২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

একটি গান পাল্টে দিচ্ছে পুরো দৃশ্যপট

-

সেদিন শনিবার। জাতীয় প্রেস ক্লাবে জমেছিল দীর্ঘ আড্ডা। আমার চরিত্র আড্ডার পক্ষে খুব সুবিধার নয়। মুখে সহজে কথা সরে না। তবে সেখানে এক সাংবাদিক কবি ছিলেন, কথা বলায় যিনি একাই এক শ’। যেমন তার বিরতিহীন মুখে উঠে আসে সংস্কৃতি জগতের অনেক জানা অজানা তথ্য, তেমনি তার কান গরম করা চুটকিতে ছোটে হাসির হররা।

সেই আড্ডারই এক পর্যায়ে একটি গানের প্রসঙ্গ ওঠে। কবি বলেন, একটি গান দিয়েই এবার পশ্চিমবঙ্গ মাতিয়ে দিয়েছে মুসলমানরা। গানটির শিরোনাম শুনে নিলাম কবির কাছ থেকে। ‘ছেড়ে দে নৌকা মাঝি, যাব মদিনা।’ আরেক সাংবাদিক জানালেন, মমতা তো এবার জিতেছে মুসলমানদের ভোটেই। এর পেছনে মুসলমানদের উৎসাহিত করেছে এই গান। কবি জানালেন, গত মাস কয়েক ধরে পশ্চিমবঙ্গে নাকি রীতিমতো জোয়ার তুলেছে গানটি। খুব কৌত‚হল হলো গানটির ব্যাপারে।

বাসায় ফিরে সন্ধ্যায় বসে গেলাম ডেস্কটপে। কানে হেডফোন, মনিটরে ইউটিউব। তার আগে গুগল করে জেনে নিয়েছি গানের বাণী এবং গীতিকারের নাম। এ নিয়ে বিস্তারে যাওয়ার আগে বলে নিই গানটি কতটা জোয়ার তুলেছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে। না, শুধু মুসলমান নয়। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবারই কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে এ গান। যে হিন্দু সম্প্রদায় নিজেদের উত্তমর্ণ বিবেচনায় অধমর্ণ হচ্ছে যৌবনের ছোঁয়া বাঁচাতে, তাদেরই কথিত বঙ্গমাতার অঙ্গছেদন করতে দ্বিধা করেনি, সেই তাদেরই কণ্ঠে ‘মুচলমানের’ গান কেমন এক আজব ব্যাপার মনে হলো। কিন্তু আসলে অবাক হওয়ার মতো কিছু এতে নেই। সে কথায় পরে আসছি।

পশ্চিমবঙ্গ মাতিয়ে দেয়া গানটি ইউটিউবে পাওয়া যাবে ‘দে দে পাল তুলে দে’ এই শিরোনামে সার্চ দিলে। এই নামেই শত শত শিল্পী গানটি অবিরাম গেয়ে যাচ্ছেন। যেমন ফোক গানের শিল্পীরা তেমনি আধুনিক ব্যান্ড গানের মঞ্চ কাঁপানো শিল্পীরাও। গানের বাণী বা কথাগুলো না জানলে বুঝতে পারবেন না কেন একটি গান নিয়ে এত কথা। কথাগুলো এরকম : “দে, দে, পাল তুলে দে/ও মাঝি হেলা করিস না/ছেড়ে দে নৌকা মাঝি, যাবো মদিনা। দুনিয়ায় নবী এলো মা আমিনার ঘরে/হাসিলে হাজার মানিক, কাঁদিলেও মুক্তা ঝরে/দয়াল মুর্শিদ যার সহায়/তার কিসের ভাবনা/হৃদয় মাঝে কা’বা, নয়নে মদিনা...”

বাউল ফকিরের গান এটি। মরমি শিল্পীদের প্রিয়। সেই সূত্রেই গানটি বাউল সাধুদের কণ্ঠে ভেসে চলে গেছে ভারতে। খুঁজে দেখলাম, কয়েক মাস নয়, তিন-চার বছর ধরে গানটি পরিবেশিত হচ্ছে ওই রাজ্যের নানা প্রান্তে। নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। কোনো সরকারি দফতরের অফিসার্স ক্লাবের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে, কোনো স্কুলের কালচারাল ফাংশনে, গ্রামের কোনো যুবসংঘের বার্ষিক প্রোগ্রামে, এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামের শ্যামা পূজার অনুষ্ঠানে পর্যন্ত। কোথাও জি বাংলা টিভি চ্যানেলের সারেগামাপা সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পাওয়া শিশুশিল্পী অঙ্কিতা ও তার মা দ্বৈতকণ্ঠে পরিবেশন করছে এই গান; কোথাওবা রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে কবিগুরুর বৃহদাকৃতির ছবি পেছনে রেখে দর্শকদের সঙ্গে নিয়ে সমস্বরে গাইছেন কোনো আমন্ত্রিত শিল্পী, “আমার হৃদয় মাঝে কা’বা, নয়নে মদিনা।” মহানামযজ্ঞ মহোৎসব ও লীলাকীর্তনের অনুষ্ঠানে শিল্পীরা শ্রোতারা কণ্ঠ মিলিয়ে গাইছেন, ‘দুনিয়ায় নবী এলো, মা আমিনার ঘরে/নবী হাসিলে হাজার মানিক, কাঁদিলেও মুক্তা ঝরে/দয়াল মুর্শিদ যার সহায়, তার কিসের ভাবনা/ছেড়ে দে নৌকা মাঝি, যাবো মদিনা।’

এক তরুণী শিল্পী মুসলমান বান্ধবীর অনুরোধে মঞ্চে দাঁড়িয়ে শরীর দুলিয়ে নেচে নেচে গানটি গাইছেন। লোকগানের এক খ্যাতনামা শিল্পী তো মঞ্চে এই গান পরিবেশনের আগে একটি কাহিনীই শুনিয়ে দিলেন। তিনি কলকাতা থেকে উবারের ট্যাক্সি ধরেছেন কোথাও যাওয়ার জন্য। স্বভাব মতোই হরির বন্দনামূলক কোনো গানের সুর ভাঁজছিলেন গুনগুনিয়ে। সে গান শুনে ট্যাক্সির ড্রাইভার সবিনয়ে অনুমতি নিয়ে অনেকটা কুণ্ঠার সঙ্গেই শিল্পীর কাছে জানতে চাইল, দিদি, আপনি তো শিল্পী, একটা কথা বলি; আপনি যে মুখে হরিনাম নিচ্ছেন সেই মুখে আল্লাহর নাম নিতে পারবেন? শিল্পী প্রথমে খুব হাসলেন। তারপর ট্যাক্সির ভেতরেই ড্রাইভারকে উদ্দেশ করে গান ধরলেন, “দয়াল মুর্শিদ যার সহায়/তার কিসের ভাবনা/হৃদয় মাঝে কা’বা, নয়নে মদিনা...।” এই শিল্পী হলেন পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত লোকশিল্পী পৌষালী ব্যানার্জি। পৌষালী মঞ্চে গানটি গাইবার আগে বললেন, সুর তো আদতে একটাই। কেউ হরি বলি, কেউ আল্লা বলি, কিন্তু সুর তো ওই একটাই, ওই একজনেরই।

পৌষালীর বক্তব্যে লোকজ ও বাউল বিশ্বাসের প্রতিধ্বনি আছে। সেটা তাদের, থাকুক। আমার মনে হয়েছে, গানটি সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও শুদ্ধ মেজাজে গেয়েছেন নদীয়ার নবদ্বীপের বাউল শিল্পী বাসুদেব রাজবংশী। গানের শুরুতে আল্লা, আল্লা ধ্বনি দিচ্ছেন অনেকটা জিকিরের ধরনে, ভাবের আবেশে চোখ উল্টে ফেলার ভঙ্গি করছেন, গানের কথার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেন সত্যিই মুর্শিদের পায়ে বিগলিত হয়ে পড়ছেন। সেই অতুলনীয় গায়কী না দেখলে বোঝানো কঠিন।

আমরা গানটি সম্পর্কে আরো কিছু জেনে নিই। গুগলে ব্রাউজ করে প্রথমে যে গীতিকার ও শিল্পীর নাম পাই, পরে দেখি সেটি ভুল। সে নাম উহ্যই থাকুক। ভুল তথ্য জানার কোনো মানে হয় না। গানটির মূল শিল্পীর নাম শুনলে অবাক হবেন। তিনি আমাদের অতি ঘনিষ্ঠ ও আপনজন, ফকির আবদুর রহমান বয়াতি। সঙ্গীতশিল্পী রহমান বয়াতিকে যদি কেউ না চেনেন তাহলে তিনি দুর্ভাগা। তার সেই দেশ কাঁপানো গানটি নিশ্চয়ই অনেকের মনে থাকার কথা। ‘মন আমার দেহঘড়ি, সন্ধান করি কোন মিস্তরি বানায়াছে/একখান চাবি মাইরা দিছে ছাইড়া, জনম ভর চলতে আছে।’

সেই আবদুর রহমান বয়াতি আজকের আলোচিত গানটি অর্থাৎ ‘ছেড়ে দে নৌকা মাঝি’, ঠিক কোন সময়ে গেয়েছেন আমরা জানি না। ইউটিউবে তার গাওয়া এই গানের ভিডিওটি ২০১১ সালের। এই মুহূর্তে বিপুল জনপ্রিয়তা পাওয়া গানটির বাণী আবদুর রহমান বয়াতির বাণী থেকে সামান্য আলাদা। ‘আমার হৃদয় মাঝে কা’বা, নয়নে মদিনা’ এই সুনিপুণ আধুনিক কবিসুলভ বাক্যটি বয়াতির গানে নেই। আছে ভিন্ন কিছু কথা। কিন্তু আরেকজন বিখ্যাত বাউল যিনি ‘তোমার দিল কি দয়া হয় না’ গানের জন্য গোটা উপমহাদেশে স্বনামখ্যাত, ভারতের সেই পবন দাস বাউলের কণ্ঠে এই বাক্যটি প্রথম পাচ্ছি। সেটি ইউটিউবে আপলোড দেয়া হয়েছে ২০১৫ সালে।

এরপর বাউল তথা লোকজ গানের শিল্পীদের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী অসংখ্য বাউল, সাধু, গায়ক, আধুনিক শিল্পী ও ব্যান্ড দল এই ‘ছেড়ে দে নৌকা মাঝি’ গেয়েছেন। তারা সবাই অনলাইনে ভিডিও দিয়েছেন। গানের অনেক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গানটি বিভিন্ন শিল্পীকে দিয়ে পরিবেশন করিয়ে পোস্ট করেছে নিজেদের ইউটিউব চ্যানেলে এবং সঙ্গীত প্লাটফরমে। অ্যাপল মিউজিক, অ্যামাজন, স্পুটিফাই, লিডেল, ডিওজার, গানাসহ অসংখ্য প্লাটফরমে গানটি পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি নিউ ইয়র্কের কাইনেটিক মিউজিকও এক অখ্যাত বাংলাদেশীর গাওয়া এই গানের রিমেকের বিপণন করছে। এসব ভিডিওর সঙ্গে যেসব ছবি দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে আছে মরূদ্যান, মাটির বাড়িঘরসহ প্রাচীন মদিনার দৃশ্য, পবিত্র কা’বা শরিফ, নবীজি সা:-এর রওজা মুবারক, পৃথিবীর সব সুদৃশ্য মসজিদ, পবিত্র হারাম শরিফ, খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি রহ্:-এর মাজার, হজের এবং কা’বা ঘর তাওয়াফের দৃশ্য। কোথাও স্কুলের বাচ্চারা টুপি, পাজামা-পাঞ্জাবি পরে নেচে নেচে গানটি গেয়েছে, কোথাও কওমি মাদরাসার হুজুররা গেয়েছেন, কোথাও মডার্ন মেয়েরা দলীয় নাচের সঙ্গে গেয়েছেন। সব মিলিয়ে এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য, অবিশ্বাস্য প্লাবন।

বাংলাদেশে শফি মণ্ডল থেকে শুরু করে বিন্দু কণা পর্যন্ত কত শিল্পী যে গেয়েছেন, ইয়ত্তা নেই। নোবেল, আশিক, সানিয়া, রোমাসহ অসংখ্য শিল্পী ও ব্যান্ডের নাম বলতে গেলে ব্যাপারটা বিরক্তিকর হয়ে যাবে। যাই হোক, শিল্পীরা একটি ভালো গান অনেকে গেয়ে থাকেন। এতে অভিনবত্ব কিছু নেই। তারা রাধাকৃষ্ণের গান যেমন করেন তেমনি আল্লাহ রাসূল সা:কে নিয়েও একইভাবে গান করেন। এজন্য কেউ বলতেই পারেন, আমার আপনার খুশি হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু আমি নিজে খুশি। মুসলমানদের যে সংস্কৃতি বলে কিছু একটা আছে সা¤প্রতিককালে দেশের পরিস্থিতি দেখে সেটি বোঝার উপায় নেই। সাংস্কৃতিক কর্মীরা কেউ কেউ বেদের স্তোত্র গেয়ে তাদের অনুষ্ঠান শুরু করছেন। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে মুসলিম পরিচিতি নিশ্চিহ্নপ্রায়। এমনই পরিস্থিতিতে এই একটি গান যে কাজটি করেছে, তার গুরুত্ব বোঝার মতো মেধা আমাদের ইসলামী রাজনীতির ধারকবাহকদের আছে কিনা সন্দেহ। কিন্তু আমরা বলতে চাই, লক্ষ কোটি টাকা ব্যয় করেও সা¤প্রদায়িক হিন্দুর মুখে আল্লাহ, নবীর নাম তুলে দেয়ার এই কাজটি কেউ করতে পারতেন না।

আমাদের দেশ বাউল ফকিরের দেশ। লালন, হাছন থেকে শুরু করে রাধারমণ, শাহ আবদুল করিম পর্যন্ত সুদীর্ঘ এই ধারা। মুসলমানের এই বাংলাদেশে এমন একটি গান জনপ্রিয় হতেই পারে যেমন হয়ে এসেছে যুগে যুগে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে কেমন করে হলো? সেটাই আশ্চর্য।

বিশ্বজুড়ে ইসলামী সঙ্গীতের বিকাশ বিষয়ে আগের এক লেখায় বলেছিলাম, ‘বছরের পর বছর ওয়াজ করে যে ফল পাওয়া যায়, তার চেয়ে একটি গানের মাহফিল বেশি কার্যকর হতে পারে তরুণদের উদ্বুদ্ধ করতে।’ বলেছিলাম, ‘যারা বাদ্য ছাড়া গান করছেন, তারা আসলে ভিত বা ফাউন্ডেশন তৈরি না করেই বহুতল ভবন তৈরি করার ব্যর্থ কোশেশ করছেন মাত্র।’ এখন দেখা যাচ্ছে, দেশের ইসলামী সঙ্গীতের গ্রæপগুলো যা করতে পারেনি, আমাদের বাউল, ফকিররা সেই কাজটি করে দিয়েছেন। ইসলামী অনুষঙ্গ যে মানুষের হৃদয়ে অনুরণন তুলতে সক্ষম এবং তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে এই গান তা প্রমাণ করেছে। একটি সঙ্গীত পাল্টে দিচ্ছে রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের পুরো অসুস্থ দৃশ্যপট। এর সুফল সুদূরপ্রসারী হবে।

আমরা ফকির আবদুর রহমান বয়াতিসহ সব লোকশিল্পী এবং যারা এই গানটি জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন তাদের সবাইকে গভীর শ্রদ্ধা জানাই, জানাই শত সালাম।

[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement