২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বিশ্ববিদ্যালয় হাবে ঈদ

ঈদের নামাজে লেখক - ছবি : নয়া দিগন্ত

এক মাসের বেশি সময় ধরে আমেরিকায় আছি। দেশে ফেরার কথা থাকলেও কোভিডের কারণে স্থগিত রাখতে হয়েছে। এবার ঈদুল আজহার দিনটি কেটেছে ম্যাসাচুসেটস রাজ্যের বোস্টনে। ছেলে এমআইটিতে পড়াশোনা করছে। সেই সুবাদে আসা। বিদেশ বিভূঁইয়ে ঈদ উদযাপন আমার জন্য বিরল এক অভিজ্ঞতা। এর আগে পিএইচডি করার সময় চার বছর দেশের বাইরে (যুক্তরাজ্যে) ঈদ করতে হয়েছে। এ ছাড়া এটি আমার জীবনের দ্বিতীয় ঈদ যা দেশের বাইরে উদযাপন করলাম। ১৯৯৬ সালে এক কনফারেন্স উপলক্ষে মালয়েশিয়া ছিলাম। তখন সেখানে ঈদ করেছি।

গত বছর পর্যন্ত বাকি ঈদগুলো মায়ের সঙ্গে করেছি। গত কোরবানির ঈদের আগের দিন আমার মা ইন্তেকাল করেন। বাবা ইন্তেকাল করেছেন ২০১০ সালে। বাবার অনুপস্থিতি মাকে দিয়ে পূরণ করছিলাম। তাই জুলাই মাসটি আমার জন্য শোকের। মাকে ছাড়া এটি আমার দ্বিতীয় ঈদ। মায়ের অভাব সবসময় তীব্রভাবে অনুভব করি । মা-বাবাকে হারিয়ে মনে হয় মাথার ওপরে থাকা ছাদটি হারিয়ে গেছে। আমার মা-বাবা দু’জনেই আমার সঙ্গে থেকেছেন। তাদের ইন্তেকালের সময় কাছে থাকতে পেরেছি। এ জন্য নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি। অতীতে বহুবার আমেরিকায় আসলেও ঈদের সময় থাকিনি। তুলনামূলক দীর্ঘ সময় আমেরিকাতেই আমার থাকা হয়েছে। অন্য কোনো দেশে কনফারেন্স বা কোনো অনুষ্ঠান উপলক্ষে যেতাম। তবে সাত-আট দিনের বেশি থাকা হয়নি। আম্মা বেঁচে থাকতে যতটা সম্ভব দেশে থাকার চেষ্টা করেছি। ওনাকে রেখে বিদেশে সময় কাটানো ভালো লাগত না। এবারই প্রথম একটানা এক মাসের বেশি সময় দেশের বাইরে আছি। আম্মা বেঁচে থাকলে এবারের ঈদও হয়তো দেশেই কাটাতাম। মা দীর্ঘদিন কঠিন রোগে শয্যাশায়ী ছিলেন। কিন্তু কথা বলতে পারতেন। বিদেশে গেলেও টেলিফোনে কথা হতো। মা-বাবা সন্তানদের জন্য অনেক বড় সম্পদ। যাদের মা-বাবা বেঁচে আছেন, তাদের উচিত এই সম্পদের যথাযথ যত্ন নেয়া। যাদের মা-বাবা বেঁচে নেই তাদের জন্য দোয়া করা। বাবার সান্নিধ্য পেয়েছি প্রায় ষাট বছর। আর মাকে প্রায় সত্তর বছর। এটা এক বিশাল ব্যাপার। মা মারা যাওয়ার পর দিন ছিল ঈদ। ছোটবেলা থেকে ঈদগাহে ঈদের জামাত পড়েছি। গত বছর ঈদগাহে নামাজের ব্যবস্থা করা হয়নি। কোভিড পরিস্থিতির কারণে ঢাকায় বাড়ির মধ্যেই ঈদ জামাতের ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। এবারও দেশের কোভিড পরিস্থিতি খুব ভালো নয়। তবে বোস্টনের পরিবেশ ভিন্ন। এখানে কোভিডের প্রকোপ কমে এসেছে। প্রায় সবাই টিকা নিয়েছে। মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক নয়। মাস্ক ছাড়াই মানুষ সর্বত্র চলাফেরা করছে।

বোস্টনকে বলা হয় ‘হাব অব ইউনিভার্সিটিজ’। শহরটিতে ১৬টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। আর ম্যাসাচুসেটস রাজ্যে এর সংখ্যা ৫৫টি। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় মানের শতাধিক কলেজ রয়েছে। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় এমআইটি, হার্ভার্ড, বোস্টন ইউনিভার্সিটি এখানেই। বিশ্বের আর কোনো শহরে এত সেরা ইউনিভার্সিটির সমাবেশ ঘটেনি। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে অবশ্য আমেরিকানদের চেয়ে বিদেশী শিক্ষার্থী বেশি। সবচেয়ে বেশি চায়নিজরা। বাংলাদেশীও আছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয় স্কলারশিপ দিয়ে বিদেশী মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিয়ে আসে। এখানে এসে একটি মজার বিষয় লক্ষ করেছি। সেটা হলো ছেলে-বুড়ো সবাই শরীর ‘ফিট’ রাখতে খুবই সচেতন। এমআইটির ক্যাম্পাসসংলগ্ন এলাকায় ছেলের বাসায় থাকছি। ক্যাম্পাসের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে চার্লস নদী। ঘর থেকে বের হলেই দেখি লোকজন শরীরচর্চার হরেক রকম কসরতে ব্যস্ত। প্রতিটি সড়কে হাঁটা চলা ও সাইক্লিংয়ের আলাদা লেন আছে। সারা দিনই লোকজন দৌড়াচ্ছে বা সাইক্লিং করছে। বয়সের বাছবিচার নেই। কেউ দৌড়াচ্ছে, কেউ হাঁটছে, কেউ ব্যায়াম করছে, কেউ পড়াশোনা করছে, দলবেঁধে আলোচনা করছে... এক কথায় কেউ অলস বসে নেই। গোটা শহরের একই অবস্থা। দেখে মনে হবে শহরটি যেন কোনো এক অজানা প্রতিযোগিতায় মত্ত হয়ে ছুটে চলছে।
পশ্চিমা বিশ্বে পোশাকের সংস্কৃতি বেশ চোখে লাগে। বিশেষ করে মেয়েদের সংক্ষিপ্ত পোশাক ব্যক্তিগতভাবে আমার দৃষ্টিকটু মনে হয়। যদিও এখানকার সংস্কৃতি এটাই। আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাসে ছেলেমেয়েদের যেরকম বেলেল্লাপনা বা অসামাজিক দৃশ্য চোখে পড়ে এখানে এক মাসেরও বেশি থেকেও তেমন কিছু এখানে দেখিনি। ইউরোপে অবশ্য এটা দেখেছি। সেই দিক দিয়ে বোস্টনের ক্যাম্পাস বেশ পরিচ্ছন্ন। এর অন্যতম কারণ, এখানে ছেলেমেয়েরা একই হোস্টেলে থাকতে পারে। যেসব ছেলে-মেয়ে বিয়ে ছাড়াই একত্রে থাকে বা ‘লিভ টুগেদার’ করে তাদের ‘কাপল’ বলে। তাদের জন্য কোয়ার্টার রয়েছে এখানে। ইনডোরে অবাধ মেলামেশার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু প্রকাশ্যে আপত্তিকর কোনো কিছু নেই।

বোস্টনে মুসলিম কমিউনিটি বেশ বড়। প্রভাবশালী। এখানে মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় এক লাখ। বাংলাদেশীদের সংখ্যাই প্রায় ২৫ হাজার। শহরে মসজিদের সংখ্যা ১৫-২০টির কম হবে না। প্রতিটির সঙ্গে আছে ইসলামিক সেন্টার। ঈদের নামাজ পড়েছি বোস্টনের নেইবারহুড ‘রক্সবারি নামক এলাকার মসজিদে। এটা অনেক বড়। এই অঞ্চলের কেন্দ্রীয় মসজিদ। আমি নদীর যে পাশে থাকি সেটা ক্যাম্ব্রিজ এলাকায়। আর মসজিদ নদীর অপর পাড়ে বোস্টনে পড়েছে। সকাল সাড়ে ১০টার জামাতে অংশ নিই। এটা তৃতীয় জামাত। এর আগে আরো দু’টি জামাত হয়েছে। নামাজ পড়তে আগেই অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করে নিতে হয়েছে। গম্বুজ ও মিনারওয়ালা বিশাল মসজিদ। বহু দেশের বিচিত্রসব মানুষের সঙ্গে ঈদের নামাজ পড়া আসলেই আনন্দের। ইমাম সাহেব সম্ভবত আরব। অবশ্য তার সাথে আলাপ করার সুযোগ হয়নি। চেহারা দেখে মনে হলো মিসরীয় বা সিরিয়ান হবেন, ফর্সা চেহারা। আমেরিকার বেশির ভাগ মসজিদের ইমাম আরব থেকে আসা। তাদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মিসরীয়। আমেরিকাতে আরব কমিউনিটি বেশ প্রভাবশালী। আরব মুসলিমের সংখ্যা বেশি। আফ্রিকান কালো আরব যেমন আছে; তেমনি ফর্সা, বাদামি চেহারার আরবও আছে। মিসরীয় বা মরক্কোর অধিবাসীরা আফ্রিকান হলেও তাদের গাত্রবর্ণ ফর্সা। ইমাম সাহেব বয়ানে কোরবানির প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। আল্লাহ কিভাবে স্বপ্নের মাধ্যমে ইবরাহিম আ:কে নিজ সন্তানকে কোরবানির নির্দেশ দেন, তার বিস্তারিত বর্ণনা করেন। নবীদের স্বপ্ন সবসময় সত্য হয়। ইবরাহিম আ: যখন ছেলে ইসমাইল আ:-এর কাছে স্বপ্নের কথা বলেন, সাথে সাথে ছেলে তা মেনে নিয়ে আল্লাহর হুকুম তামিল করতে বলেন। হজরত নুহ আ: স্বপ্নের মাধ্যমে মহাপ্লাবনের বার্তা পান। তিনি এর প্রস্তুতি হিসেবে বিশাল নৌযান তৈরি করতে শুরু করেন। শুকনো জনপদে এমন কাজ করতে দেখে নুহ আ:কে পাগল ভাবে মানুষ। নৌকা তৈরির পর নুহ আ: যখন তাঁর সন্তানকে এতে আরোহণের আহ্বান জানান, তখন সে ওই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে জবাব দেয়- কোনো প্লাবন এলে সে পাহাড়ে উঠে জীবন বাঁচাতে পারবে। এখানে ইমাম সাহেব যা বলতে চেয়েছেন, তা হলো কাউকে বুঝানোর ক্ষেত্রে বাচনভঙ্গি কেমন হবে। অর্থাৎ সন্তানের প্রতি পিতা-মাতাকে সহনশীল হতে হবে। সে যদি বখেও যায়; তবুও স্নেহ, মমতা দিয়ে ভালো কাজের দিকে আহ্বান করতে হবে। কোরবানি নিয়ে অনেক আলোচনা শুনেছি। কিন্তু রক্সবারি মসজিদের ইমামের আলোচনা অনন্য মনে হয়েছে। কোরবানির আলোচনায় ঠিক এই পয়েন্টটি হাইলাইট করতে কখনো শুনিনি।

ঈদের জামাতে আরব, বাঙালি, পাকিস্তানি, ভারতীয়, আফ্রিকানসহ বহু দেশের মানুষ অংশ নেয়। সবার পোশাক, গাত্রবর্ণ, চেহারা, দৈহিক গড়ন বিচিত্র। তবে বিদেশে মুসলিম কমিউনিটিগুলো নারীদের পর্দা বা হিজাবের ধারণাটি কিভাবে ব্যাখ্যা করেন তা জানা নেই। কারণ অনেক শহরের রাস্তায়, এমনকি মসজিদে নামাজে অংশ নেয়া অনেক মুসলিম নারীকে আঁটসাঁট পোশাক পরতে দেখেছি। মাথায় স্কার্ফ আছে ঠিকই, কিন্তু গায়ের পোশাক ততটা ঢিলেঢালা নয়। এ প্রবণতা আমাদের দেশেও সাম্প্রতিক সময়ে শুরু হয়েছে। ইসলাম নারীকে এমন পোশাক পরতে বলে যা তার দৈহিক গড়নের প্রকাশ ঘটাবে না। নারী-পুরুষ উভয়ের পোশাক হবে তাকওয়ার অংশ। এ ধারণা অনুযায়ী পশ্চিমা বিশ্বের অনেক মুসলিম কমিউনিটিতে নারীদের পোশাক মানসম্মত মনে হয়নি। নামাজের পর দুই আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে যাই। সেখানে অনেক অতিথির সমাগম হয়। সেখানেও বাংলাদেশী মেয়েদের মধ্যে দুই-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সত্যিকারের হিজাব পরতে কাউকে দেখিনি। পোশাক দেখে মনে হবে যেন পাল্লা দিয়ে পশ্চিমাদের অনুকরণ করছে। এ দৃশ্য অবাক ও ব্যথিত করেছে। ইসলামের সত্যিকারের যে শিক্ষা, বিশেষ করে হিজাবের যে শিক্ষা এবং নারী ও পুরুষের মেলামেশায় যে বিধিনিষেধ রয়েছে; সেটি থেকে আমরা কত দূরে সরে গেছি এখানে এসে উপলব্ধি করতে পারি। আমেরিকান সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের অনেকের লীন হয়ে যাওয়া দেখে দুঃখবোধ হয়েছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়েও বাংলাদেশীদের এ অবস্থা দেখেছি। পশ্চিমা সংস্কৃতি মানুষকে ধর্মবিমুখ করে তুলছে। মেয়েদের পোশাক কতটা সংক্ষিপ্ত করা যায়; সেটাই এ দেশের সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতি মুসলিমদের প্রভাবিত করছে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। অবশ্য এমন মেয়েও আছে যে কিনা ইসলাম নিয়ে ভালোভাবে পড়াশুনা করে। মর্ম উপলব্ধি করে ইসলামী জীবনধারার অনুসারী হয়েছে। আমেরিকায় আমার অনেক বন্ধু এবং ছাত্র-ছাত্রী আছে। তাদের বেশির ভাগ এখানে পরিবার নিয়ে বসবাস করছে। এখানে বাংলাদেশীদের অন্যতম সমস্যা হলো স্বকীয়তা হারানোর প্রবণতা। কেউ মুসলিম জীবনযাত্রা নির্বাহ করতে চাইলে তাকে সাংস্কৃতিক সংঘাতে অবতীর্ণ হতে হবে। আমেরিকান সংস্কৃতির সাথে তার দ্বন্দ্ব বাধবে। মাঝে কয়েক দিন মিশিগানে ছিলাম। সেখানে একটি বাঙালি পাড়া আছে। গিয়ে মনে হয়েছে যেন বাংলাদেশেই আছি। সেখানকার মেয়েরা বাংলাদেশী মেয়েদের স্টাইলে হিজাব পরছে, চলাফেরা করছে। এটি দেখে বেশ ভালো লেগেছে।

আমেরিকায় বাংলাদেশী মুসলিম বাবা-মার জন্য মেয়ে বিয়ে দেয়া একটি বড় সমস্যা। আমার বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিতজনদের অনেকে বলেছেন, এখানে মেয়েদের বিয়ে দেয়া সহজ হয় না। মেয়েরা সহজে বিয়ে করতে চায় না। তারা উচ্চতর ডিগ্রি নেয়া, চাকরি করা, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চিন্তায় বিভোর থাকে। আমার পরিচিত অনেকের মেয়ের বিয়ে হয়নি। ছেলেদের বিয়ে করানো সহজ। অনেকে দেশে গিয়ে ছেলেদের বিয়ে করিয়ে আনেন। ছেলের বউ এখানে এসে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে। কিন্তু মেয়ের বেলায় সেটা হয় না বললেই চলে। এখানকার পরিবেশে বেড়ে ওঠা মেয়েরা খুবই স্পর্শকাতর। খুবই সিলেকটিভ। তারা বাংলাদেশে গিয়ে বিয়ে করতে রাজি নয়। তারা মনে করে, বাংলাদেশী স্বামী তাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করবে। আবার বাংলাদেশে তাদের যোগ্য ছেলে পাওয়াও মুশকিল। যারা বাংলাদেশে বড় হয়েছে; তারা এখানে এসে কতটা মানিয়ে নিতে পারবে সে প্রশ্নও থাকে। সব মিলিয়ে মেয়েদের বিয়ে দেয়া নিয়ে বাঙালি মুসলিম কমিউনিটির বাবা-মায়েদের পেরেশানিতে থাকতে দেখেছি।

উপমহাদেশের সংস্কৃতিতে বড় হওয়া মানুষের আমেরিকায় গিয়ে শেষ বয়সে সমস্যায় পড়তে হয়। এখানে বৃদ্ধ বয়সে বাবা-মা বলতে গেলে বিচ্ছিন্ন ও নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করেন। এ জীবন বেশ কষ্টের। সেই তুলনায় বাংলাদেশে আমরা অনেক ভালো আছি। এখানকার আইন ও সংস্কৃতি অনুযায়ী ছেলেমেয়ের বয়স ১৮ বছর হওয়ার পরই তারা বাবা-মা থেকে আলাদা হয়ে যেতে চায়। ছেলেমেয়েরা বিভিন্ন রাজ্যে পড়াশোনা বা কাজ করতে চলে যায়। তারা বাবা-মার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে পারে না বা রাখে না। হয়তো বছরে একবার জন্মদিন বা কোনো উপলক্ষে আসে। শেষ বয়সে দেশে গিয়ে থিত হওয়াও সম্ভব হয় না। দেশের পরিস্থিতির সাথে মানাতে পারবে কি না সে চিন্তা থাকে। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে। আমেরিকায় অন্তত একটি নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন করা যায়। কিন্তু সব মিলিয়ে এখানকার বয়স্করা ভালো আছেন বলে মনে হয়নি। একাকিত্ব নিয়েই তাদের জীবনের শেষ দিনগুলো পার করতে হয়। এটা মুসলিম পিতা-মাতার জন্য বড়ই পীড়াদায়ক। মুসলমানদের পারিবারিক বন্ধন, পোশাক-আশাক, খাদ্যাভ্যাস পশ্চিমাদের মতো নয়।

আমেরিকায় অনেককে চিনি যারা দীর্ঘদিন ধরে আছেন। তাদের ছেলেমেয়েরা এখানে বড় হয়েছে। কিন্তু দেশের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। বাবা-মায়েরা কখনো সন্তানদের দেশে নিয়ে যাননি। সন্তানরাও এখন বাড়ির কথা ভালোভাবে বলতে পারে না। একজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তার বাড়ি কোথায়। সে চট্টগ্রাম বলতে পারলেও কোন থানায় বলতে পারেনি। বলেছে, আমার জন্ম হয়েছে আমেরিকায়। কখনো বাংলাদেশে যাইনি। এটা একটি বড় সমস্যা। আমেরিকায় আমাদের এমন একটি প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে; যারা বাংলাদেশে আর যেতে চায় না। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত হলেও বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। অনেককে বুঝানোর চেষ্টা করেছি; তারা যেন দেশের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে। অবশ্য একটি ভালো দিক হলো, গত পাঁচ-দশ বছরে বাংলাদেশ থেকে যারা এখানে এসেছেন, বিশেষ করে আমার ছাত্রদের মধ্যে যারা পিএইচডি করতে এসেছে তাদের পরিবারগুলো যতটা সম্ভব মুসলিম সংস্কৃতি অনুসরণ করছে। তাদের স্ত্রী, মেয়েরা হিজাব পরছে। এখানে ইসলামিক স্কুল আছে। বাংলাদেশী শিক্ষার্থীরাও সেখানে পড়াশোনা করে। যেখানে মুসলিম সংখ্যা বেশি সেখানে মসজিদ আছে। মসজিদের সাথে ইসলামিক সেন্টারও রয়েছে। এগুলোতে মুসলিম ছেলেমেয়েরা ইসলামী শিক্ষা লাভ করে।

বাংলাদেশী পরিচিতজনদের বলার চেষ্টা করেছি, তারা যেন ছেলেমেয়েদের ছোট থাকতেই এরকম কোনো ইসলামিক সেন্টারের সাথে যুক্ত করে দেন। তাহলে তারা ইসলামের বিধিবিধানগুলো জানতে পারবে। তাদের বাঙালি এবং মুসলমান এ দুই পরিচিতির ভিত্তিতে মানুষ করতে হবে। কোনো একটি পরিচয় ভুলে গেলে চলবে না। তারা যেন বছরে একবার বাংলাদেশে আসেন। ছেলেমেয়েদের সাথে নিয়ে আসেন সেই অনুরোধও করেছি। আমেরিকা থেকে যখন ছোটবেলায় কেউ এখানে বেড়াতে আসবে তখন সে আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে যে আদর যতœ পাবে সেটা তার স্মৃতিতে গেঁথে থাকবে। এই পারিবারিক বন্ধনের সাথে তাদের পরিচিত করানো উচিত। তারা আমেরিকাতে এটা পাবে না। ছোট অবস্থায় আসা-যাওয়া করলে দেশের প্রতি আলাদা একটি টান তৈরি হবে। নিজের দেশকে তারা ভালোবাসবে।

আমেরিকায় বাংলাদেশী মুসলিম কমিউনিটিতে আরেকটি সমস্যা লক্ষণীয়। সেটা হলো বাংলা ভাষা নিয়ে সমস্যা। এখানে অনেক বাংলাদেশী বাসাতেও ইংরেজিতে কথা বলেন। ফলে তাদের সন্তানরা আর বাংলা শিখছে না। বাসায় অন্তত বাংলা ভাষার চর্চা থাকা উচিত। এটা না হওয়ায় বাংলাদেশ থেকে কেউ বেড়াতে এলে তার সাথে বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েরা ঠিক মতো ‘কমিউনিকেট’ করতে পারে না। আমার জোরালো আবেদন থাকবে, যারা বিদেশে গিয়ে দীর্ঘদিন থাকার চিন্তা করেছেন তারা যেন বাসায় অন্তত বাংলায় কথা বলেন, বাংলা ভাষার চর্চা জারি রাখেন। সন্তানকে ইংরেজি ভাষা শেখার দরকার নেই। তারা বাইরে চলাফেরা বা স্কুলে গিয়ে এমনিতেই তা শিখে ফেলবে। বাসায় বাবা-মা যদি বাংলায় কথা বলেন, তাহলে সন্তানরাও বাংলা শিখবে। বাংলাদেশের সংস্কৃতির সাথে তাদের সম্পর্ক তৈরি হবে। মুসলিম ও বাংলাদেশী পরিচিতি ধরে রাখতে পারলে তারা বিয়ে-শাদিসহ অন্য যেসব সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে তার অনেকগুলোই কাটানো যাবে বলে মনে করি।

আমেরিকান সংস্কৃতিতে এখন পরিবার ব্যবস্থা একরকম উঠেই গেছে। এখানকার সংস্কৃতিকে ‘নগ্ন সংস্কৃতি’ বললে অত্যুক্তি হবে না। সেখানকার সংস্কৃতি ধারণ করে কারো পক্ষে আর মুসলিম বা বাঙালি থাকা সম্ভব নয়। দুই সংস্কৃতি এক সাথে ধারণ করা কঠিন। মুসলিম বাবা-মা যদি সন্তানদের ইসলামী শিক্ষা না দেন; তাহলে ওরা ওই খোলামেলা সংস্কৃতিই আত্মস্থ করবে।
লেখক : ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্স এবং সাবেক ডিন ও অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অব ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিস্ট্রি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মেইল : cmhasan@gmail.com

 


আরো সংবাদ



premium cement