২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০ পৌষ ১৪৩১, ২২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

আপনাকে দেখে তো মন্ত্রীর মতো লাগছে না

-

আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন এ দেশে এমপি-মন্ত্রীদের সামাজিক মর্যাদা অনেকের চেয়ে ভালো ছিল। তারা নির্ভয়ে রাতবিরেতে একাকী ঘুরতেন। হাট-বাজার, বিপণিবিতানে যেতেন এবং বৌ-বাচ্চাদের নিয়ে পার্কে হাঁটাহাঁটির পর সাধারণ মানের হোটেল রেস্তোরাঁয় বসে চা-নাস্তা খেতেন। তাদের দেখে জনগণ সালাম দিত এবং অতি উৎসাহীরা এসে ছবি তোলার আবদার জানাত।

বিয়েশাদি-জন্মদিন বা বিয়েবার্ষিকীর মতো সামাজিক অনুষ্ঠানের আয়োজক যদি একটু ধনাঢ্য বা প্রভাবশালী হতেন তবে তারা এক বা একাধিক এমপি-মন্ত্রীকে দাওয়াত করে নিজেদের মানমর্যাদা বৃদ্ধির চেষ্টা চালাতেন।

এমপি-মন্ত্রীদের অনেকের শিক্ষা-দীক্ষা কাক্সিক্ষত মানের ছিল না। তার পরও রাষ্ট্রের আমলা-কামলারা তাদের জনপ্রতিনিধিরূপে যথেষ্ট ইজ্জত করতেন। রাতের ভোট-আটো পাস কিংবা ভোটের দিনের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তি অথবা বিনা ভোটের এমপি ইত্যাদি শব্দমালা যখন আমাদের দেশের লোকজন শুনেনি ঠিক সেই সময়ে ঢাকার একটি অভিজাত ক্লাবের জনৈক মন্ত্রীকে নিয়ে একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল। বাংলাসাহিত্যের জীবন্ত কিংবদন্তি সমরেশ মজুমদার সেবার কী কারণে ঢাকা এসেছিলেন। তার আগমন উপলক্ষে হাল আমলের আলোচিত একজন ধনাঢ্য পত্রিকা সম্পাদক ঢাকা ক্লাবে একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। সম্পাদক সাহেব তার পছন্দের লেখক-সাহিত্যিক-রাজনীতিবিদ, আমলা-কামলা এবং ব্যবসায়ীকে দাওয়াত করেছিলেন। আমন্ত্রিত অতিথির তালিকায় এমপি হিসেবে আমি ছিলাম এবং মন্ত্রী হিসেবে ছিলেন সেই ব্যক্তি যার কাহিনী নিয়ে আজকের শিরোনাম।

উল্লেখিত অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত সব অতিথিই সমরেশ মজুমদারের মানমর্যাদা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন এবং সেভাবেই তার সঙ্গে তমিজসহকারে ব্যবহার করছিলেন। অনেকে তার সঙ্গে আলাপ জমানোর চেষ্টা করছিলেন; কিন্তু কেন জানি আমি ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে তিনি আড্ডা দিতে তেমন স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছিলেন না। আমরা একটি সোফায় পাশাপাশি বসে দুই বাংলার সাহিত্য-রাজনীতি এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের মাখামাখি পিরিতির ভ‚ত-ভবিষ্যৎ নিয়ে এমন চটুল আলোচনা শুরু করেছিলাম- যার উচ্ছলতা দেখে অনেকে এগিয়ে এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু সমরেশ বাবুর দিক থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে তারা ফিরে গিয়ে যার যার টেবিলে বসে বাঁকা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে হিংসেয় জ্বলতে থাকলেন।

