হাকিম বনাম দার্শনিক
- মুসা আল হাফিজ
- ১৬ আগস্ট ২০২১, ২০:৩৭
দর্শন মুসলিম ঐতিহ্যে হিকমাহ নামে খ্যাত। আল কিন্দিও একে হিকমাহ বলেছেন। মামুনুর রশীদের দর্শনকেন্দ্রও ছিল বায়তুল হিকমাহ। হিকমাহ কুরআনি এক পরিভাষা। এর আভিধানিক অর্থ-প্রজ্ঞা (wisdom)। কিন্তু কুরআনি পরিভাষায় হিকমার অর্থ বিস্তৃত। জ্ঞান ও আচারে যথার্থতা, ইনসাফ, ন্যায়বিচার ও morality সংক্রান্ত বিশেষ জ্ঞানও এর আওতায় আসে। অর্জিত জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, বাস্তবজ্ঞান, সাধারণ জ্ঞান ও গভীর চিন্তার সমন্বয় ঘটিয়ে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ ও ব্যবহারের ক্ষমতাকেও হিকমাহ বলা যায়।
পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে : আমি তাকে দান করলাম প্রজ্ঞা ও জ্ঞান। (সূরা আম্বিয়া : ৭৯) তখন আমি তাকে প্রজ্ঞা ও জ্ঞান দান করলাম। (সূরা কাসাস : ১৪) তখন আমি তাকে প্রজ্ঞা ও জ্ঞান দান করলাম। (সূরা ইউসুফ : ২২)
এ আয়াতগুলোতে হিকমাত ও জ্ঞানকে পৃথকভাবে আনা হয়েছে। যদি জ্ঞান ও হিকমাত একই বস্তু হতো তাহলে পৃথকভাবে আসত না।
পবিত্র কুরআনের সূরা রুমের ৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে : তারা পার্থিব জীবনের বাহ্যিক দিক সম্পর্কে জ্ঞান রাখে, অথচ পরকালের খবর রাখে না। অতএব, এখানে ‘জ্ঞান’ শব্দটি বস্তুর বাহ্যিক দিক সম্পর্কে অবগত হওয়া অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে।
প্রতিটি যুগে আগত নবীদের আল্লাহ পাক হিকমাহ দান করেছেন। সেই দানের উল্লেখ কুরআনে রয়েছে নানাভাবে। সূরা আলে ইমরানের ৪৮ ও ৮১ নম্বর আয়াতে, সূরা আন নিসার ৫৪ নম্বর আয়াতে, সূরা লোকমানের ১২ নম্বর আয়াতে, সূরা যুখরুফের ৬৩ নম্বর আয়াতে, সূরা বাকারার ২৮৫ নম্বর আয়াতে হিকমাহ দানের উল্লেখ রয়েছে। হিকমাহ আসলে কী? এর পরিচয় নানাভাবে দেয়ার চেষ্টা হয়েছে। ইস্তালাহাতুস সুফিয়্যাহ গ্রন্থে ইমাম আবদুর রাজ্জাক কাসানী প্রদান করেছেন অন্তর্দৃষ্টিময় এক সংজ্ঞা। তার ভাষায়, হিকমাহ হচ্ছে, প্রত্যেক বস্তুর প্রকৃত রূপ, বস্তুর গুণাবলি, বৈশিষ্ট্য, যথোচিত নিয়ম-বিধান, আর অস্তিত্ব জগতের আইন ও শৃঙ্খলা, বিভিন্ন কার্যকারণের রহস্য ও তাদের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ক বিষয়ে অবগতি ও সে অনুযায়ী কাজ চালনা হলো হিকমাহ। হিকমাহর আরো যত সংজ্ঞা আছে, তাতে প্রায় সবাই উল্লেখ করেছেন- প্রতিটি বস্তুর আসল রূপ দর্শন করা হলো হিকমাত। আর যিনি এ দর্শন লাভ করেন তিনিই হলেন হাকিম। নবীগণ এ দর্শন লাভ করেন হাকিকত দর্শনের মাধ্যমে। সরাসরি ওহির মাধ্যমে।
