দম্ভ নয় বিনয় চাই
- সালাহউদ্দিন বাবর
- ০৭ আগস্ট ২০২১, ২০:৪৫
সমাজে যারা আলোকিত মানুষ তাদের অবস্থান যত উঁচুতেই থাকুক তারা তত বেশি বিবেচক বিনয়ী কৃতজ্ঞতাবোধ প্রকাশে অগ্রগণ্য, সংযত ও ঔচিত্ববোধের সীমার মধ্যে তাদের অবস্থান, বাক্যালাপে পরিশীলিত, অহংকার অহমিকা, দাম্ভিকতা প্রকাশ থেকে বহু দূরে অবস্থান করেন। সমাজ তাদের সে জন্য উচ্চ মর্যাদায় বরণ করে নেয়। তা ছাড়া তাদের সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি আর বিবেচনা সমাজকে বহু আপদ-বিপদ থেকে সুরক্ষা দিতে সক্ষম হয়। সাধারণভাবে একটা কথা প্রচলিত, ফলবতী বৃক্ষ তার ফল ভারে নুয়ে পড়ে। অর যে বৃক্ষ বন্ধ্যা তা কেবল উপরের দিকে উত্থিত হয়। যেমন ‘শূন্য কলস বেশি নড়াচড়া করে’। এসব কথা মনে উদয় হয়েছে এ কারণে যে, গত বছর মহামারী কোভিডের সংক্রমণ কিছুটা হ্রাস পেতে থাকলে সরকারের একজন দায়িত্বশীল নেতা দম্ভভরেই বলেছিলেন, আমরা কোভিডকে নিয়ন্ত্রণ করেছি। সে বক্তব্যে তখন বোদ্ধা সমাজ মনে মনে হলেও তার এই বক্তব্যকে আত্মম্ভরিতা বলেই বিবেচনা করেছিল। তার দৃষ্টি সম্ভবত আত্মপ্রসাদে ছিল আচ্ছন্ন, দৃষ্টি সীমাবদ্ধ ছিল চার দেয়ালের মধ্যে। পক্ষান্তরে, তখন কোভিডের গতি প্রকৃতি এবং করোনাভাইরাসের রূপান্তর নিয়ে বিশেষজ্ঞরা চিন্তিত এবং ভবিষ্যতে এর স্বরূপ কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় সে ভাবনায় ছিলেন উৎকণ্ঠিত।
যখন সেই দায়িত্বশীল দম্ভোক্তি করেছিলেন তখন কোভিড নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ আয়োজন ছিল নিতান্ত অনুল্লেখযোগ্য। বলতে গেলে অনেকটা স্বাভাবিকভাবেই সে সময় সংক্রমণ কমেছিল। আজ অবশ্য সে অবস্থা নেই। কোভিডের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য সতর্কতা, উদ্যোগ আয়োজন বহু গুণে বেড়েছে, চিকিৎসার ব্যবস্থা সম্প্রসারিত হয়েছে, মানুষকে কোভিড প্রতিরোধক টিকা দেয়া হচ্ছে। তবে তার পরও পরিস্থিতি ভয়াবহ। কোভিড সংক্রমণ নিয়ে এখন সরকারি কর্তৃপক্ষের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। তাই এ প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবে আসে, কোভিড নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দম্ভ করে কোভিডের বিরুদ্ধে যুদ্ধেও যে কথা সেই নেতা বলেছিলেন। তার দূরদৃষ্টির অভাব কতটা আর বাগাড়ম্ভর কত বেশি ছিল এবং একজন দায়িত্বশীলের জন্য ছিল কতটা বেমানান। নেতাদের বহু গুণে গুণান্বিত হতে হয়, তাদের দূরদৃষ্টি আর বিভিন্ন বিষয়ে দেশ-বিদেশের সর্বশেষ অগ্রগতি নিয়ে সম্যক ওয়াকিবহাল থাকা অত্যাবশ্যক। অথচ এর অভাবে দেশকে কত নাকালই না হতে হচ্ছে। তাদের প্রতিযোগিতার বিষয় হচ্ছে প্রতিপক্ষকে কে কতটা বাক্যবাণে বিদ্ধ করতে পারে। অর্থহীন এমন সব বাকপটুতা এবং সব কিছু নিয়ে ক‚টরাজনীতি করা অর্বাচীনের লক্ষণ। যে দায়িত্বশীল ব্যক্তির দম্ভের কথা উল্লেখ করেছি তার সেই বক্তব্য দেয়ার পেছনে হয়তো এমন উদ্দেশ্য ছিল, রাজনৈতিক কিছু ফায়দা হাসিল আর কৃতিত্ব জাহির করা। ভাবা উচিত ছিল এমন কথা জনগণের কাছে কতটা ভুল বার্তা নিয়ে যায় আর তারা স্বাস্থ্যবিধি অগ্রাহ্য করতে উৎসাহিত হয়। কেননা কোভিড পরিস্থিতি তো এখন ‘নিয়ন্ত্রণে’। আমাদের দেশের মানুষ এমনিতেই বেপরোয়া, এসব কথা তাদের আরো উসকে দেয়। আজ মানুষের যে দায়িত্ববোধহীন কর্মকাণ্ড, তাতে কোভিড পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যেতে সহায়তা করছে। আবেদন-নিবেদন করা হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য; কিন্তু তা কোনো কাজেই আসছে না। এটা তো আমাদের ‘প্রাপ্য’ই ছিল। দূর অতীত থেকে দেশের মানুষকে কেবল রাজনীতির অ্যাক্টিভিস্ট হতে দীক্ষা দেয়া হয়েছে; নিজ দলের স্বার্থে উচ্ছৃঙ্খল সংঘর্ষ সঙ্ঘাত করতে উৎসাহিত করা হয়েছে। সুনাগরিক হওয়া, বিচার-বিবেচনার দ্বারা সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার শিক্ষা দেয়ার বিষয়টি কস্মিনকালেও দেখিনি। এখন আফসোস করে আর কি লাভ? বঙ্গবন্ধু সম্ভবত এ জন্য দুঃখ করে বলেছিলেন, সোনার বাংলা গড়তে আমি সোনার মানুষ পাইনি; এ কথা তার অনুসারীদের লক্ষ করে বলা হয়েছিল বলে মনে হয়।
দেশের বহু নেতা আজ অথবা গতকাল পরিচালনার রাষ্ট্র দায়িত্ব পালন করেছেন বা এখন করছেন। তারা দেশের চেয়ে দলীয় রাজনীতির স্বার্থকে বিবেচনার সর্বাগ্রে রেখেছেন। তাই তাদের দেশসেবার জন্য কর্মীরা দীক্ষিত হয়নি। দলকেও তারা আধুনিক এই যুগে দেশ পরিচালনার মতো গুণে সমৃদ্ধ করতে পারেননি। ব্যক্তি ও দলের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশকে বিবেচনায় নিতে পারেননি। অথচ এ দেশের যুবসমাজের সম্ভাবনার কোনো ঘাটতির কথা মেনে নেয়া যায় না। এই যুবকরা যখন দেশের বাইরে যায় তখন তাদের কর্মস্পৃহা, মেধা সৃজনশীলতা শত গুণে বিকশিত হয়ে ওঠে। ফলে তাদের পদযুগলে সম্মান মর্যাদা লুটিপুটি খায়।
আমাদের দায়িত্বশীল মহলের বোধ বিবেচনার সীমাবদ্ধতা, পশ্চাৎমুখিতা; পক্ষান্তরে বিশ্বে আমাদের সমপর্যায়ের বা উন্নত দেশের নেতাদের অগ্রসর চিন্তা, দায়িত্ব নির্ধারণ ও পালনের ব্যাপারে একনিষ্ঠতার কথা বিচার করলে ‘ঈর্ষান্বিত’ হতে হবে। তাদের দক্ষ কার্যক্রম ন্যায়নিষ্ঠ এবং মানুষকে সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতিবদ্ধতা আছে। আমাদের কত পেছনে ফেলে তারা চলে যাচ্ছে। তার জন্য কারো গ্লানিবোধ রয়েছে বলে মনে হয় না। কিছুকাল আগে, একটি খবরের ব্যাপারে পাঠক অবশ্যই ভুলে যাননি। সেটি এ লেখায় প্রাসঙ্গিক হওয়ার কারণে স্মরণ করতে চাই। কিছুকাল আগে শিল্পোন্নত সাত জাতির সম্মেলনে সেসব নেতা পৃথিবীর ক্রমাবনতিশীল পরিবেশ ও জলবায়ুর অদ্ভুত পরিবর্তন নিয়ে আলোচনায় বসেছিলেন। সে বৈঠকে আরো একটি বিষয় বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল। বিষয়টি ছিল, ভবিষ্যতে যদি কোভিডের মতো আর কোনো মহামারী পৃথিবীতে আবিভর্‚ত হয়, তবে তার প্রতিকার করার ক্ষেত্রে ১০০ দিনের মধ্যে যাতে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া যায়- এখন থেকেই তার প্রস্তুতি নিয়ে ভাবতে হবে। আসলে তারা বিশ্বকে এমনি এমনি নেতৃত্ব দেয়ার অবস্থানে পৌঁছেননি। নানা বিষয়ে তাদের গবেষণা অনুসন্ধান সব সময়ই চলতে থাকে। সব ক্ষেত্রেই তারা সর্বদা হালনাগাদ থাকেন।
কোভিড নিয়ে শুধু আমরা নই, গোটা বিশ্বই এখন নাস্তানাবুদ। আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থা, ব্যক্তি ও সামষ্টিক যোগ্যতার স্তর, সক্ষম মানুষ ও দূরদৃষ্টির অধিকারী নেতৃত্বের সঙ্কট এসব আমাদের ভয়ানক বিপদের মধ্যে ফেলেছে। তদুপরি রাজনীতিতে এসব ভাবনা উল্লেখ করার মতো নয় বরং বিভিন্ন ইস্যুতে আমাদের স্বভাব, পানি ঘোলা করা। এসব আমাদের বড় অযোগ্যতা। বরং এখন তো আমাদের সার্বক্ষণিক ভাবনার বিষয় হওয়া উচিত অপ্রতিরোধ্য কোভিডকে নিয়ে। জাতিগতভাবেই দেশের মানুষ যেকোনো সমালোচনা নিয়েই ভীষণ স্পর্শকাতর। সমালোচকদের অস্পৃশ্যই মনে করা হয়। সমালোচনার জন্য সমালোচনা আর সৎ উদ্দেশ্যে সমালোচনার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে পারি না। এমনটা সরকারি মহলেই বেশি লক্ষ করা যায়। সব প্রতিপক্ষকে এক পাল্লায় ওজন করা শুদ্ধাচারের পরিপন্থী। কেউ যদি এমন সমালোচনা করে যা সরকারের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে, তা আলোচনায় নিয়ে আসাকে স্বাগত জানানোর মানসিকতা থাকা উচিত। বিশুদ্ধ হওয়া আর ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য তা অত্যন্ত সহায়ক বিষয়। বিজ্ঞজন তো ভুল ভ্রান্তি ধরিয়ে দেয়ার ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে নিজের বন্ধু বলে বিবেচনা করেন। তবে প্রতিপক্ষকেও উচ্চ মানসিকতার পরিচয় দিতে হবে। কাউকে খাটো করা ও হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে কথা বলা হলে নিজেকেই খাটো করে ফেলা হয়। বক্তব্য অভিযোগ পেশের ক্ষেত্রে নিয়ত যেন সৎ হয়, কল্যাণ কামনাই যেন নিমিত্ত হয়।
বিশ্বাসী মানুষ হিসেবে পরনিন্দা পরচর্চার ক্ষেত্রে যে নীতিবোধ রয়েছে তার সীমা লঙ্ঘন করা ঠিক নয়।
সে যাই হোক, অন্যদের কথা ছাপিয়ে একটা কথা সততার সাথে স্বীকার করতে হবে কোভিড নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মানসিকতা, প্রতিশ্রুতিবদ্ধতা কর্মতৎপরতা-দিকনির্দেশনা প্রশংসনীয়। তিনি সম্প্রতি জাতিকে এই আশ্বাস দিয়েছেন- এই জনপদের প্রতিটি ব্যক্তিকে কোভিডের টিকা দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে। বাংলাদেশের মতো একটি দেশের পক্ষে সেটি খুব সহজ ব্যাপার নয়। এ জন্য যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন, সে অর্থের সংস্থান তিনি করেছেন বলে তার বক্তব্য বিবৃতিতেই প্রকাশ পেয়েছে। কোভিড নিয়ন্ত্রণে যে দুর্বলতা আমরা লক্ষ করেছি, সেটি মূলত সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের। কিছুকাল আগে স্বয়ং অর্থমন্ত্রী সরাসরি স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে অভিযুক্ত করেছিলেন। টিকা আনতে যে বিলম্ব ঘটেছে, তার জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রীই দায়ী। তা ছাড়া জাতীয় সংসদেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নানা ব্যর্থতা অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। একটা উদাহরণ দিতে চাই নদীর দেশের মানুষ হিসেবে। আর সেটি হলো, নৌকার দাঁড় বায় ১০ জনে। আর হাল ধরে একজনে। যে ১০ জন দাঁড় বায় তারা যদি ঢিলেমি করে, তবে শুধু হাল ধরে নৌকাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না। দেশের কতক দায়িত্বশীল নেতা বস্তুত নৌকাকে তীরে নিতে সমভাবে কাজ করতে পারছেন না বলে এমন বিষয় উঠে এসেছে।
জনগণ খুশি দেশের প্রতিটি মানুষকে কোভিডের টিকার আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি কথা শুনে। কিন্তু ইতোমধ্যে টিকা দেয়া নিয়ে নানা অব্যবস্থার খবর পত্রপত্রিকায় প্রকাশ পাচ্ছে। সেই সাথে এ খবরও প্রতিদিনই পত্রিকায় পাঠ করছি যে, বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচুর টিকার চালান দেশে আসছে। এই দুটো খবর পাশাপাশি রেখে এখন ভীত হয়ে পড়ছি : টিকা কার্যক্রম না বড় ধরনের সঙ্কটে পড়ে যায়। এত পরিশ্রম চিন্তাভাবনা আর বিপুল অর্থ ব্যয়ে টিকা আনার যে কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে তা বিরল ঘটনা বটে।
কিন্তু ব্যথিত হচ্ছি, উৎকণ্ঠা বোধ করছি এ কারণে যে, নানা বিশৃঙ্খলার খবর শুনছি। টিকা কার্যক্রম নিয়ে পূর্বপরিকল্পনা বা রোড ম্যাপ রচনা করা হয়েছে কি? প্রশাসনের মধ্যে এ জন্য সমন্বিত সুবিন্যস্ত ব্যবস্থা করা আছে কি না। এ লেখায় ইঙ্গিত করা হয়েছে, উচ্চপর্যায়ের কিছু ব্যক্তির কাজে ঢিলেমি দেখা যায়।
সব দায়িত্বশীল যদি এক কদমে চলতে না পারেন, বিশেষ করে টিকা দেয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও দায়িত্বশীলরা, তবে এত পরিশ্রম করার পর তীরে এসে যদি তরী ডোবার উপক্রম হয়- এই হেলাফেলার জন্য কী জবাব সংশ্লিষ্টরা দেবেন? তারা বুঝতে পারছেন কি না জানি না, তাদের অবহেলা জাতিকে কত মারাত্মক ঝুঁকির মুখে ফেলে দেবে। দেশে হাজার হাজার মানুষ কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন। ভবিষ্যতে কত মানুষ মারা যেতে পারেন একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন। লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়ে কত কষ্ট ভোগ করছেন। আর প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। যারা টিকা দেয়া নিয়ে কাজ করছেন, তাদের কাজের গতি বাড়াতে হবে। কেননা দক্ষিণ এশিয়ায় টিকা দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক পেছনে রয়েছে বলে সংবাদপত্রে প্রকাশ। সেই সাথে এটাও উল্লেখ করা দরকার; আগে টিকা নেয়ার ক্ষেত্রে সাধারণের মধ্যে যে অনীহা লক্ষ করা গেছে, তা কেটে গেছে। তারা বরং টিকা নিতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। কিন্তু কেউ যেন মনে না করেন- টিকা নিলেই সব বিপদ কেটে যায়, দেশের সাধারণ মানুষের বোধ বিবেচনায় এমন ধারণাই কাজ করতে পারে। স্বাস্থ্যবিধি মানা এবং সময়ে সময়ে সরকারের এ-সংক্রান্ত নির্দেশাবলি ও পরামর্শ যাতে অনুসরণ করা হয় তারও ব্যবস্থা করা দরকার।
সরকারি কর্তৃপক্ষ ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি ওয়াকিবহাল এ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে যত টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে তার মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যেসব টিকা মানব দেহে প্রয়োগের অনুমতি দিয়েছেন, তা বিশ্বব্যাপী জনগণকে প্রয়োগের কার্যক্রম চলছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এসব টিকা কত সময় পর্যন্ত ব্যক্তিকে কোভিডের সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা দেবে? তার জবাব কিন্তু কোথা থেকেও পাওয়া যাচ্ছে না। এ নিয়ে গবেষণা হচ্ছে বটে; কিন্তু তার কোনো ফলাফল জানা যায়নি। তবে সাধারণভাবে বলা যায় একটি স্থায়ী এবং কার্যকর টিকা আবিষ্কার করতে এক দশকেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে।
এ দিকে টিকা গ্রহণের পুরো কোর্স শেষ করার পর অনেকেই কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন এবং হচ্ছেন। টিকার কার্যকারিতার ব্যাপারে সম্যক ওয়াকিবহাল হওয়ার আগ পর্যন্ত ধরে নিতে হয়, প্রতি বছরই মানুষ নতুন করে টিকা নেয়ার প্রয়োজন হতে পারে। তা ছাড়া বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দু-চার-পাঁচ বছরের মধ্যে কোভিড শেষ হয়ে যাবে- এমনটাও ভাবা যায় না।
এসব বাস্তবতা দরিদ্র দেশগুলোর জন্য কী ভীষণ দুশ্চিন্তার ও দুঃস্বপ্নের কারণ তা সহজেই বোধগম্য। বিশ্বের সাত শতাধিক কোটি মানুষ, তার মধ্যে এখন পর্যন্ত খুব স্বল্পসংখ্যক মানুষকেই টিকার আওতায় আনা গেছে। দরিদ্র দেশের মানুষের জন্য টিকা এখনো বহু মূল্যের সোনার হরিণের মতো হয়ে আছে। অন্যদের কথা তো আছেই, বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষকে টিকার আওতায় আনা শুধু ব্যয়বহুল ব্যাপারই নয়, এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। প্রধানমন্ত্রী এখন এই ঝুঁকি গ্রহণ করে অসীম সাহসিকতা এবং দেশের মানুষের প্রতি তার গভীর মমতা ও দায়িত্বের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। কিন্তু প্রতি বছর সবার জন্য বিনামূল্যে টিকার ব্যবস্থা করা কতটা বাস্তবসম্মত? এত সম্পদ আমাদের কোথায়? তা ছাড়া টিকা দেয়ার জন্য প্রতি বছর যদি গোটা রাষ্ট্রীয় প্রশাসনকে এখনকার মতো ব্যস্ত থাকতে হয়, তবে রাষ্ট্রের আর সব কাজ তো শিকায় উঠবে। আরো বিপদ হচ্ছে প্রতি বছর টিকা দিতে না পারলে, লকডাউনসহ নানা বিধিনিষেধে জাতীয় অর্থনীতিকে ধসিয়ে দেবে। অন্য দিকে কোভিডের টিকা নিতে না পারলে তো মানুষের জীবন বিপন্ন হবে। তা ছাড়া এমন অবস্থা বিরাজ করলে দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। ইতোমধ্যে অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর পাশাপাশি অসংখ্য চিকিৎসক কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন; শুধু তাই নয়, বহু চিকিৎসক এতে মৃত্যুবরণ করেছেন।
আর কোভিডের কারণে কোটি কোটি মানুষ হতদরিদ্র হয়ে পড়েছে। তদুপরি অসংখ্য ছোট মাঝারি এমনকি বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানও বন্ধ হয়ে গেছে, তাতে লাখ লাখ মানুষ বেকার। মানুষ ‘গৃহবন্দী’ হয়ে আছে। কেউ কোথায় যেতে পারছে না। এ এক ভয়ঙ্কর অবস্থা। আর মানুষ দীনহীন হয়ে পড়বে।
আমরা মনে করি রাষ্ট্রীয় প্রশাসন এ ব্যাপারে ঘরের দরজা বন্ধ করে অন্ধকারে বসে রয়েছে এমন হয়ত নয়। পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য হয়তো সরকার ভাবছে, তাদের বিবেচনায় অনেক বিকল্প থাকতে হবে। সাম্প্রতিককালে টিকা সংগ্রহ নিয়ে একমুখিতার কারণে কী ভয়াবহ বিপদ হয়েছে- এই তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা অবশ্যই মন মগজে থাকতে হবে। একটা ধারণা পাওয়া গেছে যা নিয়ে অনেক দিন থেকেই কথা চালাচালি হচ্ছে। বিশ্বের স্বীকৃত অন্তত দু’টি টিকা যৌথভাবে বাংলাদেশে উৎপাদনের ব্যবস্থার কথা শোনা গেছে। কিছুকাল আগে ঢাকার চীন ও রাশিয়ার রাষ্ট্রদূতদ্বয় এমন তথ্য দিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশে টিকা উৎপাদনে সক্ষম কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সাথে এ ব্যাপারে কথা হচ্ছে। তবে এখন এ বিষয়ে কতটা অগ্রগতি হয়েছে সে তথ্য এখনো সাধারণের জানা নেই। আমরা মনে করি , এ ক্ষেত্রে ‘চুক্তি’ হওয়া উচিত। কেননা এমন টিকাই বাছাই করতে হবে- যা মানুষকে সর্বোচ্চ সুরক্ষা দিতে সক্ষম। দেশের বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে টিকা উৎপাদন করতে সক্ষম। তাদের উন্নত ব্যবস্থাপনা, কারিগরি জ্ঞান ও প্রতিষ্ঠানের যন্ত্রপাতির উচ্চ খ্যাতি রয়েছে, যা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছে।
তবে আর একটা বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ টিকা দেয়ার ক্ষেত্রে। সরকারি ব্যবস্থাপনার যে ত্রুটির খবরা-খবর আগে উল্লেখ করা হয়েছে; সে অভিজ্ঞতার ফলে যাতে বেসরকারি পর্যায়ের কার্যক্রমে যেন তেমন কিছু না ঘটে। এ বিষয় সরকারি বিবেচনায় থাকতে হবে। বেসরকারিভাবে উৎপাদিত টিকার বিলিবণ্টনের ক্ষেত্রে একটা সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এখন থেকে গড়ে তোলার কথা ভাবতে হবে। এসব ক্ষেত্রে অবশ্যই সরকারের ‘ইনভলবমেন্ট’ থাকবে বলে আশা করি।
টিকা দেয়ার ক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত লোকবল নিয়েও তদারকি থাকা দরকার। এ নিয়ে প্রশিক্ষণ দ্রুত সমাপ্ত করা দরকার। অনেক ক্ষেত্রে টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেছে। সেগুলো সামলানোর বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এতে মানুষের জন্য বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে।
টিকা উৎপাদন ও বিপণনের ক্ষেত্রে কেবল লাভের কথা বিবেচনায় থাকলেই চলবে না মানবিকতা ও দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার কথা বিবেচনায় রাখতে হবে। সরকারকেও এর সাথে জড়িত থাকতে হবে। কেননা টিকা যদি সাধারণের ক্ষয়ক্ষমতার ঊর্ধ্বে থাকে, তবে আমাদের দারিদ্র্যপীড়িত দেশের মানুষের পক্ষে সেটি নেয়া সম্ভব হবে না। প্রয়োজনে মূল্য গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে রাখার স্বার্থে সরকারকে ভর্তুকি প্রদানে বিষয়টিও ভাবনায় রাখতে হবে। আমাদের প্রত্যাশা, টিকা নিয়ে যে বিরাট কাজ হাতে নেয়া হয়েছে, আল্লাহ যেন তা সফল করেন। স্মরণ রাখা দরকার এ নিয়ে দম্ভ ও আত্মম্ভরিতা প্রকাশ যেন আর না ঘটে। কেননা এসব স্রষ্টার চরম অসন্তুষ্টির কারণ হয়ে থাকে। এসব কাজ প্রকৃতপক্ষে সরকারের দায়িত্বের আওতার মধ্যে পড়ে। তা নিয়ে লম্ফ ঝম্প করা গর্হিত কাজ। আসুন প্রার্থনা করি, আল্লাহ দেশকে সুরক্ষা দিন।
ndigantababor@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা