা দার্শনিকগুরু প্লেটোর কথা মনে পড়ল এবং তার অমিয় বাণীগুলোর মধ্যে গণতন্ত্র ও রাজনীতি নিয়ে তার বক্তব্য কেন আমায় এই সময়ে প্রভাবিত করছে। আপনারা যদি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক শাসনব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা এবং গণতন্ত্রের অগস্ত্যযাত্রার হালচাল নিয়ে তুলনামূলক বিচার বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করেন তবে আমার অস্থিরতা এবং আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে এথেন্স নগরীতে বসবাসরত মহামতি প্লেটোর মনোবেদনার চমৎকার একটি মিল খুঁজে পাবেন।

আজকের সমাজে যা হচ্ছে তা কিন্তু প্লেটোর সমাজে এতটা নির্মম, নিষ্ঠুর এবং উলঙ্গভাবে ঘটত না। হেলেন ও প্যারিসের পরকীয়াকে অনৈতিক এবং অবমাননাকর আখ্যা দিয়ে আজ থেকে তিন হাজার বছর আগে যেভাবে সমাজ, সংসার, রাষ্ট্র অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল তা আজকের কোনো দেশে কল্পনাও করা যায় না। এখনকার দুনিয়ায় পরকীয়া, অবাধ যৌনাচার, দুর্নীতি, লুটপাট এবং গুম, হত্যা, ধর্ষণ, ক্ষমতার দণ্ড বা ক্ষমতার হাতিয়াররূপে বিবেচিত হয়। আজকের সমাজে প্লেটো জীবিত থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে নিজের মতাদর্শের ছাত্রছাত্রী তৈরি করা তো দূরের কথা- ঘর থেকে বের হতে পারতেন না। এমনকি হঠাৎ হয়তো দালাল মিডিয়ায় এমন খবর বের হতো যে, ‘গহিন অরণ্যে প্লেটোর জঙ্গি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে অমুক বাহিনীর অভিযান। মদের বোতল, গাঁজার কৌটা, রামদায়ের হাতল, কুড়াল ধার করার শিলপাটা এবং জঙ্গি বইপুস্তকসহ প্লেটোকে তার সত্তরজন সহযোগীসহ গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার মূল সহচর অ্যারিস্টটলকে গ্রেফতার করা যায়নি। সে অভিযান পরিচালনাকারীদের চোখে বালিথেরাপি দিয়ে গণ্ডারের পিঠে সওয়ার হয়ে সিনেমাটিক কায়দায় গভীর জঙ্গলে পালিয়ে গেছে।’

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement