২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

কাবুলের বোমা ও হোটেলের মাতাল

-

আফগানিস্তানের প্রধান খবর হলো- কাবুলে তালেবানের ক্ষমতায় অধিষ্ঠান। তবে ২৭ আগস্ট সকালে টিভিতে প্রচারিত কাবুল বিমানবন্দরে আত্মঘাতী বোমা হামলার খবর দুনিয়ার মানুষের দৃষ্টিকে অন্য দিকে নিয়ে যেতে পারে। নজিরবিহীন হলেও সম্ভাব্য এ আক্রমণের দায় বহুল আলোচিত আইএস জঙ্গিরা স্বীকার করেছে। অন্য দিকে নিন্দা করল ক্ষমতায় সদ্যাগত আফগান তালেবান। হামলায় মৃতের সংখ্যা ২৭ তারিখেই ৬০ থেকে ৯০ হয়ে ১১০-এ উঠে গেছে। শ’ দুয়েক মৃত্যুর আশঙ্কা। আহত দেড় শতাধিক মানুষ।

আইএস ও তালেবান উভয়ই ‘জঙ্গি’ হিসেবে অভিহিত। তবে এ দুইয়ের মধ্যে বেমিলও আছে বটে। ওসামা বিন লাদেন থেকে তালেবানের দূরত্ব দৃশ্যত বর্তমান আইএস থেকে অধিক। ৯/১১-এর জঘন্য হামলা ঘটিয়েছিল লাদেনের অনুসারীরা। তালেবান এতে সম্পৃক্ত বলে আসলে প্রমাণ মেলেনি। যা হোক, ‘নামে নামে যমে টানে’র মতো জঙ্গি তালেবান অতীতে শেষ রক্ষা করতে পারেনি। তাদের ঝাড়ে বংশে উৎখাত করতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ ছিলেন মরিয়া। নিউ ইয়র্ক টুইন টাওয়ারে ২০০১-এর সেই ভয়াবহ হামলার জেরে আফগানিস্তানে তালেবানকে ক্ষমতা হারিয়ে জেরবার হতে হয়েছিল। তার এক দশক পরে আরেক মার্কিন প্রশাসন ‘নাই’ করে দেয় বিন লাদেনকে।

গালভর্তি দাড়িওয়ালা তালেবানের ভয়ে দুই গাল ভরা গোঁফওয়ালা ‘মুচুয়া’রা কেন মোচ নামিয়ে কেউ দুই হাত তুলে সারেন্ডার, কেউ বিজয়ী তালেবানদের বাহিনীতে ভিড়লেন, আবার কেউবা পাশের দেশে পালিয়ে বাঁচলেন? এ প্রশ্নের জবাব দেবেন কে বা কারা? আমেরিকা এত টাকা ঢেলেছে সরকারি ‘আফগান প্রতিরক্ষা বাহিনী’র পেছনে, তাতে লাভ হলো কী? সে টাকা কেন কাজে লাগেনি? কোথায় গেল সোয়া দুই ট্রিলিয়ন ডলার? Unsmart তালেবানি ‘মোল্লা’দের সামনে পাশ্চাত্যের এত সাধ ও স্বপ্নের smart boy দের এত শিগগির ‘গোল্লা’ হওয়ার কারণ বোধগম্য নয়।

যে রাশিয়ার দখলদারির বিরুদ্ধে তালেবানের জন্ম, সে দেশের প্রতিনিধির সরল উক্তি, আফগানিস্তানে তালেবান আবার ক্ষমতা পাওয়ার বিকল্প ছিল না। অন্য দিকে যে আরব আমিরাত হচ্ছে সে তিন দেশের একটি, যারা ১৯৯৬ সালে তালেবানের পয়লা সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল; এখন রাজনীতির জটিল সমীকরণের সরল ফলাফল হিসাবে সে দেশের মেহমান হয়েছেন তালেবানের ‘ইসলামী’ আমিরাতের দুশমন ও বিগত আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি। এ দিকে টিভিতে বলা হচ্ছে, আফগানিস্তানে আমেরিকা নিজের স্বার্থ ছাড়া এক পয়সাও খরচ করেনি। ‘গরিব’ দেশটির অত্যধিক মূল্যবান পাথরসহ ভূগর্ভের সম্পদের ওপর আমেরিকার নজর থাকলেও এখন তা চলে আসবে প্রতিপক্ষ চীনের দখলে। এটিকেই হয়তো ‘নিয়তি’ বলা হয়। অবশ্য চীনের বরাত কী, তা ভবিতব্যই বলতে পারে।