ঢাকা ক্লাবের সে রাতের অনুষ্ঠানে সমরেশ মজুমদারের কল্যাণে হঠাৎ করেই সব অতি গুরুত্বপূর্ণ মেহমানদের মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলাম। ২০১০-১১ সালে আমার রাজনৈতিক-পরিচিতি পদ-পদবি এবং তারুণ্যের গরমে আহ্লাদিত হয়ে নিজেকে সমরেশ মজুমদারের পাশে এমনভাবে সেঁটে দিলাম যা ভেদ করে অন্য কোনো অতিথি তার পাশে বসার সুযোগ পেলেন না। দু’জনের আলাপ দেখে অনেকে ধারণা করলেন যে, আমাদের সখ্য বহু পুরনো এবং ঘনিষ্ঠতা নিবিড়। ফলে অনেক মেহমান এসে আমাকে অনুরোধ করলেন সমরেশ মজুমদারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য। তো এ অবস্থায় আলোচিত মন্ত্রী মহোদয়ও এলেন। তিনি সমরেশ বাবুকে নমস্কার জানালেন আর আমি মন্ত্রীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরলাম। সমরেশ বাবু সব শুনে একটু মুচকি হেসে মন্ত্রীর দিকে ক্ষণেকের তরে তাকালেন এবং মুখে শুধু ও আচ্ছা! তাই নাকি, এ কথা বলে আবারও আমার সঙ্গে আড্ডায় মেতে ওঠার চেষ্টা করলেন।

সমরেশ মজুমদারের আচরণে মন্ত্রীর মনে খানিকটা সন্দেহ হলো। তিনি হয়তো মনে করলেন, তার প্রিয় সাহিত্যিক বোধ হয় বুঝতে পারেননি যে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের একক মন্ত্রী এবং তার রয়েছে বর্ণাঢ্য এক রাজনৈতিক ইতিহাস। বাংলাদেশের সব রাজনীতিসচেতন মানুষ তাকে চেনে এবং তিনি যে সমসামায়িক রাজনীতির প্রভাবশালী গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এ কথা নিজের মুখে বলে সমরেশ বাবুকে নিজের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য তিনি জোর করেই আমাদের পাশে বসে পড়লেন এবং নিজের সম্পর্কে বলতে আরম্ভ করলেন। মন্ত্রীর মনোভাব বোঝার মতো অন্তর্দৃষ্টি সমরেশ বাবুর ছিল। তাই তিনি অনেকটা আনমনে তার কথা শুনলেন। আমিও আমাদের মন্ত্রীর গুরুত্ব বোঝানোর জন্য দু’চারটি বাক্য বললাম।

সব কথা শুনে সমরেশ মজুমদার বললেন, ‘ও তাই বুঝি! আপনি মন্ত্রী! কিন্তু আপনাকে দেখে তো মন্ত্রীর মতো লাগছে না!’ মন্ত্রীর মুখ পাংশুবর্ণ হয়ে গেল। তিনি কোনোমতে ঢোঁক গিলে তারপর কোনো কিছু না বলে কাষ্ঠহাসি দিয়ে সমরেশ বাবুর মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। এবার সমরেশ বাবু অর্থপূর্ণ মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, আপনাকে তো ভদ্রলোকের ছেলে বলে মনে হচ্ছে। তার কথা শুনে মন্ত্রী কী বুঝলেন তা বলতে পারব না। তবে তিনি প্রচণ্ড খুশি হলেন এবং গদগদ স্বরে বলতে আরম্ভ করলেন তার পিতৃপরিচয়, যিনি পাকিস্তান জমানায় একটি সরকারি করপোরেশনে জেনারেল ম্যানেজারের মতো উঁচু পদে চাকরি করতেন। অন্য দিকে তিনি নিজে বুয়েটের ছাত্র হওয়া সত্তে¡ও ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন বাদ দিয়ে রাজনীতিতে সঁপে দিয়েছিলেন এবং প্রাণের মায়া ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তারপর স্বাধীন দেশে কী করেছেন এবং বর্তমানে মন্ত্রী হিসেবে কী কী করছেন তা এমনভাবে বর্ণনা দিতে আরম্ভ করলেন যা শুনে সমরেশ বাবু বারবার হাই তুলতে আরম্ভ করলেন।

মন্ত্রী মহোদয়ের খুশির জোয়ার দেখে প্রমাদ গুনলাম। কারণ যারা উঁচুমার্গের সাহিত্য চর্চা করেন তাদের মধ্যে কতগুলো অদ্ভুত মুখপোড়া স্বভাব রয়েছে। তারা মুহূর্তের মধ্যে যেমন সব কিছু থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিতে পারেন আবার তেমনি সব কিছু ছেড়ে দিয়ে তুচ্ছাতিতুচ্ছ কোনো বিষয়ের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে এমন আনন্দে মেতে উঠতে পারেন যা দেখে সাধারণ মানুষ হয়তো ভাববে, লোকটি হয়তো পাগল হয়ে গেছে। এ ছাড়া তাদের আচার-আচরণ কথা-বার্তা-পোশাক এমনকি খাদ্যাভ্যাস নিয়েও সাধারণ মানুষের রয়েছে এন্তার অভিযোগ। সুতরাং মন্ত্রীর খুশির জোয়ার বন্ধ করার জন্য সমরেশ বাবু কী কাণ্ড ঘটান তা ভেবে রীতিমতো আতঙ্কিত বোধ করতে আরম্ভ করলাম।

লক্ষ করলাম, মন্ত্রী শুধু বলেই চলেছেন আর সমরেশ বাবু একটু একটু হাই তুলছেন এবং ব্ল্যাক লেবেল নামক দামি মদ পান করেই চলছেন। এ অবস্থায় সমরেশ বাবু হঠাৎ করেই ওয়েটারকে ডেকে মন্ত্রীকে মদ পরিবেশন করতে বললেন। মদপানের প্রস্তাব শুনে মন্ত্রী সম্বিত ফিরে পেলেন। খুব কাঁচুমাচু করে বললেন- দাদা! আমি ওসব খাই না। মন্ত্রীর কথা শুনে সমরেশ মজুমদার এবার একটু উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠলেন। মন্ত্রী কী বুঝলেন তা আমি বলতে পারব না, তবে দেখলাম তিনি আর কোনো কথা না বলে দ্রুত স্থান ত্যাগ করলেন। সমরেশ বাবু এবার আমার দিকে তাকিয়ে অর্থপূর্ণ হাসি দিলেন এবং বললেন- আচ্ছা এমপি সাহেব! ভদ্রলোকের ছেলে এবং ভদ্রলোক এই দু’টি শব্দের মধ্যে কি কোনো পার্থক্য আছে?

সমরেশ মজুমদারের সে দিনের প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারিনি- আসলে সে দিন উত্তর দেয়ার মতো মেধা বা সাহস কোনোটিই আমার ছিল না। অন্য দিকে তিনিও আগবাড়িয়ে আর কিছু বলেননি। ফলে তার সে দিনকার প্রশ্নটি অনবরত আমার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। যখনই সময় পাই তখনই ভাবি- কেন সন্তানরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পিতা-মাতার মতো হয় না অথবা পিতা-মাতারা কেন সন্তানের বিনয়-ভদ্রতার জিম্মাদার হতে পারেন না। কেন নেতারা তাদের কর্মীদের ভদ্রতা শেখান না অথবা ভদ্র কর্মীরা কেন অভদ্র নেতার তাঁবেদারি করেন। শিক্ষকরা কেন ছাত্রছাত্রীদের ভদ্রলোক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য যত্নবান হন না অথবা অভদ্ররা কেন শিক্ষক-বিচারক, আমলা, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি মহান পেশার ওপর প্রভুত্ব করার সুযোগ পায়!

