২১ নভেম্বর ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : জাতীয় উন্মেষের বেদিমূল

- ফাইল ছবি

‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’- দুই শব্দের এ জাদুকরী নামটি শুধু একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়। এটি একটি সমৃদ্ধ ইতিহাসের প্রোজ্জ্বল পাতা, এ জাতির উন্মেষের যাত্রা বিন্দু, একটি দেশের গোড়াপত্তনের সূচনা, অস্তিত্বের তিলক, আমাদের স্বাধিকার-স্বাধীনতার বেদিমূল, জাতির বিবেক। পৃথিবীতে আর কোনো প্রতিষ্ঠানকে কখনো একসাথে এতগুলো দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হয়েছিল কি না, আমার জানা নেই। শতবর্ষ আগে একটি জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক অধিকারের আবরণে যে প্রতিষ্ঠানের জন্ম, সেটি যে এত সুবিশাল দিগন্ত প্রসারিত এক মহীরুহের রূপ নেবে তা কখনো কেউ কি ভাবতে পেরেছিল? হয়তো পেরেছিল, হয়তো বা পারেনি। তাতে কী আসে-যায়? তার জন্য কি কিছু থেমে রয়েছে? প্রতিষ্ঠানটি তো জাতিকে দিয়েই চলেছে অর্জনের পাতা ভরে।

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রাম যখন তুঙ্গে, তখন এ দেশের নির্যাতিত নিগৃহীত মুসলিম সম্প্রদায় নিজেদের অধিকার নিজেদের মতো করে ভোগ করার সুবিধার্থে বাংলার বিভক্তি চাইল। এটি গণমানুষের সুতীব্র দাবিতে পরিণত হলো। তখন বাধ্য হয়ে ব্রিটিশ সরকার ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা করল- ঢাকাকেন্দ্রিক পূর্ববঙ্গ আর কলকাতাকেন্দ্রিক পশ্চিমবঙ্গ। আর যায় কোথায়? এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলল একটি সম্প্রদায়। এ প্রতিরোধ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ল পুরো বঙ্গীয় হিন্দু সম্প্রদায়। বাদ যাননি পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী বঙ্কিম চন্দ্র, শরৎচন্দ্র এমনকি বিশ্বকবি। বঙ্গভঙ্গে তাদের কী অসুবিধা? তাদের কোনোই অসুবিধা নেই। তবে সুবিধা হতো পূর্ববঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায়ের। আর মুসলমানদের এ সুবিধাটুকু প্রাপ্তিও তাদের পছন্দ হচ্ছিল না, এমনকি হিন্দু বুদ্ধিজীবীদেরও না। তাদের প্রতিবাদ প্রতিরোধে মুসলমানদের মনে এ ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেল যে, ‘বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্ববঙ্গের পশ্চাৎপদ মুসলমান সম্প্রদায়কে শাসন-শোষণের সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে’। এ চিন্তাই তাদের পেয়ে বসে। আর তো কোনো কারণ নেই। ভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতিবাদের ধরন মুসলমানদের বেশ ভাবিয়ে তুলল। তাই হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিবাদের মুখে ব্রিটিশ সরকার যখন পৃষ্ঠ-প্রদর্শন করল, তাদের প্রতিশ্রæতি থেকে সরে গিয়ে ১৯১১ সালে আবার বঙ্গভঙ্গ রদ করে দেয়; তখন পূর্ববঙ্গের মুসলিম সম্প্রদায় সত্যিই ভেঙে পড়ে। যে দিন এ ঘোষণা এলো সে মুহূর্তে ঘোষণাটি শুনে মুসলিম সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান নেতা ও বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের রূপকার নবাব সলিমুল্লাহ সাথে সাথে নাকি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এ পর্যায়ে মুসলমানদের ক্ষোভ প্রশমনের জন্য ব্রিটিশ সরকার ‘কিছু একটা করার’ চিন্তাভাবনা শুরু করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ও ধনবাড়ির নবাব নওয়াব আলী চৌধুরীর প্রস্তাবের ভিত্তিতে ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১২ সালে পূর্ববঙ্গের অনগ্রসর মুসলিম সম্প্রদায়ের উচ্চশিক্ষার জন্য নাথান রিপোর্ট অনুসারে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনার ঘোষণা দেন। এ উদ্যোগেরও বিরোধিতা করলেন কলকাতার এলিটরা। তবে তা আর টিকল না। সরকারের ঘোষণার বাস্তবায়ন ঘটে ১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। নওয়াব সলিমুল্লাহ এতই আন্তরিক ছিলেন যে, ঢাকার নওয়াবী শাসন প্রায় অস্তমিত থাকলেও তিনি নবাব পরিবারের বিশাল ভ‚সম্পত্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য দান করে দেন। ঢাকা শহরে দক্ষিণে ফুলবাড়িয়া থেকে উত্তরে গ্রিন রোড এবং পূর্বে ইডেন বিল্ডিং (বর্তমানে সচিবালয়) থেকে পশ্চিমে আজিমপুর পর্যন্ত বিশাল এলাকার প্রায় ৬০০ একর জমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য দান করা হয়। পরে এ জায়গার একটি বড় অংশ রেলওয়েসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থার দখলে চলে যায়। এর পরও যে ২৭৫ একর জায়গা এখনো অবশিষ্ট আছে তাতে ১৪০টি বিভাগ ও ইনস্টিটিউট সমৃদ্ধ সুবিশাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই চলছে।

নওয়াব পরিবার প্রদত্ত বিশাল এলাকায় যাত্রা শুরু করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রারম্ভিক কর্মকাণ্ড ছিল খুবই ক্ষুদ্র অবয়বে। তিনটি অনুষদের অধীনে মাত্র ১২টি বিভাগ। মানবিক অনুষদে সংস্কৃত-বাংলা, ইংরেজি, আরবি, দর্শন, ইতিহাস, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও উর্দু-ফারসি এ আটটি বিভাগ। বিজ্ঞান অনুষদে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও গণিত বিভাগ এবং আইন অনুষদে শুধুই আইন বিভাগ। ১৯২১ সালে সূচনালগ্নে সর্বমোট মাত্র ৬০ জন শিক্ষক, ৮৫০ জন শিক্ষার্থী এবং সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ঢাকা হল ও জগন্নাথ হলে ৬৫০ জন আবাসিক ছাত্র নিয়ে শুরু হয়েছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম। এর পরের ইতিহাস অর্থাৎ শতবর্ষী এ প্রতিষ্ঠান আজ যে বিশাল মহীরুহের অবয়ব লাভ করেছে, তার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সময়ে কর্মরত শিক্ষক সমাজের এবং নিঃসন্দেহে কিংবদন্তিতুল্য সম্মানিত উপাচার্যদের। যে উপাচার্যের হাত ধরে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পথচলা শুরু, তিনি হলেন স্যার ফিলিপ হার্টগ। ছিলেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক রেজিস্ট্রার। পাঁচ বছরের অসম্ভব পরিশ্রমের পর তিনি যখন অবসরে গেলেন, তখন বিশ্ববিদ্যালয়টি মোটামুটি একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে। তার পর একে একে এলেন জর্জ এইচ ল্যাংলি, স্যার এ এফ রহমান, রমেশ চন্দ্র মজুমদার, মাহমুদ হোসেন, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন, ডবিøউ এ জেংকিনস, বিচারপতি মোহাম্মদ ইব্রাহিম, বিচারপতি হামুদুর রহমান, মাহমুদ হোসেন, ড. মো: ওসমান গণি, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, মোজাফফর আহমদ চৌধুরী (গঅঈ), আবদুল মতিন চৌধুরী, শামসুল হক (পদার্থবিজ্ঞান), ফজলুল হালিম চৌধুরী, এ কে এম সিদ্দিক, শামসউল হক (সাবেক ডিপিআই এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী), আবদুল মান্নান, মনিরুজ্জামান মিয়া, এমাজউদ্দিন আহমদ, এ কে আজাদ চৌধুরী, আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী, এস এম এ ফায়েজ, আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ও সর্বশেষ বর্তমানে মুহম্মদ আখতারুজ্জামান। অসংখ্য স্বনামধন্য শিক্ষকের মধ্যে কয়েকজন কিংবদন্তিতুল্য ব্যক্তিত্ব হলেন ইতিহাসবিদ প্রফেসর রমেশ চন্দ্র মজুমদার, নরেশ সেন গুপ্ত, প্রফেসর নলিনী বসু, প্রফেসর হরিপ্রসাদ ভট্টাচার্য, মহামহোপাধ্যায় প্রফেসর হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ‘আইনস্টাইন-বোস তত্ত¡’খ্যাত প্রফেসর সত্যেন বোস, বিশ^নন্দিত বিদ্যাপীঠ আইআইটি খড়গপুরের (ভারত) প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর জ্ঞান চন্দ্র ঘোষ, ড. মন্মথ নাথ ঘোষ, জ্ঞান তাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী মোতাহার হোসেন, মুনীর চৌধুরী, ড. জি সি দেব, প্রফেসর মোকাররম হোসেন খোন্দকার প্রমুখ। এদেরই কর্মযজ্ঞের ফসল হলো আজকের বিশাল মহীরুহসম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমান ১৩টি অনুষদের অধীনে ৮৫টি বিভাগ, ১২টি ইনস্টিটিউট, ৫৬টি ব্যুরো ও সেন্টারসমৃদ্ধ এ প্রতিষ্ঠানে রয়েছে প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষার্থী ও দুই সহস্রাধিক শিক্ষক; ২০টি ছাত্রনিবাস ও তিনটি হোস্টেল। এর কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যাও কম নয়, প্রায় পাঁচ হাজার।

একসময়ের ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিনা কারণে এ নামটি অর্জন করেনি। এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবন গঠনে এ প্রতিষ্ঠান অনন্য ভ‚মিকা পালন করেছে। আর তার পেছনে রয়েছে অভিজ্ঞতাসিক্ত প্রবীণ সব শিক্ষকের সাথে যৌবনদীপ্ত কর্মোদ্যমী শিক্ষকদের মেধা ও নির্মোহ নিবেদিত প্রাণ দায়িত্ব পালন। যে প্রফেসর জ্ঞান ঘোষ ভারতের বিশ্বখ্যাত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান আইআইটি প্রতিষ্ঠা করে স্মরণীয় হয়ে আছেন, তিনি মাত্র ২৯ বছর বয়সে লন্ডন থেকে সরাসরি এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন রসায়ন বিভাগে পূর্ণ প্রফেসর ও পরে বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের সাথে কাজ করে বোস-আইনস্টাইন থিওরির উদ্ভাবক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছেন প্রফেসর সত্যেন বোস। তিনিও যখন পদার্থবিদ্যা বিভাগে প্রফেসর হয়েছিলেন, তখন তার বয়স ৩৫-ও পেরোয়নি। একইভাবে কিংবদন্তি ইতিহাসবিদ প্রফেসর রমেশ চন্দ্র মজুমদার মাত্র ৩৩ বছর বয়সে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে যখন এখানে যোগ দিলেন, তখন তিনি পূর্ণ প্রফেসর ও পরে ডিন হয়েছিলেন। আর ৪৫ বছর বয়সে তিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় সব ভারতীয় প্রখ্যাত শিক্ষক এ বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে ভারত চলে গেলে তীব্র শিক্ষক সঙ্কট সৃষ্ট হয়েছিল। তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেনের মতো এক অসামান্য দক্ষ ও পরিশ্রমী ব্যক্তিত্ব না থাকলে হয়তো এ বিশ্ববিদ্যালয় মুখ থুবড়ে পড়ত। দ্বারে দ্বারে ঘুরে সৈয়দ আলী আহসান, সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েনের মতো শিক্ষকদের সংগ্রহ করে তিনি পরিস্থিতি সামাল দিয়েছিলেন অসাধারণ কৃতিত্বের সাথে। একইভাবে এ বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনের আজকের যেসব প্রাচীন অবকাঠামো দেখা যায়, তার প্রায় সবই রয়েছে দূরদর্শী ভাইস চ্যান্সেলর ড. মাহমুদ হোসেনের ছোঁয়া।

আরো বহু বিদগ্ধ শিক্ষক এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মানকে অভ‚তপূর্ব উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। তারা যেমনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী তেমনি অভাবনীয় নিষ্ঠাবান ও নির্লোভ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের ছাত্র অমিয় দাসগুপ্ত ১৯২৪ সালে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে মাত্র ১২৫ টাকা মাসিক বেতনে লেকচারার হিসেবে ডিপার্টমেন্টে জয়েন করলেন; যদিও ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে ২৫০ টাকা বেতনে দাপট ও বিত্তবৈভবে তিনি সরকারি ক্লাস ওয়ান চাকরি করতে পারতেন, কিন্তু শিক্ষকতাই পছন্দ করলেন। একই পদে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত ১৬ বছর কাটিয়ে দিলেন, টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করেননি। এমনকি বেঙ্গল গভর্নমেন্ট হঠাৎ করে ৯৫০ টাকার অস্বাভাবিক উচ্চ বেতনে তাকে কৃষি মন্ত্রণালয়ে অ্যাডভাইজার হিসেবে নিয়ে গেলেও তিনি আবার দেড় বছরের মাথায় ১৯৪১ সালের শেষ দিকে একই পদে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় ফিরে এলেন। কী অসাধারণ শিক্ষাপ্রীতি! একইভাবে এক আত্মনিবেদিত ব্যক্তিত্ব প্রফেসর কাজী মোতাহার হোসেন ১৯২১ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত মাত্র ২০০ টাকা মাসিক বেতনে লেকচারার হিসেবে ২৫টি বছর নীরবে নিঃশব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত-পরিসংখ্যান বিভাগে পড়িয়ে গেছেন। সত্যেন বোস, জ্ঞান চন্দ্র ঘোষ, এস কে দে, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রমেশ মজুমদার, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, এ এফ রহমানের মতো সব কৃতী ব্যক্তি কী হিমালয়সদৃশ উচ্চতার শিক্ষক ছিলেন, তা আজ কাউকে বলে বোঝানো যাবে না। আমার ছাত্রজীবনে ১৯৬৭-৭২ সাল পর্যন্ত যেসব কীর্তিমান মহাজ্ঞানী শিক্ষকের সাহচর্যে সরাসরি এসেছি ও পাঠ গ্রহণ করেছি যেমন আমার নিজের রসায়ন বিভাগের প্রফেসর মোকাররম হোসেন খোন্দকার, প্রফেসর মফিজ উদ্দিন আহমদ, প্রফেসর এস জেড হায়দার, প্রফেসর আলী নওয়াব, প্রফেসর মাহবুবুল হক এবং পদার্থবিদ্যার প্রফেসর ইন্নাস আলী, ড. আবদুল মতিন চৌধুরী অথবা চার পাশে প্রতিদিন দেখেছি ক্যাম্পাসে অন্যান্য বিভাগের শিক্ষক যেমন প্রাণরসায়নের প্রফেসর কামাল উদ্দিন আহমদ, অর্থনীতির ড. এম এন হুদা, বাংলার মুহম্মদ আবদুল হাই, ইংরেজির প্রফেসর সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মোজাফ্ফর আহমেদ চৌধুরী, জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক- তাদের জ্ঞানের পরিধি, কথা বলার ঢঙ, ব্যক্তিত্ব যেন আজো চোখের সামনে সেই দিনের মতোই জীবন্ত। স্মরণ করলে শ্রদ্ধায় মন নুয়ে আসে। এদের পাঠদানের যে অসাধারণ পদ্ধতি-বাচনভঙ্গি দেখেছি, তা নিজের শিক্ষকতা জীবনে অনুসরণ করার চেষ্টা করেছি। আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক প্রফেসর মফিজ উদ্দিন আহমদ, প্রফেসর মাহবুবুল হক, ড. মহিবুর রহমান বা পদার্থবিদ্যার প্রফেসর মুহাম্মদ ইবরাহিম কিভাবে যে মনের অজান্তেই আমার শিক্ষকতা জীবনের পথিকৃত হয়ে গিয়েছিলেন, তা টের পেতে বেশি দেরি হয়নি।

আমাদের এ প্রিয় আলমামেটার তার এ শতবর্ষী পথপরিক্রমায় কত যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পুরোধার জন্ম দিয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে আবার এখানেই শিক্ষকতায় নিয়োজিত হয়েছেন যারা, সে সংখ্যাও অনেক। তবে এর বাইরের সংখ্যাটিও ততোধিক বিপুল। নোবেলবিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস, পাকিস্তানের ডন পত্রিকার দীর্ঘকালের সম্পাদক আলতাফ হোসেন, আধুনিক বিশ্বে স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পথিকৃত বিশ্ববিখ্যাত স্থপতি ফজলুর রহমান খান (এফ আর খান), কবি বুদ্ধদেব বসু, ক‚টনীতিক আবুল ফতেহ, রসায়নবিদ ও আর্সেনিক-ফিল্টারের উদ্ভাবক এবং বর্তমানে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ম্যাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর আবুল হোসাম, জহির রায়হান, হুমায়ূন আহমেদ, প্রফেসর আবদুল্লাহ আবু সায়ীদসহ এ দেশের প্রায় সব প্রখ্যাত রাজনীতিক, প্রশাসনিক কর্ণধার, ব্যবসায়িক ব্যক্তিত্বসহ বিভিন্ন প্রতিভাবানদের বেশির ভাগই এ স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানেরই ‘প্রোডাক্ট’।

যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধুই একটি প্রতিষ্ঠান নয়। এটি ইতিহাসের একটি বাঁক, একটি জাতির উত্থানের বেদিমূল। এ অঞ্চলের একটি বিশাল জনগোষ্ঠী যখন শিক্ষার অভাবে শুধু পিছিয়ে পড়ছিল, প্রায় অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল; তখনই দৃশ্যপটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবির্ভাব যেন ধ্রুবতারার মতো। এ অঞ্চলের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর মধ্যে তা নতুনভাবে প্রাণের সঞ্চার করেছিল। তার পর শুধু শিক্ষায় আলোকিত হওয়া আর এগিলে চলার পালা। ১৯৪৭-এ দেশ বিভাগের পর আর এক নতুন দায়িত্ব চাপল প্রতিষ্ঠানটির কাঁধে। বছর না পেরোতেই ভাষা আন্দোলন। তার পর বায়ান্নর সে রক্তঝরা দিনে নির্ভীক সেনানী সালাম-বরকতের প্রাণ বিসর্জনসহ সেই দিন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তা বিরল। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অকুতোভয় শিক্ষার্থীদের রক্তে প্রতিষ্ঠানটির আঙ্গিনা শুধু রঞ্জিতই হয়নি, সাথে রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে এগিয়ে যাওয়ার এক বিরল সাহসও জুগিয়েছিল জাতিকে। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার এ সংগ্রামে শুধু শিক্ষার্থী নয়, এ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরাও এগিয়ে এসেছিলেন। এর ফল দাঁড়াল প্রফেসর মোজাফফর আহমদ, মুনীর চৌধুরী প্রমুখের কারাবরণ ও চাকরিহরণ। ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর মোয়াজ্জেম হোসেনকেও পদ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। আর এ রক্তাক্ত পথ বেয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রামী ছাত্রসমাজের নেতৃত্বে বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন আর ঊনসত্তরের উত্তাল গণ-অভ্যুত্থান ঘটে। এক আসাদের প্রাণের বিনিময়ে অসংখ্য আসাদের জন্ম হলো। এর পরের ইতিহাস শুধুই সংগ্রাম আর অর্জনের। যেখানে অধিকার হরণ সেখানেই আবির্ভাব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীনতা এ জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। এতেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজের গৌরবোজ্জ্বল ভ‚মিকাই আমাদের এনে দিয়েছিল লাল-সবুজের পতাকা। তার পর নব্বইয়ের অগ্নিঝরা স্বৈরাচারবিরোধী গণ-অভ্যুত্থানেও ডাকসু ঢাকাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজই ছিল রাজপথের অগ্রসেনানী।

এত গৌরব আর সৌরভের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন যেন নব্বইয়ের পর থেকে উল্টোপথে হাঁটা শুরু করল। একসময়ের প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের শিক্ষার মানে এখন অধোগতি। শিক্ষকদের মধ্যে দলাদলি আর অতি রাজনীতিকরণ এবং শিক্ষার্থীদের পারস্পরিক বিরোধ ও লেখাপড়ায় অনীহা শ্রেণিকক্ষের পাঠদানে ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিভিন্ন অনিয়ম আর বিদ্বেষ, সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ এমনকি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা এবং রাতের অন্ধকারে ছাত্রীকে হল থেকে বের করে দেয়ার মতো ঘটনা ক্যাম্পাসের পরিবেশকে কী রকম বিষিয়ে তুলেছিল, তা প্রকটভাবে বাইরে ফুটে উঠেছে শিক্ষার্থীদের বিগত কোটাবিরোধী আন্দোলন এবং গত ডাকসু নির্বাচনের সময়। আমরা এ আলমামেটারের সাবেক সদস্যরা এসব দেখে যতটা না কষ্ট পেয়েছি, তার চেয়ে বেশি লজ্জিত হয়েছি যখন দেখেছি, সারা জাতি বলছিল ‘ছি! এ কেমন নোংরামি প্রাচ্যের এ অক্সফোর্ডে!’ এসবের পরও আমরা অন্তরের মধ্য থেকে কামনা করব, সব গ্লানিকে ঝেড়ে ফেলে আমাদের প্রাণের প্রতিষ্ঠানটি আবারো মাথা উচুঁ করে দাঁড়াবে এবং সগর্বে জানান দেবে- আমি তো প্রাচ্যের অক্সফোর্ডই আছি। সংগ্রামে-শান্তিতে জাতিকে নেতৃত্ব দিতে আমি সম্পূর্ণ প্রস্তুত। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কাছে আমাদের পুরনোদের পক্ষ থেকে আকুল আবেদন থাকবে- আপনারা বাইরের প্রভাবমুক্ত থেকে নিজেদের মতো করে নিজেদের পথটা করে নিন। আর সে পথে জাতিকেও সাথে নিয়ে চলুন যেমনটি চলেছিলেন আপনাদের অত্যন্ত মেধাবী অগ্রজরাও। যেন সবাই বলে বাহ! এই তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এই তো বাংলাদেশ।

লেখক : প্রফেসর, রসায়ন ও সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, বাংলাদেশ


আরো সংবাদ



premium cement
সশস্ত্র বাহিনী বিশ্বাস ও আস্থার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে : অধ্যাপক ইউনূস কুবিতে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা হলের নাম পরিবর্তন ব্যাংক খাত সংস্কারে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা সোমবার ঢাকায় আসছেন আইসিসির প্রধান কৌঁসুলি পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-বেনাপোল ট্রেন চলাচল শুরু ২ ডিসেম্বর ব্রাজিল সফরকালে ইউক্রেনে শান্তি ও গাজায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান শি’র রাষ্ট্রপতির সাথে তিন বাহিনী প্রধানের সৌজন্য সাক্ষাৎ নরসিংদীতে গলায় ফাঁস লাগিয়ে যুবকের আত্মহত্যা ঈশ্বরগঞ্জে টিসিবির পুরনো তালিকা, সাধারণ মানুষের ক্ষোভ যুক্তরাজ্যের প্রায় আড়াই শ’ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ করছে : এইচএসবিসি আবারো বাড়ল স্বর্ণের দাম

সকল