২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০ পৌষ ১৪৩১, ২২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

মনের কাজ ও আল কুরআন

আল কোরআন - ছবি : সংগৃহীত

মনের কাজ নিয়ে ভাবছি। আল্লাহর কালামে তার স্বরূপ কী?
গাজ্জালি ও শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ: হাজির হলেন ভাবলোকে।
গাজ্জালি বললেন, কুরআন নির্দেশিত মনের কাজ হচ্ছে, তাদাব্বুর। সমর্থন করলেন শাহ ওয়ালিউল্লাহ।

তাদাব্বুর মানে পরিণতি, পেছনের দিক।
কোনো বিষয়ের পরিণতি কী? এবং বাহ্যদৃশ্যের পেছনের দিক আসলে কী? সেটার ভাবনা তো গুরুতর বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক ব্যাপার। তাদাব্বুরকে যারাই সংজ্ঞায়িত করেছেন; বলেছেন, এ হচ্ছে কোনো বিষয়ের পরিণতি, তাৎপর্য ও ফলাফলবিষয়ক পদ্ধতিগত গভীর চিন্তা-অন্বেষা ও গবেষণা। পদ্ধতি ও স্বরূপের সাথে সম্পর্কিত বিজ্ঞান। অন্বেষা ও সারসত্য বা হাকিকতের সাথে সম্পর্কিত দর্শন।

এ তো আমার পরম অভিপ্রায়। এর প্রতিটি ধাপে আমার অস্তিত্বের খাদ্য। আমি তাদাব্বুর চাই। একে কর্মরূপ দিতে চাই। কারণ আল্লাহর বাণী প্রত্যাখ্যানকারী হতে চাই না।
ইমাম ইবনে তায়মিয়া রহ: বলেছেন-

‘যে ব্যক্তি কুরআন শরিফ পড়ল না, সে কুরআন শরিফকে প্রত্যাখ্যান করল। যে কুরআন শরিফ পড়ল অথচ তা নিয়ে তাদাব্বুর করল না সে কুরআনকে প্রত্যাখ্যান করল। যে তাদাব্বুর করল অথচ এর ওপর আমল করল না, সেও কুরআনকে প্রত্যাখ্যান করল।’
গাজ্জালিকে বললাম, তাদাব্বুর আপনার বিচারে কী?
জানালেন, জ্ঞাত দুই বিষয়ের সাহায্যে তৃতীয় অজ্ঞাত বিষয় জানার মানসিক প্রক্রিয়া হচ্ছে তাদাব্বুর।

জানতে চাইলাম, এর স্বরূপ কী?
গাজ্জালি বললেন, পরম আত্মঅভিজ্ঞান।
বললাম, একটু ব্যাখ্যা করুন। ব্যাখ্যা ছাড়া লোকেরা কিছুই বোঝে না।
গাজ্জালি বললেন, যারা তাদাব্বুর করবে, তারা আত্মঅভিজ্ঞান না বুঝলে তাদাব্বুর করবে কিভাবে?

বললাম, যারা বোঝে না, প্রধানত তারাই এখন তাদাব্বুরের দাবিদার। তাফসিরুল কুরআনের জমিদারি দাবি করে তারা। অল্প কথায় যা বোঝানো হয়, তা থেকে তারা এমন কিছু বুঝে নেবে এবং লোকদের বোঝাতে থাকবে, যা শুনলে আপনি বেহেশতেও শান্তি পাবেন না।
গাজ্জালি বললেন, তুমি এই সমাজে টুকরো টুকরো চিন্তার কথা বলো কোন সাহসে?
জানালাম, আমাকে তারা সেভাবে শোনে না এবং গ্রাহ্য করে না। ফলে আমি নিজের মতো করে অল্প হলেও বলতে পারছি। যদি ওদের কাছে গ্রাহ্য হয়ে যাই, নিজের কথাটুকু নিজের ধরনে মোটেও বলতে পারব না।

গাজ্জালি বললেন, তোমার এই নৈঃসঙ্গ উদযাপন ক্ষতিকর।
নিবেদন করলাম, আমি নিজেই বরং অসুস্থ প্রবণতার কাছে ক্ষতিকর হয়ে আছি। এতে অসুস্থ সমাজ আমাকে আঘাত করে। খারাপ লাগে বটে! কিন্তু তারা আমাকে গ্রহণ করলে এমনভাবে ও ভাষায় গ্রহণ করত, যাকে আমি আরো বেশি খারাপ মনে করতাম!

গাজ্জালি বললেন, তা হলে তাদাব্বুর তুমি কাকে বোঝাবে?

বললাম, আমি বোঝাব না। বোঝাবেন আপনি। আমি আপনার হয়ে কথাগুলো ছড়িয়ে দেবো। আপনার নাম শুনতে ও শোনাতে তারা মজা পায়, যদিও আপনার চিন্তাকে ধারণের জায়গায় তারা নেই!

গাজ্জালি বললেন, শুনো তা হলে! ধরো, কেউ একজন ডুবে আছে পার্থিবতার কুহেলিকায়। মোহে ও মায়ায়। তার সামনে হাজির করা হলো পারলৌকিক জীবনের বার্তা। উভয় জীবনের কোনটিকে সে উদ্দেশ্য বানাবে, তা নিয়ে সে ভাবতে লাগল। সামনে সে দেখতে পেল সম্ভাব্য দু’টি পথ।
একপথ হচ্ছে, কারো পেছনে পেছনে হাঁটার। নিজে কিছু বুঝে বা না বুঝে কারো কাছ থেকে পারলৌকিক জীবনের রূপ ও ধরন এবং মহিমা ও অপরিহার্যতা জেনে বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং দুনিয়া ও আখেরাতের মধ্যে কোনটি উদ্দেশ্য আর কোনটি বিধেয়, সে সিদ্ধান্ত তার কাছ থেকে নেবে। এটি সর্বনিম্ন রকমের মারিফত বা পরিচয়; যা খুবই দুর্বল।

এ প্রক্রিয়ায় বিশ্বাস আর সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রশংসনীয় নয় এবং এর নাম আততাকলিদুল ফিকরিয়্যু বা বুদ্ধিবৃত্তিক অন্ধ অনুসরণ।

বললাম, এটি তো আমি সমাজকে শোনাতে পারব না। ধড়ের ওপর মাথা থাকবে না।
গাজ্জালি জানতে চাইলেন, কারণ কী?

বললাম, লোকেরা বলবে, আমি তাকলিদবিরোধী। দা, কুড়াল, লাঠি, মুগুর প্রভৃতির অভাব হবে না। ফিকরি তাকলিদ বা চৈন্তিক অন্ধ অনুসরণ এবং ফিকহি তাকলিদ বা আইনগত অন্ধ অনুসরণের পার্থক্য তারা বুঝবে না। আপনি কোনো কিতাবে কথাটি লিখেছেন?
গাজ্জালি জানালেন, লিখেছি, ইহইয়া-উ উলূমিদদীন-এর চতুর্থ খণ্ডে।
বললাম, তা হলে এবার শুনানো যাবে। মানে আপনার তাকলিদ করলেই তারা তাকলিদ না করা বিষয়ক এ কথা শুনবে।

গাজ্জালি বললেন, দ্বিতীয় পথ হচ্ছে, লোকটি এই প্রতীতি অর্জন করবে যে, ইহকাল-পরকালের দু’টির মধ্যে একটি হচ্ছে চিরস্থায়ী এবং চিরস্থায়ী প্রাপ্তিটাই হবে উদ্দেশ্য। এরপর সে জ্ঞানসাধনার মাধ্যমে জানল পার্থিবতার রূপ ও ধরন, সমস্যা ও সুযোগ, দুর্বলতা ও সবলতা, স্বরূপ ও প্রকৃতি। জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে সে বুঝতে পারল, উভয়ের মধ্যে চিরস্থায়ী হচ্ছে পরকাল। এরপর পরকালের স্বরূপ, তাৎপর্য ও বাস্তবতার জ্ঞান অর্জন করে সে প্রাধান্য দিলো পরকালকে।
এটি হচ্ছে মারিফতের পথ। এটি প্রশংসনীয়।

কিন্তু এই দুই স্তরের মারিফত অর্জন করার পরে তৃতীয় আরেক মারিফত অর্জন বাকি থেকে যায়। সেটি হচ্ছে, উভয় প্রকারের মারিফতকে চিন্তায়, অনুধ্যানে, উপলব্ধিতে, মননে একাকার ও সুস্থির করে নেয়া। এই ‘নেয়া’টার পথে মনের যে কাজ, সেটি হচ্ছে, তাদাব্বুর।
শাহ ওয়ালিউল্লাহ মনোযোগসহকারে গাজ্জালিকে শুনছিলেন। কী বিনয় তার!
তার সমীপে জানতে চাইলাম তাদাব্বুরের স্তর সম্পর্কে।

শাহ ওয়ালিউল্লাহ বললেন-
তাদাব্বুরের প্রথম স্তর হচ্ছে, মহাজগতের যিনি নিয়ন্তা, তার সত্তা সম্পর্কে তাদাব্বুর। এই সত্তা তো সীমায়িত নন। সীমার অতিরিক্ত। মনুষ্যবোধের পরিবেষ্টনের ঊর্ধ্বে। তার সত্তার স্বরূপ এটাই যে, তার স্বরূপকে অধিকার করতে পারবে না মানুষের সসীম জ্ঞান। অতএব তার সত্তাকে নিয়ে তাদাব্বুর আত্মঘাতী। একে নিষেধ করেছেন রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। নিষেধ করেছেন সব নবী ও রাসূল!

তাদাব্বুরের দ্বিতীয় স্তর হচ্ছে, মহান আল্লাহর গুণাবলি এবং এর প্রকাশ ও হাকিকত নিয়ে তাদাব্বুর। সূফিরা একে বলেন মুরাকাবা। এটি অর্জন করতে হয় সাধনাধারায়। এর জন্য প্রয়োজন জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও অনুধ্যানের বিশেষ মাত্রা। তাঁর জ্ঞান, তাঁর করুণা, তাঁর ক্ষমতা, তাঁর সৌন্দর্য প্রভৃতি অনুধ্যান কত গভীর, কত অতল! এর স্বাদ কেবল সেই বুঝেছে, যে এ রহস্যসমুদ্রে নিমজ্জিত হয়েছে।

তৃতীয় স্তর হচ্ছে, আল্লাহ পাকের ক্রিয়াকর্ম নিয়ে তাদাব্বুর। তিনি কেন বর্ষাচ্ছেন বৃষ্টি? কেন ফোটাচ্ছেন ফুল? কেন পাকাচ্ছেন ফসল? কেন সাজাচ্ছেন সবুজের গালিচা? কেন গড়েছেন জীবনের লীলামঞ্চ?

কী উদ্দেশ্য দিন-রাতের এই আবর্তনের? কী রহস্য ও লক্ষ্য এই আকাশ-পৃথিবী ও মহাজগতের?
রহস্যনিবিড় এই তাদাব্বুর! আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন, চাঁদের সৌন্দর্য গলে পড়ছে, গ্রহ-নক্ষত্র আবর্তিত হচ্ছে নিরন্তর। আপনি অসীমের সাজানো বাগানে ডুবে অনুসন্ধান করছেন তার সৌন্দর্য!

এ অনুসন্ধান, এ ভাবনা এক ইবাদত।
চতুর্থ স্তর হচ্ছে, বিশ্বজগতের ইতিহাস ও সভ্যতা ও জাতিগুলোর ঘটনাচক্র নিয়ে তাদাব্বুর। কোন জাতিকে কিভাবে তিনি উত্থান দিলেন? কিভাবে দিলেন বিকাশ ও প্রতিষ্ঠা? কিভাবে তারা নিয়ে এলো সুন্দর দিন? কিভাবে তারা খারাপের দিকে ধাবিত হলো? কিভাবে পতন ও অবক্ষয়ের মধ্যে ডুবে গেল? কিভাবে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয় জাতিগুলো? গোষ্ঠীগুলো? কিসে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, জ্ঞানতাত্ত্বিক, সামরিক নেতৃত্ব অর্জন করে জাতিগুলো? কিভাবে হারায়? কিভাবে শাসক হয়? কিভাবে হয় দাস?

এসব নিয়ে তাদাব্বুরে নিহিত আছে আল্লাহর নিদর্শন।
পঞ্চম স্তর হচ্ছে, মৃত্যু-পরবর্তী জীবন নিয়ে তাদাব্বুর। মৃত্যু মানুষের জন্য চিরন্তন এক শিক্ষা। এর স্বরূপ ও অমোঘতা মানুষকে নিত্যই বার্তা দিয়ে যায়। মরণ-পরবর্তী জীবন নিয়ে ভেবে যেতে হবে এবং করতে হবে মনের তৈরি। শেখার জন্য, নিজেকে শুদ্ধ করার জন্য, আলোক লাভের জন্য। পথের পাশে যে কবরস্থান, সে উপদেশ দিচ্ছে। সেখানে ঘুমিয়ে থাকা মানুষের জীবন কেমন, সেটি কি আদৌ জীবন? এ জীবনের ধরন কেমন? কেমন হবে হাশর-মহা উত্থান? কেমন হবে জান্নাত-জাহান্নাম? কর্মফল? আত্ম-পরিণাম? এ ভাবনা কেবল ভাবনা-বিলাস হবে না, কর্মে নিশ্চিত করবে প্রভাব।

যা আমাদের জীবনকে দেয় এবং দিচ্ছে শুদ্ধ ও বুদ্ধ হওয়ার ডাক!

লেখক : কবি, গবেষক


আরো সংবাদ



premium cement
দেশে কুয়াশাসহ মাঝারি ধরনের শৈত্যপ্রবাহের সম্ভাবনা রয়েছে : আবহাওয়া অধিদফতর কামালপুর যুদ্ধের দুই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে জামালপুর সমিতির সম্মাননা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের কা‌ছে নবনিযুক্ত বাংলাদেশী দূতের পরিচয়পত্র পেশ বিশ্বে ক্ষুধার্ত মানুষ বাড়ছে, কমছে ধনী দেশের সাহায্য বড়দিন উপলক্ষে হিলি স্থলবন্দরে আমদানি-রফতানি বন্ধ বিপিএলের সর্বশেষ খবর দুর্নীতির অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি হাসিনাপুত্র জয়ের ছেলে আর ফিরবে না জেনেও ‘হালুয়া’ বানিয়ে অপেক্ষায় থাকেন মা জাহাজে ৭ খুনের ঘটনায় সন্দেহভাজন ব্যক্তি গ্রেফতার মুন্সীগঞ্জে ইউপি চেয়ারম্যানকে আটক করে পুলিশে দিলো ছাত্ররা রাজনীতিতে আ’লীগের আর ফেরা সম্ভব না : ফজলুর রহমান

সকল