তালেবানবৈরী মিডিয়ার খবর, ‘আফগানিস্তানের উত্তর সীমান্তের পাঞ্জশিরে তালেবানবিরোধীরা এক হচ্ছে।’ এদের মধ্যে রয়েছে বিদ্রোহী সেনাবাহিনী আর স্থানীয় জনগোষ্ঠী। এসব গোষ্ঠীর মধ্যে আছে বিভিন্ন গোত্র, যাদের অনেকেই নানা সামাজিক কারণে তালেবানকে অপছন্দ করে। তাদের অনেকে ‘যুদ্ধবাজ’ ও হানাহানিতে অভ্যস্ত। তাই তালেবানের বিরোধী হলেই দেশপ্রেমিক, গণতান্ত্রিক কিংবা জনকল্যাণকামী হবে, তার নিশ্চয়তা নেই। শক্তিমান বহিঃশক্তি তাদের নিয়ে রক্তক্ষয়ী নতুন খেলায় মেতে উঠতে পারে; কিন্তু তাতে তালেবানের ক্ষতি হলেও আফগানিস্তানের লাভ কী? সর্বোপরি এখন পর্যন্ত যা দেখা যায়- তাতে বলতে হচ্ছে, এ তালেবান ও আগের তালেবানে কিছুটা হলেও ‘পার্থক্য’ আছে।

আফগানিস্তানের সর্ব উত্তর প্রান্তের ‘পাঞ্জশির’-এর নাম কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর কাবুল সফরনামার সুবাদে সুপরিচিত। এ এলাকা চিরতুষারাবৃত পর্বত দিয়ে শোভিত। এর সন্তান আবদুর রহমান ছিল মুজতবা আলীর ‘হরফুন মৌলা’ বা সকল কাজের কাজী। সে তার খাদেম ও বাবুর্চি হলেও আলীর প্রথম থেকেই মনে হতো, বাজার করা থেকে মানুষ খুন করা অবধি দরকারি-বেদরকারি সব কাজই তার দ্বারা সম্ভব। আবদুর রহমান পাঞ্জশিরের নানা গল্প করত তার কাছে। সে পাঞ্জশিরের কোনো বদনাম শুনতে পারত না। তাই তার ভাষায়, ‘ইনহাস্ত ওয়াতানাম’ (এই তো আমার জন্মভূমি)। তবে বর্তমান পাঞ্জশিরের তালেবানবিরোধী জোটের সবাইকে জন্মভ‚মির প্রেমিক মনে না করার কারণ আছে। তালেবানের ঘোরবিরোধী পড়শি রাষ্ট্র তাজিকিস্তানের সংলগ্ন এই পাঞ্জশির। আফগান সরকারি সেনাবাহিনীর অনেকে আগেই পালিয়ে ঠাঁই নিয়েছে সে দেশে। সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রটির প্রশাসন তালেবানদের ‘মৌলবাদী সন্ত্রাসী’ মনে করে। নিজেরাও লড়ছে স্বদেশের মৌলবাদীদের সাথে।