হাল আমলের বিশ্বরাজনীতি এবং স্থানীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে আমাদের সমাজের অভদ্রতা ও অভব্যতার যেসব দৃশ্য দেখতে পাই তাতে বারবার সমরেশ মজুমদারের সেই প্রশ্নটি অর্থাৎ ভদ্রলোকের ছেলে এবং ভদ্রলোক এই দু’টি শব্দের মধ্যে কী কোনো পার্থক্য আছে- সামনে চলে আসে। আফগানিস্তানে তালেবানরা বিজয়ী হয়েছে এবং মার্কিনিরা তাদের দলবলসহ অপমানজনকভাবে পরাজিত হয়েছে। কিন্তু তার পরও উভয়পক্ষ ভদ্রতার খাতিরে এবং সময়ের প্রয়োজনে বারবার বৈঠক করছে। কাবুল কাতার ওয়াশিংটন ইসলামাবাদ ছাড়াও দুবাই দিল্লিতে উভয়পক্ষ সমঝোতার জন্য ঘন ঘন বৈঠক করছে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রতিনিধিরূপে সিআইএ’র প্রধান সরাসরি কাবুলে এসে তালেবান প্রধানের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করেছেন। অথচ আমাদের দেশে আফগান তালেবান শব্দ নিয়ে যেসব অরুচিকর অভব্য শব্দ ব্যবহার করে বড় বড় পদের লোকজন যেসব কথা বলছেন তা আফগান তালেবানদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত পশ্চিমা দুনিয়ার কোনো রাজনীতিবিদ বলছেন না।

আমাদের দেশের খ্যাতনামা অধ্যাপক এবং লেখক জনাব আসিফ নজরুলের সঙ্গে ইদানীংকালে যে ব্যবহার করা হচ্ছে- বিশেষত তার ছাত্রছাত্রীদের মধ্য থেকে কেউ কেউ যখন মুদ্রণ অযোগ্য বাক্য ব্যবহার করে তার বিরুদ্ধে বক্তব্য দিচ্ছেন এবং তাকে শারীরিকভাবে অপমান করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রতিহত করার যে হুমকি দেয়া হচ্ছে তখন আমি জানার চেষ্টা করছি তালেবানরা কাবুল দখল করার পর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের সঙ্গে অশালীন আচরণ করেছেন কি না! অন্য দিকে বরিশাল শহরে একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বনাম মন্ত্রীর মর্যাদাসম্পন্ন একজন জনপ্রতিনিধির পরিচয়ধারী মেয়রের মধ্যে যা কিছু ঘটল তা সভ্য দুনিয়ার রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য কি সভ্য উদাহরণ নাকি অসভ্য উদাহরণ হিসেবে লিখিত হবে সেই সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষমতা মন্ত্রী-এমপি আমলা কামলাদের নেই।

পরিবার সমাজ রাষ্ট্রের যারা কর্তা তাদের বিনয় ও ভদ্রতার মানদণ্ড, শিক্ষা-দীক্ষার গুণগত মান এবং সততা কর্মনিষ্ঠা এবং নীতিবোধের ওপরই নির্ভর করে একটি জাতিরাষ্ট্রের সভ্যতা ও ভব্যতা। যে দেশের নেতারা নিজেদের অভদ্রতা অসভ্যতা মিথ্যাচার পাপাচার অন্যায় জুলুম এবং বাহারি দুর্নীতি বগলদাবা করে বড় বড় পদ পদবিতে বসে ভদ্রতার মুখোশ পরে দিবানিশি মোনাফেকি করে বেড়ায় তারা এক দিকে যেমন নিজেদের নিয়তির অভিশাপের জালে আবদ্ধ করে ফেলে তদ্রুপ তাদের কুকর্মের সহযোগী এবং যারা মুখ বুজে সব কিছু সহ্য করে তারাও নিয়তির কবলে পড়লে কোন পরিস্থিতির শিকার হয় তার বাস্তব দৃশ্য সম্প্রতি আমরা দেখতে পেয়েছি কাবুল বিমানবন্দরে।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement