২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

করোনার টিকা বিজ্ঞানীদের মজার কথা

করোনার টিকা বিজ্ঞানীদের মজার কথা - ছবি : নয়া দিগন্ত

করোনা মহামারী মোকাবেলায় টিকাই এখন বড় অস্ত্র। এ ভাইরাসে এখন পর্যন্ত বিশ্বের সাড়ে ৪২ লাখ মানুষের মৃত্যু এবং প্রায় ২০ কোটি সংক্রমিত হয়েছে। বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টায় উদ্ভাবিত ও অনুমোদিত ১০টি টিকা এখন মানব দেহে প্রয়োগ করা হচ্ছে। ওয়ার্ল্ডোমিটারসের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, এখন পর্যন্ত বিশ্বে ৪১১ কোটি ডোজ টিকা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে সম্পূর্ণ বা দুই ডোজ টিকা দেয়া হয়েছে ১১৩ কোটি মানুষকে, যা বিশ্ব জনসংখ্যার ১৪.৫ শতাংশ। টিকা উদ্ভাবনে যেসব বিজ্ঞানী অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়, তারা এখন আলোচিত মুখ। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় টিকা বিজ্ঞানীদের গবেষণা নিয়ে নানা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এসব প্রতিবেদনে উঠে এসেছে টিকা আবিষ্কারের কাহিনী।

ফাইজার-বায়োএনটেক ও মডার্নার করোনার টিকা দু’টি তৈরি করা হয়েছে মেসেঞ্জার বা বার্তাবাহী আরএনএ প্রযুক্তি ব্যবহার করে। এমআরএনএ প্রযুক্তিতে বিশ্বে এ দু’টি টিকাই প্রথম আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলো ‘নেক্সট জেন টিকা’ বা পরবর্তী প্রজন্মের টিকা হিসেবে পরিচিত। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা এবং অন্য কয়েকটি টিকা ডিএনএভিত্তিক টিকা; অর্থাৎ এগুলো তৈরি করা হয়েছে ভাইরাল ভেক্টর প্রযুক্তি ব্যবহার করে। এগুলোও নেক্সট জেন টিকা।

টিকা আবিষ্কার সময়সাপেক্ষ। কোনো কোনো টিকা আবিষ্কারে ১০ বছরও লাগে। এইচআইভি এইডসের টিকা এখনো উদ্ভাবিত হয়নি। কিন্তু করোনার টিকা মাত্র আট মাসের মধ্যেই আবিষ্কৃত হয়েছে। তৃতীয় ট্রায়াল সম্পন্ন করে নিরাপদ হিসেবেই টিকাগুলো বাজারে এসেছে।
তাড়াতাড়ি করোনা টিকা তৈরির পেছনে কারণ হচ্ছে ভ্যাকসিনগুলো কয়েক দশকের বৈজ্ঞানিক গবেষণার ভিত্তিতেই তৈরি হয়েছে। একই সাথে বিপুল অর্থ ও ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে সরকারি সহযোগিতা ও ভলেন্টিয়ার পাওয়া। এ ছাড়া উহানে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পরপরই দ্রুত চীনা বিজ্ঞানীদের কোভিড-১৯ ভাইরাসের জিনোম প্রকাশ করে উন্মুক্ত করায় ভ্যাকসিন তৈরির অন্যতম কারণ।

করোনাভাইরাসের জেনেটিক সিকোয়েন্স প্রকাশিত হওয়ামাত্র বিজ্ঞানীরা নাওয়া-খাওয়া ভুলে ল্যাবে কোভিড-১৯ এর জিন সিকোয়েন্স পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেন। করোনাভাইরাসের গায়ে সুচালো ফলার মতো লাগানো থাকে। এগুলো ‘এস প্রোটিন’ বা স্পাইক প্রোটিন। বিজ্ঞানীরা চিন্তা করলেন কোভিড-১৯ এর জিনোম পরীক্ষা করে যদি স্পাইক প্রোটিন তৈরির সঙ্কেত ধরা যায়, তা হলে শরীরের মধ্যে গোটা ভাইরাসটি না ঢুকিয়ে সিনথেটিক (ল্যাবে তৈরি করা) ‘মেসেঞ্জার আরএনএ’-এর সাহায্যে শুধু স্পাইক প্রোটিনটিকেই কোষের মধ্যে তৈরি করা যেতে পারে। তা হলেই ইউরেকা! কোষ ধরে নেবে যে শরীরে আসল ভাইরাস ঢুকে পড়েছে। যথারীতি শরীর করোনাভাইরাসের সাথে লড়াই করতে প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবডি তৈরি করতে থাকবে। এভাবেই বিজ্ঞানীরা কম্পিউটারে কয়েকটি আরএনএ ভ্যাকসিন ডিজাইন করেন, যেগুলো মানুষের শরীরে কোষের মধ্যে গিয়ে স্পাইক প্রোটিন তৈরি করার সঙ্কেত দিতে পারে।

আরএনএ এবং ডিএনএভিত্তিক ভ্যাকসিনগুলো শরীরকে প্রয়োজনীয় জিনগত কোড দেয়, যা আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ইমিউন সিস্টেমকে নিজ থেকেই অ্যান্টিজেন তৈরি করতে সহায়তা করে। সবগুলো টিকার সাহায্যেই দেহকে ‘মেমরি টি-লিম্ফোসাইট’ সরবরাহ করা হয়, যা কিভাবে ভবিষ্যতে সেই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে তা মনে রাখবে। টিকা দেয়ার পর শরীরে ‘টি-লিম্ফোসাইট’ ও বি-লিম্ফোসাইটগুলো তৈরি হতে কয়েক সপ্তাহ লাগে।

এমআরএনএ প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞানী ক্যাটালিন ও ড্রিউয়ের গল্প
ফাইজার-বায়োএনটেক ও মডার্নার কোভিড টিকা দু’টি মেসেঞ্জার আরএনএ টিকা। এমআরএনএ হচ্ছে একটি অণু, যাতে প্রোটিন তৈরির নীলনকশা বা ব্লু-প্রিন্ট দেয়া তাকে। ৩০ বছরেরও বেশি ধরে এ প্রযুক্তির ওপর গবেষণা হয়েছে। শুরুতে এমআরএনএ প্রযুক্তিকে কেউই গুরুত্ব দেয়নি। নিরাপদে শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে শান্ত রেখে এমআরএনএ পদ্ধতি ব্যবহার করার অন্যতম পথিকৃৎ হাঙ্গেরীয় বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানী ড. ক্যাটালিন কারিকো ও ড. ড্র্রিউ ওয়াইজম্যান। তাদের আবিষ্কৃত ‘এমআরএনএ প্রযুক্তি’ ব্যবহার করেই তৈরি হয়েছে ফাইজার-বায়োএনটেক ও মডার্নার টিকা।

ড. ক্যাটালিন কারিকোর জন্ম হাঙ্গেরিতে। গোশত বিক্রেতার মেয়ে। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার আগে যদিও তার কোনো বিজ্ঞানীর সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়নি। হাঙ্গেরীয় ইউনিভার্সিটি অব জাগেড থেকে পিএইচডি করেন। এরপর এ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার একটি চাকরিও পেয়ে যান। কিন্তু ১৯৮৫ সালে দেশজুড়ে আর্থিক সঙ্কটে গবেষণা বরাদ্দ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ক্যাটালিনর চাকরিও চলে যায়। চাকরি খুঁজতে গিয়ে আমেরিকার ফিলাডেলফিয়ার টেম্পল বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেলোশিপ পেয়ে যান। দুই বছরের মেয়ে ও স্বামীকে নিয়ে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। পোস্ট ডক্টরাল গবেষণার কাজ। সেই থেকেই এমআরএনএ নিয়ে তার গবেষণা। ক্যারিয়ারের বেশির ভাগ সময় এক গবেষণাগার থেকে অন্য গবেষণাগারে কাজ করেছেন। চাকরি ছিল সাময়িক। কখনোই স্থায়ী চাকরি পাননি। গবেষণার বেশির ভাগ সময়েই কোনো বড় বরাদ্দ পাননি ক্যাটালিন। পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করেন দীর্ঘ দিন। তার ধারণাকে কল্পবিজ্ঞান বলে উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই দমেননি তিনি।

১৯৮৯ সালে এমআরএনএ নিয়ে বড় বড় গবেষণা শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রে। পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী এলিয়ট বারনামন গবেষণার একটি বরাদ্দ পেলেন। সেখানেই বিজ্ঞানী হিসেবে যোগ দেন ক্যাটালিন। উদ্দেশ্য এমআরএনএ-কে কোষে ঢোকানোর প্রযুক্তি উদ্ভাবন। তার পর কোষকে প্রোটিন বানানোর নির্দেশ দেয়া। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গের যাবতীয় কাজে প্রোটিনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। প্রোটিন বানালেই হবে না, নতুন প্রোটিন তৈরি হয়েছে তা প্রমাণও করতে হবে। এ সময় ক্যাটালিন ও এলিয়টের গবেষণা নিয়ে অনেকে হাসাহাসিও করেন। বেশ কিছু দিন পর সবাইকে ভুল প্রমাণ করেন এ দুই বিজ্ঞানী। এমআরএনএ-কে ব্যবহার করে শরীরের কোষকে দিয়েই প্রোটিন তৈরি করেছিলেন তারা। আর বর্তমানে এ পদ্ধতিতে শরীরে সঙ্কেত পাঠিয়ে কোভিডের অ্যান্টিজেন তৈরি হয়। কার্যকরী হয় মানব দেহে প্রতিরোধব্যবস্থা। শরীর মনে রাখে ভাইরাসটির ধরন। একসময় বিজ্ঞানী এলিয়ট পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেন।

ক্যাটালিনর চাকরিও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বলা হয় বরাদ্দ জোগাড় পেলে গবেষণা চলবে। এ সময়ই এগিয়ে এলেন নিউরোসার্জন ড. ল্যাংগার। ক্যাটালিনকে আরো সুযোগ দিতে অনুরোধ করেন। কিছু দিন পর ড. ল্যাংগার চাকরি বদল করে অন্য জায়গায় চলে গেলে আবার সঙ্কটে পড়েন ক্যাটালিন। এ সময় একটি ফটোকপি করতে গিয়ে পরিচয় হয় ড. ড্রিউ ওয়াইজম্যানের সাথে। তিনি পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর। ক্যাটালিন তাকে জানান, এমআরএনএ দিয়ে যেকোনো প্রোটিন বানাতে পারেন তিনি। ড্রিউ চমকে উঠে বললেন, বানিয়ে দেখান, চাকরি দেবো।

তবে শর্ত ছিল ল্যাবের বিকারে নয়, জীবিত প্রাণীর শরীরে করতে হবে। ইঁদুরের শরীরে সফলভাবে এমআরএনএ-এর মাধ্যমে প্রোটিন বানিয়ে দেখালেন। এরপর তারা দুই বিজ্ঞানী এ নিয়ে বিশদ গবেষণা চালালেন। অধিকতর গবেষণায় নানা জায়গায় বরাদ্দের আবেদন করলেন। নামকরা সাময়িকীতে প্রবন্ধ পাঠালেন। ইমিউনিটি নামের সাময়িকীতে প্রবন্ধ ছাপা হলো। কিন্তু বিজ্ঞানী মহলে এ নিয়ে আগ্রহ দেখা গেল না। বরাদ্দও পাওয়া গেল না। ওষুধ কোম্পানির কাছে এ প্রযুক্তির সম্ভাবনা তুলে ধরা হলো। কিন্তু সাড়া নেই। এ গবেষণা করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাটালিনর পদ নামিয়ে দেয়া হয়েছে। বছরে ৬০ হাজার ডলারের বেশি বেতন কখনই আয় করতে পারেননি। অবশেষে আমেরিকার মডার্না ও জার্মানির বায়োএনটেকের নজরে এলেন দুই বিজ্ঞানী। ড. ক্যাটালিন পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যোগ দিলেন ড. উগর শাহিন ও ড. ওজলেম তুরেসির বায়োএনটেক কোম্পানিতে সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে। করোনাভাইরাস মহামারী দেখা দেয়ার পর এই এমআরএনএ প্রযুক্তিরই জয়জয়কার। এ প্রযুক্তি ব্যবহার করেই মডার্না ও ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা তৈরি হয়ে গেল, যা মহামারী অবসানে ভূমিকা রাখছে। ড. ক্যাটালিন কারিকো এখন সারা বিশ্বে একজন নন্দিত বিজ্ঞানী। যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ড. অ্যান্থনি ফাউসি বলেন, এমআরএনএ নিয়ে পাগলের মতো লেগে ছিলেন ড. ক্যাটালিন। শুধু এ টিকাই নয়; ভবিষ্যতে এ প্রযুক্তিতে এইচআইভি, ক্যান্সার, ম্যালেরিয়া ও ইনফ্লুয়েঞ্জারের বিরুদ্ধে উন্নত টিকা যুগান্তকারী পথ দেখাবে। ক্যাটালিন সম্পর্কে তার স্বামীর মন্তব্য, জীবনের বেশির ভাগ সময়ই ক্যাটালিন ল্যাবে কাটিয়েছেন। বয়স এখন ৬৬ বছর। হিসাব করে দেখেছি গবেষণায় ডুবে থাকতে গিয়ে ক্যাটালিন ঘণ্টায় কামিয়েছেন মাত্র এক ডলার। ড. ক্যাটালিন ও ড. ড্রিউ ওয়াইজম্যান তাদের গবেষণার জন্য এখন নোবেল পুরস্কারের দাবিদার।

ফাইজারের টিকার আবিষ্কার উগর-তুরেসি দম্পতির কথা
জার্মানির মাইনজ শহর। এখানে গুটেনবার্গ ১৪৪০ সালে প্রথম ছাপাখানা তৈরি করে পৃথিবীকে বদলে দিয়েছিলেন। এত বছর পর সেই মাইনজ শহরেই ঘটল করোনাভাইরাস টিকা আবিষ্কারের আরেক অবাক করা ঘটনা।

জানুয়ারি ২০২০-এর এক শীতের সকালে ডাক্তার গবেষক ড. উগর শাহিন কফি খেতে গিয়ে বিশ্বখ্যাত মেডিক্যাল জার্নাল ল্যানসেটে দৃষ্টি দিতেই চমকে উঠলেন। চীনের এক নতুন ভাইরাস নিয়ে একটি প্রবন্ধ বেরিয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে নতুন এই ভাইরাস একজন থেকে আরেকজনে সংক্রমিত হচ্ছে। যিনি সংক্রমিত হচ্ছেন তিনি জানতেও পারছেন না ভাইরাসে সংক্রমিত। কারণ তার মধ্যে সংক্রমণের তেমন লক্ষণ ফুটে উঠছে না। লেখাটি পড়ে উগর শাহিন উত্তেজিত। গবেষক স্ত্রী ওজলেম তুরেসিকে ডেকে তাকেও লেখাটি পড়ালেন। তারা বারবার পড়লেন লেখাটি। তখন পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের আগ্রাসী থাবা বিস্তার হয়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্যানডেমিক ঘোষণার দুই মাস আগের এ ঘটনা। কিন্তু লেখাটি পড়ে উগর শাহিন দম্পতি বুঝতে পেরেছিলেন ভাইরাসটি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়ে ছাড়বে।

উগর শাহিনের জন্ম তুরস্কের ইস্কেন্দেরুন শহরে। চার বছর বয়সে অভিবাসী হিসেবে জার্মানিতে আসেন। বাবা ফোর্ড গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে কোনো রকমে সংসার চালাতেন। ছোটবেলা থেকেই তার স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হওয়ার। মা-বাবার টানাটানির সংসারে অনেক কষ্টে চিকিৎসক হন। এতেই থেমে থাকেননি। ১৯৯৩ সালে পিএইচডি করেন। সেখানেই পরিচয় হয় ড. ওজলেম তুরেসির সাথে। তার পর বিয়ে।

তুরেসির জন্ম জার্মানিতে। বাবা-মা ওখানে অভিবাসী হন। বাবা ছিলেন চিকিৎসক। বাবাকে অনুসরণ করে তিনিও চিকিৎসক হন। ইমিউনোলজিস্ট হিসেবে তার খ্যাতি রয়েছে। এ বিজ্ঞানী দম্পতি মিলে মাইনজ শহরে গড়ে তোলেন বায়োএনটেক নামে এক গবেষণা প্রতিষ্ঠান। ক্যান্সার নিয়ে গবেষণার জন্যই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলা হয়।

ল্যানসেটের লেখাটি দু’জন মিলে পড়ার পর উগর তার সাইকেল নিয়ে দৌড়ান রিসার্চ ল্যাবে। উপার্জন যথেষ্টই ছিল। কিন্তু গাড়ি ব্যবহার করেন না। এমনকি নিজস্ব ড্রাইভিং লাইসেন্সও নেই। সেই ল্যাবটিতে তারা দিনের পর দিন ক্যান্সার নিয়ে গবেষণায় ছিলেন। কিভাবে ক্যান্সারের ওষুধ তৈরি করা যায়, প্রতিষেধক টিকা তৈরি করা যায়। নতুন প্রযুক্তি বার্তাবাহক বা ‘মেসেঞ্জার আরএনএ’-এর সাহায্যে ক্যান্সারের ওষুধ তৈরি ছিল লক্ষ্য! তারা ত্বকের ক্যান্সারের টিকা ‘বিএনটি১১২’ তৈরিও করেন। জার্মানিতে দুই বছর আগে এক সেমিনারে ‘এমআরএনএ’ নিয়ে গবেষণামূলক প্রবন্ধও উপস্থাপন করেন। প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলেন, আরএনএ, এমআরএনএ নিয়ে মানুষের বিশদ গবেষণায় ভবিষ্যতে কোনো মহামারীর হাত থেকে মানবসভ্যতাকে বাঁচানো সম্ভব হবে। সেখানেই তার সাথে পরিচয় হয়েছিল ফাইজারের সিইও আলবার্ট বোরলার সাথে। বোরলার মনে গেঁথে গিয়েছিল উগর শাহিনের কথা।

সিবিএস নিউজের ‘সিক্সটি মিনিটস’ অনুষ্ঠানে উগর শাহিন বলেন, ল্যানসেটে পড়লাম চীনের উহানে রহস্যময় ভাইরাসের সংক্রমণের কথা। তখনই বুঝতে পারলাম এ বিপর্যয় রুখতে সময় এসেছে। তার স্ত্রী ড. তুরেগি বললেন, আমরা ভাবতে লাগলাম কিভাবে এই ভাইরাস প্রতিরোধে ভ্যাকসিন তৈরি করা যায়। ল্যাবে আমরা কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন আবিষ্কারের গবেষণা শুরু করি। ক্যান্সার চিকিৎসায় তৈরি ‘এমআরএনএ’-কে করোনার বিরুদ্ধে এমআরএনএ ভ্যাকসিনে রূপান্তরে উদ্যোগ নিই। ফাইজারের সাথে যৌথ উদ্যোগে ভ্যাকসিন তৈরিতে সফল হই। এভাবেই মুসলিম বিজ্ঞানী দম্পতি ড. উগর শাহিন ও ড. তুরেসি প্রথম অনুমোদিত করোনার টিকা তৈরির অন্যতম পথিকৃৎ হয়ে পৃথিবীকে নতুন আশার আলো দেখালেন।

মডার্না টিকার কারিগর ড. কিজমেকিয়া করবেট
মডার্নার টিকা আবিষ্কারের মূল কারিগর নর্থ ক্যারোলিনার কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান বিজ্ঞানী ড. কিজমেকিয়া করবেট। ড. বার্নি গ্রাহামের সাথে কাজ করেন তিনি। বয়স ৩৫। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের (এনআআএইচ) একজন গবেষক। করোনাভাইরাসের টিকা আবিষ্কারের অসাধারণ গবেষণা কাজে এরই মধ্যে টাইম ম্যাগাজিনের পার্সন অব দ্য ইয়ারের শীর্ষ ১০০ জনের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের জৈব প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মডার্না ও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের ভ্যাকসিন রিসার্চ সেন্টার যৌথভাবে কাজ করে করোনাভাইরাসের টিকাটি বাজারে এনেছে। এনআইএইচের এই ভ্যাকসিন রিসার্চ সেন্টারে ড. করবেট কাজ করছেন ছয় বছর ধরে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের পরপরই টিকা নিয়ে ল্যাবে গবেষণা শুরু করেন তিনি।

কিজমেকিয়া করবেটের জন্ম নর্থ ক্যারোলিনার হার্ডল মিলসে ১৯৮৬ সালের ২৬ জানুয়ারি। তিনি বান্টিমোর কাউন্টির মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএস এবং নর্থ ক্যারোলিন বিশ্ববিদ্যালয় চ্যাপেল হিল থেকে মাইক্রোবায়োলজি ও ইমিউনোলজিতে এমএস ও পিএইচডি করেন। পিএইচডির বিষয় ছিল ‘শ্রীলঙ্কার ডেঙ্গু ভাইরাসের প্যাথোজেনেসিসে মানব অ্যান্টিবডিগুলোর ভূমিকা বিশ্লেষণ’। কোভিড-১৯ টিকার জন্যই এখন বিজ্ঞানী মহলে তার পরিচিত। ২০১৪ সালে তিনি এনআইএইচে ভাইরাল ইমিউনোলজিস্ট হিসেবে গবেষণায় যোগ দেন। ২০২০ সালে করোনা মহামারীর শুরুতে ড. করবেট মানুষকে এ ভাইরাস থেকে রক্ষায় একটি ভ্যাকসিন আবিষ্কারে কাজ শুরু করেন। মেসেঞ্জার আরএনএ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভ্যাকসিন আবিষ্কারে সফল হন।

ড. সারাহ গিলবার্টের নেতৃত্বে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা
অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাটির আবিষ্কারের নেতৃত্ব দেন ভ্যাকসিনোলজির অধ্যাপক ড. সারাহ ক্যাথেরিন গিলবার্ট। শিম্পাঞ্জিদের সংক্রমিত করতে পারে এমন একটি কমন কোল্ড বা সাধারণ ঠাণ্ডা-জ্বর তথা সর্দি-কাশির ভাইরাসের (অ্যাডেনোভাইরাস) মধ্যে জিনগত পরিবর্তন এনে অক্সফোর্ডের টিকাটি তৈরি করা হয়েছে। এটিকে এমনভাবে পরিবর্তন করা হয়েছে, যাতে এটি মানবদেহে সংক্রমণ ঘটাতে না পারে। এর মধ্যে রয়েছে করোনাভাইরাসের মূল নকশার একটি অংশ, যা ‘স্পাইক প্রোটিন’ নামে পরিচিত। এই মূল নকশাটি শরীরে প্রবেশ করানো হলে সেটি মানবদেহে স্পাইক প্রোটিন তৈরি করতে শুরু করে। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা তখন এটিকে হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে। এটিকে ধ্বংসের চেষ্টা করে। পরে যখন ওই ব্যক্তি আসল ভাইরাসে অর্থাৎ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবে, তখন তার শরীর আগে থেকে জানবে যে কিভাবে এ ভাইরাসকে প্রতিরোধ করা যায়। এটি ডিএনএ-নির্ভর একটি ভাইরার ভ্যাক্টর টিকা। এ টিকার উদ্ভাবক ড. গিলবার্ট ইনফ্লুয়েঞ্জা, ম্যালেরিয়া ও ইবোলার টিকা তৈরিতেও ভূমিকা রাখেন।

অন্যান্য টিকা
যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ কোম্পানি জনসন এ জনসনের টিকাটিও অ্যাডেনোভাইরাসভিত্তিক ভাইরাল ভেক্টর টিকা। তবে তারা শিম্পাঞ্জি নয়, মানুষের সাধারণ ঠাণ্ডা লাগার জন্য দায়ী তুলনামূলক নিরীহ বা দুর্বল অ্যাডেনোভাইরাস এই টিকার ব্যবহার করেছে।

রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি টিকাটিও অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনার টিকার মতোই ভাইরাল ভ্যাক্টর ব্যবহার করা হয়েছে। তবে চীনে উদ্ভাবিত টিকাগুলো অর্থাৎ সিনোফার্ম ও সিনোভ্যাক করোনার টিকায় নিষ্ক্রিয় ভাইরাস ব্যবহার করা হয়েছে। এসব ভাইরাসকে ল্যাবে তৈরি করে নিষ্ক্রিয় করা হয়। যেন টিকা গ্রহণকারীর সংক্রমণ না হয়। এ ধরনের টিকা নেয়ার পর শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, কিন্তু অসুস্থ হয় না। এই টিকা দু’টিতে অনেক প্রোটিন রয়েছে বলে শরীরে উল্লেখযোগ্য অ্যান্টিবডি তৈরিতে তা অবদান রাখছে।

আমেরিকার বায়োটেকনোলজি কোম্পানি নোভাভ্যাক্স সাব প্রোটিন ইউনিটভিত্তিক আরেকটি করোনার টিকা নিয়ে কাজ করছে। এ টিকায় একটি ভাইরাসের সেই অংশকে ব্যবহার হয়, যা প্রাণঘাতী ভাইরাসকে রুখতে ইমিউন সিস্টেমকে সবচেয়ে বেশি উদ্দীপনা জোগাতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসির মতে, সাধারণ ওষুধগুলো কোনো একটি রোগের প্রতিকার করে সারিয়ে তোলে। কিন্তু টিকার সবচেয়ে শক্তিশালী দিক বা ক্ষমতা হচ্ছে এটি ওই রোগটিকেই প্রতিরোধ
করে।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক


আরো সংবাদ



premium cement