২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

তালেবান : হট ইস্যু ও উড়ো খই

- ছবি : নয়া দিগন্ত

‘তালেবান’ ইস্যু বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে Hot and Spicy বিষয়। মনে পড়ল তিন দশকেরও বেশি আগে বাংলাদেশের একজন সিনিয়র সাংবাদিক পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণে গিয়ে দেখেছিলেন, সীমান্ত এলাকার কোথাও কোথাও ছাত্রদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ চলছে। নতুন ‘মুজাহিদ’ হিসেবে আফগান রণাঙ্গনে তাদের যুদ্ধ করার কথা তদানীন্তন রুশ দখলদার বহিঃশক্তির বিরুদ্ধে। এসব শিক্ষার্থীই ‘তালেবান’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে পরবর্তীকালে।

‘তালেবান’ কথার অর্থই ছাত্র; বিশেষ করে মাদরাসার। এর মধ্যে গত কয়েক দশকে তালেবানের বিস্তৃতি ঘটেছে অন্যান্য দেশেও। স্মর্তব্য, প্রথম থেকেই তালেবানে শামিল ছিল বাংলাদেশের অনেকে। তাদের কেউ বা স্বদেশ থেকে আফগানিস্তানে গেছে লড়তে; কেউ কেউ অন্যান্য দেশে পড়াশোনা স্থগিত রেখে আফগান ফ্রন্টে যুদ্ধ করতে যায়। তাদের অনেকে যুদ্ধে প্রাণও দিয়েছে বলে জানা গেছে। এত বছর পর এখন বাংলাদেশী কেউ যুদ্ধদীর্ণ সে দেশে আছে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশ সরকারও তা মনে করে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা সেটাই।

তালেবান বাহিনীর অগ্রাভিযান সাম্প্রতিক বিশ্ব ইতিহাসের অপর বিস্ময়কর ঘটনা। আফগানিস্তানে তারা দিনে গড়ে দু’টি করে প্রদেশের রাজধানী দখল করে নিয়েছে প্রায় বিনা রক্তপাতে। অবশেষে বিদ্যুৎগতিতে দেশের রাজধানী কাবুল পর্যন্ত অধিকার করেছে গুলি না ছুড়েই। অথচ দখলবাজ মার্কিন পরাশক্তিও সম্প্রতি ধারণা করেছিল, তালেবানদের রাজধানী দখল করতে কয়েক মাস লেগে যাবে। তখন তালেবানবিরোধী অনেকে এ বলে সান্ত্বনা পেতে চেয়েছেন, ‘আর যাই হোক, তালেবানরা কাবুলে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না।’ শেষ দিকে ছয় হাজার মার্কিন সেনা আবার সে দেশে পাঠানোর ঘটনা নিশ্চয়ই তাদের এ বিশ্বাস চাঙ্গা করেছিল যদিও সাময়িকভাবে।

ভুলে গেলে চলে না, ইসলাম ও গণতন্ত্র কোনোটাই জোর করে চাপিয়ে দেয়ার বিষয় নয়। মানুষের স্বতঃস্ফ‚র্ত আগ্রহ ও সচেতন আকর্ষণ ছাড়া কিছুই টিকবে না। এটি সবার ক্ষেত্রেই সত্য।

তালেবানের জন্ম সাবেক সোভিয়েত বা রুশ দখলদারির বিরুদ্ধে। সেই রাশিয়া এখন সুকৌশলে তালেবানের অনুক‚লে থাকতে চায়। তারাই প্রচার করছে- তালেবানের শত্রু, আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি চার গাড়ি বোঝাই কোটি কোটি টাকা নিয়ে এবং মুদ্রার অসংখ্য নোটে হেলিকপ্টার ঠেসে, বাকি সব নোট কাবুল বিমানবন্দরে ফেলে রেখেই এবার ‘অজানা’ স্থানে পালালেন। কেউ বলছেন কাছের দেশ তাজিকিস্তান, কারো মতে দূরের আমেরিকা তার গন্তব্য। জানা যায়, উনি আছেন ‘আমিরাতের মেহমান হিসেবে’। অন্য দিকে আলকায়েদার মতো তালেবানও মূলত মার্কিন মদদে ও তাদের স্বার্থে সৃষ্ট বলে প্রতিপক্ষ মহলের ব্যাপক প্রচারণা আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘকাল আগে তালেবানদের ক্ষমতা থেকে হঠিয়ে তাদের সন্ত্রাসী বলে এসেছে এবং এখনো তারা পরস্পর প্রতিপক্ষই বলা যায়। এসব হচ্ছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির লীলাখেলা। কথায় বলে, Nothing is unfair in love and politics (ভালোবাসা ও রাজনীতিতে অন্যায় বলে কিছু নেই), আর যুদ্ধ বা ধিৎ রাজনীতিরই অংশ।

প্রসঙ্গক্রমে আরো বলতে হয়, তালেবান প্রথম ক্ষমতায় এসে দুনিয়ার কেবল তিন-চারটি দেশের স্বীকৃতি পেয়েছিল। সেগুলোর মধ্যে ছিল পাকিস্তান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রভৃতি। এবার এ ক্ষেত্রে জটিল রাজনীতির প্রভাবে সৌদি সরকার সতর্ক। সে কারণে তারা তড়িঘড়ি করে নিজেদের সব লোকজনকে সরিয়ে নিয়েছে তালেবান অধিকৃত আফগানিস্তান থেকে। ভবিষ্যতে তারা তালেবানের প্রতি কোন দৃষ্টিতে দেখে, তা অনিশ্চিত। ইরান অতীতে ঘোর তালেবানবিরোধী ছিল (বিশেষ করে মাজার ই শরিফে শিয়াদের হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায়), এখন তেহরান তালেবানের বিজয়কে দেখছে বড় ‘শয়তান’ যুক্তরাষ্ট্রের ‘পরাজয়’রূপে। আর খোদ মার্কিন রাষ্ট্রপতির স্বীকৃতি ‘যুক্তরাষ্ট্রের আফগান নীতিতে কয়েকটি ভুল ছিল, যদিও সে রণাঙ্গনের সেনা ফিরিয়ে আনা আফসোসের বিষয় নয়।’

তালেবান শাসনের ধরন এবার কেমন হবে, তা অনিশ্চিত। এ যাবৎ তাদের পরিচিতি ‘উগ্রপন্থী সুন্নি মৌলবাদী গোষ্ঠী’ হিসেবে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ বিস্তর; তবে এর অনেকটাই তারা স্বীকার করেনি এবং অনেকটা রঞ্জিত ও শঙ্কার ফল। অবশ্য তালেবান বরাবরই প্রচলিত মিডিয়ার আনুক‚ল্য বঞ্চিত। এবার তাদের ‘বিজয়’ পর্বেও এ চিত্র বদলায়নি। এ জন্য তালেবানের সামরিক সাফল্য ‘আগ্রাসন ও অগ্রাভিযান তাণ্ডব’ হিসেবে চিত্রিত। এর কারণ এক দিকে তাদের আদর্শিক ও রাজনৈতিক বিরোধিতা এবং তালেবানের কিছু উগ্রতা ও বাড়াবাড়ি। শরিয়াহ আইনের ভীতি আধুনিক যুগে প্রবল এবং তালেবান এ আইনের প্রশ্নে অত্যন্ত সরব। তারা আফগানিস্তানকে শুধু ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র’ হিসেবে নয়, ইসলামী ‘ইমারত’ (আমির পরিচালিত) হিসেবে দেখতে আগ্রহী। এই ইসলামী নেতা তালেবান প্রধান কিংবা তার অনুমোদিত কেউ নিঃসন্দেহে।

সম্ভবত হামিদ কারজাই আমলেই আফগান জাতীয় পতাকায় মসজিদ স্থান পেয়েছে। এবার তালেবান বিরোধিতার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সে পতাকারও বিরোধিতা করার অভিযোগ এসেছে।

বলা হয়েছে, ১৭ আগস্ট জার্মানিতে তালেবানবিরোধী ব্যাপক বিক্ষোভে আফগানিস্তানের বর্তমান নয়, সাবেক পতাকাকে ‘সর্বাধিক প্রিয়’ হিসেবে তুলে ধরেছেন কিছু ব্যক্তি। তা ছাড়া নারীদের কেউ কেউ যে পোশাকে এতে অংশ নিলেন, সেটি তালেবানের জন্য ‘উসকানিমূলক’। পরে ২০ আগস্টও বিশাল মাপের পুরনো পতাকা নিয়ে মিছিল করা হয়েছে। এ দিকে তালেবান তাদের আগের অবস্থান থেকে দৃশ্যত পিছিয়ে এসে বলেছে, ‘বোরকা নয়, হিজাব নারীর জন্য বাধ্যতামূলক।’ আসলে ‘বোরকা’ হলো কয়েক দেশে প্রচলিত পর্দার ধরন আর ‘হিজাব’ হচ্ছে ইসলাম নির্দেশিত অপরিহার্য শালীনতা। এবার আফগানিস্তানে অনেক সেক্যুলার মহিলা বোরকা পরে পালিয়েছে বলে জানা গেছে।

১৯৯৬ সালে তালেবান গোষ্ঠী আফগানিস্তানে ক্ষমতাসীন হয়েছিল প্রথমবারের মতো। ১৯৯৭ সালে একটি ব্যক্তিগত কাজে একাধিকবার গেছি গাজীপুর। তখন সম্ভবত টঙ্গীর দেয়ালে প্রথম লেখা দেখেছি, ‘আমরা হবো তালেবান/বাংলা হবে আফগান’। কারা লিখেছে, তার উল্লেখ বোধহয় ছিল না। অত্যুৎসাহী কোনো ব্যক্তি এটি করেছে বলে মনে করা যায়। এখন সরকারের ঘনিষ্ঠ মহল বলছে, ‘বাংলাদেশকে আফগানিস্তান হতে দেয়া হবে না’। আসলে মুসলিম অধ্যুষিত এ দেশের মানুষ ইসলামের প্রকৃত অনুসারী হলে অন্য কিছু হওয়ার দরকার পড়ে না।

তালেবানের সামনে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ। মনে রাখতে হবে, ২০০১ সাল আর ২০২১ সাল ভিন্ন। কথাটা পাশ্চাত্য ও আফগানিস্তান, উভয়ের জন্যই সত্য। আফগান রাষ্ট্র যতটা এগিয়েছে, তা পেছানো অনুচিত। অন্য দিকে তালেবান ‘ইসলামী মূল্যবোধ’কে প্রাধান্য দেয়াই স্বাভাবিক। সব মহল বা সংগঠনের একটি আদর্শ থাকে; এটি সবাই মেনে নিতে হবে। তেমনি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, জাতীয় ঐক্য ও সামাজিক স্থিতিশীলতাকে প্রাধান্য দিতে হয়। আশা করি, এটি সত্য হবে আফগান সরকারের বেলায়ও। তালেবান বিশেষত পশ্চিমা দুনিয়ার অনেকের কাছে মহা আতঙ্কের নাম কারণে-অকারণে। অন্য দিকে অনেকে তাদের ‘ইসলামের প্রতিনিধি’ মনে করে। বাস্তবতার আলোকেই সবারই সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। পূর্ব ধারণা নয়, তালেবানের কর্মকাণ্ডই তাদের সরকারকে স্বীকৃতিদানের ভিত্তি হওয়া প্রয়োজন। আফগান জনগণ তাদের মেনে নিলে বাইরের কেউ এর বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগা কি সঠিক হবে!

এ দিক দিয়ে বাংলাদেশ সরকার ঠিকই করেছে। তারা শরণার্থী প্রশ্নে যুক্তিসঙ্গত কঠোরতার পাশাপাশি পারস্পরিক সহায়তার দিক দিয়ে বাস্তবভিত্তিক নমনীয়তা দেখিয়েছে। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র এবং সার্ক সদস্য। আফগানিস্তানও অনুরূপ। অতএব, দুই দেশের সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে পরের মুখে ঝাল খাবার দরকার নেই। বাংলাদেশকে কোনো আঞ্চলিক বা বৈশ্বিক বৃহৎশক্তি নির্দেশ না দিয়ে মনে রাখা চাই, আমরা নিজের ভালোমন্দ নিজেরাই বুঝি।

উড়ো খই গোবিন্দায় নমঃ
‘উড়ো খই গোবিন্দায় নমঃ’ বলে একটি কথা আছে। এর মানে হলো এক লোক খই নিয়ে রাস্তা দিয়ে আসছিল। এমন সময়ে প্রবল বাতাস শুকনা খইগুলোর বিরাট অংশই উড়িয়ে নিয়ে গেল। লোকটি ভাবল, ইহকালে খই হারালেও পরকালে পুণ্য পাওয়া যেতে পারে। তখন সে আওড়াতে থাকে, ‘উড়ো খই গোবিন্দায় নমঃ’ অর্থাৎ উড়ে যাওয়া খই দেবতাকে দিয়ে দিলাম। আর হাতে না বাকি রইল, তা তো আমার জন্য আছেই।

কথাটা মনে পড়ল, ১৮ আগস্ট বুধবার সকালে আফগান পরিস্থিতির ওপর টিভিতে সম্প্রচারিত একটি ছবি দেখে। এতে দেখা যায়, ক. প্রচুর টাকা-পয়সা নিয়ে দেশ ছেড়ে দুই দিন আগে বিদেশে পালানো আফগান বিদায়ী প্রেসিডেন্ট (বিশ্বব্যাংকের সাবেক কর্তাব্যক্তি) আশরাফ গনির হাতে লম্বা তসবিহর মালা; অর্থাৎ তিনি ‘চোর’ হলেও মানুষ ‘ভালো’ এই অর্থহীন কথাটার প্রমাণ দিতে চাচ্ছেন। মিডিয়ায় প্রচার করা হয়েছে, গনি প্রশাসনের ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালেহ তার দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন তালেবান আতঙ্কে। তাকেই দেখা গেল, নিজেকে আফগানিস্তানের ‘প্রেসিডেন্ট’ ঘোষণা করতে। তার দাবি, তিনি নাকি দেশেই আছেন। আফগান দেশে প্রেসিডেন্ট প্যালেস তালেবান দখল করে মসনদে বসে আছে, তার কী হবে? আর টিভি ছবিতে এক সভায় পাশে উপবিষ্ট গনি স্বয়ং বেঁচে থাকতে সালেহ কেন ও কিভাবে প্রেসিডেন্ট হবেন? গনির মেয়াদ তো ফুরিয়ে যায়নি, যদিও তাদের ‘নির্বাচন’ নিয়ে অনেক কথা।

দেখা যাক, এখন অবস্থা কী দাঁড়ায়। তবে কেউ উসকানিমূলক ও হাস্যকর কোনো আচরণ করবেন না বলেই সবার প্রত্যাশা। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের দায়িত্ববোধই মানুষ আশা করছে। Selective Justice নয়; Comprehencive Justice হোক সবার প্রার্থিত ও কাম্য। কারো প্রতি অবিচার নয়; সবার প্রতি সুবিচার করাই একটি শ্রেষ্ঠ নীতি। আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে সবাই বিবেকের টানে আয়নায় নিজ নিজ চেহারা দেখে, কর্তব্য পালনে তথা অন্যায়-অনাচার শোষণ ও বৈষম্য নিরসনে, এগিয়ে আসুন।


আরো সংবাদ



premium cement