স্মর্তব্য, ১৯৯৬ সালে তালেবান ক্ষমতায় এসে দেশের ২০ শতাংশ এলাকা (প্রধানত এই উত্তরে) নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। তাদের পতনও ঘটেছিল Northern Alliance বা উত্তরাঞ্চলীয় জোটের দ্বারা। এ জোট ছিল একাধারে মার্কিন মদদ, সোভিয়েত বা রুশ সহায়তা আর ইরানি সাহায্যে পরিপুষ্ট। বিখ্যাত ইসলামী ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক বুরহানউদ্দিন রব্বানি আর তার Blue eyed boy আহমদ শাহ মাসুদের (উভয়েই তাজিক) মতো বিখ্যাত ব্যক্তিরা নেতৃত্ব দিয়েছেন এ মোর্চায়। তাদের মোকাবেলা করা তখন তালেবানের পক্ষে সম্ভব ছিল না। মাসুদ ছিলেন দুর্ধর্ষ গেরিলা মুজাহিদ কমান্ডার, যাকে আমেরিকা প্রথমে রাশিয়ার বিরুদ্ধে, পরে তালেবানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার অভিযোগ আছে। তাজিকরা আফগান রাষ্ট্রে দ্বিতীয় বৃহৎ নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী, যাদের শতাংশ হার ২৩ থেকে ৩০-এর মতো। আর তালেবান অতীতে ছিল দেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠী পশতুন বা ‘দরি’ভাষী পাঠানদের দ্বারা অধ্যুষিত। যা হোক, এখন আহমদ শাহ মাসুদের প্রশিক্ষিত ছেলেকে সামনে রেখে তালেবানবিরোধীরা এগোতে চায়। এই ছেলে ব্রিটেনের স্যান্ডহার্স্ট মিলিটারি একাডেমির মতো বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠানে সামরিক প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়েছেন। তবে তিনি তালেবান তাড়াতে কতটা সফল হন, তা অনিশ্চিত। মিডিয়া তাকে তুলে ধরতে শুরু করেছে। এখন তাদের উচিত সত্যিকার দেশপ্রেমের পরিচয় দেয়া আর বর্তমান তালেবান সরকারকে চলতে হবে হিসাব করে ও সংযমী হয়ে। কোনো পক্ষই এমন কিছু করা অনুচিত, যাতে দেশের স্থিতি আর জাতির ঐক্য বিপন্ন হতে পারে। আফগান দেশটি টুকরো টুকরো হয়ে গেলে এতে এ জাতির কোনো লাভ নেই; বরং তাতে ‘সাত ভ‚তের লুটপাটে’র সুযোগ বাড়বে।

তালেবানরা কেবল সেক্যুলারদের নয়, অনেক ইসলামপন্থীরও মাথাব্যথার হেতু। কারণ অতীতে দেখা গেছে, তারা ‘ইসলামী জোশ’ জাগালেও হুঁশ জ্ঞান পর্যাপ্ত না থাকায় অনেক সময় তারা ইসলামের সুনামের বদলে বদনামের কারণ হয়েছে। তালেবানের বিরুদ্ধে একটি বড় অভিযোগ ছিল, তারা ইসলামের ব্যাখ্যা দেয় ‘ইচ্ছামতো’; তারা শুভাকাক্সক্ষীদেরও কথা শোনে না প্রভৃতি। এবার যেন তালেবান একই ভুল আবার না করে। ভরসা Experience is the best teacher (অভিজ্ঞতাই সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক)। তালেবানের বিরুদ্ধে এমন অনেকে অসন্তুষ্ট ছিলেন, যারা নিঃসন্দেহে ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের‘ সিপাহি’, এমনকি কেউবা ‘সিপাহসালার’। দেখা যাচ্ছে, এবার তালেবান ইসলামপন্থী ও সেক্যুলার নির্বিশেষে সবার মন জয় করতে চাচ্ছে। তবে সাবধানী না হলে একসাথে দুই নৌকায় পা ফেলা যায় না।

বিভিন্ন মহলের ধারণা, কাবুলের বিমানবন্দরে যে-ই ভয়াবহ হামলা করুক না কেন, এই মর্মান্তিক ঘটনার মূল বেনিফিশিয়ারি কিন্তু জঙ্গিরা নয়, খোদ আমেরিকাসহ পাশ্চাত্যশক্তি। কারণ ১. এতে প্রমাণিত হয়েছে, মার্কিন গোয়েন্দাদের আশঙ্কা সঠিক। তারা আগেই জানায় বিমানবন্দরে আইএস হামলা করতে পারে। এ জন্য মার্কিন কর্তৃপক্ষ তাদের নাগরিকদের সতর্ক থাকতে বলেছিল। ২. তালেবান ক্ষমতায় এলেও আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা নয়; সন্ত্রাস বেড়েছে- এটিই ‘প্রমাণিত’ হয়েছে এ ঘটনায়। ৩. আফগানিস্তানে তালেবানের পাশাপাশি আইএস, আলকায়েদা প্রভৃতি নামের জঙ্গিরা রয়েছে- এমন প্রচারণাকে এখন সত্য বলে ধরে নিতে হবে। ৪. তালেবান কাবুলে ক্ষমতায় এলে জঙ্গিরা উৎসাহ পাবে- এ প্রোপাগান্ডাই এবার সঠিক হয়ে গেল। ৫. আবার মার্কিন সেনা আফগানিস্তানে থাকার যৌক্তিকতা প্রমাণিত হলো, যা মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের জন্য বিব্রতকর।

আফগানিস্তান নিয়ে উভয় সঙ্কট প্রায় সবার। খোদ তালেবান থেকে শুরু করে ভারত, পাকিস্তান, চীন, রাশিয়া, আমেরিকাসহ পশ্চিমা জগৎ, ধনাঢ্য আরব দেশগুলো, ইরান, তুরস্কসহ সবাই এই গুরুতর সমস্যায় পড়েছে। আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়া কিংবা তালেবানের বিরোধিতা এত সোজা নয়, বলেই দেখা যাচ্ছে। দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি কী দাঁড়ায়।

খায়া পিয়া কুছ নেহি...
এটি কয়েক দশক আগে ঢাকায় ব্যাপকভাবে প্রচলিত একটি উর্দু কথা। ব্যাপার হলো, রাজধানীর তদানীন্তন জিন্নাহ এভিনিউ, মানে বর্তমান বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে ছিল নামীদামি রেস্তোরাঁ। এক দিন এক মাতাল সেখানে ঢুকেই ছুটে যায় খালি আসনের দিকে। সেখানে ধপাস করে বসে পড়ে ওয়েটারকে কড়া অর্ডার, ‘এক গেলাস পানি লাও’। ছেলেটি পড়িমরি করে গেলাসভর্তি পানি তাকে এনে দিলো। তখন সেই মদখোর পানি কিছুটা খেয়ে বাকিটাসহ আস্ত গেলাসটা পাকা ফ্লোরে ছুড়ে মারল। সাথে সাথে ঝনাৎ করে সব ভেঙে টুকরো টুকরো। এর পরপরই লোকটি যেমনি এসেছিল, তেমনি বিদ্যুৎবেগে বেরিয়ে যায়। তখন কাউন্টার থেকে ম্যানেজার ওয়েটারকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ও যে চলে গেল, কত টাকার বিল হয়েছিল তার?’ বিহারি বয়টা জবাব দিলো সাথে সাথে, ‘খায়া পিয়া কুছ নেহি; গেলাস তোড়া ছে আনা’ (কিছুই খায়নি এখানে; বরং ছ’আনা দামের গেলাসটা ভেঙে ফেলেছে)। সে যুগের ছ’আনা বা ৩৭ পয়সাও একেবারে কম ছিল না।

আফগান রণাঙ্গনে বিশ্বের সেরা বৃহৎশক্তি আমেরিকা দীর্ঘ দুই দশক ‘যুদ্ধ’ করেও ‘খায়া পিয়া কুছ নেহি, গেলাস তোড়া ছে আনা’র বেশি কিছু করতে পারেনি। তা ভিয়েতনামের পরে এবার আফগানিস্তানেও প্রমাণিত হলো।


আরো সংবাদ



premium cement