২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

সমস্যা শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে

-

গত ১১ তারিখ থেকে কঠোর বিধিনিষেধ অনেকটা শিথিল করা হলেও দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে ইতিবাচক কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। মনে হচ্ছে, দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোই এখন করোনার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। তাই সব কিছুতেই স্বাভাবিকতার ছোঁয়া লাগলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার আশু সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। সম্প্রতি এক সরকারি প্রজ্ঞাপনে করোনা পরিস্থিতির ‘উন্নতি না হওয়া’র কথা বলে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চলমান ছুটি আবারো বাড়ানো হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়- সারা দেশের করোনা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মচারী ও অভিভাবকদের স্বাস্থ্য-সুরক্ষা ও সার্বিক নিরাপত্তা বিবেচনায় কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় পরামর্শক কমিটির পরামর্শক্রমে দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ইবতেদায়ি ও কওমি মাদরাসার চলমান ছুটি আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
করোনার বিস্তৃতি নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে দীর্ঘ পরিসরের এই ছুটিকে কেউ-ই স্বাভাবিকভাবে দেখছেন না। বিষয়টি দৃষ্টি এড়ায়নি জাতিসঙ্ঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর। ইউনিসেফের প্রেস কর্মকর্তা ডয়েচে ভেলেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, জোর করে স্কুল বন্ধ রাখার কারণে বিশ্ব শিক্ষা সঙ্কটের কবলে পড়েছে। তার ভাষায়, বিশ্বব্যাপী স্কুল বন্ধ করার ফলে শিক্ষাসঙ্কট ছাড়াও আগামী কয়েক দশক ধরে বিশ্বে এর নেতিবাচক প্রভাব থাকতে পারে। ফলে বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হবে শিক্ষার্থীরা, যা অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত।

ইউনিসেফের এক জরিপে বলা হয়েছে, বিশ্বের যে ১৪টি দেশে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোর মনে করেন, ‘করোনার দ্বিতীয় বছরেও শিশুরা স্কুলে যেতে পারবে না বা সীমিতভাবে লেখাপড়া করবে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। স্কুল খোলাকে এখন সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়া দরকার। এর জন্য পরিকল্পনা করতে হবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে’। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টরা মোটেই আগ্রহী নন বলে দেখা যায়।

এ দিকে দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি বাড়তে বাড়তে ইতোমধ্যে ৫০০ দিন পেরিয়ে গেছে। অথচ জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেও দেশের শিল্পকারখানাগুলো চালুই ছিল। কোরবানির ঈদ-পরবর্তী সীমিত কয়েক দিনের জন্য এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হলেও গত ১ আগস্ট আবারো খুলে দেয়া হয়েছে। কিন্তু জাতির ভবিষ্যৎ বিবেচনায় যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো খোলার বিষয়ে কর্তৃপক্ষের ইতিবাচক কোনো পদক্ষেপ নেই।

শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, শিক্ষার্থীদের টিকা দেয়া শেষ হলে অল্পসময়ের মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হবে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের টিকা দেয়া কবে নাগাদ শেষ করা হবে তার কোনো সময়সীমা তিনি উল্লেখ করেননি। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে খবর প্রকাশিত হয়েছে, সরকার যে গতিতে টিকা কার্যক্রম পরিচালনা করছে, তাতে দেশের সবার জন্য টিকা নিশ্চিত করতে ৫৭ বছর সময় লেগে যাবে। তাই শিক্ষার্থীদের জন্য টিকা নিশ্চিত করতে কত সময় লাগবে তা কারো কাছেই বোধগম্য নয়। তাই প্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে বড় ধরনের অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে। পাওয়া যাচ্ছে না এর কোনো রোডম্যাপও।

বিভিন্ন মহল থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হলেও বিষয়টি নিয়ে সরকারসহ শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের তেমন মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। তারা সাক্ষীগোপাল হিসেবে অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রমের কথাই ফলাও করে প্রচার করে আসছেন। কিন্তু অনলাইন শিক্ষা আনুষ্ঠানিক শিক্ষার বিকল্প নয়। বিষয়টি সীমিত পরিসরে কার্যকর হলেও দীর্ঘ পরিসরে কোনোভাবেই ফলপ্রসূ হওয়ার সুযোগ নেই। আর এ ক্ষেত্রে আমাদের নানাবিধ সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। এখনো আমাদের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সবার জন্য ইন্টারনেট সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। সব শিক্ষার্থীর হাতে এখন পর্যন্ত স্মার্টফোনসহ প্রয়োজনীয় ডিভাইসও তুলে দেয়া যায়নি। আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা অনলাইন শিক্ষায় অভ্যস্তও হয়ে ওঠেনি। শিক্ষাবিদরা বলছেন, অনলাইন শিক্ষায় শতভাগ সফলতার সম্ভাবনা নেই। তারা পরিস্থিতি বিবেচনায় শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরানো এবং ধারাবাহিক শিক্ষাকার্যক্রমের ওপর গুরুত্বারোপ করছেন; কিন্তু বিষয়টিকে সংশ্লিষ্টরা কোনোভাবেই গুরুত্ব দিচ্ছেন না।

চলমান বন্ধকালে প্রতিষ্ঠানগুলোতে কোনো বার্ষিক বা সমাপনী পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়নি। সীমিত সিলেবাসে অ্যাসাইনমেন্ট-ভিত্তিক মূল্যায়ন করা হচ্ছে। এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা পেয়েছেন অটো পাস, যা শিক্ষার্থীর মেধা ও মনন বিকাশে প্রতিবন্ধক হিসেবেই মনে করা হচ্ছে। তবে এবার অটো পাস না দিয়ে সীমিত সিলেবাসে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা নেয়ার চিন্তা করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইনে ক্লাস নিলেও পরীক্ষা নিতে পারছে না। তাদের ভর্তি পরীক্ষাও নেয়া সম্ভব হয়নি। ফলে আমাদের জাতীয় শিক্ষাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। আর এই বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সরকারের কোনো ইতিবাচক কর্মপরিকল্পনা আপাতত লক্ষ করা যাচ্ছে না।

আসলে বারবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের মেয়াদ বাড়ানোর ঘোষণাটিই নেতিবাচক বলে মনে করছেন দেশবাসী। তারপর শিক্ষা নিয়ে করোনার এই দীর্ঘ সময়ে কোনো সঠিক পরিকল্পনাই করা হয়নি। মনে করা হয়েছিল, যেভাবেই শিক্ষা চালু রাখা হোক না কেন শিক্ষার্থীদের সাথে নিবিড় সম্পর্ক রেখে করা হবে। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। টেলিভিশনের মাধ্যমে পাঠদানের কোনো উন্নতিও লক্ষ করা যায়নি। আর অনলাইন তো গতানুগতিক ও নিয়ম রক্ষার কার্যক্রম। অটো পাসও মেধাবিকাশে বড় ধরনের অন্তরায়। ফলে অটো পাস শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়ছে বিভিন্ন দিক থেকে। যদি শুরু থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হতো, তাহলে হয়তো এখন স্কুল খোলা সম্ভব হতো। অটো পাসও দিতে হতো না। সব খাতে প্রণোদনা দেয়া হলেও শিক্ষা খাত বরাবরের মতো উপেক্ষিতই থেকেছে যা শুধু অযৌক্তিক ও অনাকাক্সিক্ষতই নয় বরং আত্মঘাতীও।

মূলত, শিক্ষার্থীদের শিক্ষার সাথে কোনো আপস করা আত্মঘাতী। ইন্টারনেট ও ডিভাইস সবার হাতে না থাকায় অনলাইন শিক্ষায় সবাই অংশ নেয়ার সুযোগ নেই। ফলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা এবং কম আয়ের পরিবারের সন্তান সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও একই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছোট ছোট পাইলট প্রকল্প করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুল খোলার সম্ভাব্যতা যাচাই করা সম্ভব ছিল; কিন্তু তা করা হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শহরে একটু সমস্যা হলেও গ্রামে পরীক্ষা নেয়া সম্ভব হতো। শহরেও একটু পরিকল্পনা করে পরীক্ষা নেয়া অসম্ভব ছিল না; কিন্তু সরকার সে পথে কোনোভাবেই অগ্রসর হয়নি। সার্বিক বিবেচনায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার কোনো আগ্রহ আপাতত লক্ষ করা যাচ্ছে না। ফলে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে লাখ লাখ শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ।

শিশুদের এখন যে অনলাইন ক্লাস হচ্ছে, তাতে চাইল্ড সাইকোলজির পাঠ থাকা খুবই জরুরি মনে করেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা; কিন্তু বিষয়টিকে কোনোভাবেই বিবেচনায় নেয়া হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনায় স্কুল বন্ধ থাকায় শিশুদের মানসিক সমস্যা চার থেকে আট গুণ বেড়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। শিশুদের জন্য সারা বিশ্বে এখন ‘ব্যাক টু স্কুল’ প্রোগ্রাম শুরু হয়েছে। আমাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিভাগের সেই উদ্যোগ নেয়া উচিত। কিন্তু সরকার বারবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি বৃদ্ধি করে কোনো সম্ভাবনাকেই কাজে লাগাচ্ছে না। ফলে অনিশ্চিতই থেকে যাচ্ছে আমাদের জাতীয় শিক্ষার গন্তব্য।

মূলত দীর্ঘ দিন দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় আমাদের ক্ষেত্রে বড় ধরনের বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে। তাই দেশ ও জাতিকে এই অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি থেকে বাঁচাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। প্রয়োজনে সীমিত পরিসরে পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করে সম্ভাব্যতা যাচাই করে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের অবশ্যই ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। সবকিছু খুলে দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা আত্মঘাতী, যা অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত।

মেইল : smmjoy@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement