২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

আনন্দ ও বিস্ময়ের যত কথকতা

-

সরকারি তথ্য উদ্ধৃত করে সম্প্রতি সংবাদপত্র ও অন্যান্য মিডিয়ার মারফত জনগণ জেনেছে, দেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়ে ৭২ বছরে উন্নীত হয়েছে। এই তথ্য জেনে আমরা যুগপৎ আনন্দিত এবং কিছুটা বিস্মিতও বটে। আনন্দিত হয়েছি এ জন্য, দেশের মানুষ অনেক দিন বেঁচে থেকে স্রষ্টার অফুরান নিয়ামত উপভোগ করতে পারবে, বিশ্বের অপার সৌন্দর্য অবগাহন করা যাবে, স্বজন সুহৃদ বন্ধুবান্ধর হিতাকাঙ্ক্ষীদের মধুর সান্নিধ্য লাভ দীর্ঘতর হতে পারবে, আল্লাহ তায়ালার করুণা লাভের জন্য ইবাদত-বন্দেগি করা যাবে। কথায় আছে ‘ওল্ড ইজ গোল্ড’। এতে প্রবীণদের অভিজ্ঞতাসঞ্জাত জ্ঞান বুৎপত্তি আরো সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে। সঞ্চিত সেই জ্ঞান আর উপলব্ধি সমাজকে বোধ বিবেচনার স্তর উচ্চতর পর্যায়ে উন্নীত করে তোলার জন্য অবদান রাখতে পারবে, অনেক তথ্য ও তত্ত¡সম্ভার বিলিয়ে দিতে সক্ষম হবে। এসব প্রবীণের নখদর্পণে ভেসে বেড়ায় বহু ইতিহাস আর নানা উত্থানপতনের যত কথকতা। এসব বিষয় তারা উত্তরসূরিদের মাঝে সঞ্চারিত করে দিয়ে যেতে পারবেন।

আর বিস্মিত হয়েছি এমনটা ভেবে, আজ যেখানে হাজার মানুষ কোভিডে আক্রান্ত; প্রায় ২০ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যুর কথা শোনা যায়; তা ছাড়া বিপুলসংখ্যক মানুষ চরম দরিদ্রতার মধ্যে জীবন অতিবাহিত করছে, দু’বেলা যাদের খাবার জোটে না, অনাহারে-অর্ধাহারে কাটে দিন, চরম পুষ্টিহীনতায় অসংখ্য শিশু-কিশোর নানা রোগে ভোগে, যেখানে শিশুমৃত্যুর উচ্চ হার, ন্যূনতম চিকিৎসা লাভের সুযোগও সাধারণের সাধ্যের বাইরে, বহু মানুষের মাথার উপর নেই তেমন কোনো ছাউনি, গরিব মানুষ সীমাহীন বৈষম্যের শিকার, যোগ্য আর ভালো-মন্দ বুঝে ওঠা, সচেতন হওয়ার জন্য শিক্ষা লাভের সুযোগ থেকে হাজার শিশু বঞ্চিত, মানবাধিকারের ক্ষেত্রে যত প্রতিবন্ধকতা। সে দেশে মানুষ কিভাবে পেল এই দীর্ঘ দিন বেঁচে থাকার এত প্রাণশক্তি? কোন অজানা শক্তির বলে এতসব প্রতিক‚লতা জয় করতে সক্ষম হলো তারা? কোন অদৃশ্য শক্তির মদদে দেশের মানুষ দীর্ঘ আয়ু পাওয়ার ক্ষেত্রে এতটা এগিয়ে নিতে পেরেছে? সে জন্য কখনো কখনো মনে উঁকি দেয়, এ কি সংখ্যাতত্ত্বের কোনো হেরফের? যে দু’টি সূত্র দীর্ঘ জীবন লাভের তথ্যাদি প্রকাশ করেছে, তারা সরকারি জরিপের উদ্ধৃতি পেশ করেছেন। কিন্তু কবে কখন এমন জরিপ পরিচালিত হয়েছে এবং কাদের মাঝে এই জরিপের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে, তার কোনো ঘোষণা কখনো শুনতে পাইনি।

এসব বক্তব্য ছিদ্রান্বেষণের নিমিত্তে বা দুরভিসন্ধিমূলক বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কোনো কিছু নয়। বরং তথ্যের এবং দেশের বাস্তবতার মধ্যে যে বৈপরীত্য, তারই প্রেক্ষাপটে স্বাভাবিক জিজ্ঞাসা, আর অনুসন্ধিৎসু মনের কৌত‚হল। হ্যাঁ, স্রষ্টা এমন মিরাকেল ঘটাতে পারেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর এ কথা প্রত্যয়ের সাথে বলতে চাই, সাংবাদিকরা রাজনীতি করেন না। রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিস্টদের মতো পথেঘাটে ক‚ট রাজনীতির চর্চা, প্রচার-প্রপাগান্ডা চালানোর নোংরা রুচি সাংবাদিকদের নেই। সাংবাদিকদের অবশ্যই একটা রাজনৈতিক বিশ্বাস আছে, সেটি কেবল ভোটচর্চার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। অন্যত্র নয়। বরং সমাজের অনিয়ম, অবক্ষয়, আর যত বৈপরীত্য, মানুষের বঞ্চনাজনিত দুঃখ কষ্ট, সরকারি অর্থ সম্পদের অপচয় ও অনিষ্ট করা- এ সবই তাদের দায়িত্বানুভূতিকে নাড়া দেয়। তাই সেখানেই তারা কলম চালনা করে। তাদের এ জন্য কম দুর্ভোগ সহ্য করতে হয় না, হুমকি-ধমকি সাংবাদিকদের নিত্যদিনের অভিজ্ঞতা। কিন্তু তারা অকুতোভয়, কেননা দেশ জাতি জনগণের জন্য কাজ করার উদ্দেশ্যে তারা ‘কমিটেড’। রাজনৈতিক দ্বেষ-বিদ্বেষ তাদের কাছে কোনো ‘ফ্যাক্টর’ই নয়।

আমরা ধরেই নিতে চাই, প্রকাশিত আয়ুবৃদ্ধির তথ্যে কোনো ত্রুটি নেই; কিন্তু যে বাস্তবতা দেশে বিরাজ করছে তাতে এগিয়ে যাওয়ার জো কোথায়? যেসব সমস্যার জন্য এমন সংশয়, তার সুরাহা করার উদ্যোগ গত ৫০ বছরে কতটুকু কী করা হয়েছ? এমন প্রশ্ন তো উঠতেই পারে এবং তা অস্বাভাবিক নয়।

এসব সমস্যার সুরাহা করা নিয়ে কিছু পথ যে এগোনো গেছে তা অবশ্যই স্বীকার করব। তবে সমস্যার সাগরে তা কিন্তু অনেকটা বারি বিন্দুর মতো। এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন আজ যারা ক্ষমতায় রয়েছেন তাদের ঘাড়েই এর দায় চাপানো হবে। এই দায় অতীতে যারা দায়িত্বে ছিলেন তাদেরও অবশ্যই ‘শেয়ার’ করতে হবে। কেননা, যে সমস্যা এখন স্তরে স্তরে পুঞ্জীভূত হয়েছে, সেটি আজ তৈরি হয়নি। আর এটাও আমাদের দৃষ্টি এড়ায়নি যে, সমস্যার সাগরে ভাসমান তরীকে তীরে নেয়ার কিছু চেষ্টা উদ্যোগ চলছে। তবে তার গতিকে ত্বরান্বিত করতে ‘দশে মিলে করি কাজ’ এমন দশের সাপোর্ট খুবই জরুরি। সেই দশের দায়িত্বশীলতা ও নিষ্ঠার স্ফুরণ ঘটাতে হবে। কিন্তু সেই দশের সবাই একযোগে জোরকদমে চলতে পারছে কি? ধরুন না, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কথা। এ নিয়ে আমরা কিছু বলব না। পাঠক, নিশ্চয়ই সংসদে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নানা দুর্নীতি অনিয়ম অদক্ষমতা অপারগতা নিয়ে তুলাধোনা করা হয়েছে, তাতে তাদের তো কোনো কূট উদ্দেশ্য ছিল না। তথ্যভিত্তিক সেসব সমালোচনা তো আর শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো অবস্থায় নেই। এও বিবেচনায় থাকতে হবে, কোনো অবস্থায় কোনো দেশে শুধু নেতার ঘাড়ে সব বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয় না। নেতৃত্বের প্রধান দায়িত্ব হলো নীতিনির্ধারণ আর সব দিকে নজর রাখা।

লেখার সূচনায় দেশের খাদ্যসঙ্কট আর কিছু সমস্যার প্রতি যে ইঙ্গিত করা হয়েছে তার সাথে আরেকটা গুরুতর সমস্যার বিষয় তুলে ধরতে চাই। সেটি সুরাহা করা হয়তো খুব কঠিন নয়। মাঝে মধ্যে তা নিরসনের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের কিছু প্রয়াস লক্ষ করা যায়। কিন্তু তা লাগাতারই হওয়া উচিত ছিল, সমস্যার দাবিও সেটি। সেটি হলো খাদ্যে ভেজাল, মানহীন কুখাদ্য বাজারজাত করার যে অবাধ সুযোগ এখন রয়েছে তা এতটা ক্ষতিকর এবং এর সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া ভয়াবহ এক পরিণতি ঘটাবে। এ সমস্যার কবলে শুধু নিম্ন আয়ের মানুষই নিমজ্জিত হয়ে আছে, তা নয়।
সামগ্রিকভাবে শ্রেণী গোত্র নির্বিশেষে সব মানুষের স্বাস্থ্যসঙ্কট আর রোগ বালাইয়ের মুখোমুখি হওয়ার ক্ষেত্রে এমন মানহীন খাদ্য চরম হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যক্তি, সমাজ ও খোদ রাষ্ট্রের জন্য মানসম্মত খাবার কখনোই আকাশ থেকে পড়বে না বা এটা আমদানি করার ভাবনা শুধু অযৌক্তিকই নয়, অর্বাচীনের মস্তিষ্কপ্রসূত যত আজগুবি চিন্তা। পৃথিবীর বহু দেশ যা পারে আমাদেরও সেটি পারতে হবে।

মাছ ও ফল মূল খাওয়াও এখন নিরাপদ নয়। কেননা ফরমালিনসহ নানা প্রিজারভেটিভ, যা বিষতুল্য, এসব মাছ সবজি ও ফলমূল সংরক্ষণের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। দেশে এখন রোগ বালাইয়ের যে ব্যাপক বিস্তৃতি অখাদ্য কুখাদ্য গ্রহণ করাই এর মূল কারণ। এভাবে মানুষের পক্ষে কিভাবে সুস্থভাবে বেঁচে থাকা সম্ভব। বিদ্যমান খাদ্যের মানহীনতা ও বিরূপ পরিবেশ, সেখানে দীর্ঘ জীবন লাভের কথা ভাবা তো নিছক বাতুলতা।
ভেজাল আর নিম্নমানের খাবার বাজারজাতকরণ ও বিক্রির পাশাপাশি এমন খবর পত্রিকায় নিয়তই প্রকাশিত হয় যে, ভেজাল, মানহীন, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ সারা দেশে ছড়িয়ে আছে, মানুষ তা সেবন করছে। তা ছাড়া ভেজাল ওষুধ প্রস্তুত করার বহু কারখানা, ভুয়া বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চেম্বার। আরো কত যে অনাচার অনিয়ম তা বলে শেষ করা যাবে না। গ্রামেগঞ্জে সর্বরোগের এমন সব ‘মহৌষধ’ মানুষকে খাওয়ানো হচ্ছে। তার পরিণতি কী যে হবে তা খোদাই জানেন। খোদ রাজধানীতেই চর্মরোগের নানা মলম মাইকিং করে বিক্রি করা হয়। চমকপ্রদ সব কথা বলে এসব মলম বিক্রয় করা হয় যাতে সাধারণ সহজ সরল মানুষ অনায়াসে ক্যানভাসারদের ফাঁদে পড়ে যায়। এসব ‘মহৌষধ’ আর ‘ম্যাজিক’ মলম প্রশাসনের নাকের ডগায় ব্যবসা করে কিভাবে? তথাকথিত এমন ওষুধ মলম বিক্রি হয় যা মানবদেহের বিপুল পরিমাণ ক্ষতি করছে। তার কি কোনো আন্দাজ অনুমান করা যাবে? জানি না এমন ফ্রি স্টাইল ব্যবসা কোনো উন্নয়নশীল দেশে চলে কি না। আমাদের সাধারণ বিবেচনায় এ কথাই মনে জাগে, স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে এত হেলা অবহেলা কিভাবে চলছে?
অথচ আমরা জানি বাংলাদেশের ওষুধশিল্প এতটা উন্নতি করেছে যে আন্তর্জাতিক মানের বহু ওষুধ দেশে তৈরি হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রস্তুতকৃত ওষুধ বহু দেশে রফতানি হচ্ছে। সেসব ওষুধের মান গুণ বহুল প্রশংসিত। যে দেশের ওষুধশিল্পের এতটা উন্নতি হয়েছে, তার পাশাপাশি মানুষকে বিষতুল্য সব কিছু পান করানো আর ব্যবহার করার আয়োজন কতটা বৈপরীত্যের ব্যাপার তা কি কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখেছে?

দেশের বোদ্ধারা এ কথা ভেবে বিস্মিত হন, দেশে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে এত আইন বিধিবিধান থাকা সত্ত্বেও এমন ফ্রি স্টাইল চর্চা কতটা যে সাংঘর্ষিক। আমরা জাতি হিসেবে এগিয়ে যেতে চাই- সে স্বপ্নের কথাও আমাদের শোনানো হয়েছে, তাতে মানুষ আশ্বস্ত। একটি জাতির এগিয়ে যাওয়ার জন্য অনেক পূর্বশর্ত থাকে। তার অন্যতম হচ্ছে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এক জনগোষ্ঠী। তার জন্য নির্ভেজাল খাদ্য, সুচিকিৎসা অত্যাবশ্যক। তার ঘাটতি থাকলে যে স্বপ্নের কথা বলা হচ্ছে তা তো ছায়া হয়ে মিলিয়ে যাবে। একটা কথা উল্লেখ করলে অপ্রাসঙ্গিক হয়তো হবে না। কোভিডে তারাই প্রথমে আক্রান্ত হন যারা স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা করে না এবং হীনবল মানুষ। আমরা খাদ্য নিয়ে যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছি, সে খাদ্য তো মানুষকে রোগাক্রান্ত করবে, আর অপুষ্টিতে ভোগাবে। আমরা বলেছি ‘ওল্ড ইজ গোল্ড’। সেই স্বর্ণপিণ্ড হারানো কি অমানবিক হবে না?

আমরা আমাদের সংবিধানকে অনন্য এবং নানা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত বলে মনে করি। তার অনেক হেতু আছে। প্রায় সব জাতীয় সমস্যার সব নিয়েই ভাবি; তার সুরাহার দিকনির্দেশনা দেশের সংবিধানে পাওয়া যায়। সংবিধানে দেশের মহান স্থপতির দৃষ্টিভঙ্গি চিন্তাচেতনার প্রতিফলন ঘটেছে। যে বিষয় নিয়ে এ নিবন্ধে আলোচনা করে চলেছি, সেটি খাদ্যের ভেজাল ও তার ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া। এ প্রসঙ্গে আমাদের সংবিধানের সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে ১৮(১) অনুচ্ছেদে। সেখানে সন্নিবেশিত রয়েছে, ‘জনগণের পুষ্টির স্তর-উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন এবং বিশেষত : ... স্বাস্থ্যহানিকর ভেষজের ব্যবহার নিষিদ্ধকরণের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’ এ ছাড়া বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি জারি করা হয়। এর বিভিন্ন উদ্দেশ্য ছিল। তার অন্যতম ছিল, ‘খাদ্যপানীয়, ওষুধ ও প্রসাধনী দ্রব্যে ভেজাল দেয়া বা ভেজাল দ্রব্য বিক্রির বিরুদ্ধে শাস্তি বিধান করা।’

দেশের সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত খাদ্যের ভেজাল নিয়ে তাদের উদ্বেগের কথা প্রকাশ করেছিলেন কিছুকাল আগে। বিচার বিভাগের দায়িত্ব মূলত বিচারকার্য সম্পন্ন করা। কিন্তু ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিও আদালতের দায়বদ্ধতার কারণে অনেক সামাজিক ইস্যু ও অসঙ্গতি নিয়ে উচ্চ আদালত তাদের পর্যবেক্ষণ ও প্রশাসনের প্রতি নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। ভেজাল প্রসঙ্গে আদালত তাদের এক নির্দেশনায় বলেন, ভেজাল খাদ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। এই যুদ্ধের লক্ষ্য হবে, খাদ্য, খাওয়ার পানি ও ওষুধ ইত্যাদিতে ভেজাল দেয়া কিছু উৎপাদন, সরবরাহ ও বিক্রি বন্ধ করা। আদালত আরো বলেন, আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ করছি, খাদ্য ভেজালকারীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ও কঠোর পদক্ষেপ নিতে সক্ষম, এরকম একাধিক সরকারি সংস্থা, কর্তৃপক্ষ রয়েছে। অথচ তারা নির্লিপ্ত। মানুষ প্রতিদিনই একটা বাধ্যতামূলক পরিস্থিতির শিকার হয়ে নিম্নমানের বা ভেজাল খাদ্য, পানি, ওষুধ ইত্যাদি কিনছেন। (সরকারি) প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের শুধু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী হিসেবে ভাবলেই চলবে না, তাদের দেশপ্রেম এবং মানুষের প্রতি ভালোবাসার মনোভাব নিয়ে ভেজাল খাদ্যবিরোধী অভিযানে অংশ নিতে হবে। অন্যথায় ভেজাল খাদ্যের মহামারী ঠেকানো যাবে না। উচ্চ আদালতের এমন পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষের কচ্ছপ গতি তথা স্থবিরতা কাটার কোনো লক্ষণ নেই। লক্ষণীয় ব্যাপার, ঈদ অনুষ্ঠানের আগে তাদের হঠাৎ করে যেন নিদ্রা ভাঙে। ব্যাপক তৎপরতা দেখা যায় সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থার। ধরপাকড় জেল-জরিমানাসহ অনেক কিছুই দেখা যায়। কিন্তু তারপর সব নীরব নিথর চলৎশক্তিহীন হয়ে পড়ে। অনেকটা সেই কল্পকাহিনীর রিপভ্যান উইংক্যালের মতো গভীর নিদ্রায় অচেতন হয়ে যাওয়া অথবা হিমালয়ের মগ্ন মৈনাকের মতো কোনো একসময় আবার মাথা জাগিয়ে তুলে নিজের অস্তিত্বের জানান দিয়ে যায়।

এ লেখার লক্ষ্য শুধু ঢাকায় বসবাসকারী মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা নয়। গোটা দেশের মানুষের খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়টি লেখার অবিচ্ছেদ্য লক্ষ্য। ঢাকা দেশের কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপনগরী নয়, যে তার জন্য ভিন্ন ব্যবস্থা দরকার। এমন একপেশে আর পক্ষপাতের কোনো চিন্তা মাথায় আসতে পারে না। আর এটাও আমাদের মাথায় রয়েছে, ঢাকার বাইরের অগণিত মানুষ ঢাকাবাসীর মতো এতটা প্রিভিলেজড নয়। তাই তাদের সঙ্কট কষ্ট বেদনা অনেক বেশি। এই ধারণাটি সবার বিশেষ করে, কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় থাকতে হবে। ঢাকার বাইরে সুচিকিৎসার সুযোগ অনেক কম এবং বহু মানুষের তেমন সঙ্গতির অভাব রয়েছে। বাধ্য হয়ে তারা বাছ বিচার ছাড়াই যা জোটাতে পারে তাই খায়। আর অসুখ বিসুখে সেই সর্বরোগের মহৌষধের দ্বারস্থ হতে হয়। পরিণতিতে তাদের কষ্টের মাত্রা অনেক বেশি। আমাদের সংবিধানের এমন বৈষম্য দূর করার ওপর জোর দেয়া সত্ত্বেও গত প্রায় অর্ধশতাব্দী সময় পার করলেও এমন কোনো উদ্যোগ বা প্রকল্প পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়নি যা সরাসরি মফস্বলের মানুষের উপকারে এসেছে বা যাতে তাদের স্বাস্থ্যে নিরাপত্তা বেড়েছে।
দেশের ভোক্তাশ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে একটি বিধান করা হয়েছে। এ বিষয়ে আলোচনার আগে জাতিসঙ্ঘ বহু আগে যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করার সুপারিশ করেছে তা নিয়ে কিঞ্চিৎ কথা বলব। আমাদের ঘুম থেকে জাগতে কতকাল গেছে? প্রতিনিয়ত ভোক্তাস্বার্থ লঙ্ঘিত হওয়া, জনগণ প্রতারিত হওয়া এবং জনভোগান্তি লাঘবের জন্য দীর্ঘ দিন ধরে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের আইনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়ে আসছিল। তবে ভোক্তা অধিকার বলতে অনেকে দ্রব্য, খাদ্যসামগ্রীর কেবল ভেজালকে বুঝে থাকলেও প্রকৃতপক্ষে মানুষের জীবন ও জীবিকার সাথে জড়িত অধিকার ও সেবাগুলোকেই ভোক্তা অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে জাতিসঙ্ঘ। সে হিসেবে ‘অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার পাশাপাশি নিরাপদ তথ্য আদান-প্রদান, ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও মোবাইলে আর্থিক লেনদেন, জীবিকা নির্বাহ, নিরাপদ যাতায়াত, মুক্ত মত প্রকাশসহ সবকিছুই ভোক্তা অধিকারের আওতাভুক্ত।’ বহু আগে তা জাতিসঙ্ঘ স্থিরীকৃত করেছে। ১৯৮৫ সালের ৯ এপ্রিল সাধারণ পরিষদের ৩৯তম অধিবেশনে বিশ্ব সংস্থা বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রের সরকারকে ক্রেতাস্বার্থ সমুন্নত রাখার জন্য এক নির্দেশ জারি করেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের সরকারের ওপর এমন আইন তৈরির দায়িত্ব বর্তায়।

১৯৯০ সালের জুলাই মাসে ব্যাংককে অনুষ্ঠিত এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তের আলোকে ১৯৯২ সালে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ক্যাবের উদ্যোগে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন প্রণয়নের কাজ শুরু হয়। ‘ক্যাব’ বিভিন্ন দেশের সংশ্লিষ্ট আইন পর্যালোচনা শেষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় ১৯৯৮ সালে এই আইনের প্রথম খসড়া প্রণয়ন ও প্রকাশ করে। এরপর বহুবার এটার খসড়া পাল্টা খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। বিগত বিভিন্ন সরকারের সময় খসড়া আইনটি কয়েক দফা মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হয়েছে এবং মন্ত্রিপরিষদ নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে তা পাসের জন্য; কিন্তু এটি আর আলোর মুখ দেখেনি। বহু চড়াই উতরাই পেরিয়ে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ দিকে ২০০৮ সালের ৬ অক্টোবর আইনটি অধ্যাদেশ আকারে জারি হয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেই অধ্যাদেশটিতে কিছু সংযোজন করে ২০০৯ সালের ১ এপ্রিল জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে তা পাস হয়। জনস্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট এই গুরুত্বপূর্ণ আইনটি জাতীয় সংসদ পর্যন্ত নিয়ে যেতে ক্যাবকে ১৮ বছর রাজপথে বহু আন্দোলন সংগ্রাম করতে হয়েছে।
এ কথা বহুবার বলে আসছি, বাংলাদেশে জনহিতকর আইনের কোনো কমতি নেই। সেসব আইন যদি কার্যকর হতো তবে আমাদের অনেক সমস্যার বহু আগেই ইতি ঘটত। সবচেয়ে অবাক লাগে এ কথা ভেবে যে, দেশের সংবিধানকে ‘ইউনিক’ বলা হয় তার বহু বৈশিষ্ট্যের কারণে; মানুষের হিতের জন্য সেখানে বহু দিকনির্দেশনা রয়েছে এবং যা দেশের সর্বোচ্চ আইনও বটে। আজ পর্যন্ত তাকেই বহুভাবে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসীন হয় তাদের সবার সংবিধানের আলোকে শপথ নিতে হয়। সংবিধানকে উচ্চকিত করা, অক্ষরে অক্ষরে মান্য করা এবং প্রতিষ্ঠা করার অঙ্গীকার তাদের শপথের আওতাভুক্ত; কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে তাকে পাশ কাটানোর যে কথা উপরে বলা হয়েছে, তা এতটুকু বাড়িয়ে বলা হয়নি।

ভোক্তা অধিকার আইনে ভেজাল ও নিম্নমানের পণ্য সরবরাহের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির কথা আছে। তার অবস্থা এমনটাই যে, কেতাবের মধ্যে কেবল তা শোভা বর্ধন করে আছে। আর ভেজালবিরোধী অভিযান যে কালেভদ্রে ঘটে অনেকটা যেন শীতের আবির্ভাব ঘটার পর কোকিলের আবির্ভাবের মতো। কখনো যখন মিডিয়া চোখে আঙুল দিয়ে কোনো ভেজাল খাদ্য তৈরির প্রক্রিয়ার সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করে, তাতে লজ্জায় মাথা কাটার দশা হয়। তখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কিছু তৎপরতা দেখায়। তারপর কুম্ভকর্ণের মতো দিবানিদ্রায় ভিন্নজগতে পৌঁছে যায়। বাংলাদেশে প্রশাসনের কোথায় হাত দেয়া যাবে? কেননা, তার সর্ব অঙ্গে বিষ ব্যথা বেদনা বাসা বেঁধেছে। পরিস্থিতি এমন যে, দূষিত লোম বাছতে গেলে কম্বলই উজাড় হয়ে যাবে।

বাংলাদেশে সবচেয়ে শস্তা হচ্ছে বাগাড়ম্বর। কেননা, এ জন্য ট্যাক্স দিতেও হয় না। কথা বা আশ্বাস দিলে সেটি রক্ষা করার কোনো দায়বদ্ধতা নেই। উদাহরণ হিসেবে বলছি, কিছুকাল আগে ঢাকা দক্ষিণের সাবেক মেয়র অত্যন্ত প্রত্যয় নিয়ে বলেছিলেন, ‘খাদ্যে ভেজাল নিয়ন্ত্রণ না হওয়া পর্যন্ত অভিযান অব্যাহত থাকবে। আমি ভেজালবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য সব সংস্থাকে এর কার্যক্রম আরো জোরদারের নির্দেশ দিচ্ছি।’ এখন সেই রাজাও নেই, তার সব নির্দেশও নিরুদ্দেশ।
ndigantababor@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement