কালাম দর্শন বনাম গ্রিক দর্শন
- মুসা আল হাফিজ
- ২৬ জুলাই ২০২১, ২০:২০, আপডেট: ১০ আগস্ট ২০২১, ১৫:১৬
মুসলিম থিয়োলোজিতে শুরু থেকেই ইলমে কালামের মূল বিষয় ছিল আকিদা। শাস্ত্রীয়ভাবে সেটি আল ফিকহুল আকবার বা ইলুমত-তাওহিদ বা আসসুন্নাহ নামে চর্চিত হচ্ছিল। তখন তার বাকরীতি ছিল একরকম। আব্বাসি আমলে বিভিন্ন জাতি ও সভ্যতার দর্শন ও চিন্তাধারা ইসলামের মূল আদর্শকে বিষাক্ত করতে উদ্যত হয়। তখন সেই ইলমুত-তাওহিদই নতুন বাকরীতি ও পদ্ধতি অবলম্বন করে। বহুমাত্রিক জ্ঞান ও শাস্ত্রের আত্তীকরণ করে। গ্রহণ করে কালাম দর্শনের রূপ। গ্রিক ও অন্যান্য দর্শনের মোকাবেলায় এর নবরূপায়ণ হয়।
এখানে যেটা আলোচনা করা জরুরি, তা হচ্ছে- কালাম দর্শন বা ইসলামী দর্শন কোনোভাবেই ইসলামের বাইরের কোনো উৎস থেকে জন্মলাভ করেনি। এমন কোনো ধারণা হলো সত্যের প্রতি চরম অবিচার। গ্রিক দর্শন থেকে জন্ম নেয়া কালাম দর্শন কিভাবে মোকাবেলা করতে পারত গ্রিক দর্শনের? যেখানে কালাম দর্শনের অগ্রনায়কদের আক্রমণে গ্রিক দর্শনের প্রাসাদের বুনিয়াদই কেঁপে উঠেছিল! সে তার প্রতিপত্তি হারিয়েছিল মুসলিম জাহানে। তার প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বন্ধন আলগা করে এর ওপর অপারেশন চালাল ইসলামী দর্শন। খুঁত ও অগ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করল সম্পূর্ণ বিপরীত দিক থেকে। তাকে আক্রমণ করল, বিফল করে দিলো ইসলামী আকিদাবিরোধী তার সব যুক্তিজাল। এ অবস্থায় বিবেকের কোন রায়ে কালাম দর্শনকে গ্রিক দর্শনের সন্তান হিসেবে প্রতিপন্ন করা যায়?
এটি ঠিক যে, মুসলিম দার্শনিকরা প্লেটো-এরিস্টটলের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। গ্রিকদের পদার্থবিদ্যা ও গণিত দিয়ে তারা উপকৃত হয়েছেন। কিন্তু কালাম দর্শনের প্রধান আলোচ্য বিষয় হচ্ছে খোদাতত্ত্ব। এ বিষয়ে গ্রিক দার্শনিকদের চিন্তাধারা নিয়ে মুসলিম দার্শনিকরা হাসাহাসি করতেন। তাদের থেকে কিছুই নেয়ার ছিল না। কালাম দর্শন এর পরে আলোচনা করে নবুওয়াত ও মৃত্যুর পর পুনরুত্থান নিয়ে। কিন্তু এ বিষয়ে গ্রিক দার্শনিকদের বক্তব্য তারা গ্রহণ করেননি। এ বিষয়ে মুসলিমদের চিন্তাধারা থেকে বহু দূরে ছিল গ্রিক দর্শন। তাদের কাছ থেকে এ জায়গায় নেয়ার মতো কিছুই ছিল না। খোদাতত্ত্ব সম্পর্কে ফারাবি, ইবনে সিনার বক্তব্য মূলত প্রাচীন মুতাকাল্লিমদের বক্তব্যের নবায়ন। ইমাম গাজ্জালি তাদের বক্তব্যকে গ্রিকদের অনুকরণ বলে সমালোচনা করেছেন। কিন্তু ইবনে তাইমিয়া, ইবনে রুশদ ও শিবলি নোমানি দেখিয়েছেন, এ অভিযোগ যথার্থ নয়। তারা বিবিধ ক্ষেত্রে গ্রিক অনুরাগী ছিলেন সত্য, কিন্তু এর চেয়ে সুদৃঢ় সত্য হলো, ইসলামী বিশ্বাস ও জীবনবোধের ওপর তাদের প্রগাঢ় বিশ্বাস।
ইসলামী দর্শনের মেজাজ বুঝতে হলে আবুল বারাকাত, ইমাম গাজ্জালি, ইমাম রাযি, ইমাম আমুদি, ইমাম ইবনে তাইমিয়া প্রমুখের রচনাবলি পড়া উচিত; যা গ্রিকদের ভ্রান্তি, স্ববিরোধ ও দুর্বলতাগুলো প্রমাণ করেই সামনে অগ্রসর হয়েছে। গ্রিক দর্শনে প্রতি বিন্দুমাত্র সমীহ নয়, বরং তার প্রতি একের পর এক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে কথা বলে। মুসলিম দুনিয়ায় গ্রিক দর্শনের চর্চা ছিল এটি সত্য, কিন্তু ইসলামী দর্শন বরাবরই গ্রিক দর্শনের অসারতা প্রতিপন্ন করছিল। মহাকবি জালালউদ্দিন রুমির মসনবি ও দেওয়ান গ্রিক দর্শনের অসারতা বর্ণনায় মুখর। তার একটি পঙ্ক্তি প্রবাদের মর্যাদা পেয়েছে। সেটি হচ্ছে, হেকমতে ইউনানি বা গ্রিক দর্শনের অধ্যয়নে আর কতকাল তুমি পড়ে থাকবে। এবার হেকমতে কোরআনি বা কোরআনি দর্শন অধ্যয়নে মনোযোগী হও।
গ্রিক দর্শনের পদ্ধতির সাথে ইসলামী দর্শনের পদ্ধতির মিল ছিল না। গ্রিকদের দার্শনিক পদ্ধতি ছিল সংজ্ঞায়ন ও যুক্তি, সিদ্ধান্ত। গ্রিক সংজ্ঞায়নের সফল রূপ হচ্ছে মানুষের সংজ্ঞায়ন। সেটি কেমন? গ্রিকরা তর্কশাস্ত্রের নিয়মে সেটি করেন। সুগরা কুবরা ও নতিজা মিলিয়ে সিদ্ধান্ত নেন। সুগরা হলো সব মানুষ প্রাণী, কুবরা হলো মানুষমাত্রই যুক্তিবাদী; অতএব নতিজা বা উপসংহার হলো মানুষমাত্রই যুক্তিবাদী প্রাণী। এ থেকেই মানবজনমকে সার্থক করতে রেশনালিজম ও যুক্তিবাদের ওপর চূড়ান্ত জোর দেয়া হয়।
গ্রিকদের যুক্তিবাদের ভিত্তি এ সংজ্ঞায়নে ওপর। কালাম দর্শন গ্রিকদের দর্শন ও যুক্তিবাদের প্রধান ভিত্তিটাকেই অসার প্রমাণ করে দেয়। ইমাম গাজ্জালি রহ: গণিত ও অ্যালজেব্রার সাহায্যে গ্রিক যুক্তিবাদ খণ্ডন করেন। তিনি সুগরা কুবরা ও নতিজাকে ভুল প্রমাণ করেন বাস্তব গাণিতিক নিয়মে।
এটি ছিল এক বিপ্লব। গ্রিক সংজ্ঞায়ন ও যুক্তিবাদ অচল হয়ে গিয়েছিল। ধারাটা বুঝলে বিষয়টি সহজেই হৃদয়ঙ্গম করা যাবে। যেমন ধরুন, গ্রিকরা মানুষের সংজ্ঞায়নে যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন, সেটি ভুল হয়ে যায়, যদি দেখানো যায় যে, যুক্তির ব্যবহার মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীর মধ্যেও থাকতে পারে। অন্য দিকে এমন মানুষের সাক্ষাৎ পাওয়া যেতে পারে, যারা কোনো কোনো পশুর চেয়ে কম যুক্তিবাদী। ধারণা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে গ্রিক সিদ্ধান্তকে অন্য কোনো শক্তিশালী মাধ্যমে প্রমাণ করা যায় যে, ওগুলো অকাট্য সত্য নয়। ফলত এর ভিত্তিতে যে সংজ্ঞা তারা স্থির করেন, সেটিও চূড়ান্ত সত্য হতে পারে না। গাজ্জালি সেটিই করলেন। তার্কিক সিদ্ধান্তের অসঙ্গতি তিনি দেখিয়ে দিলেন গাণিতিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে। গাজ্জালি খুবই শক্তিশালী অস্ত্র ব্যবহার করেছিলেন। কারণ গণিত ও অ্যালজেব্রা যুক্তিবাদের চেয়েও অকাট্য বিজ্ঞান।
ইসলামী দর্শন কখনোই সংজ্ঞায়ন ও যুক্তিবাদের মাধ্যমে সিদ্ধান্তে যায় না। গ্রিকদের সংজ্ঞায়ন ও যুক্তিবাদ তাই মুসলিম দার্শনিকদের হাতে সমালোচিত হয়েছে প্রথম থেকেই। এ সমালোচনায় মুতাজিলি হন আর আশআরি মাতুরিদি হন, কেউ কোনোভাবেই পিছিয়ে ছিলেন না। ফলে আমরা দেখি গাজ্জালি, ইবনে তাইমিয়ার বহু আগেই যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে কঠোর আওয়াজ তুলেছেন মুসলিম দার্শনিকরা।
ইসলামী দর্শনে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া হলো সূত্রায়ন বা ফর্মুলা। সূত্রায়ন বা ফর্মুলেশন ইসলামী জ্ঞানের অন্যতম ভিত্তি। ইলমের মাধ্যমে হাকিকতে পৌঁছাতে হবে।
গ্রিক দর্শনের মৌলিক আলোচনার সাথে মিল ছিল না মুসলিম দর্শনের। ইসলামী দর্শন যখন বলা হয়, এর মূল বুনিয়াদ আল্লাহতে বিশ্বাস মানতে হয়। সেখানে ইসলামের সাথে গ্রিক চিন্তার দূরত্ব মেরুসমান।
এরিস্টটলের ঈশ্বর আছেন আবার নেই। কারণ তার ঈশ্বর অস্তিত্বশীল নন। অস্তিত্বশীল ঈশ্বরকে হতে নেই। কেননা অস্তিত্বশীল হতে হলে থাকতে হবে আকার ও উপাদান। এ দুটোর কোনো একটি না থাকলে অস্তিত্ব হয় না। কিন্তু ঈশ্বর আকার হলেও উপাদানহীন। কেননা তিনি বিশুদ্ধ আকার। বিশুদ্ধ আকার হলো সব আকারের আকার। সব আকারের আকার মানে উপাদানহীন আকার। আকারে যখন উপাদান থাকবে, বিশুদ্ধ আকার হবে না তা। আর আকার ও উপাদান যখন থাকবে না, অস্তিত্ব আছে বলা যাবে না।
অস্তিত্ব যখন নেই, ব্যক্তিত্ববান সত্তার আচরণও নেই। সৃষ্টিও নেই, পরিচালনাও নেই। এরিস্টটলের ঈশ্বর জগতকে না বানান, না চালান। তিনি কেবল ফার্স্ট মুভার। কিন্তু যিনি জগতকে বানান না, চালান না, তিনি কি ঈশ্বর? এ ঈশ্বরের থাকা কি ঈশ্বরের থাকা?
এখন বলেন, ইসলামী দর্শনে যে খোদাতত্ত্ব, তার সাথে এরিস্টটলীয় খোদাতত্ত্বের কী সম্পর্ক?
ইসলামের খোদা সৃষ্টি করেন, প্রতিপালন করেন, নিয়ন্ত্রণ করেন। এরিস্টটলের খোদা শুধু সব কারণের কারণ। শুধু প্রথম গতিদাতা। ইসলামের খোদা সত্তা ও গুণাবলির পরিপূর্ণ ধারক। এরিস্টটলের খোদা একান্তই ব্যক্তিহীন। ইসলামের খোদা ভালোর জন্য পুরস্কার দেন, মন্দের জন্য দেন শাস্তি। এরিস্টটটলের খোদা বিচার করেন না। ইসলামের খোদার কাছে মানুষ প্রার্থনা করে, এরিস্টটলের খোদা এমন কেউ নন, যার কাছে প্রার্থনা করা যায়। ইসলামে খোদার অস্তিত্ব অনাদি, অনন্ত। এরিস্টটলের খোদার অস্তিত্বই নেই। কেবল তা এক বাস্তবতা।
গ্রিক দর্শন পরকাল সম্পর্কে উদাসীন, কিংবা কাল্পনিক কথাবার্তা বলে। মুসলিম দর্শনের কাছে ইহকাল ও পরকাল সমান গুরুত্বপূর্ণ। পরকালীন জীবনের সব কিছু মুসলিম দর্শনে পরিষ্কার। বিশ্বটা কোথা থেকে এলো? আমরা এখানে কেন? আমাদের করণীয় কী? ইত্যাদি বিষয় গ্রিক দর্শনের মূল আলোচ্য।
কিন্তু ইসলাম এসব বিষয়ে ওহিভিত্তিক জ্ঞান প্রদান করে। ফলে মুসলিম দর্শন আরেক ধাপ অগ্রসর হয়ে আলোচনা শুরু করে; অর্থাৎ ইসলামী দর্শন শুরু করে সেখান থেকে যেখানে আসতে আসতে গ্রিক দর্শন ক্লান্ত হয়ে যায়। ইসলামী দর্শনের মূল প্রশ্ন ছিল মানুষের ইহকালীন জীবনের সাথে পরকালীন জীবনের সম্পর্ক। মুসলমানদের মনে প্রশ্ন জেগে ওঠে অন্য রকম। তাদের জিজ্ঞাসা ছিল মানবিক জীবনে স্বাধীনতা জরুরি, কিন্তু এই স্বাধীনতার স্বরূপ কী? তাৎপর্য কী? মানুষের চিন্তা ও কর্মের স্বাধীনতার ধরন কেমন? কতটুকু এর পরিসর? এর সাথে ইহকাল পরকালের সম্পর্ক কতটুকু? এসব প্রশ্ন ঠিক ঈমান ও আমলের সাথে হাজির হয়ে গিয়েছিল। মুসলিমদের বিশ্বাসের জগৎ ঈমান যেভাবে এসব প্রশ্নে মুখর ছিল, তেমনি কর্মের জগৎ বা আমল এসব বিষয়ের পর্যালোচনায়ও ছিল। এগুলো কোনো শৌখিন ভদ্রলোকীয় আলোচনা ছিল না। গ্রিক দর্শন ছিল একশ্রেণীর ভদ্রলোকের আলোচনার বিষয়। কিন্তু ইসলামী দর্শনের আলোচ্য বিষয়গুলো নিবিড়ভাবে প্রাত্যহিক বিশ্বাস ও কর্মের সাথে জড়িত ছিল। ইচ্ছা ও কর্মের স্বাধীনতা প্রশ্নে অনেকেই বহিরাগত নানা চিন্তাধারার সাথে মিলিয়ে একে বিশ্লেষণ করতে থাকলেন। ফলত এ প্রশ্নে তিনটি পরস্পরবিরোধী মতবাদ জন্ম নেয়। এগুলো হচ্ছে জবরিয়্যা, কাদরিয়্যা ও মুরজিয়্যা। এসব মতবাদ বাইরের উপাদান ও চিন্তাধারা দিয়ে যতটা প্রভাবিত হয়েছে, ততটাই বিচ্ছিন্ন হয়েছে ইসলামের মৌলিক ভাবধারা থেকে। ততটাই বিচ্ছিন্ন হয়েছে মুসলিম সমাজ থেকে। মুসলিম মিল্লাতে এসব মতবাদ গ্রহণীয় হতে পারেনি ইসলামী দর্শনের উৎস থেকে অনেকটা সরে গিয়ে এরিয়ান রোমান, মিসরীয় খ্রিষ্টীয় ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হওয়ার কারণে।
লেখক : কবি, গবেষক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা