২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

অতুলনীয়-অনুকরণীয় সম্পাদক আবদুস সালাম

- ছবি- সংগৃহীত

আবদুস সালাম। জন্ম ১১১ বছর আগে ২ আগস্ট। চলে গেছেন, তাও ৪৪ বছর হলো। তিনি নেই, কিন্তু এখনো তার সাহস, দেশপ্রেম ও প্রজ্ঞা অতুলনীয় ও অনুকরণীয়। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন প্রখ্যাত এ সাংবাদিক। শতাব্দীর সাংবাদিকতার ইতিহাস লিখলে তাকে বাদ দিয়ে সম্ভব নয়। প্রথিতযশা সাংবাদিক আবদুস সালাম কর্মক্ষেত্রে ভাস্বর দৃষ্টান্ত রেখে যাওয়া মানুষদের একজন। সাংবাদিকতার জগতে তিনি ছিলেন জ্যোতিষ্ক। স্মরণীয় ও বরণীয় সম্পাদকদের হাতেগোনা তালিকায় তার অবস্থান সমুজ্জ্বল ও শীর্ষে। পাকিস্তান থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশর সত্তরের দশক পর্যন্ত যে কয়েকজন মুষ্টিমেয় সম্পাদক তাদের মননশীলতা, দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা, প্রখরতা, দৃঢ়চিত্ততা ও দূরদৃষ্টির জন্য বাংলাদেশে গৌরবোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন আবদুস সালাম তাদের অন্যতম।

পথিকৃৎ সাংবাদিক আবদুস সালাম স্মরণে এক আলোচনায় আরেক গুণী সম্পাদক ও বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মরহুম আহমেদ হুমায়ুন বলেছেন, ‘আবদুস সালামের জীবনী, স্মৃতি ও সাংবাদিক হিসেবে তার স্বীকৃতি আমাকে এই দৃঢ় প্রতীতি দিয়েছে যে, তার পেশাগত বিশ^াসের শক্তি ও নিজের মতপ্রকাশের সাহস থেকে আমাদের শেখার আছে, পাওয়ার আছে। মূলগতভাবে সালাম ছিলেন সাংবাদিক এবং সাংবাদিক হিসেবেই সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে তিনি তার অবদান রাখতে পেরেছিলেন।’

আহমেদ হুমায়ুনের ভাষায়- “আবদুস সালাম বিশ্বাস করতেন, সাংবাদিকতা স্বতন্ত্র ধরনের পেশা। ‘এ প্রফেশন উইথ এ ডিফারেন্স’ বা বাড়তি মাত্রা সম্বলিত একটি কাজ। সাংবাদিকতার সামাজিক ভ‚মিকাই এই পেশাকে স্বতন্ত্র গুরুত্বমণ্ডিত করেছে। শুধু খোঁজখবর দেয়াই নয়, সমাজ পরিবর্তনে, সমাজের কল্যাণকর ক্ষেত্রে ভ‚মিকা রাখতে না পারলে, সত্যের অসঙ্কোচ প্রকাশে সমর্থ না হলে সাংবাদিকতা সার্থকতা পায় না বলে মনে করতেন এই গুণী সম্পাদক। নির্দ্বিধায় সত্য লিখে বারবার রাজরোষে পড়েও নীতির প্রশ্নে আপস করেননি।”

মরহুম আবদুস সালামের জন্ম তৎকালীন নোয়াখালী জেলাধীন ফেনী মহুকুমার ছাগলনাইয়া থানার দক্ষিণ ধর্মপুর গ্রামে। কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে তিনি ইংরেজি সাহিত্যে অনার্সসহ প্রথম বিভাগে এমএ পাস করেন। ১৯৩১ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে প্রথম বিভাগে এমএ পাস করা একমাত্র শিক্ষার্থী ছিলেন আবদুস সালাম। তার প্রখর মেধার বিচ্ছুরণে অভিভ‚ত হন কলেজ কর্তৃপক্ষ। শিক্ষাজীবন শেষে ফেনী কলেজে ইংরেজি প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। মেধার জোরে খুব সহজেই তিনি একটি সরকারি চাকরি পেয়ে যান। অধ্যাপনা ছেড়ে যোগ দেন সরকারের আয়কর বিভাগে। পরে সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্টে যোগ দেন। কলকাতা রেশনিং অফিসে ডিরেক্টর অব অ্যাকাউন্টসের দায়িত্ব পান। আরো পরে যোগ দেন অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস সার্ভিসে। সেখানে বাঙালি কর্মকর্তাদের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ ও ঊর্র্ধ্বতনদের নিপীড়নের প্রতিবাদে ১৯৪৯ সালে সরকারি চাকরি ছেড়ে দেন। শুরু হয় তার কলমের সংগ্রাম।

১৯৫০ সালের ৩ জুন যোগ দেন সদ্যপ্রকাশিত পাকিস্তান অবজারভারের সম্পাদক হিসেবে। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি খ্যাতি অর্জন করেন নির্ভীক সম্পাদক হিসেবে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি অর্থনৈতিক বৈষম্য ও নানা বঞ্চনার বিষয়ে সোচ্চার ভ‚মিকা নেয়ায় পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ ১৯৫১ সালের ১২ ফেব্রæয়ারি পত্রিকাটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। সম্পাদক আবদুস সালামকে গ্রেফতার করে জেলে বন্দী করা হয়। মুসলিম লীগ যতদিন ক্ষমতায় ছিল ততদিন পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ ছিল। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ী হলে পাকিস্তান অবজারভার ফের প্রকাশিত হয়। অবশ্য পাকিস্তান অবজারভারে সম্পাদক হিসেবে যোগদানের আগ থেকেই তিনি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে ‘ইকোনমিক নোটস’ শিরোনামে লিখতে শুরু করেন। গোটা পাকিস্তানে সম্পাদক হিসেবে আবদুস সালাম তারকাখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তার মেধা ও সাহসিকতাকে সম্মান করতেন পাকিস্তানের প্রভাবশালী সংবাদপত্রের সম্পাদকরাও। ফলে পাকিস্তান সম্পাদক পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত করা হয় তাকে। তিনি ১৯৬৩-৬৪ সালে সামরিক শাসক আইয়ুুব খানের সংবাদপত্রের স্বাধীনতাবিরোধী কালাকানুনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেন। তার নির্ভীক সম্পাদকীয় নীতিকে সমিহ করত পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীও। তিনিই প্রথম পাকিস্তানের তৎকালীন প্ররাক্রমশালী স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের লেখা ‘ফ্রেন্ডস নট মাস্টারস’ গ্রন্থে বাঙালিদের সম্পর্কে আপত্তিকর ও অবমাননাজনক মন্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানান। ব্যস্ত সম্পাকীয় জীবনেও তিনি জ্ঞানচর্চায় ব্রতী ছিলেন। সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির অঙ্গনে তার ছিল অবাধ বিচরণ। তিনি পাকিস্তান অবজারভার ও পরে বাংলাদেশ অবজারভারের সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকালে নিজে শুধু সম্পাদকীয় লিখতেন তা নয়, ছদ্মনামে অবজারভারে ‘আইডেল থটস’ শীর্ষক নিয়মিত কলাম লিখতেন।

সম্পাদকীয় নিবন্ধ রচনায় সম্পাদক আবদুস সালামের ভাবনা ছিল ভিন্নমাত্রিক। ইংরেজি সাংবাদিকতা করলেও তিনি বাংলা ভাষার সংবাদপত্রে সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় বিষয়ে অনেক প্রশিক্ষণ কর্মশালায় নির্দেশনা দেন।

পাকিস্তান আমলের একটি সময়ে সম্পাদক আবদুস সালাম রাজনীতিতেও সক্রিয় ছিলেন। যুক্তফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থী হিসেবে পূর্বপাকিস্তান ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অল্প দিনের মধ্যে তিনি সরকারের রোষানলে পড়েন। স্বাধীনতা-পরবর্তী সরকারের নানা ব্যর্থতার বিরুদ্ধে তার ক্ষুরধার লেখনী সহ্য করতে পারেনি তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী। ‘দ্য সুপ্রিম টেস্ট’ শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় লেখার কারণে অপসারিত হন বাংলাদেশ অবজারভারের (পাকিস্তান অবজারভারের পরিবর্তিত নাম) সম্পাদক আবদুস সালাম। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি) ১৯৭৬ সালে গঠিত হলে পথিকৃৎ সম্পাদক আবদুস সালাম মহাপরিচালক হিসেবে যোগ দেন। একই বছর সাংবাদিকতায় অনবদ্য অবদানের জন্য তিনি একুশে পদকে ভ‚ষিত হন।

বাংলাদেশের সংবাদপত্র ও সংবাদমাধ্যম আজ একেবারে খাদের কিনারায়। সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানও দিকভ্রান্ত। সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানের মান নিয়েও নানা আলোচনা চলছে সামাজিক মাধ্যমে। গণমাধ্যমের এ ঘোর দুর্দিনে আবদুস সালামের মতো নির্ভীক, দৃঢ়চিত্ত ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সম্পাদকের অভাব খুব বেশি অনুভ‚ত হচ্ছে।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি, বিএফইউজে


আরো সংবাদ



premium cement