দার্শনিকরা এ হাকিকতের সন্ধান তথা উপলব্ধি লাভের সাধনায় জীবন কাটিয়ে দেন। পশ্চিমা দর্শন সূত্র দিয়ে বুঝতে চায় প্রতিটি বস্তুর সত্যস্বরূপ। ইসলামী দর্শনে তা নবীদের মুশাহাদাহ তথা প্রত্যক্ষণ, অন্তরালোকে নিগূঢ় রহস্যের উন্মোচন এবং সর্বোপরি ঐশী নিশ্চয়তার সাথে মানবীয় সীমার সর্বোচ্চ মানে ও মাত্রায় অবিচল, অকাট্যতার সাথে প্রতিষ্ঠিত। যা প্রতিফলিত হয় ব্যবহারিক প্রজ্ঞায়। যার মধ্যে রয়েছে মানুষ এবং বিশ্বজগতে ব্যাপ্ত খোদার প্রজ্ঞার সাথে যোগাযোগ এবং তার পরিচয় স্পষ্টীকরণ। এ ধারায় মানুষের নিজের সাথে নিজের সম্পর্ক, অন্য মানুষের সাথে তার সম্পর্ক, বিশ্বজগৎ ও প্রকৃতির সাথে তার সম্পর্ক এবং মহাবিশ্বের স্রষ্টা ও প্রভুর সাথে তার সম্পর্কের নীতি ও আচরণের বিধি।
ইসলামী হিকমতে তাফাক্কুর বি আখলাকিল্লাহ বা আল্লাহর সৃষ্টিজগতের গঠন, ক্রিয়া এবং চরিত্র-বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা, জ্ঞান, ধ্যান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে নিহিত আছে বস্তু জগতের উপলব্ধি, উদ্ভিদজগতের উপলব্ধি, পশুসমূহের উপলব্ধি এবং মানবিক উপলব্ধি, যাকে বুদ্ধিবৃত্তি বা আকল বলা হয়ে থাকে। এই বুদ্ধিবৃত্তি সাধনা, আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে ইরফান, ফিকর, তাদাব্বুর, কাশফ ও শুহুদের (Intution) স্তরে উত্তীর্ণ হতে পারে। বস্তু থেকে শুরু করে এই উপলব্ধি ক্রমোন্নয়নমুখী ধারা অতিক্রম করে ইলহাম লাভের উপযোগী হয়ে ওঠে। যা হৃদয়ের প্রত্যক্ষণের পর্যায়ে নিয়ে যায়।
বিষয়টাকে আরেকটু ব্যাখ্যা করি। মুসলিম তত্ত্বজ্ঞানীরা জ্ঞান-প্রজ্ঞার যাত্রায় একজন সালিক বা অভিযাত্রীর চার ধরনের অভিজ্ঞতা ও ধাপ নির্দেশ করেন। প্রথমত তিনি অনুভূতির সহায়তায় চলেন। পঞ্চ ইন্দ্রিয় তাকে জ্ঞান জোগায়। তিনি জ্ঞানীয় বিষয়ের সাথে পরিচিত হতে থাকেন। এ হচ্ছে ইরফান বা তত্ত্ব-পরিচয়ের একটি ধাপ। এই ইরফানের অনেক স্তর রয়েছে এবং এ থেকে এসেছে মা’রিফত বা আধ্যাত্মিকতা। ইসলামে যার উদ্দেশ্য জ্ঞান-সাধনার সব উপায় এবং অভিভূতির সফল বিকাশের মাধ্যমে পরম সত্য বা আল্লাহর পরিচয়ে প্রবুদ্ধ হওয়া। তাহলে এই ধাপে আমরা দেখছি অনুভূতিলব্ধ জ্ঞান থেকে যাত্রা শুরু হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, চোখের সাহায্য ছাড়া দেখা। মানে ভেবে দেখা। নজর ও ফিকির বা যুক্তিপ্রয়োগ ও চিন্তা। এ বিষয়ে মুঈনুদ্দীন আহমদ খানের আলোকপাতের ভাষা সুন্দর। তিনি ভেবে দেখাকে যুক্তি দিয়ে দেখা বলেন। তার ভাষা হুবহু উদ্ধার করছি। তিনি লিখেন, ‘চাক্ষুষ দর্শন বা চোখ দিয়ে দেখা, যেমন ইন্দ্রিয়ানুভূতি বা চর্মচক্ষুতে দর্শন, চোখ বন্ধ করে দেখা, চিন্তা করে দেখা, তেমনি যুক্তি দিয়ে দেখা। এ চাক্ষুষ দর্শনকে গ্রিকরা ফিজিক্যাল বা পদার্থিক জ্ঞান এবং ভেবে দেখাকে পদার্থ অতীত বা মেটাফিজিক্যাল জ্ঞান বলে অভিহিত করে। এরূপ ভেবে দেখা বা যুক্তি দিয়ে দেখাকে গ্রিকরা ফিলসফি বা ফিলজফি বলে। এটি র্যাশিও ও রিজন থেকে র্যাশনাল নলেজ বা ভারতীয় আর্যদের ভাষায় দর্শন। এক কথায় চিন্তালব্ধ জ্ঞানের স্বরূপ দর্শন। আরবিতে একে ফালাসিফা ও ফিকর বা নজর বলে।’ গ্রিক দর্শন এ অবধিই। গ্রিকপন্থার পথিক দার্শনিক ফিজিক্যাল ও মেটাফিজিক্যাল বিষয়াবলির মধ্যেই সচেষ্ট থাকেন, সাধনা করেন। তাহলে আমরা দেখছি ওয়েস্টার্ন ফিলোসফি দুইটি methodology কথা বলেছে। কিন্তু ইসলামিক এপিস্টিমোলোজি, যাকে ইলমে কালাম বলা যেতে পারে, সেখানে ‘judgement’ কিংবা প্রামাণ্যবিষয়ক methodology আরো বেশি। আবার রেশনাল judgement এর ওপর ইসলামিক এপিস্টিমোলোজি যেভাবে আলোকপাত করেছে ওয়েস্টার্ন ফিলোসফি সেইভাবে এগোতে পারেনি।
ইসলামে যার আনুগত্য, তিনি এগিয়ে যান তাদাব্বুরে, হৃদয়ঙ্গমে। তাদাব্বুর মানে, পরিণতি, পেছনের দিক। কোনো বিষয়ের পরিণতি কী এবং বাহ্যদৃশ্যের পেছনের দিক আসলে কী? সেটার ভাবনা তো গুরুতর বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক ব্যাপার। তাদাব্বুরকে যারাই সংজ্ঞায়িত করেছেন, বলেছেন, এ হচ্ছে, কোনো বিষয়ের পরিণতি, তাৎপর্য ও ফলাফল বিষয়ক পদ্ধতিগত গভীর চিন্তা-অন্বেষা ও গবেষণা।
পদ্ধতি ও স্বরূপের সাথে সম্পর্কিত বিজ্ঞান। মা’রিফত ও তাফাক্কুর (‘চিন্তা’ করা, দর্শন) পথে এটি ঊর্ধ্বতন স্তর। ইমাম গাযযালি ইহইয়াউ উলুমিদ্দীন-এ বিষয়টি বুঝিয়ে দিয়েছেন।
ধরো, কেউ একজন ডুবে আছে পার্থিবতার কুহেলিকায়। মোহে ও মায়ায়। তার সামনে হাজির করা হলো পারলৌকিক জীবনের বার্তা। উভয় জীবনের কোনটাকে সে উদ্দেশ্য বানাবে, তা নিয়ে সে ভাবতে লাগল। সামনে সে দেখতে পেল সম্ভাব্য দু’টি পথ। এক পথ হচ্ছে, কারো পেছনে পেছনে হাঁটার। নিজে কিছু বুঝে বা না বুঝে কারো নিকট থেকে পারলৌকিক জীবনের রূপ ও ধরন এবং মহিমা ও অপরিহার্যতা জেনে বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং দুনিয়া ও আখেরাতের মধ্যে কোনটা উদ্দেশ্য আর কোনটা বিধেয় সে সিদ্ধান্ত তার কাছ থেকে নেবে। এটি সর্বনিম্ন রকমের মা’রিফত। যা খুবই দুর্বল।
এ প্রক্রিয়ায় বিশ্বাস আর সিদ্ধান্ত গ্রহণ মোটেও প্রশংসনীয় নয় এবং এর নাম তাকলিদ।
দ্বিতীয় পথ হচ্ছে, লোকটি এই প্রতীতি অর্জন করবে যে, ইহকাল-পরকালের দু’টির মধ্যে একটি হচ্ছে চিরস্থায়ী এবং চিরস্থায়ী প্রাপ্তিটাই হবে উদ্দেশ্য। এরপর সে জ্ঞানসাধনার মাধ্যমে জানল পার্থিবতার রূপ ও ধরন, সমস্যা ও সুযোগ, দুর্বলতা ও সবলতা, স্বরূপ ও প্রকৃতি। জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে সে বুঝতে পারল, উভয়ের মধ্যে চিরস্থায়ী হচ্ছে পরকাল। এরপর পরকালের স্বরূপ, তাৎপর্য ও বাস্তবতার জ্ঞান অর্জন করে সে প্রাধান্য দিলো পরকালকে। এটি হচ্ছে মা’রিফতের পথ।
কিন্তু এই দুই স্তরের মা’রিফত অর্জন করার পরে তৃতীয় আরেক মা’রিফত অর্জন বাকি থেকে যায়। সেটা হচ্ছে, উভয় প্রকারের মা’রিফতকে চিন্তায়, অনুধ্যানে, উপলব্ধিতে, মননে একাকার ও সুস্থির করে নেয়া। এই ‘নেয়া’টার পথে মনের যে কাজ, সেটা হচ্ছে, তাদাব্বুর। এ কাজ ফিকির থেকে গ্রহণ করে ভাবধারা, তাকে মন্থন করে হৃদয় দিয়ে, কাজে লাগায় বিবেকবোধ, সেখান থেকে লাভ করে তত্ত্বজ্ঞান।
হাকিমের পথ এই তত্ত্বজ্ঞানেই থেমে যায় না। তিনি ইলহাম দ্বারাও সমৃদ্ধ হতে থাকেন। যা ওহির ছায়া।
সবার ওপরে রয়েছে ওহি। ওহি তাকে দান করে নিশ্চিত সত্যের বিভা। সরাসরি তা নবীর কাছে আগমন করে। এ হচ্ছে এমন সূক্ষ্ম ও গোপন ইশারা, যা ইশারাকারী ও ইশারা গ্রহণকারী ছাড়া তৃতীয় কেউ টের পায় না। এ মানুষকে সেই সত্যের সন্ধান দেয়, যেখানে তার জ্ঞানের অন্যান্য মাধ্যম খেই হারিয়ে ফেলে। এটি সর্বোচ্চ স্তর। এর ওপর নির্ভর করার মানে অন্যান্য উপায়কে নিষ্ক্রিয় করা নয়। কারণ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে, বুদ্ধির ভিত্তিতে এবং সংজ্ঞার ভিত্তিতে কাজ ও সত্য তালাশের নির্দেশনা ওহির মধ্যেই রয়েছে। ওহি বরং মানবীয় এসব উপায়ের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার উপায়। সব মিলিয়ে একটি কাঠামো, যার মধ্যে রয়েছে একের পর এক সিঁড়ি। কোনোটাই কোনোটাকে অস্বীকার করে না, সহায়তা করে।
তাকী ওসমানী এ সমন্বয়কে প্রথাগত ভাষায় ব্যক্ত করেছেন। তার মতে, মানুষের জন্য অপরিহার্য হলো ‘ইলম’। কেননা সে যতক্ষণ পর্যন্ত না জানবে এই সৃষ্টিজগতের হাকিকত কী, এর কোন বস্তুর কী বৈশিষ্ট্য এবং এর দ্বারা কিভাবে উপকার গ্রহণ সম্ভব, ততক্ষণ পর্যন্ত জগতের কোনো একটি জিনিসকেও সে নিজ কাজে ব্যবহার করতে পারবে না। এমনিভাবে সে যতক্ষণ পর্যন্ত জানতে না পারবে, আল্লাহ তায়ালার মর্জি কী এবং তিনি কোন কাজ পছন্দ ও কোন কাজ অপছন্দ করেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তার পক্ষে আল্লাহ তায়ালার মর্জি মোতাবেক জীবন যাপন করা সম্ভব নয়।
আর এ বিষয়টি একমাত্র ওহির মাধ্যমেই জানা সম্ভব। তাই যুগে যুগে আল্লাহ পাক মানুষের হেদায়েতের জন্য যেরূপভাবে অনেক নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন, তদ্রুপ তাঁদের বিভিন্নজনের উপরে বিভিন্ন প্রত্যাদেশ নাজিল করে স্বীয় বিধানও তাঁদের জানিয়ে দিয়েছেন। আর এটাকেই ওহি বলা হয়।
অপর দিকে পশ্চিমা দার্শনিক জ্ঞানতত্ত্ব নিয়ে গভীর সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যান। এখানে জ্ঞানতাত্ত্বিক আলাপ মূলত horizontal। তাকে তর্ক শুনতে হয় কোনটা নেবেন, কোনটা বাদ দেবেন। কে ভালো, কে খারাপ। বুদ্ধিবাদী হবেন নাকি অভিজ্ঞতাবাদী। কিন্তু বুদ্ধির সাথে কি অভিজ্ঞতার সম্পর্ক নেই? বুদ্ধিতে যা, তা কি মানুষের মধ্যে আগ থেকেই তৈরি হয়ে আসছে না। ফলে উভয়টাকে সমন্বয়ের আলাপও তাকে করতে হয়। সে পথকেও যাচাই করতে হয়।
সঙ্কট এখানেই নয়। পশ্চিমা অর্থে একজন দার্শনিক নিজের উপলব্ধির সীমায় সংশয়কাতর বাস্তবতায় শুরু করেন এবং সংশয়ের উপরে উঠে কোনো নিশ্চয়তায় উপনীত হতে পারেন না। কোনো নিশ্চয়তার দাবি তিনি উচ্চারণ করলেও পরবর্তী পর্যবেক্ষণ তার ফাঁক ও ফাঁকি স্পষ্ট করে দিচ্ছে এবং এভাবেই সাবেক পর্যবেক্ষণকে দুর্বল বা বাতিল দেখিয়ে দর্শন এগোতে থাকে। এক অন্তহীন সংশয়, প্রশ্ন, দ্বিধা ও আত্মখননের মধ্যে দর্শনের আবর্তন। কিন্তু ইসলামের হিকমাহ এই আবর্তনের অংশীদার হতে চায় না, হয় না। নবীদের হিকমাহকে অবলম্বন করে মুসলিম হাকিম বা দার্শনিক এগিয়ে যান।
তবে হিকমাহ যেহেতু খোদার সাথে সম্পর্কভিত্তিক এবং তা যেহেতু প্রধানত আত্মিক প্রত্যক্ষণ ও হাকিকতে উপনীতি, ফলে এর প্রথম ধারক শ্রেণী নবীগণ এবং এ ধারাবাহিকতায় আধ্যাত্মিক মানুষগণ। ইসলামে দর্শন তাই খোদা পরিচয় (মা’রিফত) প্রত্যক্ষণের সদাজাগ্রত অনুভূতি (এহসান) চায়। জ্ঞান ও প্রজ্ঞাই এখানে সবটুকু নয়। কিন্তু স্বচ্ছ ও উদ্ভাসিত জ্ঞান-প্রজ্ঞা ছাড়া মূল বিষয় অর্জিত হবে না। এর সাথে থাকতে হবে প্রবল ও নিরন্তর আত্মশাসন, সাধনা। এমনকি প্রজ্ঞা এখানে তাকওয়া লঙ্ঘন করে হয় না। ফলে পশ্চিমা অর্থে দর্শন এবং ইসলামী অর্থে হিকমাহর মান, পরিধি ও মাত্রায় রয়েছে বিশাল ভিন্নতা। ইসলামের হাকিমের চেয়ে পশ্চিমা দার্শনিক অনেক ভিন্ন, আলাদা। পশ্চিমা অর্থে দার্শনিক জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রতি অনুরাগ দিয়ে সত্য উপলব্ধি করতে চান। আধ্যাত্মিক মানবদের মূল জোর আত্মায়, দার্শনিকদের আসল মনোযোগ বুদ্ধিবৃত্তি ও চিন্তায়। তার আত্মা কখনো আধ্যাত্মিক মানবের বিশালতা-গভীরতাকে ধারণ করতে পারে না। যদি তিনি জ্ঞান-বুদ্ধিবৃত্তি ও আত্মিক সাধনার সমন্বয় নিশ্চিত না করেন। ইসলামের হাকিম বা দার্শনিক এই সমন্বয়ের প্রতীক।
পশ্চিমা অর্থে দর্শন চর্চাকারী মুসলিম হাকিম এর পুরো তাৎপর্যে উপনীত হতে পারেন না। ভিন্নতা থেকেই যায়। গ্রিক দর্শন মুসলিম দুনিয়ায় আগমনের পরে পশ্চিমা অর্থে দার্শনিক শ্রেণির সাক্ষাৎও ঘটল। অতীতের ধারায় দর্শন চর্চার অর্থে তারা হাকিম বলেই পরিচিত হতেন। কিন্তু আগের সাথে এখনকার চর্চায় ব্যবধান ঘটে যায় এবং একসময় তার মধ্যে নিন্দনীয় আবহও চলে আসে।
লেখক : কবি, গবেষক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা